ড. আর এম দেবনাথ
‘আমেরিকা আবার মহান হবে’—এই হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েছেন। পুরো বিশ্ব পৃথিবীর এক নম্বর দেশের দিকে তাকিয়ে। কী হয় এবার? ট্রাম্প কীভাবে আমেরিকাকে আবার মহান করে গড়ে তুলবেন? তা তিনি তুলুন, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যত্র। আমেরিকা আবার মহান হলে আমাদের কী লাভ? সারা বিশ্বের মানুষেরই-বা কী লাভ? হ্যাঁ, প্রতিশ্রুতিমতো তিনি যদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন, সমুদ্রপথকে সবার বাণিজ্যের জন্য বাধামুক্ত করতে পারেন—তাহলে কিছু একটা হয় অন্তত। কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়েই গেল। আমাদের কী লাভ? বিশ্ববাসীর কী লাভ? তিনি কি বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করবেন? তিনি কি বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারবেন? তিনি কি বিশ্বকে বৈষম্যমুক্ত করতে আগ্রহী হবেন?
অনেক প্রশ্ন। কারণ আমেরিকা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ, প্রভাবশালী দেশ। তারপরেই চীন, যে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। রয়েছে ভারত। পাশে রাশিয়া। আছে উদীয়মান ‘ব্রিকস’। আছে সাউথ-সাউথ ব্লক। অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তবে এই আলোচনার কোনো শেষ নেই। কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে কথার মিল নেই। কেমন? একটা জিনিস লক্ষণীয়—ট্রাম্পের অতিথিদের মধ্যে প্রধান কারা দেখেছেন? দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় ধনী, শ্রেষ্ঠ ধনী—ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস আছেন। রয়েছেন প্রতিবেশী ভারতের অনিল আম্বানি, নন্দন নিলেকানির মতো লোক। আর তাঁর সঙ্গীরা হচ্ছেন ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণি, যাঁরা ভারতীয়দের টাকায় লেখাপড়া শিখে মার্কিনিদের ‘সেবা’ করছেন। হয়েছেন গরিব দেশের নাগরিক থেকে ধনী দেশের নাগরিক।
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তুলনীয় ঘটনা আরও একটি আছে। সেটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সেখানে দুনিয়ার বড় যত ব্যবসায়ী, সবাই যান। আগে শুনতাম, ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের প্রধানদের আনুকূল্য প্রার্থনা করতেন। এখন এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রনায়কেরা, মন্ত্রীরা যান এসব অনুষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য। বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য। উন্নয়ন আরকি। সবার নজরই উন্নয়ন। মনে হচ্ছে, উন্নয়ন মানে শক্তি। অর্থনৈতিক শক্তি। আবার উন্নয়ন হলেই দরকার সামরিক শক্তি। দুনিয়াকে বোঝানো যে আমরা শক্তিশালী। আর শক্তি দেখাতে অস্ত্র দরকার। অস্ত্র উৎপাদন দরকার। দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত ‘উন্নয়ন’ হয় অস্ত্রের, অস্ত্র উৎপাদন এবং যুদ্ধই হয়ে ওঠে অ্যাজেন্ডা এবং এটাই নির্ধারণ করে দুনিয়ার ভবিষ্যৎ।
শেষ বিচারে দারিদ্র্যবিমোচন পেছনে পড়ে যায়। গরিবের কথা ‘বাসি’ হয়ে যায়। এখন বলি একটা, করি আমরা আরেকটা। মুখে যুদ্ধ নয়, শান্তি—বাস্তবে যুদ্ধের প্রস্তুতি। একজনের পেছনে লাগা। প্রতিবেশী হলে তো কথাই নেই। প্রতিবেশীকে দমন করা এক নম্বর কাজ! হাত পাকানো আরকি। দুনিয়ার এই হচ্ছে নমুনা। আজকাল রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরা আর কবি-সাহিত্যিক নিয়ে ঘোরেন না। তাঁদের লালন-পালন করেন না। তাঁদের দেখা হয় অনুগ্রহপ্রার্থী হিসেবে। এটাই হয়ে পড়েছে নতুন সভ্যতা।
আমাদের প্রত্যাশা খুবই কম। কোনো রাষ্ট্রই তার নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের জন্য কিছু করবে না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে আমরা যেতে পারি। আমরা সেখানে কী অভিজ্ঞতার কথা বলব? তারা জানে আমাদের মাইক্রোক্রেডিটের কথা। বলাই বাহুল্য, তারা এসব ব্যবসা করে না। তাদের ব্যবসা হচ্ছে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের। এক বিলিয়ন মানে শতকোটি। এই অবস্থায় তাদের কাছে বড় কিছু আশা করে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের একটা দাবি আছে। সেটা আমাদের নিজস্ব স্বার্থের কথা। দুনিয়ার তাবৎ ধনী ব্যবসায়ীরা জানেন টাকা কোত্থেকে আসে, কোথায় যায়, টাকা কোথায় রাখা হয়, কারা টাকার ম্যানেজার।
এমতাবস্থায় ধনীদের কাছে আমরা একটা দাবি করতেই পারি। তাঁরা জানেন, আমাদের দেশের চুরি-ঘুষের টাকা পাচার হয়ে তাঁদের দেশে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, হংকং, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় দেশ, আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে আমাদের দেশের চোরেরা অর্থ পাচার করে ডলার জমাচ্ছে। তাদের ধরে ধরে খোঁজ করে ডলারগুলো বের করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমরা মোটামুটি একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। চারদিকে খবর দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশে সরকার খবর করছে। সম্পত্তি ক্রোকও করছে। এসব কথা জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পর্যন্ত জানে। তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। তারা তাদের দেশের আইন বদল করতে পারে। ‘চোরাই’ ডলার না রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার থেকে নিয়ম করেছে অবৈধ অভিবাসীদের তারা সেখান থেকে বের করে দেবে। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি? মার্কিনদের লাভ নিশ্চয়ই। ক্ষতি অবৈধদের, যে দেশ থেকে তাঁরা এসেছেন। তবে এখানেও লাভ আছে। তাঁরা ভিনদেশে অবৈধভাবে না গিয়ে নিজের দেশকে উন্নত করতে পারেন। তাঁদের সব ধরনের মেধা আছে, তাঁরা পরিশ্রমী। এই চেষ্টায় মার্কিনরা তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে।
‘রেজিম চেঞ্জ’ না করে, অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকে না মেরে, বয়কট না করে মার্কিনরা এভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতে পারে। তাদের হাতে, তাদের দেশের ধনীদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা। তারা অর্থশক্তিতে বলীয়ান, এটা তাদের কাছে কিছুই না। এসবের পরিবর্তে যদি দেখা যায়, বছরে একবার-দুইবার দাভোসে মিটিংয়ে বসে করমর্দন করা হচ্ছে। তাহলে কার লাভ? এ ছাড়া বছরে তারা যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়, সেগুলো কি বাস্তবায়িত হয়? তারা কি বিশ্বের সব সমস্যা সমাধানে একমত? দ্বিধা-বিভক্তি তাদের মধ্যে প্রবল। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। শুধু আলোচনা। দেখা গেল, দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর আলোচনা হচ্ছে। অথচ সেমিনার হলে কোনো লোক নেই। বক্তাই শুধু। শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা হচ্ছে। অথচ ভেতরে-ভেতরে ব্যক্তিগত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বিশ্বশান্তি এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু তা হয় না। বড়জোর শেষ পর্যন্ত কফি আর আড্ডাতেই সময় চলে যায়। যেন ‘চোরের মন খিরাখেতে’। আলোচনা যা-ই হোক না কেন, কী করব তা তো ঠিকই করা আছে!
আসলে শুধু আমেরিকা ‘মহান’ হলে হবে না। বিশ্বের সব দেশকে মহান হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। টেকনোলজি, অর্থ, ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং ইত্যাদি একজনের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলে হবে না। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে সবার মঙ্গলের জন্য। এমনিতেই গড় হিসাবে বিশ্বের কয়েকজন ধনীর হাতে যে ডলার, সম্পদ, অর্থবিত্ত তা পুরো মানবজাতির সম্পদের সমান। করোনাকাল ছিল দুর্দিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও তা-ই। কিন্তু এরই মধ্যে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। গরিবরা হয়েছেন গরিব। একবার টাকা করে ফেলতে পারলে টাকার অভাব হয় না। আর যেহেতু অভাব হয় না, তাই টাকার গরমই আলাদা! আবার এই টাকা অনেক সময় ক্ষতিও করে। বেসরকারি বিনিয়োগে অনেক লাভ-উন্নতি। আবার ক্ষতিও আছে। এই যেমন আমাদের নদীর তীরে তীরে শিল্প-কারখানা, শিপইয়ার্ড। শিল্প হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে যাচ্ছে আমাদের নদী। নদীর জলে হাত দেওয়া যায় না। নদী গেল, জল গেল, নাব্যতা গেল—অথচ উন্নতি তো হলো! জিডিপি তো বড় হলো।
অবস্থা তা-ই। বিশ্বের বড় ধনীরা যদি এসব নিয়ে ভাবতেন, তাহলে আমরা লাভবান হতাম। অশান্তির কারণও অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই। যুদ্ধ তাঁদেরই সৃষ্টি। পণ্যের গুণগত মান বিনাশ, পণ্যের অপ্রাপ্তি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, কার্টেল, মনোপলি, সিন্ডিকেট তাঁদেরই সৃষ্টি। আবাসনসংকট, চাকরিচ্যুতি, বেকারত্ব তাঁদেরই সৃষ্টি। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নেই—তাও তাঁদেরই কীর্তি। শ্রমিকের সঙ্গে ধনীদের ঝগড়া আজীবন। দুই পয়সা তাঁরা বেতন বাড়াতে চান না। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প এর একটা প্রমাণ। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা যত তরতাজা হন, শ্রমিকেরা হন ততটাই হাড্ডিসার।
‘আমেরিকা আবার মহান হবে’—এই হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েছেন। পুরো বিশ্ব পৃথিবীর এক নম্বর দেশের দিকে তাকিয়ে। কী হয় এবার? ট্রাম্প কীভাবে আমেরিকাকে আবার মহান করে গড়ে তুলবেন? তা তিনি তুলুন, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যত্র। আমেরিকা আবার মহান হলে আমাদের কী লাভ? সারা বিশ্বের মানুষেরই-বা কী লাভ? হ্যাঁ, প্রতিশ্রুতিমতো তিনি যদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন, সমুদ্রপথকে সবার বাণিজ্যের জন্য বাধামুক্ত করতে পারেন—তাহলে কিছু একটা হয় অন্তত। কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়েই গেল। আমাদের কী লাভ? বিশ্ববাসীর কী লাভ? তিনি কি বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করবেন? তিনি কি বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারবেন? তিনি কি বিশ্বকে বৈষম্যমুক্ত করতে আগ্রহী হবেন?
অনেক প্রশ্ন। কারণ আমেরিকা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ, প্রভাবশালী দেশ। তারপরেই চীন, যে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। রয়েছে ভারত। পাশে রাশিয়া। আছে উদীয়মান ‘ব্রিকস’। আছে সাউথ-সাউথ ব্লক। অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তবে এই আলোচনার কোনো শেষ নেই। কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে কথার মিল নেই। কেমন? একটা জিনিস লক্ষণীয়—ট্রাম্পের অতিথিদের মধ্যে প্রধান কারা দেখেছেন? দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় ধনী, শ্রেষ্ঠ ধনী—ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস আছেন। রয়েছেন প্রতিবেশী ভারতের অনিল আম্বানি, নন্দন নিলেকানির মতো লোক। আর তাঁর সঙ্গীরা হচ্ছেন ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণি, যাঁরা ভারতীয়দের টাকায় লেখাপড়া শিখে মার্কিনিদের ‘সেবা’ করছেন। হয়েছেন গরিব দেশের নাগরিক থেকে ধনী দেশের নাগরিক।
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তুলনীয় ঘটনা আরও একটি আছে। সেটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সেখানে দুনিয়ার বড় যত ব্যবসায়ী, সবাই যান। আগে শুনতাম, ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের প্রধানদের আনুকূল্য প্রার্থনা করতেন। এখন এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রনায়কেরা, মন্ত্রীরা যান এসব অনুষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য। বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য। উন্নয়ন আরকি। সবার নজরই উন্নয়ন। মনে হচ্ছে, উন্নয়ন মানে শক্তি। অর্থনৈতিক শক্তি। আবার উন্নয়ন হলেই দরকার সামরিক শক্তি। দুনিয়াকে বোঝানো যে আমরা শক্তিশালী। আর শক্তি দেখাতে অস্ত্র দরকার। অস্ত্র উৎপাদন দরকার। দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত ‘উন্নয়ন’ হয় অস্ত্রের, অস্ত্র উৎপাদন এবং যুদ্ধই হয়ে ওঠে অ্যাজেন্ডা এবং এটাই নির্ধারণ করে দুনিয়ার ভবিষ্যৎ।
শেষ বিচারে দারিদ্র্যবিমোচন পেছনে পড়ে যায়। গরিবের কথা ‘বাসি’ হয়ে যায়। এখন বলি একটা, করি আমরা আরেকটা। মুখে যুদ্ধ নয়, শান্তি—বাস্তবে যুদ্ধের প্রস্তুতি। একজনের পেছনে লাগা। প্রতিবেশী হলে তো কথাই নেই। প্রতিবেশীকে দমন করা এক নম্বর কাজ! হাত পাকানো আরকি। দুনিয়ার এই হচ্ছে নমুনা। আজকাল রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরা আর কবি-সাহিত্যিক নিয়ে ঘোরেন না। তাঁদের লালন-পালন করেন না। তাঁদের দেখা হয় অনুগ্রহপ্রার্থী হিসেবে। এটাই হয়ে পড়েছে নতুন সভ্যতা।
আমাদের প্রত্যাশা খুবই কম। কোনো রাষ্ট্রই তার নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের জন্য কিছু করবে না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে আমরা যেতে পারি। আমরা সেখানে কী অভিজ্ঞতার কথা বলব? তারা জানে আমাদের মাইক্রোক্রেডিটের কথা। বলাই বাহুল্য, তারা এসব ব্যবসা করে না। তাদের ব্যবসা হচ্ছে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের। এক বিলিয়ন মানে শতকোটি। এই অবস্থায় তাদের কাছে বড় কিছু আশা করে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের একটা দাবি আছে। সেটা আমাদের নিজস্ব স্বার্থের কথা। দুনিয়ার তাবৎ ধনী ব্যবসায়ীরা জানেন টাকা কোত্থেকে আসে, কোথায় যায়, টাকা কোথায় রাখা হয়, কারা টাকার ম্যানেজার।
এমতাবস্থায় ধনীদের কাছে আমরা একটা দাবি করতেই পারি। তাঁরা জানেন, আমাদের দেশের চুরি-ঘুষের টাকা পাচার হয়ে তাঁদের দেশে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, হংকং, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় দেশ, আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে আমাদের দেশের চোরেরা অর্থ পাচার করে ডলার জমাচ্ছে। তাদের ধরে ধরে খোঁজ করে ডলারগুলো বের করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমরা মোটামুটি একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। চারদিকে খবর দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশে সরকার খবর করছে। সম্পত্তি ক্রোকও করছে। এসব কথা জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পর্যন্ত জানে। তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। তারা তাদের দেশের আইন বদল করতে পারে। ‘চোরাই’ ডলার না রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার থেকে নিয়ম করেছে অবৈধ অভিবাসীদের তারা সেখান থেকে বের করে দেবে। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি? মার্কিনদের লাভ নিশ্চয়ই। ক্ষতি অবৈধদের, যে দেশ থেকে তাঁরা এসেছেন। তবে এখানেও লাভ আছে। তাঁরা ভিনদেশে অবৈধভাবে না গিয়ে নিজের দেশকে উন্নত করতে পারেন। তাঁদের সব ধরনের মেধা আছে, তাঁরা পরিশ্রমী। এই চেষ্টায় মার্কিনরা তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে।
‘রেজিম চেঞ্জ’ না করে, অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকে না মেরে, বয়কট না করে মার্কিনরা এভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতে পারে। তাদের হাতে, তাদের দেশের ধনীদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা। তারা অর্থশক্তিতে বলীয়ান, এটা তাদের কাছে কিছুই না। এসবের পরিবর্তে যদি দেখা যায়, বছরে একবার-দুইবার দাভোসে মিটিংয়ে বসে করমর্দন করা হচ্ছে। তাহলে কার লাভ? এ ছাড়া বছরে তারা যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়, সেগুলো কি বাস্তবায়িত হয়? তারা কি বিশ্বের সব সমস্যা সমাধানে একমত? দ্বিধা-বিভক্তি তাদের মধ্যে প্রবল। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। শুধু আলোচনা। দেখা গেল, দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর আলোচনা হচ্ছে। অথচ সেমিনার হলে কোনো লোক নেই। বক্তাই শুধু। শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা হচ্ছে। অথচ ভেতরে-ভেতরে ব্যক্তিগত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বিশ্বশান্তি এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু তা হয় না। বড়জোর শেষ পর্যন্ত কফি আর আড্ডাতেই সময় চলে যায়। যেন ‘চোরের মন খিরাখেতে’। আলোচনা যা-ই হোক না কেন, কী করব তা তো ঠিকই করা আছে!
আসলে শুধু আমেরিকা ‘মহান’ হলে হবে না। বিশ্বের সব দেশকে মহান হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। টেকনোলজি, অর্থ, ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং ইত্যাদি একজনের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলে হবে না। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে সবার মঙ্গলের জন্য। এমনিতেই গড় হিসাবে বিশ্বের কয়েকজন ধনীর হাতে যে ডলার, সম্পদ, অর্থবিত্ত তা পুরো মানবজাতির সম্পদের সমান। করোনাকাল ছিল দুর্দিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও তা-ই। কিন্তু এরই মধ্যে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। গরিবরা হয়েছেন গরিব। একবার টাকা করে ফেলতে পারলে টাকার অভাব হয় না। আর যেহেতু অভাব হয় না, তাই টাকার গরমই আলাদা! আবার এই টাকা অনেক সময় ক্ষতিও করে। বেসরকারি বিনিয়োগে অনেক লাভ-উন্নতি। আবার ক্ষতিও আছে। এই যেমন আমাদের নদীর তীরে তীরে শিল্প-কারখানা, শিপইয়ার্ড। শিল্প হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে যাচ্ছে আমাদের নদী। নদীর জলে হাত দেওয়া যায় না। নদী গেল, জল গেল, নাব্যতা গেল—অথচ উন্নতি তো হলো! জিডিপি তো বড় হলো।
অবস্থা তা-ই। বিশ্বের বড় ধনীরা যদি এসব নিয়ে ভাবতেন, তাহলে আমরা লাভবান হতাম। অশান্তির কারণও অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই। যুদ্ধ তাঁদেরই সৃষ্টি। পণ্যের গুণগত মান বিনাশ, পণ্যের অপ্রাপ্তি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, কার্টেল, মনোপলি, সিন্ডিকেট তাঁদেরই সৃষ্টি। আবাসনসংকট, চাকরিচ্যুতি, বেকারত্ব তাঁদেরই সৃষ্টি। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নেই—তাও তাঁদেরই কীর্তি। শ্রমিকের সঙ্গে ধনীদের ঝগড়া আজীবন। দুই পয়সা তাঁরা বেতন বাড়াতে চান না। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প এর একটা প্রমাণ। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা যত তরতাজা হন, শ্রমিকেরা হন ততটাই হাড্ডিসার।
যোদ্ধা ও ভিক্ষুকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং চরিত্র নিয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি অসাধারণ লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি নানা কারণেই একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে পড়েছে। যদিও এসব কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এমন তুলনামূলক বিশ্লেষণ কখনোই সেভাবে আসেনি।
৬ ঘণ্টা আগেঅভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামনে প্রকৃত অর্থেই এক নবযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক নতুন ভোরের সূর্যোদয়। কিন্তু ছয় মাস না পেরোতেই আশা ফিকে হয়ে আসছে। ঈষান কোণের কালো মেঘ তার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
৬ ঘণ্টা আগেঘুণে ধরা সমাজ বা কাঁচা বাশে ঘুণে ধরার কথা দৈনন্দিন জীবনে আমরা কে না শুনেছি? আবার ঘুণাক্ষরে টের না পাওয়ার বিষয়টিও আমরা কমবেশি শুনেছি। নেতিবাচক অর্থে এই ঘুণে ধরার বিষয়টি আমাদের সমাজব্যবস্থায় যেন পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঘুষ-দুর্নীতির যে শিকড় এ দেশে গজিয়েছে তা এতটাই বিস্তৃত, সরকারের অদল-বদল কিংবা আইনশৃঙ্খলার কঠোরতাকে থোড়াই পাত্তা দেয়! কিছুতেই যেন এই অপরাধের তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।
৬ ঘণ্টা আগে