অবরুদ্ধ দেশের সাংবাদিকতা: প্রেক্ষিত একাত্তর-১

জাহীদ রেজা নূর  
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ০৩
প্রতিবাদের কথা ছাপা হলেও কৌশলে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়েছিল ইত্তেফাক। ছবি: সংগৃহীত

বিজয়ের মাসে যে লেখাটি লিখতে চাইছি, তাতে একাত্তরের সাংবাদিকতার কথাই থাকবে। অবরুদ্ধ বাংলায় স্বাধীনতাকামী সংবাদপত্রগুলো কীভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে, সে কথা বলতে হবে। একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের দালাল হয়ে যারা সাংবাদিক হত্যায় অংশ নিয়েছে, তাদের কথাও বলা হবে। ১৯৭১ সালের বাস্তবতা দিয়ে সে সময়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত থেকে সেই বাস্তবতাকে খুঁজে নিতে হবে।

সংবাদমাধ্যম স্বাধীন কি স্বাধীন নয়, সেটা বোঝা যায়, তাতে কী ছাপা হচ্ছে আর কী দেখানো হচ্ছে, তা অনুধাবন করে। যদি চলমান সরকারের গুণগান ও অন্যদের বিষোদ্গার করা হতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সংবাদমাধ্যম মোটেই স্বাধীন নয়। স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়ে ঘোষণা থাকলেও কেউ সেই স্বাধীনতা ভোগ করার অবস্থায় থাকে না। ১৯৭১ সালেও সে রকম একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সে সময় সাংবাদিকেরা কীভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।

১৯৭১ সালে আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ইত্তেফাক গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর পাকিস্তানে কোনো অঘটন ঘটেনি, তা প্রমাণ করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক সরকারই ইত্তেফাক নতুন করে চালু করার দায়িত্ব নেয়। সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রথমে সে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে চাননি, পরে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার স্ত্রী মাজেদা বেগমের অনুরোধে দায়িত্ব নেন। শর্ত দেন, নিজে যা বোঝেন, সেভাবেই লেখালেখি করবেন। ১৯৭১ সালের ইত্তেফাকে সিরাজুদ্দীন হোসেনের সেই সাহসী সাংবাদিকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সেই সময় ইত্তেফাকে তিনি যা যা লিখেছেন, তা নিয়ে আমরা একটা বইও প্রকাশ করেছি ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া’ নামে। আগ্রহী পাঠক তাতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

অবরুদ্ধ নগরীর সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে তার পটভূমি নিয়েও খানিক আলাপ করে নিতে হয়। আর তার বর্ণনা করতে হলে অবধারিতভাবে সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাটি সম্পর্কেও জানতে হয়। নতুন প্রজন্ম যেন বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে না যায়, সে জন্য ইতিহাসের কাছে নতজানু হয়েই ঘটনার বর্ণনা করতে হবে।

২. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে ইয়াহিয়া-ভুট্টো যে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করেছেন, বাংলার নেতা শেখ মুজিবের হাতে যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না, তার আলামত পাওয়া যাচ্ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাদের ঢাকায় নিয়ে আসার ঘটনায়। একটা ধ্বংসযজ্ঞ যে ক্রমেই কাছিয়ে আসছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠন হওয়ার পর থেকেই মিথ্যা, জুলুম, কোটারি স্বার্থ রক্ষা আর বঞ্চনার পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৬৬ সাল থেকে ৬ দফার যে আন্দোলন চলছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা তাবৎ বড় নেতাদের ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছিলেন বাংলার কণ্ঠস্বর। আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরও অনেক দল ছিল সে সময়, কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগই পেয়েছিল সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় আসন। তাতে অবশ্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্য বদলায়নি। অতীতের মতোই বাংলাকে পদদলিত করে রাখার সব ফন্দি করে রেখেছিলেন ইয়াহিয়া আর ভুট্টো। যার ফলে অপারেশন সার্চলাইটের হত্যাযজ্ঞ সব আলোচনার সমাধি ঘটাল এবং পূর্ব বাংলার মানুষ দেশ স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র তুলে নিল হাতে।

এ রকম এক বাস্তব অবস্থার মধ্যে দেশ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের মতলব কী, তা দুটো ঘটনায় প্রকাশিত হয়ে পড়ল। রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজার নেতৃত্বে অপারেশন সার্চলাইটের তাণ্ডব যখন চলছে গোটা পূর্ব বাংলায়, তখন ঢাকা শহরের তিনটি পত্রিকাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। বাঙালির স্বার্থরক্ষায় অবিচল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দ্য পিপল পত্রিকায় চলল এই ধ্বংসযজ্ঞ। অন্যদিকে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার খবর গোপন করার জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো বিমানবন্দরে, সার্চ করে দেখা হলো, তাঁরা এই হত্যাযজ্ঞের কোনো খবর নিয়ে যাচ্ছেন কি না, সে রকম কিছু নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হলো তাঁদের।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এ রকম বিজয় পাবে, সে খবর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদেরও ধারণার বাইরে ছিল। তাঁরা যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতে বাংলায় নানা দলের মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যাবে, এ রকম একটা আভাস ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ পেল ভূমিধস বিজয়। ফলে এ অবস্থায় করণীয় কী, সেটা পাকিস্তান সরকার বুঝে উঠতে পারছিল না। এরই জেরে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা করা হয় এবং চালানো হয় এই হত্যাযজ্ঞ। ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন, আকস্মিক আক্রমণে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হলে বাঙালির পক্ষে আর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। বাঙালির হাতে ক্ষমতাও দিতে হবে না।

ইয়াহিয়া খানের ধারণা যে ভুল ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাবলিতেই প্রকাশ পেয়েছে। এই সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছিল কিছু দিগ্‌ভ্রান্ত চৈনিক বাম আর জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এ ছাড়া সবাই শামিল হয়েছিল এই যুদ্ধে। এটি ছিল জনযুদ্ধ। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এই যুদ্ধে।

২৫ মার্চের পর থেকে পাল্টে গিয়েছিল দৃশ্যপট। আশাবাদী যাঁরা ১৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ভেবেছেন, ক্ষমতার বরফ গলছে, তাঁরাও বুঝতে পারলেন, দেশ আজ মহা সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। এ রকম অবরুদ্ধ এক জনপদে কীভাবে কাজ করছিল সংবাদপত্র, সে বিষয়েই কিছু কথা বলব।

৩. টিক্কা খান এ সময় সংবাদপত্রের গলায় লাগাম পরানোর চেষ্টা করেন। বিধিনিষেধের মধ্যে ছিল ক. পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনা করা বা করার চেষ্টা, খ. সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনা, গ. জনগণকে বিভ্রান্ত করা বা কোনো প্রকার আতঙ্ক সৃষ্টি করা, ঘ. সশস্ত্র বাহিনী, সরকার, পুলিশ অথবা কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে জনমনে বিদ্রোহের সৃষ্টি করা, ঙ. পাকিস্তান রাষ্ট্র বা কোনো অঞ্চলের বিরুদ্ধে উসকানি বা অসন্তোষ সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া, চ. সরকারের নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া বা কোনো ছাড়পত্র ব্যতীত সব ধরনের রাজনৈতিক খবরাখবর মুদ্রণ নিষিদ্ধ। এইসব আদেশ লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

এই রকম সামরিক নির্দেশের পর কোনো সংবাদপত্রের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা দুরূহ। কিন্তু এরই মধ্যে সাংবাদিকেরা চেষ্টা করেছেন সরকারের সমালোচনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোনো না কোনোভাবে অংশ নিতে। বিশেষ করে সামরিক বিধিনিষেধের মধ্যেই ইত্তেফাক এমন কিছু সংবাদ পরিবেশন করেছে কিংবা এমন কিছু শিরোনাম করেছে, যা থেকে বোঝা যায়, যেমনতেমনভাবে লোক ভুলিয়ে পাকিস্তানি শাসন অব্যাহত রাখা যাবে না।

১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকেই জামায়াতে ইসলামীসহ নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন ঘোষণার দাবি জানায়। এই ধরনের অযৌক্তিক দাবির সমালোচনা করে ইত্তেফাক যে সম্পাদকীয়টি প্রকাশ করে, তার কয়েকটি বাক্য এ রকম:

‘নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাতিল করিয়া দিয়া কোনো কোনো মহল হইতে নূতনভাবে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী উঠিতে দেখি, তখন প্রমাদ না গুনিয়া পারি না। বলাবাহুল্য, এই দাবীকারীদের মধ্যে সেই সব পুরাতন পরিচিত মুখেরই আমরা দেখা পাই, যাহাদের কেহ বা বিগত নির্বাচনে পরাজিত হইয়াছেন, কিংবা নিজ জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সচেতন বলিয়া নির্বাচনের ধারেকাছেও ঘেষেন নাই, অথবা কেহ মাত্র দুই একটি আসন দখলকারী নেতা।...দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন জনগণের আস্থা ও সহযোগিতা অর্জন একান্তই প্রয়োজন, তখন জনগণের আস্থাভাজন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়া সমস্যা সমাধান বা জাতীয় বৃহত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ করা যাইতে পারে, এমনটা আমাদের বিশ্বাস নাই। তাই জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করিয়া দিয়া সমস্যা সমাধানের নিত্যনতুন নোখতা যাহারা বাতলাইতেছেন, তাহাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বাভাবিক কারণেই আমরা কেবল সন্দিহানই নই—উদ্বিগ্নও বটে।’

মতলববাজদের মতলবি রাজনীতির ব্যাপারে এই সতর্ক অথচ বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে পেরেছিল পত্রিকাটি।

আমরা ধারাবাহিকভাবে সে সময়ের অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে যে সাংবাদিকতা করা হয়েছে, তার বিবরণ জানাব পাঠককে। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়’—গানের এই পঙ্‌ক্তিগুলো যে সত্যে ভাস্বর, সেটা কে অস্বীকার করবে? আর অস্বীকার করলেই কি তা ইতিহাস থেকে মুছে যাবে।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত