
দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লব—এগুলো একেক সময় একেক প্রকৃতির হয় আর প্রত্যেকটি সামাল দিতে বিশেষ দক্ষতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অতীত ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সেনাপ্রধান ভবিষ্যৎ সংকটগুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে—কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তারা জনস্বার্থে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। আবার কেউ কেউ জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার কারণে সেনাবাহিনীকে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয়েছিল এবং তাঁরাও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দিকেই ঝোঁকে। কারণ অতীতে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ—মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে গুলি করে হত্যা করা হয়, জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়, জেনারেল এরশাদ কারাভোগ করেন, জেনারেল নাসিম গ্রেপ্তার হয়ে অকাল অবসর নেন, আর জেনারেল মঈনকে এখনো দেশছাড়া অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীতে আরও দু’টি বিদ্রোহ হয়েছিল, যা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয় বরং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ক্ষমতার দ্বন্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব ঘটনায় অফিসার এবং সৈনিক উভয় পক্ষকেই সরাসরি কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রণোদনা সৈনিকদের আগ্রহের সঙ্গে মেলেনি বলে তারা পুরোপুরি তাতে সমর্থন দেয়নি। মূলত, এগুলো ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু জেনারেলের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সৈন্যরা দেখেছিল যে পরিস্থিতি কার পক্ষে যাচ্ছে, তারপর হয় চুপ থেকেছে কিংবা দেখেশুনে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্বে সংগঠিত বিদ্রোহ। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা প্রথমে উল্লসিত হয়ে উঠলেও, দ্রুতই বুঝতে পারে যে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের উৎসাহে সরকার সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকে, যার ফলে বিদ্রোহীরা নৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মনোবল হারিয়ে ফেলে। সরকারের তুলনায় কম শক্তি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে জেনারেল মনজুর দ্রুতই তাঁর অধস্তন অফিসার আর সৈনিকদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা এরশাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সরকারের পক্ষ নেন এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদই জয়ী হন।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম দুর্বল পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরিপক্কতা, অধস্তনদের দোদুল্যমান আনুগত্য এবং বিশ্বস্ত সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনীর ভেতরে কতখানি বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে যখন তিনি ঢাকায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই তাঁর কমান্ড অচল হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, এসএসসি ব্যাচ-১-এর পরিবর্তনশীল আনুগত্য এবং ৯ম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমাম-উজ-জামানের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে নাসিমের ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সফলভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চারটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজেরাই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন কয়েকজন তরুণ মেজর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতাসীন করে। সে সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ তার গৌয়েন্দা সংস্থা সমুহের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণরূপে হতবাক হয়ে যান। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটার ফলে তিনি কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেননি। কেবলমাত্র ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন চালু করেই ওই তরুণ মেজররা ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করে দেয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিপরীতে সেনাপ্রধান নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। পরের দু’মাস “ইয়াং টার্কস” নামে পরিচিত ওই তরুণ অফিসারের দলই বঙ্গভবন থেকে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া তখন সবকিছু শুধু নীরবে দেখছিলেন। কেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী তার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ওদের দমন করেননি তা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে। আর এভাবেই এই অস্থির তরুন অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতিতে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে—যার নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ), ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
জেনারেল জিয়ার নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়ে মোশাররফ ও তাঁর নিজের মতাদর্শী কিছু অফিসার ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন, জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন, বঙ্গভবনের ওই তরুণ মেজরদের পালাতে বাধ্য করেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। তবে এই ক্ষমতা দখল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোশাররফ বুঝতেই পারেননি যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের (জাসদ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে সেই বিদ্রোহ পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়ে মোশাররফের নবগঠিত সরকারকে উৎখাত করে এবং জিয়াকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থেকে যান।
১৯৮২ সালে তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আগের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে বিনা বাধায় এবং কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা যায়। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকুরিচুত্য করেন, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা (রিপ্যাট্রিয়েটেড) অফিসারদের ওপর নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশবাসীর নিকট চিত্রিত করেন। একই সঙ্গে, “দেশগঠনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা উচিত”—এই ধারণাটিকে প্রচার করে তিনি অনেককে নিজের পক্ষে টানেন। তিনি আরও অনেক পাকিস্তান হতে ফেরত আসা অনুগত জেনারেলকে ডিভিশন এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা-পদে বসান এবং ১৯৮১ সালে নির্বাচিত পেসিডেন্ট সাত্তারের প্রশাসনের কিছু সদস্যকেও পাশে টানেন। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নম্র স্বভাব ও জিয়া-উত্তর বিএনপির বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরশাদ সহজেই বহুদিনের লালিত স্বপ্ন—সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যা অনেকেই “মসৃণ ক্ষমতা দখল” বলে আখ্যা দেন।
২০০৭ সালে শেষ অভ্যুত্থানটি ঘটে জেনারেল মইন-এর সময়। বেগম জিয়ার পদত্যাগের পর কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন ও প্রশাসন চালাবেন--এই বাক বিতন্ডায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় যা থেকে ঢাকা শহরে সহিংসতা দ্রুত বেড়ে যায়। এই অস্থিরতা ও অচলবস্থা কাজে লাগিয়ে জেনারেল মইন নিজের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেন। পশ্চিমা দূতাবাস এবং স্থানীয় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর সহায়তায় তিনি বিশ্বস্ত কিছু সহযোগীকে বেছে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। এর আগে বিএনপি নিজেদের অনুগত জেনারেলদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল বটে, কিন্তু মইন বুঝেছিলেন—নতুন নেতৃত্ব এলে অনেকেই পক্ষ বদলায়। তিনিও সফলভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, যারা “রং বদলানো গিরগিটি”-এর মতো সুবিধামতো দলে ভিড়ে যায়। তাঁর মূল মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি। তাঁরা সকলে মিলে গোপনে মইনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এএইচকিউ (আর্মি হেডকোয়ার্টার)-এর অপারেশন শাখাকে পাশ কাটিয়ে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্যদের সাভার থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি জালচিঠি দেখিয়ে ষ্টেট অব ইমারজেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। চিঠিতে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে সব বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দেশে ফেরত পাঠানো হবে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মইন এক নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন যা শুধু সামনের পর্দার ভূমিকায় ছিল। পরে এই সরকার জনপ্রিয়তা হারালে এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিলে, নিজের রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ মইন ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ চান। আর এর বিনিময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণ তিনি নিশ্চিত করেন।
বিপ্লব মোকাবিলা করা হয়তো একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। অনেক সময় একটি রাষ্ট্র বা সমাজ তার গর্ভে বিপ্লবের ভ্রুন ধারণ করলেও (যাকে বলা হয় “বিপ্লবে গর্ভবতী সমাজ”) তা প্রসব করতে বহু বছর লেগে যায়। যেমন, শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। আবার অন্য সময় বিপ্লব ঝড়ের গতিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে সবকিছু তছনছ করে ফেলে—যেমন বাংলাদেশে ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে। লেনিন বলেছিলেন, “জনগণের কোনো বিপ্লবই পুরোনো শাসন-ব্যবস্থার সমর্থক সশস্ত্র বাহিনীর একটা অংশের সহায়তা ছাড়া জয়ী হতে পারে না। ” আর স্ট্যানিসল এন্ড্রিজিয়স্কি (Stanislaw Andrzejewski) তাঁর Military Organization and Society গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারলে কোনো বিদ্রোহই সফল হবে না। ” বাস্তবেও, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সরকারকে সমর্থন করে, তবে কোনো বিপ্লব টেকার সম্ভাবনা কম। ফলে বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা নিরপেক্ষতা নিয়ে ভীষণ হিসাব-নিকাশ করে। সেনাবাহিনী সরকারকে আঁকড়ে থাকবে, না কি ছেড়ে দেবে—এই প্রশ্ন বিপ্লবীদের কাছে যেমন জটিল, তেমনি সেনাবাহিনীও ভোগে দ্বিধাদ্বন্দে—কারণ জনগণের আন্দোলন আদৌ কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, শাসক দলের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, প্রজন্মভেদ, আর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীও দেখার চেষ্টা করে আন্দোলনের সঠিকতা, সরকারের অজনপ্রিয়তা, জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা, জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য, এবং আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করবে কি না। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেই উভয় পক্ষ ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়।
বিপ্লবে সেনাবাহিনীর অবস্থান কীভাবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়—তার তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি। এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)-এর সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আবার নিজেও বড় রদবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেখানে অভিজাত অফিসাররা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, আর সাধারণ শ্রেণির সৈনিকরা নিচের স্তরে থাকত। এই বৈষম্যের কারণে বাহিনীর ভেতরে দ্বন্দ্ব বাড়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—এই বিপ্লবী ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার পর। যখন বিপ্লব জোরদার হয়, সেনাবাহিনীর আনুগত্য নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। অনেক অভিজাত অফিসার (সেনাবাহিনীর ৬০ %) দেশত্যাগ করে নিপীড়নের ভয়ে পালাতে থাকে। তখন বাহিনীর অফিসার পর্যায়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগে ১৭৯৩ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় কনভেনশন লেভে আঁ ম্যাস (levée en masse) ঘোষণা করে, যেখানে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী অবিবাহিত পুরুষদের সৈন্য দলে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এভাবে নাগরিক-সৈন্যদের নিয়ে এক জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে, যেখানে অফিসার পদোন্নতিতে সমতা ও বিপ্লবী চেতনা নতুন উদ্যম জোগায়। এই নতুন কাঠামোর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং দেশের সীমানাও বাড়ায়। যদিও ১৭৯২ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ ছিল বৈদেশিক শক্তির সাথে, তবুও অনেক সময় দেশের ভেতরের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং অভ্যুত্থান দমাতে এটিকে ব্যবহার করা হয় (যেমন ভেন্ডি বিদ্রোহ দমন)। সামরিক বাহিনী অচিরেই ফরাসি রাজনীতিতে এক শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে। ১৭৯৯ সালে সামরিক শক্তির জোরেই তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ফরাসি বিপ্লবের সময় কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল—তা স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপ্লবের সময় থেকে পরবর্তী কালেও।
রুশ-জাপানি যুদ্ধে (১৯০৪-১৯০৫) রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বড় ধরনের পরাজয়ের পরপরই ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত এই কারণে যে, সামরিক বাহিনী তখনও জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের প্রতি অনুগত থাকে। রিজার্ভ বাহিনীতে কিছু বিদ্রোহের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে সেভাস্তোপোল, ভ্লাদিভস্তক ও ক্রনস্টাড্টে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে—এর মধ্যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে সরকার এগুলো দমন করে, যেখানে দুই হাজারের বেশি নাবিক মারা যায়। যদিও ব্যাপক অস্থিরতা চলছিল, সেনাবাহিনীর মূল অংশ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে সরকার ১৯০৫ সালের এ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে সফল হয়।
এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির ‘ব্লাডি সানডে’। সেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় ইম্পেরিয়াল গার্ড, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয়। কিন্তু একপর্যায়ে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সরকার আর্টিলারি ব্যবহার করে বিদ্রোহী এলাকাগুলো ধ্বংস করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ওই বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যায়ের মস্কোর আন্দোলনও কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এভাবে ১৯০৫ সালের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়, আর প্রমাণিত হয়—যদি সেনাবাহিনী সরকারপক্ষ থাকে তাহলে বিদ্রোহের পক্ষের শক্তির জয়ী হওয়া কঠিন।
অন্যদিকে ১৯১৭ সালের দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমূলক শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে সৈনিকদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। খাদ্য, অস্ত্র ও রসদের ব্যাপক সংকটের কারণে অধিকাংশ কৃষক-সৈনিক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেত্রোগ্রাদে গণবিক্ষোভ শুরু হলে, অনেক সৈনিক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়—বরং তারা বিক্ষোভে যোগ দেয়। এতে জার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহ আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আনুগত্য আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জারি করা ‘অর্ডার নং ১ ’-এর ফলে সৈনিকদের কমিটিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এর কারণে সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায়। ফ্রন্টলাইনে ধারাবাহিক পরাজয় আর অসন্তোষের জের ধরে বলশেভিকরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা কাজে লাগিয়ে তারা পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। অসন্তুষ্ট সেনা ইউনিটগুলো বলশেভিক রেড গার্ডের পক্ষে চলে আসে, ফলে খুব কম প্রতিরোধের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে জারপন্থা ত্যাগ করে বলশেভিকদের সঙ্গে যাওয়া সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলই রুশ বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায় এবং পরে রাশিয়ায় বলশেভিকদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। ঘটনাটি এটিই বোঝায় যে সেনাবাহিনীর সমর্থন বা অস্বীকৃতি বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি গঠনে সবসময় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণবিপ্লব/গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে। প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল উপেক্ষা করায় বাঙালিদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল অনেক বাঙালি সেনাসদস্যও। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম. আর. চৌধুরীর মতো কেউ কেউ আগেই পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে দেরি করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা কার্যত পূর্ব-পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ২৫ / ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করে। তবু অনেক বাঙালি সেনা ইউনিট আগে থেকেই সতর্ক ছিল বা আক্রমণের মুখে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে তারা ভারতের দিকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) আর পুলিশও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকসহ নানা পেশার মানুষ একসঙ্গে ব্রিগেড ও সেক্টরভিত্তিক বাহিনী গঠন করে। টানা নয় মাসের গোরিলা যুদ্ধ আর শেষ সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়। এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বহুজাতীয় বা বহু-জাতিগত রাষ্ট্রে সামরিক ঐক্যের চেয়ে জাতিগত পরিচয় অনেক সময় মানুষকে বেশি উদ্দীপ্ত করে, আর এটাই বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় গণবিপ্লব বা “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনকে ধরা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল এরশাদ জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি, আতঙ্ক-সৃষ্টি, বিতর্কিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভারতপন্থী নীতির কারণে দেশে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর অনেক জুনিয়র অফিসার এরশাদকে বোঝা বলে ভাবতে শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝেমধ্যে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছিল, এরশাদ এসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হন। তবে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা যৌথভাবে আন্দোলনে নামলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ফাটলের স্পষ্ট নমুনা ধরা পড়ে—সিজিএস মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবদুস সালাম (গজব আলী) এরশাদের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে সরাসরি আপত্তি জানান। অক্টোবরের পর বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে—হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে যায়। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার কথা ভাবলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ জানিয়ে দেয়, সেটি হলে সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন খানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে। এর ফলে এরশাদ সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েন। এমনকি ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকের মতো ব্যক্তিরাও প্রভাব হারিয়ে ফেলেন, কারণ সেনা সদর দপ্তর তাঁর পদক্ষেপগুলো আটকে দেয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে লাগাতার হরতাল, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, রাজপথের সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অনাগ্রহ—সবকিছু এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর এই “নিরপেক্ষ” ভূমিকার ফলেই বিদ্রোহ সফল হয়; দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও পরবর্তী নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে “আধা-বিপ্লব” বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল পুরো পদ্ধতিগত কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে, কিন্তু শিগগিরই সংবিধানগত কূটকৌশলে ও মারপ্যাচে জড়িয়ে পড়ায় তা আগের শাসনের মতোই পরিচিত ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
এটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে। আন্দোলন খুব দ্রুতই সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী এক গণজাগরণে পরিণত হয়, বিশেষত শেখ হাসিনার মন্তব্য—“মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা না পেলে কি সেটা রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে? ”—এই বক্তব্য ক্ষোভকে বাড়িয়ে তোলে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশও এ দমনে যোগ দিলে জনরোষ চরমে পৌঁছায়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে চেষ্টা করা হয় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে প্রায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগশূন্য করা হয়। কিছু সময়ের জন্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট কোটা ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করলে অন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে, কিন্তু ছয়জন আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও তাদের কাছ থেকে জোর করে “আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা” আদায় করায় বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়। ২৯ জুলাই আন্দোলন আবার জোরদার হয় এবং ১৫ বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা ধরে রাখা সরকার আগস্ট ৫-এ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, আর আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা দেশ ছেড়ে চলে যান বা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো-টাকরা মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর। তবে ভবিষ্যতে আরো তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
বর্তমানে অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে। যেমন:
যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কোনো যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়নি, ফলে কী ঘটেছিল তার চূড়ান্ত বিবরণ এখনো অপুর্ণই থেকে গেছে।
এরপরও, ফাঁস হওয়া তথ্যের টুকরো টুকরো ইঙ্গিত একত্র করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল—তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব তথ্য যাচাই করা যায়নি। তবে এসব “পাজলের টুকরো” জোড়া দিয়ে একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়—সেটি হলো, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব—যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। ১৮ বা ১৯ জুলাই আমার জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে সেনাভবনে খাবার খেতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর এমএ জানায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে হঠাৎ সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ আসায় সে ডিনার বাতিল করতে হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব বিদ্রোহ সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায়, সরকার ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীকে কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। অল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ কমে গেলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে আসে। আর সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে আগেরবারের কোণঠাসা হওয়া র্যাব ও পুলিশ আবারও বিক্ষোভকারীদের ওপর নতুন করে সহিংসতা চালায়।
এরপর ভিডিওতে দেখা যায়, র্যাব ও পুলিশ তো বটেই, কিছু সেনা সদস্যও নাগরিকদের ওপর গুলি ছুড়ছে—যা মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই সেনাবাহিনীকে রক্ষক হিসেবে দেখে আসছিল, তারা এখন সেটিকে দমনমূলক ভূমিকায় দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া হেলিকপ্টার থেকে একজন সৈনিকের গুলি চালানোর ছবি, আর জাতিসংঘের লোগো লাগানো গাড়ি ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনা জাতিসংঘের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে। ফলে সাথে সাথেই এসব লোগো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালানো—যা অনেকটা “লাইভ-ফায়ার ড্রিল”-এর মতো—শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সামরিক বাহিনীর প্রবীণ সদস্যদেরও আহত করে। বিশেষ করে জিওসি ও ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে ৫ বীরএর সৈন্যদের যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেখানেই এমন অসন্তোষ দেখা দেয়। আমি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ফোন পাই—তাঁরা জিজ্ঞেস করছিলেন, কী করা উচিত। আমি পরামর্শ দিয়েছি—“কোনো অবস্থাতেই নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। ”
(চতুর্দশ অংশে বর্ণিত ৫ বীর কর্তৃক যাত্রাবারীতে জিওসি এবং ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনগনের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি সঠিক নয়। ৫ বীর একটি গুলিও করেনি। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত)
এদিকে শিক্ষার্থীরা কালো রংয়ের বদলে (১৯৭৫ সালে নিহত নেতাদের স্মরণে ক্ষমতাসীন দল কালো ব্যাজ/কালো রঙ ব্যবহার করত) নিজেদের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করে প্রতিবাদ জানায়। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাইদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি-জ্ঞানী না হওয়ায়, আমার ছোট মেয়েকে (সে তখন আমেরিকায়) জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কীভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায়, যেটি আমি আপলোড করি, তারিখ ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে।
আমার ধারণা ছিল না এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য সেনাসদস্যের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি। আমি রাজি হইনি। এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে। ডিজিএইচএস-এ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্মরত আমার এক ভাতিজিকে তাঁর এক সহকর্মী ব্যাগ থেকে কারবাইন দেখিয়ে বলে, “আর অফিসে এসো না। ” একই সময়ে ডিজি ডিজিএফআই আর সিআইবি-এর ডিরেক্টর আমার সাথে দেখা করতে চায়, যাতে আমি একটি প্রেস কনফারেন্স করে বলি, লাল প্রোফাইল ছবি ছিল একটি “ভুল” পোস্ট। আমি রাজি হইনি। মোহাখালী ডিওএইচএস কাউন্সিল আমার বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১: ৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তাঁরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমন যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।
একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায় (RAOWA)। আমার এক বিশ্বস্ত সহযোগী মূল সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করল। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে—যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন—তাঁদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।
৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতার নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দেইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান। এর মধ্যে দেশ পুরোপুরি বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঢাকায় অবরোধ, যেটি মূলত ৬ আগস্ট হওয়ার কথা ছিল, সেটি এগিয়ে ৫ আগস্টে করা হয়। তবু শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩: ০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র্যাব, ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে—তিনি জানতেন যে বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ।
৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে, বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন—কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।
শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা—মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে—পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্বাবধায়ক (caretaker)-এর আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন।
পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন, ড. ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার” এর মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়—কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।
যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাঁদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচার মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এপরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ফাক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতোয় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।

ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
১ ঘণ্টা আগে
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
৩ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
১১ ঘণ্টা আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
আইনশৃঙ্খলা অবনতি সুষ্ঠু ভোটের বাধা হবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলো কোথায়? মাঝেমধ্যে দুয়েকটা খুন-খারাবি হয়। হাদির একটা ঘটনা হয়েছে। আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করি। এই ধরনের ঘটনা তো সবসময়ই ছিল। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া-এর প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা তো সবসময় ছিল। এ ধরনের ঘটনা হয় বাংলাদেশে, এটা নতুন কিছু না।’
সিইসি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বরং উন্নতি হয়েছে। ৫ই আগস্ট ২০২৪-এর সঙ্গে তুলনা করুন। যখন থানাগুলো ইনঅ্যাক্টিভ ছিল। পুলিশ স্টেশনে ওয়ার্ক করছিল না। এখন তো অনেক উন্নতি হয়েছে ইনশাআল্লাহ। আমরা তো শান্তিতে চলাফেরা করতে পারছি। শান্তিতে ঘুমাতে পারছি। আমরা গতকালই আমাদের শীর্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তারা নিশ্চিত করেছে যে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনে তারা সক্ষম।’
মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহলে নির্বাচন নিয়ে কিছু আশঙ্কা হয়তো আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। ইনশাআল্লাহ, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সকলের সহযোগিতা নিয়ে। এ ব্যাপারে কোনোই শঙ্কা নেই, যা-ই আসুক না কেন। যত ধরনের দুশ্চিন্তা মাথায় আসুক না কেন, দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সবাই মিলে যাতে আমরা নির্বাচনটা করতে পারি। ’
সিইসি আরও বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, নির্বাচন সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। জাতিকে আমরা যে ওয়াদা দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন ইনশাআল্লাহ তা পরিপালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আপনাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করব ইনশাআল্লাহ।
সিইসি আরও বলেন, ‘সর্বোপরি, এইবার একটি গণভোটও একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই সমস্ত দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। আমরা যে সাহস করে এই পথে নেমে পড়েছি, আমাদের এই সাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে যদি আপনাদের সকলের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের, অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হব।’

ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
আইনশৃঙ্খলা অবনতি সুষ্ঠু ভোটের বাধা হবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলো কোথায়? মাঝেমধ্যে দুয়েকটা খুন-খারাবি হয়। হাদির একটা ঘটনা হয়েছে। আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করি। এই ধরনের ঘটনা তো সবসময়ই ছিল। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া-এর প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা তো সবসময় ছিল। এ ধরনের ঘটনা হয় বাংলাদেশে, এটা নতুন কিছু না।’
সিইসি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বরং উন্নতি হয়েছে। ৫ই আগস্ট ২০২৪-এর সঙ্গে তুলনা করুন। যখন থানাগুলো ইনঅ্যাক্টিভ ছিল। পুলিশ স্টেশনে ওয়ার্ক করছিল না। এখন তো অনেক উন্নতি হয়েছে ইনশাআল্লাহ। আমরা তো শান্তিতে চলাফেরা করতে পারছি। শান্তিতে ঘুমাতে পারছি। আমরা গতকালই আমাদের শীর্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তারা নিশ্চিত করেছে যে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনে তারা সক্ষম।’
মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহলে নির্বাচন নিয়ে কিছু আশঙ্কা হয়তো আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। ইনশাআল্লাহ, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সকলের সহযোগিতা নিয়ে। এ ব্যাপারে কোনোই শঙ্কা নেই, যা-ই আসুক না কেন। যত ধরনের দুশ্চিন্তা মাথায় আসুক না কেন, দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সবাই মিলে যাতে আমরা নির্বাচনটা করতে পারি। ’
সিইসি আরও বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, নির্বাচন সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। জাতিকে আমরা যে ওয়াদা দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন ইনশাআল্লাহ তা পরিপালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আপনাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করব ইনশাআল্লাহ।
সিইসি আরও বলেন, ‘সর্বোপরি, এইবার একটি গণভোটও একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই সমস্ত দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। আমরা যে সাহস করে এই পথে নেমে পড়েছি, আমাদের এই সাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে যদি আপনাদের সকলের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের, অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হব।’

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
৩ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
১১ ঘণ্টা আগেবাসস, ঢাকা

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এই আদেশ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নতুন নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট দেশের বিচার অঙ্গনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিবৃন্দ, মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, আদালতে আগত কিছু বিচারপ্রার্থী, মামলাসংশ্লিষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি এজলাসে প্রবেশ করছেন, যা আদালতের নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং বিচারকাজ পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে বিচারপতি, আইনজীবী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি এড়াতেই নিরাপত্তার স্বার্থে এই কড়াকড়ি আরোপ করা হলো।
এজলাসকক্ষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের জন্যও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যেকোনো ধরনের সমাবেশ, মিছিল, বৈধ বা অবৈধ সব ধরনের অস্ত্র, মারণাস্ত্র, বিস্ফোরক এবং মাদকদ্রব্য বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন এই নিরাপত্তা আদেশ ১৫ ডিসেম্বর (সোমবার) থেকে কার্যকর হয়েছে এবং ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আদেশ অমান্য করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আদালত এ বিষয়ে আইনজীবী, তাঁদের সহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিচারপ্রার্থীদের সচেতন ও সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এই আদেশ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নতুন নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট দেশের বিচার অঙ্গনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিবৃন্দ, মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, আদালতে আগত কিছু বিচারপ্রার্থী, মামলাসংশ্লিষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি এজলাসে প্রবেশ করছেন, যা আদালতের নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং বিচারকাজ পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে বিচারপতি, আইনজীবী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি এড়াতেই নিরাপত্তার স্বার্থে এই কড়াকড়ি আরোপ করা হলো।
এজলাসকক্ষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের জন্যও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যেকোনো ধরনের সমাবেশ, মিছিল, বৈধ বা অবৈধ সব ধরনের অস্ত্র, মারণাস্ত্র, বিস্ফোরক এবং মাদকদ্রব্য বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন এই নিরাপত্তা আদেশ ১৫ ডিসেম্বর (সোমবার) থেকে কার্যকর হয়েছে এবং ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আদেশ অমান্য করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আদালত এ বিষয়ে আইনজীবী, তাঁদের সহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিচারপ্রার্থীদের সচেতন ও সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
১ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
১১ ঘণ্টা আগেশাহরিয়ার হাসান, ঢাকা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন হাল। নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। পরিস্থিতি ঠিক করতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে ভাব নেমে এসেছে। তফসিলের পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তাও কমে গেছে।
সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ওঠে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করা যায়। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।’
এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্তি থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সব রাজনৈতিক দল আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও এসেছে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত ও প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। অবশ্য সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর কোনো কোনো দল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির একটি চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি, কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমন ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা চ্যানেলকে সক্রিয় করতে হবে এবং অন্য কাজের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে কমিটি করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট-২ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ চিহ্নিত করা এবং অস্ত্রের পেছনে থাকা অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এসব বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থীদের এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করবে। প্রার্থীদের ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন হাল। নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। পরিস্থিতি ঠিক করতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে ভাব নেমে এসেছে। তফসিলের পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তাও কমে গেছে।
সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ওঠে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করা যায়। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।’
এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্তি থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সব রাজনৈতিক দল আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও এসেছে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত ও প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। অবশ্য সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর কোনো কোনো দল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির একটি চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি, কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমন ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা চ্যানেলকে সক্রিয় করতে হবে এবং অন্য কাজের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে কমিটি করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট-২ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ চিহ্নিত করা এবং অস্ত্রের পেছনে থাকা অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এসব বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থীদের এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করবে। প্রার্থীদের ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
১ ঘণ্টা আগে
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
৩ ঘণ্টা আগে
সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
১১ ঘণ্টা আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
শুধু শান্ত নন, সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওই ঘাঁটিতে হামলায় সেনাবাহিনীর আরও তিন সৈনিক এবং দুই কর্মচারী নিহত হয়েছেন। সবার বাড়িতে এখন মাতম চলছে। তাঁদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীদের কেউ।
২০১৮ সালে সৈনিক পদে যোগ দেওয়া শান্ত গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। শান্তর স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সাটমাধাই ডারারপাড়ে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, সেখানে কান্নার কোনো শব্দ নেই। শান্তর মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কথা নেই, কান্নাও নেই। ছেলের নাম উচ্চারণ করলেই চোখ ভিজে ওঠে সাহেরা বেগম এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের। লাশ দেশে এলে বাবার কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এখন তাঁরা লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। শান্তর ভাই সোহাগ মন্ডল বলেন, ‘যাওয়ার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, সেটিই হবে তার শেষ দেখা। এমন মৃত্যু আমাদের কল্পনার বাইরে।’
শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর) এবং সৈনিকদের মধ্যে মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), শামীম রেজা (রাজবাড়ী), শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা) নিহত হন।
এ ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির (কুড়িগ্রাম), মোসা. উম্মে হানি আক্তার (রংপুর), চুমকি আক্তার (মানিকগঞ্জ) ও মো. মানাজির আহসান (নোয়াখালী) আহত হয়েছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
হামলায় নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকের আবহ চলছে বাড়িতে। জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাই। এরপর ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে নিশ্চিত করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি আর তিন বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুনছি, বোমা ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। এ দুঃখ কেমনে সহ্য করমু?’
হামলায় নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামে। তাঁর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেন মমিনুল। কয়েক ঘণ্টা পরই আসে মৃত্যুর খবর। প্রতিবেশীরা জানান, খবর শোনার পর স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহ হয়তো তাকে ভালোবাসেন বলেই শহীদের মৃত্যু দিয়েছেন।’
ড্রোন হামলায় নিহত গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি গ্রামের সবুজ মিয়া ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে মা, স্ত্রীসহ স্বজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
হামলায় নিহত রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম রেজা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘টেলিভিশনে সুদানের ঘটনার খবর দেখার পর থেকে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রাত ১২টার পর আমরা নিশ্চিত হই ভাই আর নেই। গত শুক্রবার তিনি বাড়িতে ভিডিও কলে শেষবার কথা বলেছিলেন।’
শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ৭ মাস আগে বিদেশে গেছে। শুক্রবারও কথা বলেছি। শামীম তখন বলল, আব্বু তুমি ভালো থেকো আমি ডিউটিতে যাব। আমার ছেলেকে এনে দাও তোমরা।’
নাটোরের লালপুর উপজেলার আরবাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা নিহত হওয়ার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি সাহার উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। ২০০৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর দুই ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য।
মাসুদ রানার স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি বলেন, ‘তিনি আমার মেয়েকে এতিম করে চলে গেলেন। বাকি জীবন আমরা কীভাবে কাটাব? গতকালও আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। আজ তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।’
ড্রোন হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি নিহত শান্তিরক্ষীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।
আন্তোনিও গুতেরেসের শোক
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত।’
হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ড. ইউনূসও শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি আহত সেনাসদস্যদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এবং নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।
শুধু শান্ত নন, সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওই ঘাঁটিতে হামলায় সেনাবাহিনীর আরও তিন সৈনিক এবং দুই কর্মচারী নিহত হয়েছেন। সবার বাড়িতে এখন মাতম চলছে। তাঁদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীদের কেউ।
২০১৮ সালে সৈনিক পদে যোগ দেওয়া শান্ত গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। শান্তর স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সাটমাধাই ডারারপাড়ে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, সেখানে কান্নার কোনো শব্দ নেই। শান্তর মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কথা নেই, কান্নাও নেই। ছেলের নাম উচ্চারণ করলেই চোখ ভিজে ওঠে সাহেরা বেগম এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের। লাশ দেশে এলে বাবার কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এখন তাঁরা লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। শান্তর ভাই সোহাগ মন্ডল বলেন, ‘যাওয়ার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, সেটিই হবে তার শেষ দেখা। এমন মৃত্যু আমাদের কল্পনার বাইরে।’
শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর) এবং সৈনিকদের মধ্যে মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), শামীম রেজা (রাজবাড়ী), শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা) নিহত হন।
এ ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির (কুড়িগ্রাম), মোসা. উম্মে হানি আক্তার (রংপুর), চুমকি আক্তার (মানিকগঞ্জ) ও মো. মানাজির আহসান (নোয়াখালী) আহত হয়েছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
হামলায় নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকের আবহ চলছে বাড়িতে। জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাই। এরপর ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে নিশ্চিত করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি আর তিন বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুনছি, বোমা ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। এ দুঃখ কেমনে সহ্য করমু?’
হামলায় নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামে। তাঁর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেন মমিনুল। কয়েক ঘণ্টা পরই আসে মৃত্যুর খবর। প্রতিবেশীরা জানান, খবর শোনার পর স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহ হয়তো তাকে ভালোবাসেন বলেই শহীদের মৃত্যু দিয়েছেন।’
ড্রোন হামলায় নিহত গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি গ্রামের সবুজ মিয়া ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে মা, স্ত্রীসহ স্বজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
হামলায় নিহত রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম রেজা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘টেলিভিশনে সুদানের ঘটনার খবর দেখার পর থেকে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রাত ১২টার পর আমরা নিশ্চিত হই ভাই আর নেই। গত শুক্রবার তিনি বাড়িতে ভিডিও কলে শেষবার কথা বলেছিলেন।’
শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ৭ মাস আগে বিদেশে গেছে। শুক্রবারও কথা বলেছি। শামীম তখন বলল, আব্বু তুমি ভালো থেকো আমি ডিউটিতে যাব। আমার ছেলেকে এনে দাও তোমরা।’
নাটোরের লালপুর উপজেলার আরবাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা নিহত হওয়ার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি সাহার উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। ২০০৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর দুই ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য।
মাসুদ রানার স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি বলেন, ‘তিনি আমার মেয়েকে এতিম করে চলে গেলেন। বাকি জীবন আমরা কীভাবে কাটাব? গতকালও আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। আজ তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।’
ড্রোন হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি নিহত শান্তিরক্ষীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।
আন্তোনিও গুতেরেসের শোক
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত।’
হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ড. ইউনূসও শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি আহত সেনাসদস্যদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এবং নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

দেশে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার পতন এবং পরিবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। আজ সোমবার সকালে গুলশানে ইয়ুথ ভোটার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
১ ঘণ্টা আগে
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
৩ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে