Ajker Patrika

১৭ বছরে ভোটার চান ড. ইউনূস, এনসিপির প্রস্তাব ১৬ বছর: যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ১৮: ৪৩
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ১৬ বছর করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। গতকাল রোববার সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশমালা কমিশনে জমা দিয়েছে দলটি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলে।

গত অগাস্টে শেখ হাসিনার সরকারকে পতনের অভ্যুত্থানে জেন-জি প্রজন্ম তথা কিশোর-তরুণ প্রজন্মের ভূমিকাকে ভোটার হওয়ার বয়স ১৬ বছর করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে খাঁড়া করেছে এনসিপি। দলটির মত, অভ্যুত্থানে জেন-জির ভূমিকা বিবেচনায় নিলে ভোটারের বয়স ১৮ বছরে সীমিত রাখা গ্রহণযোগ্য নয়।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, ‘আমরা মনে করছি, ভোট দেওয়ার বয়স ১৬ বছর হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, এবারের অভ্যুত্থানকে সারা বিশ্বের জেন-জির অভ্যুত্থান বলা হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে তাদের এত বড় একটা স্টেক তৈরি হলো, এরপর পরিবর্তিত যে বাংলাদেশ এবং আসন্ন যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে তারা মতামত দিতে পারবে না শুধু বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ার কারণে, এটা আমরা যৌক্তিক মনে করছি না।’

এনসিপির বহু আগেই অভ্যুত্থানের নেতাদের আহ্বানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। গত বছর ২৭ ডিসেম্বর এক আলোচনায় সভায় তিনি ভোটারের বয়স ১৭ বছর করার পক্ষে মত দেন।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি মনে করি, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারণ হওয়া উচিত। নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবে, তা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ যদি কমিশনের সুপারিশ করা বয়স পছন্দ করে, ঐকমত্যে পৌঁছার জন‍্য আমি তা মেনে নেব।’

তবে ড. ইউনূস বা এনসিপির এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভোটার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি বাধা এবং শিশু অধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেছেন আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তিনজন বিশেষজ্ঞ আজকের পত্রিকাকে তাঁদের অভিমত জানিয়েছেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম। ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম। ছবি: সংগৃহীত

এটা করতে হলে সাংবিধানিক পরিবর্তন ও ঐকমত্য লাগবে: ড. আব্দুল আলীম

১৬ বছর বয়সীদের ভোটার করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এটি করতে হলে সংসদ লাগবে। তার আগে ১৬ বছর বয়সীদের ভোটার করা হবে কি না সে বিষয়ে ঐকমত্য লাগবে বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম।

এ বিষয়ে ড. মো. আব্দুল আলীম আজকের পত্রিকাকে বলেন, স্লোভেনিয়ায় ১৬ বছর বয়সী যদি কেউ চাকরিজীবী হয়, তখন তাকে ভোট দিতে দেওয়া হয়। আর এস্তোনিয়ায় ১৬ বছর বয়সীদের শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভোট দিতে দেওয়া হয়। আমি দু-একটি দেশের উদাহরণ জানি, যেখানে ভোটারের বয়স ১৭ আছে। এ রকম একটি দেশ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। সেখানে বিয়ের বয়সও ১৭। এ ছাড়া বেশির ভাগ দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮। তারপরও যেহেতু ছাত্ররা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন, তাই তাঁরা মনে করছেন ১৬-তেই ম্যাচিউরড হয়ে যাচ্ছেন।

সংবিধান নতুন করে লেখা বা সংশোধন সংসদ ছাড়া হবে না উল্লেখ করে আব্দুল আলীম বলেন, আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অথবা সীমানা নির্ধারণ আইন সংশোধন অধ্যাদেশ দিয়েই করা যায়। কিন্তু সংবিধানে তো ভোটার (১৮ বছর) ও প্রার্থী (২৫ বছর) হওয়ার বয়স বলা আছে। কাজেই সংবিধানের কোনো জিনিস পরিবর্তন হলে সংসদ দরকার হয়।

ভোটারের বয়স ১৬ বছর করার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমি সরাসরি এ বিষয়ে কিছু বললাম না। তবে এটি অসম্ভব বলে কিছু না। কিন্তু এটি করতে হলে ঐকমত্য লাগবে। প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৩-এর বিষয়ে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞের মত, ২৩, ২৪, ২৫ কাছাকাছি। আমার মনে হয়, যেটি আছে, ঠিক আছে।’

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ছবি: সংগৃহীত
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ছবি: সংগৃহীত

অযৌক্তিক প্রস্তাব, শিশুরা অধিকার লঙ্ঘন হবে: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

১৬ বছর বয়সীদের ভোটার করা হলে প্রটেকশনের ক্ষেত্রে শিশুরা বড় আকারে অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

এই আইনজীবী আজকের পত্রিকাকে বলেন, দেখুন এগুলো শিশুতোষ আলাপ। শিশুরা সম্পত্তির মালিক হতে পারে, কিন্তু আইন অনুযায়ী সরাসরি বিক্রি বা অন্য কিছু করতে পারে না। অভিভাবকের মাধ্যমে করতে হয়। অভিভাবকেরাও নিজে থেকে কিছু করতে পারেন না, আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে সেটি যদি শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ বা বড় করার জন্য ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজন হয় তবে করতে পারেন।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সম্পত্তির অধিকার থেকে শুরু করে কোনো কিছুতেই শিশুর নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আইনগত স্বীকৃতি কোথাও নেই। সেখানে ভোট দেওয়ার মতো বিষয়ে শিশু কীভাবে দেবে? ২০১৩ সালের শিশু আইনে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। ১৮ বছর হওয়ার পর তার ভোট দেওয়ার অধিকারসহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তৈরি হচ্ছে। ১৬ বছর করার যে দাবি, এটি আসলে অর্বাচিন দাবি। এগুলো বিবেচনায় নেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই।

ভোটারের বয়স কমাতে থাকলে শিশুর প্রটেকশনের জায়গাটা কমে আসবে উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, তারা বুঝছে না আইনের দিকে যে ঝুঁকিটা তৈরি হবে, সেটি সামাল দিতে পারবে না। শিশু আইনে তাদের যাতে জেলের মধ্যে না রাখে, তার জন্য শাস্তি না দিয়ে সংশোধন করার জন্য সংশোধনাগার তৈরি করা হয়েছে। শিশুর প্রটেকশনের জন্য জাতিসংঘের শিশুসনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সেটিতে স্বাক্ষর করায় ১৯৭৯ সালের আইন পরিবর্তন করে ২০১৩ সালে নতুন আইন করা হয়েছে। সেখানে শিশুদের প্রটেকশনের ব্যাপার আছে। সেই প্রটেকশন সব উঠে যাবে যখন ভোটার হওয়ার বয়স কমিয়ে ১৬-তে নিয়ে আসা হবে।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মতে, ‘১৬ বছর বয়সে সবার মানসিক পরিপক্বতা এতটা কোনোভাবেই হয় না। আমাদের দেশের যে পরিবেশ-পরিস্থিতি তাতে সব ভালো কাজ নয়, সব খারাপ কাজের দায়ভার তার ঘাড়ে পড়বে। এখন আমরা বিতর্ক করতে চাই বা পারি যে এটি তো শিশু আদালতে যাবে, ওতো শিশু, সবকিছু বিবেচনায় ভোটারের বয়স ১৬ বছর করার দাবি আমি অযৌক্তিক বলে মনে করি।’

২৩ বছর বয়সে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘একটি ছেলে আসলে ২৩ বছর বয়সে পড়াশোনা করে মাত্র বের হয়। সে আসলে তখন রাজনীতির কী বোঝে? পরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তো একটি বয়সের প্রয়োজন হয়। অন্যরা যে পরামর্শই দিক, আমি মনে করি প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ২৫ বছর এবং ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর—এটিই ঠিক আছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রস্তাব: ড. সাব্বির আহমেদ

ভোটের মতো বিষয়ে ১৬ বছরের একটি ছেলে বা মেয়ে সঠিকভাবে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। তাঁর মতে, ১৬ বছরে ভোটার করার উদ্যোগটি সঠিক নয়। বরং ১৮ বছর বয়স যেটি আছে, সেটি ঠিকই আছে।

অধ্যাপক সাব্বির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আরেকটি হচ্ছে, ১৬ বছর আপনি কেমনে করেন? আন্তর্জাতিকভাবে শিশুদের সংজ্ঞা আমি যতটুকু জানি, সেটি ১৬ বছর কোনোভাবেই আসে না। সুতরাং এটি করলে দেশীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনকে সাংঘর্ষিক জায়গায় নিয়ে যাবেন। আমার কাছে যেটি বড় জিনিস মনে হয়, আমি মনে করি ভোটের মতো বিষয়ে একটি ১৬ বছরের ছেলে বা মেয়ে সঠিক মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। এটি আমি মনে করি। এই ধরনের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।’

প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৩ বছর করার বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স বর্তমানে ২৫ আছে। ২৩ বছর বয়সে একজনের পড়াশোনাই তো সঠিকভাবে শেষ হয় না অনার্স, মাস্টার্স। তো এটি করার মাধ্যমে তরুণদের পড়াশোনার জায়গা থেকে নিরুৎসাহিত করা হবে। ২৩ বছর বয়সের একজন যুবকের ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতা থাকে বলে আমার মনে হয় না। তারপরও ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ এবং প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৫ যেটি আছে, সেটিই সঠিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ মার্কিন ফেডারেল সংস্থার

ভারত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রিকশাচালকের সঙ্গে তর্ক, বাংলাদেশিকে ফেরত

আকরামদের প্রথম খবর দেওয়া হয়েছিল, তামিম আর নেই

‘মদের বোতল’ হাতে বৈষম্যবিরোধী নেতা-নেত্রীর ভিডিও, সদস্যপদ স্থগিত

চীনের আগে ভারত সফরে যেতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস: দ্য হিন্দুকে প্রেস সচিব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত