রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদ এবং সুযোগের প্রশ্ন

হাসান মামুন 
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯: ৫৯
Thumbnail image
প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্র সংস্কারের কথা প্রথম জোরেশোরে উঠেছিল ওয়ান-ইলেভেনে। তবে অনেক কসরত করেও তখনকার সরকার কোনো অর্থবহ সংস্কার করতে পারেনি। একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়েই তাদের বিদায় নিতে হয় প্রায় দুই বছর পর। অতঃপর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ চালিয়ে গত আগস্টে বিদায় নিয়েছে নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে। গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারও রাষ্ট্র সংস্কারকে প্রাথমিক লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে; চূড়ান্ত লক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।

তবে শুরু থেকেই পরিস্থিতি এত জটিল যে তাদের হাতে প্রত্যাশামতো সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে সংশয় রয়েছে। সংশয় গাঢ় হচ্ছে ক্রমে।

হালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কোনো মৌলিক সংস্কারে শেষতক আগ্রহী না থাকলে সরকার শুধু নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই পথ চলবেন—এটা তিনি অবশ্য শুরু থেকেই বলছেন। এটা বলতেও দ্বিধা করেননি, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে তাঁরা বিদায় নিলে আশঙ্কা থাকবে রাজনীতির পুরোনো সংকট ফিরে আসার। রাজনৈতিক অঙ্গনের একাংশ থেকে অবশ্য ভিন্ন বক্তব্য উচ্চারিত হচ্ছে। বিএনপি বলছে, তারা গণ-অভ্যুত্থানের আগেই রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হলে তারা ওই সব দফা নিয়েই এতে লড়তেন। বিএনপি এখন বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলে এবং তাতে বিএনপি জয়ী হলে তারাই বর্তমানে আলোচিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। এটাও বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারে উদ্যোগী, তার সঙ্গে বিএনপির ৩১ দফার অনেক মিল রয়েছে। তবে সংশয়টা অন্যখানে। বিএনপি বা অন্য কোনো দল সংস্কার বিষয়ে এখন যা বলছে, ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে কি না!

সংশয়টি বেশি করে সৃষ্টি হয়েছে হাসিনা সরকারের আচরণের কারণে। তারা ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল এটা বলে যে সরকারটি তাদের আন্দোলনের ফসল। এর আগে খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তারা একই দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আর কোনো সংস্কারে মনোনিবেশ তো করেইনি—রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ঐতিহাসিক সমঝোতা’য় আসা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাও তারা বাতিল করে দেয়। এ জন্য সর্বোচ্চ আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেরও জোর অভিযোগ রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে অবশ্য। দ্রুত এর নিষ্পত্তি হবে বলে আশা। তাতে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। আওয়ামী লীগ বাদে প্রায় সব দলই এখন ব্যবস্থাটি ফিরিয়ে আনতে চাইছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ অবশ্য মাঠছাড়া। সংস্কারবিষয়ক কোনো আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগও নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এটাই শুধু বলে যাচ্ছে—তাদের উৎখাত করা হয়েছে ষড়যন্ত্র করে! তাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার বিরামহীন চেষ্টার অভিযোগও তোলা হচ্ছে বিপরীত দিক থেকে।

এর মধ্যে হাসিনা সরকারের সহযোগী বলে পরিচিত জাতীয় পার্টির মাঠে থাকার চেষ্টা লক্ষণীয়। গণ-অভ্যুত্থানের একটা পর্যায় থেকে দলটি বিগত সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনায়ও অংশ নেন এর নেতারা। সরকারের সঙ্গে শুরুর দিককার সংলাপেও তাঁরা অংশ নিয়েছিলেন। তবে একটা পর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের তরফ থেকে আপত্তি উঠলে পরবর্তী সংলাপে জাপাকে আর ডাকা হয়নি। এর মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও তাতে হামলার ঘটনা ঘটে। জাপাকে নিষিদ্ধের দাবিও ওঠে। মাঝে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংস্কার কমিশনগুলো আওয়ামী লীগ ও জাপার কোনো প্রস্তাব নেবে না। তা সত্ত্বেও দলটি রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের প্রস্তাব তৈরি করে কমিশনে জমা দিয়ে এসেছে। এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরেছে প্রস্তাবগুলো। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাবই তারা তুলে ধরেছে। এর সঙ্গে বিএনপির প্রস্তাবের মিলও লক্ষণীয়। হাসিনা সরকারের সুদীর্ঘ সহযোগী ও সুফলভোগী হিসেবে দুর্নাম কামালেও রাষ্ট্র সংস্কারে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে জাপাকে। এটা কৌতূহলোদ্দীপক।

এর আগে জামায়াতে ইসলামীও রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করে। তাতেও অভিন্ন কিছু প্রস্তাব স্থান পেয়েছে। আছে বিশেষ প্রস্তাবও। অভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয় রয়েছে। এটিকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে তারাও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। পরে অবশ্য দুই পক্ষে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিএনপি-জামায়াত সরকারও গঠিত হয়। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে জামায়াত ব্যাপক দমনের মুখে পড়ে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিকে দলটিকে নিষিদ্ধও করে সরকার। সেটি অবশ্য আপনা-আপনি অকার্যকর হয়ে যায় দ্রুত সরকারের পতন ঘটলে। নতুন সরকার গঠনে সেনানিবাসে আলোচনার জন্য ডাক পায় জামায়াত। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত বলে অভিযোগও উঠেছে। জামায়াতও সরকারকে জোর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার সেরে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে। এ জায়গায় বিএনপির সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য স্পষ্ট। বিএনপি মনে করে, ‘জরুরি সংস্কার’ ছাড়া অন্য কোথাও হাত না দিয়ে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচন করে বিদায় নেওয়া। বলা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার প্রতিশ্রুত সংস্কারে না গেলে তাদের কঠোর জবাবদিহি করতে হবে এখন। কেননা, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী জন-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।

গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের যে নেতৃত্ব সামনে ছিল, তারা এখনো মাঠে সক্রিয়। নানা চিন্তাধারার মধ্যেও একটি বিষয়ে তারা একমত—রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার হতে হবে। তাদের সঙ্গে আরও অনেকের ধারণা, সংবিধানেই ফ্যাসিবাদ পুনরুত্থানের সুযোগ রয়ে গেছে। সে কারণেই এর কিছু মৌলিক সংস্কারে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকারও সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনে দ্বিধা করেনি। সংস্কার কমিশনের আনা সুপারিশ নিয়ে অবশ্য সংলাপ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। সবার সম্মিলিত মত অনুযায়ী যেগুলো জরুরি বিবেচিত হবে, কেবল সেগুলোই বাস্তবায়ন করবে সরকার। তখন ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ও ঘোষণা করা যাবে। সংস্কারের পথ ধরে নির্বাচন—এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের বিঘোষিত নীতি। এটি বাস্তবায়নের সুযোগ অবশ্য থাকতে হবে। সে জন্য দেশকে রাখা চাই স্বাভাবিক ধারায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার যে এখনো সফল নয়, সেটা নিজেও স্বীকার করছে। সরকার মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি মোকাবিলায়ও এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। এ ক্ষেত্রে হাসিনা সরকারের সঙ্গে তার তুলনাটিও সামনে এসে যাচ্ছে—ইতিমধ্যে যে সরকারের তিন মাস অতিক্রান্ত।

মানুষ দেখেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো তিন মাসের মধ্যে মানসম্মত নির্বাচন দিয়ে দিব্যি চলে যেত। তাদের আমলে শাসন পরিস্থিতির উন্নতিও যে হয়নি, তা নয়। বর্তমান সরকার অবশ্য দায়িত্ব নিয়েছে অদৃষ্টপূর্ব জটিল পরিস্থিতিতে। তাদের প্রতিপক্ষও রয়েছে, যারা গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলেও দুর্বল নয়। তাদের দিক থেকে নিয়মিত প্রত্যাখ্যাত সরকারকে সামলাতে হচ্ছে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। ভারতের মোদি সরকার এবং তার অনুগত মিডিয়াও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলতে হবে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার কতটা সময় পাবে, সেটাও বিবেচ্য। সরকারকে দীর্ঘ সময় দেওয়ার ব্যাপারে গণ-অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যেও আছে মতপার্থক্য। সরকার সংস্কার করে গেলেও পরবর্তীকালে সেগুলো টিকে না থাকার শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের তরফ থেকে আবার বলা হচ্ছে, শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ছাত্র-জনতা এভাবে রক্ত দেয়নি। এটাও নির্মম সত্য, মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে বলেই এর ভেতর দিয়ে প্রত্যাশিত সবকিছু অর্জিত হয়ে যাবে না। পরিবেশ-পরিস্থিতি একটি বড় বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকার তো বলিষ্ঠভাবে দেশ পরিচালনা করতেও পারছে না। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংহতির বদলে দূরত্ব বাড়ায় ক্ষমতাচ্যুতদের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনাও বাড়ছে। আর সে দলটি তো কোনো ধরনের সংস্কারেরই পক্ষপাতী নয়। নজিরবিহীন অপশাসনের জন্য অনুশোচনাও দেখা যাচ্ছে না তাদের মধ্যে। এ অবস্থায় অপেক্ষা করে থাকতে হবে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ ঘিরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সংলাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত।

গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের তরফ থেকে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে বলেও খবর মিলেছে এর মধ্যে। এটি ঘটলে সে দলের সঙ্গেও নিশ্চয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সংলাপ করবে সরকার। ছাত্রদের একাধিক প্ল্যাটফর্মও মাঠে রয়েছে—সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে যাদের আছে জোরালো মতামত। রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ছাড়া শুধু নির্বাচনে যেতে তারা অনাগ্রহী। এ অবস্থায় সংস্কার বিষয়ে সামনে একটা জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। তত দিনে আইনশৃঙ্খলা ও পণ্যবাজার পরিস্থিতি কী রূপ পরিগ্রহ করে, সেটাও দেখার বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত