Ajker Patrika

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের মোড় বদলে দেন যে সাহসী সাংবাদিক

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ২২: ২১
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

‘ভাগ্য আব্দুল বারীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষের মতো তিনিও একটি ভুল করেছিলেন, মারাত্মক ভুল— পাকিস্তানি সেনা টহলের চোখে পড়েন তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর। তাকে ঘিরে ধরে পাকিস্তানি সশস্ত্র সেনারা, তিনি তখন ভয়ে কাঁপছিলেন— কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে হত্যা করা হবে।’

ভয়ার্ত ও লোমহর্ষক এই চিত্র তুলে ধরে শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের একটি। এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ দমনের নামে সেনাবাহিনী যে নৃশংশ অভিযান চালাচ্ছিল, তার বাস্তব চিত্র প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়।

সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন একজন পাকিস্তানি সাংবাদিক। এর জন্য তাকে সবকিছু ফেলে সপরিবারে প্রাণ নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালাতে হয়েছিল। সেই সাংবাদিক আর কেউ নন, তিনি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।

‘জেনোসাইড’ নামে শুধু এক শব্দের বিশাল মাস্টহেডে প্রতিবেদনটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়। তাতে প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম দমন-পীড়নের তথ্য উঠে আসে। কিন্তু সেই দমন-পীড়ন ব্যর্থ হয়। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন যে এই বিজয়ে গুরুত্ব ভূমিকা রেখেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রতিবেদনই বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং ভারতকে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করে।

তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, ‘এই প্রতিবেদন আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, ভারত সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতির জন্য আমি ইউরোপ ও মস্কো সফরে কূটনৈতিক প্রচারণা চালাতে বাধ্য হয়েছি।’

তবে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন মাসকারেনহাসের মূল উদ্দেশ্য তা ছিল না। ইভান্স তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তিনি (মাসকারেনহাস) কেবল একজন ভালো সাংবাদিক ছিলেন, যিনি সততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।’ কিন্তু এর জন্য তাকে বড় আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যেতে হয় তাকে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

একজন সাহসী সাংবাদিকের আত্মত্যাগ

১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরুর সময় পাকিস্তানের করাচির একজন সম্মানিত সাংবাদিক ছিলেন মাসকারেনহাস। সাংবাদিক হিসেবে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন গোয়া বংশোদ্ভূত ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সদস্য। স্ত্রী ইভন মাসকারেনহাস ও পাঁচ সন্তান নিয়ে সুখের জীবন ছিল তাঁর।

কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টিকেনি, ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে শুরু হয় সঙ্কট। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নিরঙ্কুশ জয় পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং পর্যায়ে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে।

এই আন্দোলন দমাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয় এবং এর প্রথম শিকার হয় জগন্নাথ হলের ছাত্র-শিক্ষকরা। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহনী গ্রামের দিকে হামলা চালাতে থাকে। তাদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর লড়াই শুরু হয়।

শুরুর দিকে দমন-পীড়নের পরিকল্পনা সফল হবে বলে ধারণা করছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সরকারের এই ‘সাফল্যের গল্প’ তুলে ধরতে ৮ জন পাকিস্তানি সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানায় সেনাবাহিনী। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। বাকিরা সবাই তাঁদের উদ্দেশ্য সাধন ধরলেও মাসকারেনহাস বেঁকে বসেছিলেন, সত্য প্রকাশের কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সত্য প্রকাশের ঝুঁকি

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে করাচি গেলেন, তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তার স্ত্রী ইভন বিবিসিকে বলেন, ‘আমি কখনোই তাকে এতটা হতাশ ও বিষণ্ণ দেখিনি। তিনি তখন বলছিলেন, তিনি প্রতিবেদন না লিখলে, তিনি আর কখনো কিছু লিখতে পারবেন না।’

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সেন্সরশিপ ছিল কঠোর। মাসকারেনহাস জানতেন, তিনি দেশে বসে এই প্রতিবেদন লিখলে তাকে হত্যা করা হবে। তাই তিনি বোনের অসুস্থতার অজুহাতে লন্ডনে চলে যান। সরাসরি সানডে টাইমসের সম্পাদকের কাছে গিয়ে সব খুলে বলেন।

সম্পাদক ইভান্স বলেন, ‘তাঁর কথা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ছিল, যে তার বক্তব্য শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে পাকিস্তানি সেনারা সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালাচ্ছিল, সেই বর্ণনা উঠে এসেছিল তাঁর কথায়।’ পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ বলে অভিহিত করেছিল।

বিপদের মুখে যেভাবে সপরিবারে পালান

কিন্তু যুগান্তকারী এই প্রতিবেদন ছাপার আগে পরিবারের নিরাপত্তার জন্য লন্ডনে থাকা নিশ্চিত করতে হয়েছিল মাসকারেনহাসকে। পরিকল্পনা ছিল, লন্ডন থেকে তিনি একটি টেলিগ্রাম পাঠালে স্ত্রী ও সন্তানরা করাচি থেকে পালাবেন। ওই টেলিগ্রাম বার্তার সংকেত ছিল, ‘অ্যানের অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে’।

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে তাঁর স্ত্রী ইভন বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে বার্তাটি পেলাম। আমি আমার সন্তানদের উঠিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমাদের এখনই লন্ডন যেতে হবে। আমরা তখন কাঁদছিলাম, যেন এক শোকযাত্রায় অংশ নিচ্ছি।

কিন্তু সন্দেহ থেকে বাঁচতে তার আগেই মাসকারেনহাসকে পাকিস্তানে ফিরতে হয়েছিল। পরে তিনি গোপনে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান ছাড়েন। লন্ডনে পৌঁছানোর পরদিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমসের প্রথম পাতায় ‘Genocide’ শিরোনামে তাঁর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের এই প্রতিবেদন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাকিস্তান সরকার মাসকারেনহাসকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করে। তবে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সততা ও দক্ষতা অটুট ছিল। পাকিস্তান যে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে সেখবর ১৯৭৯ সালে তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের বন্ধু মাসকারেনহাস

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এখনও মাসকারেনহাসের সেই প্রতিবেদন সংরক্ষিত আছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মোফিদুল হক বলেন, ‘এটি যুদ্ধকালীন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেদন। আমাদের দেশ যখন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, ঠিক তখনই এটি প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন বিশ্ববাসীকে আমাদের দুর্দশার কথা জানাতে সাহায্য করে।’

ইভন মাসকারেনহাস ও তাঁর সন্তানরা আস্তে আস্তে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হন। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘লন্ডনের মানুষ খুবই গম্ভীর ছিল। করাচিতে আমরা হাসিখুশি ছিলাম, কিন্তু এখানে সবাই ছিল নীরব। কিন্তু আমরা কখনোই আমাদের সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত নই।

(অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের যুগান্তকারী প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবিসির নিবন্ধ থেকে অনূদিত।)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত