হাসান মামুন
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
মানুষের মধ্যে অবশ্য রয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষও কম নেই। এদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হচ্ছে খুব, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিতর্ক বেড়ে যাওয়া ইতিবাচক বৈকি।বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টিও ভালো। তবে সব বক্তব্যই হওয়া উচিত তথ্যভিত্তিক। হালে ক্ষমতাচ্যুতদের মধ্য থেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা বেড়েছে। সরকারপক্ষ চেষ্টা করছে তথ্য জুগিয়ে সেটা মোকাবিলা করতে। শাস্তির ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষ দমনের বদলে এটাই ভালো পন্থা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তো ‘অবারিত’ই হওয়ার কথা, যতক্ষণ না সেটা অন্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের একজন খ্যাতিমান সম্পাদক এক সভায় ‘অতীত ও বর্তমান সরকারের দিকে তাকিয়ে’ বললেন, এখন অন্যতম অর্জন হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবে সব রকম খবর নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী প্রকাশ করা যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন বোধ হয় রয়েই গেছে। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে তো কেবল সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতা নয়। ক্ষমতাহীন প্রান্তিক মানুষটিও যেন তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের কালো আইনটি বাতিলের বিষয় প্রক্রিয়াধীন বলে জানানো হয়েছে। এর বদলে এমন কিছু করা হবে, যাতে জনগণের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। আসলে সুরক্ষা দরকার জনগণের আর সরকারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন জবাবদিহি। সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে পাঁচ বছর পরপর নয়; করতে হবে প্রতিদিন। সেটা হতে হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। সংসদ অধিবেশন না থাকলে তার জবাবদিহি চলবে সংসদীয় কমিটিতে। এখন অবশ্য সংসদ অনুপস্থিত।
বিলুপ্ত ঘোষণার আগে ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে আসা এর সিংহভাগ সদস্যই গেছেন পালিয়ে। গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পর এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
যাঁরা এর উপদেষ্টা হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই অবশ্য সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। হয়তো নিজ নিজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে তাঁরা নাম করেছেন। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলেও অদক্ষতার অভিযোগ কিন্তু কম নয়। উদ্যোগ গ্রহণে আন্তরিকতা থাকলেও বাস্তবায়নে তাদের সক্ষমতা কমই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতদের তালিকা করে তাদের ক্ষেত্রে যা যা করা একান্ত জরুরি ছিল, সে ক্ষেত্রে সৃষ্ট অচলাবস্থা। এটা ঘিরেও সম্প্রতি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় রাজধানীর একটি হাসপাতালের সামনে। প্রধান রপ্তানি খাতেও সড়ক অবরোধ ঘটে চলেছে। এর দায় হয়তো প্রধানত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের।
কিন্তু যে নজিরবিহীন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারটি এসেছে, তার বিশেষত আহতদের প্রতি সময়োচিত সুদৃষ্টি দিতে না পারাটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে সরকারকে। সরকার অবশ্য ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে দ্রুত একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে, যার সুন্দর বাস্তবায়ন এখন দেখতে চাইব।
অতীতে আমরা চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছি। এর একটি অবশ্য তিন মাসের মেয়াদ পার করে প্রায় দুই বছর ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায়। এর কোনোটির সঙ্গেও কি ইউনূস সরকারের তুলনা চলে? তুলনা চলে না সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণেই। এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তার আগে একটি স্বেচ্ছাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তিন-তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। এমন একটি ‘রেজিম’ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়লেও নতুন কোনো সরকারের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা সহজ হতো না। সেটি হোক অন্তর্বর্তী কিংবা রাজনৈতিক সরকার। আমরা জানি, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছিল ১৯৯৬ সালে। তার আগে একটি নির্বাচিত সরকারই ছিল ক্ষমতায়। এর আগে ছিল দীর্ঘ সামরিক শাসনামল।
ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠলেই শেখ হাসিনা তখন বলতেন ‘২১ বছরের জঞ্জাল’ পরিষ্কারের কথা। বর্তমান সরকারের ভেতর থেকেও বলা হচ্ছে ‘১৫ বছরের জঞ্জাল’ পরিষ্কারের কথা। হাসিনা সরকারের একটি মেয়াদ অবশ্য ছিল জনগণ দ্বারা অনুমোদিত। ওই সময়েও ‘জঞ্জাল’ তৈরি হয়নি, তা নয়। ওই সময়েই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। এর অপব্যবহার অবশ্য শুরু করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পর ব্যবস্থাটিই বাতিল করে দেওয়া হয় হাসিনার শাসনামলে। আর এটাই খুলে দেয় সর্বনাশের পথ। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হচ্ছে এখন। আদালতেও লড়াই চলছে ব্যবস্থাটি ফিরিয়ে আনার।
আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি না, সেটাই বা কে বলবে! সে ক্ষেত্রে ইউনূস সরকার হয়তো জরুরি সংস্কার সেরেই গ্রহণ করবে বিদায়। সেটা ঘটলেও, তার আগপর্যন্ত দেশটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে তাদের। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, তারা ক্ষমতা নেননি; দায়িত্ব নিয়েছেন। ‘দায়িত্ব’ নিলেও সেটা তো দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে হবে।
কারা তাদের দায়িত্ব দিয়েছে, সেটাও অস্পষ্ট নয়। কত জটিল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটাও স্পষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে ‘প্রত্যাশার চাপ’ কত বেশি থাকে, সেটাও জানা। আছে নানামুখী প্রত্যাশাও। গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশাও অভিন্ন নয়। শক্তিশালী প্রতিটি পক্ষ চাইছে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করুক! এ নিয়ে কম বিতর্কও সৃষ্টি হচ্ছে না। কোনো কোনো বিতর্কের পর সরকারকে ‘সংশোধনমূলক পদক্ষেপ’ নিতেও দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে অহেতুক বিতর্কে না জড়িয়ে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আত্মনিয়োগ করা। সিংহভাগ মানুষ যে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে, সেটা নিয়ে সম্ভবত কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু যারা পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে পারেনি, তাদের জীবনেও স্বস্তি জোগাতে হবে সরকারকে। ১ কোটির মতো মানুষ রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এদের প্রতিও সরকারের কম দায়িত্ব নেই। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ হালে আমরা দেখলাম বিমানবন্দরে ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ চালু হতে। নগরজীবনে গণপরিবহনকে মানসম্মত করার একটি উদ্যোগও রয়েছে। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের মতো জটিল কাজে মনোনিবেশ করা এই মুহূর্তে জরুরি কি না, সেই প্রশ্ন উঠবে। গণ-অভ্যুত্থানকারীদের একাংশের চাপে কিছু ‘নীতিগত কাজে’ও উৎসাহ দেখাচ্ছে সরকার, যা নিয়ে দেশে রয়েছে স্পষ্ট বিভাজন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুর মতো জানতে হলেও অন্তত গণভোটের আয়োজন করতে হবে। এই মুহূর্তে সেই বিধানও কিন্তু নেই। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য বারবারই বলছেন, তাদের মেয়াদ দীর্ঘ হবে না। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই লক্ষ্য।
তবে তার আগে শেষ হতে হবে সংস্কারগুলো। এ লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কমিশন গঠন করেছে সরকার। এত জায়গায় হাত দেওয়া ‘জরুরি’ কি না, সে বিষয়েও রয়েছে বিতর্ক। এই মুহূর্তে মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারসহ এর তালিকা হওয়া উচিত সংক্ষিপ্ত। দেশে তাদের সমর্থক বেশি বলে ধরে নিলে বলতে হয়, এটাই হয়তো অধিকাংশ মানুষের মত। তবে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের মত ভিন্ন। উপদেষ্টা পরিষদের বাইরে থেকেও সরকারের ওপর তাদের প্রভাব বেশি বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনও যে ঘটছে না, তা নয়। রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি থেকে তাদের সরে আসার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মতামতের একধরনের প্রতিফলন ঘটছে হয়তো।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে মাঠে থাকা সেনাবাহিনীকে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সম্প্রতি। তার মানে, পুলিশ এখনো সক্রিয় হয়নি। সরকার ১০০ দিনেও তাদের সক্রিয় করতে পারেনি, এটা কারও নজর এড়াচ্ছে না। এর যত কারণই থাকুক—দ্রুত এ ক্ষেত্রে উন্নতি আনতে হবে। রাষ্ট্রে যার যা দায়িত্ব, সেটি পালনে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক অপরাধও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মূলত পুলিশ সক্রিয় না থাকায়।
খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডাকাতি ও খুন বেড়েছে। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও এটা কোনো যুক্তি নয় যে, পরিস্থিতির তো আরও অবনতি ঘটতে পারত! মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি দ্রুত ভালো হওয়ার নয়, এটা সাধারণ মানুষ না বুঝলেও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বোঝেন। কিন্তু তারও বোধকরি সন্তুষ্ট নন নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। আলুর দাম মানসম্মত চালের দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থায় পাকিস্তান থেকে আমদানি বাড়বে কি না—এমন বিতর্কের কম গুরুত্ব রয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। আমদানির পাশাপাশি দেশে খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি না এলে খোদ সরকারের মধ্যেই শিথিল হয়ে আসবে সংস্কার বিষয়ে আগ্রহ। কিন্তু ‘জরুরি সংস্কার’ না হলে চলবে না, এটাও বাস্তবতা।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
মানুষের মধ্যে অবশ্য রয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষও কম নেই। এদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হচ্ছে খুব, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিতর্ক বেড়ে যাওয়া ইতিবাচক বৈকি।বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টিও ভালো। তবে সব বক্তব্যই হওয়া উচিত তথ্যভিত্তিক। হালে ক্ষমতাচ্যুতদের মধ্য থেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা বেড়েছে। সরকারপক্ষ চেষ্টা করছে তথ্য জুগিয়ে সেটা মোকাবিলা করতে। শাস্তির ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষ দমনের বদলে এটাই ভালো পন্থা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তো ‘অবারিত’ই হওয়ার কথা, যতক্ষণ না সেটা অন্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের একজন খ্যাতিমান সম্পাদক এক সভায় ‘অতীত ও বর্তমান সরকারের দিকে তাকিয়ে’ বললেন, এখন অন্যতম অর্জন হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবে সব রকম খবর নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী প্রকাশ করা যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন বোধ হয় রয়েই গেছে। আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে তো কেবল সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতা নয়। ক্ষমতাহীন প্রান্তিক মানুষটিও যেন তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের কালো আইনটি বাতিলের বিষয় প্রক্রিয়াধীন বলে জানানো হয়েছে। এর বদলে এমন কিছু করা হবে, যাতে জনগণের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। আসলে সুরক্ষা দরকার জনগণের আর সরকারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন জবাবদিহি। সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে পাঁচ বছর পরপর নয়; করতে হবে প্রতিদিন। সেটা হতে হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। সংসদ অধিবেশন না থাকলে তার জবাবদিহি চলবে সংসদীয় কমিটিতে। এখন অবশ্য সংসদ অনুপস্থিত।
বিলুপ্ত ঘোষণার আগে ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে আসা এর সিংহভাগ সদস্যই গেছেন পালিয়ে। গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পর এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
যাঁরা এর উপদেষ্টা হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই অবশ্য সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। হয়তো নিজ নিজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে তাঁরা নাম করেছেন। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলেও অদক্ষতার অভিযোগ কিন্তু কম নয়। উদ্যোগ গ্রহণে আন্তরিকতা থাকলেও বাস্তবায়নে তাদের সক্ষমতা কমই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতদের তালিকা করে তাদের ক্ষেত্রে যা যা করা একান্ত জরুরি ছিল, সে ক্ষেত্রে সৃষ্ট অচলাবস্থা। এটা ঘিরেও সম্প্রতি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় রাজধানীর একটি হাসপাতালের সামনে। প্রধান রপ্তানি খাতেও সড়ক অবরোধ ঘটে চলেছে। এর দায় হয়তো প্রধানত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের।
কিন্তু যে নজিরবিহীন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারটি এসেছে, তার বিশেষত আহতদের প্রতি সময়োচিত সুদৃষ্টি দিতে না পারাটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে সরকারকে। সরকার অবশ্য ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে দ্রুত একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে, যার সুন্দর বাস্তবায়ন এখন দেখতে চাইব।
অতীতে আমরা চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছি। এর একটি অবশ্য তিন মাসের মেয়াদ পার করে প্রায় দুই বছর ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায়। এর কোনোটির সঙ্গেও কি ইউনূস সরকারের তুলনা চলে? তুলনা চলে না সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণেই। এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তার আগে একটি স্বেচ্ছাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তিন-তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। এমন একটি ‘রেজিম’ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়লেও নতুন কোনো সরকারের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা সহজ হতো না। সেটি হোক অন্তর্বর্তী কিংবা রাজনৈতিক সরকার। আমরা জানি, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছিল ১৯৯৬ সালে। তার আগে একটি নির্বাচিত সরকারই ছিল ক্ষমতায়। এর আগে ছিল দীর্ঘ সামরিক শাসনামল।
ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠলেই শেখ হাসিনা তখন বলতেন ‘২১ বছরের জঞ্জাল’ পরিষ্কারের কথা। বর্তমান সরকারের ভেতর থেকেও বলা হচ্ছে ‘১৫ বছরের জঞ্জাল’ পরিষ্কারের কথা। হাসিনা সরকারের একটি মেয়াদ অবশ্য ছিল জনগণ দ্বারা অনুমোদিত। ওই সময়েও ‘জঞ্জাল’ তৈরি হয়নি, তা নয়। ওই সময়েই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। এর অপব্যবহার অবশ্য শুরু করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পর ব্যবস্থাটিই বাতিল করে দেওয়া হয় হাসিনার শাসনামলে। আর এটাই খুলে দেয় সর্বনাশের পথ। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হচ্ছে এখন। আদালতেও লড়াই চলছে ব্যবস্থাটি ফিরিয়ে আনার।
আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি না, সেটাই বা কে বলবে! সে ক্ষেত্রে ইউনূস সরকার হয়তো জরুরি সংস্কার সেরেই গ্রহণ করবে বিদায়। সেটা ঘটলেও, তার আগপর্যন্ত দেশটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে তাদের। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, তারা ক্ষমতা নেননি; দায়িত্ব নিয়েছেন। ‘দায়িত্ব’ নিলেও সেটা তো দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে হবে।
কারা তাদের দায়িত্ব দিয়েছে, সেটাও অস্পষ্ট নয়। কত জটিল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটাও স্পষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে ‘প্রত্যাশার চাপ’ কত বেশি থাকে, সেটাও জানা। আছে নানামুখী প্রত্যাশাও। গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশাও অভিন্ন নয়। শক্তিশালী প্রতিটি পক্ষ চাইছে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করুক! এ নিয়ে কম বিতর্কও সৃষ্টি হচ্ছে না। কোনো কোনো বিতর্কের পর সরকারকে ‘সংশোধনমূলক পদক্ষেপ’ নিতেও দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে অহেতুক বিতর্কে না জড়িয়ে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আত্মনিয়োগ করা। সিংহভাগ মানুষ যে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে, সেটা নিয়ে সম্ভবত কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু যারা পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে পারেনি, তাদের জীবনেও স্বস্তি জোগাতে হবে সরকারকে। ১ কোটির মতো মানুষ রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এদের প্রতিও সরকারের কম দায়িত্ব নেই। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ হালে আমরা দেখলাম বিমানবন্দরে ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’ চালু হতে। নগরজীবনে গণপরিবহনকে মানসম্মত করার একটি উদ্যোগও রয়েছে। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের মতো জটিল কাজে মনোনিবেশ করা এই মুহূর্তে জরুরি কি না, সেই প্রশ্ন উঠবে। গণ-অভ্যুত্থানকারীদের একাংশের চাপে কিছু ‘নীতিগত কাজে’ও উৎসাহ দেখাচ্ছে সরকার, যা নিয়ে দেশে রয়েছে স্পষ্ট বিভাজন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুর মতো জানতে হলেও অন্তত গণভোটের আয়োজন করতে হবে। এই মুহূর্তে সেই বিধানও কিন্তু নেই। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য বারবারই বলছেন, তাদের মেয়াদ দীর্ঘ হবে না। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই লক্ষ্য।
তবে তার আগে শেষ হতে হবে সংস্কারগুলো। এ লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কমিশন গঠন করেছে সরকার। এত জায়গায় হাত দেওয়া ‘জরুরি’ কি না, সে বিষয়েও রয়েছে বিতর্ক। এই মুহূর্তে মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারসহ এর তালিকা হওয়া উচিত সংক্ষিপ্ত। দেশে তাদের সমর্থক বেশি বলে ধরে নিলে বলতে হয়, এটাই হয়তো অধিকাংশ মানুষের মত। তবে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের মত ভিন্ন। উপদেষ্টা পরিষদের বাইরে থেকেও সরকারের ওপর তাদের প্রভাব বেশি বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনও যে ঘটছে না, তা নয়। রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি থেকে তাদের সরে আসার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মতামতের একধরনের প্রতিফলন ঘটছে হয়তো।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে মাঠে থাকা সেনাবাহিনীকে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সম্প্রতি। তার মানে, পুলিশ এখনো সক্রিয় হয়নি। সরকার ১০০ দিনেও তাদের সক্রিয় করতে পারেনি, এটা কারও নজর এড়াচ্ছে না। এর যত কারণই থাকুক—দ্রুত এ ক্ষেত্রে উন্নতি আনতে হবে। রাষ্ট্রে যার যা দায়িত্ব, সেটি পালনে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক অপরাধও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মূলত পুলিশ সক্রিয় না থাকায়।
খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডাকাতি ও খুন বেড়েছে। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও এটা কোনো যুক্তি নয় যে, পরিস্থিতির তো আরও অবনতি ঘটতে পারত! মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি দ্রুত ভালো হওয়ার নয়, এটা সাধারণ মানুষ না বুঝলেও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বোঝেন। কিন্তু তারও বোধকরি সন্তুষ্ট নন নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। আলুর দাম মানসম্মত চালের দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থায় পাকিস্তান থেকে আমদানি বাড়বে কি না—এমন বিতর্কের কম গুরুত্ব রয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। আমদানির পাশাপাশি দেশে খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি না এলে খোদ সরকারের মধ্যেই শিথিল হয়ে আসবে সংস্কার বিষয়ে আগ্রহ। কিন্তু ‘জরুরি সংস্কার’ না হলে চলবে না, এটাও বাস্তবতা।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৪ ঘণ্টা আগেআমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১ দিন আগে