চালশে

রাজীব কুমার সাহা
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭: ৪০
Thumbnail image
রাজীব কুমার সাহা

বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে অতিপরিচিত একটি শব্দ হলো চালশে। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা প্রায় সবাই শব্দটি প্রয়োগ করতে শুনেছি। কিন্তু এই চালশে আসলে কী? এটি কি কোনো রোগ? চল্লিশ বছর বয়সের সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে? অথবা চালের সঙ্গে কি এর কোনো সম্বন্ধ রয়েছে? এটি কি কেবল বুড়ো বয়সেই হয়ে থাকে? চালশে শব্দকে ঘিরে এতসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রবেশ করতে হবে এর ব্যুৎপত্তির অন্দরমহলে। তবে চলুন আজ জানব চালশের আদ্যোপান্ত।

‘চালশে’ শব্দটি সংস্কৃত চল্লিশ শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এটি বিশেষ্য পদ। আভিধানিকভাবে চালশে শব্দের অর্থ হলো (চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে) দৃষ্টিশক্তির স্বাভাবিক ক্ষীণতা। চালশে শব্দটির মতো বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন আরও কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় রয়েছে। বয়স সাতাত্তর বছরের সাত মাসের সপ্তম রাত্রির নাম হলো ভীমরতি। ধারণা করা হয়, এ রাতের পর মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসে। সাধারণত এই বয়সে অধিকাংশ মানুষ একদিকে যেমন শিশুর মতো অবোধ, অপরদিকে কাণ্ডজ্ঞানহীন যুবকের মতো নির্বোধ আচরণ শুরু করেন। বয়স চল্লিশ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোখের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা সচরাচর চশমা পরতে শুরু করি। দৃষ্টিশক্তির এ অবস্থাটিকেই বলা হয় চালশে। অপরদিকে বয়স সত্তর পার হওয়ার পর থেকেই কারও কারও স্মৃতিভ্রংশতা এবং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। এ অবস্থায় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বার্ধক্যহেতু দৈহিক শক্তি ও বুদ্ধি লোপ পায়। শারীরিক এ অবস্থাকে বলা হয় বাহাত্তুরে। বাহাত্তুরে পাওয়ার পরের ধাপ হলো ভীমরতিগ্রস্ত হওয়া, কেননা বয়স বিবেচনায় প্রথমটি বাহাত্তুর আর দ্বিতীয়টি সাতাত্তর। বয়সের তারতম্য হেতু উপরিউক্ত সবগুলো অবস্থাই যে বিপজ্জনক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ইঙ্গিত প্রদান করে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

চালশে হলো বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা চল্লিশ বছর বয়স্ক ব্যক্তিমাত্রই কমবেশি আক্রান্ত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় চালশেকে বলা হয় প্রেসবায়োপিয়া। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, এটি কোনো অসুখ নয় আবার এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্যও নয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে অ্যারিস্টটলের রচনায় চালশের উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে চশমার লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। চল্লিশে চালশে কথাটা প্রচলিত হলেও, অনেক সময় দেখা যায় চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বেও অনেকে চালশেতে আক্রান্ত হয়। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত। আমরা জানি, চল্লিশ বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের স্বাভাবিক দর্শনের নিকটবিন্দু ২৫-৩৫ সেন্টিমিটার। স্বাভাবিক বয়োবৃদ্ধির কারণে এ নিকটবিন্দু দূরে সরে গিয়ে ক্রমান্বয়ে এই দৃষ্টিত্রুটির জন্ম হয়। এর ফলে আমাদের কাছের বস্তু দেখতে অসুবিধা হয়।

যেকোনো দূরের বস্তুকে দেখার সময় আমাদের চোখ তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফোকাস করতে পারলেও কাছের বস্তুকে ফোকাস করতে অ্যাকোমোডেশন বা অতিরিক্ত পাওয়ারের প্রয়োজন হয়। জন্মের পরপর শিশুর চোখে অ্যাকোমোডেটিভ পাওয়ার রিজার্ভ থাকে প্রায় চৌদ্দ ডাইঅপ্টারের মতো। ডাইঅপ্টার হলো লেন্স বা চোখের রিফ্রেক্টিভ পাওয়ারের একক। চোখে বিদ্যমান প্রাকৃতিক লেন্স এই অ্যাকোমোডেশনের কাজটি সহজেই সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাকোমোডেটিভ বা রিজার্ভ পাওয়ার হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়স চল্লিশের কোঠায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে এটা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এতে তখন কাছের বস্তুকে ফোকাস করতে অসুবিধা হয় অর্থাৎ কাছের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এটিই হলো চালশে। তখন কাছের বস্তুকে ভালোভাবে দেখতে বা ফোকাস করতে অতিরিক্ত প্লাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হয়। চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বেও চালশে হতে পারে। এ অবস্থাকে আর্লি প্রেসবায়োপিয়া বলা হয়। মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আমাদের চোখের শুষ্কতা বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে আমরা বলি ‘ড্রাই আইজ’। এ অবস্থা থেকেই ক্রমান্বয়ে আমরা চালশে এবং গ্লুকোমার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। সুতরাং এ বিষয়ে এখন থেকেই সচেতনতা জরুরি।

পরিশেষে বলা যায়, কাজল লাগিয়ে চোখের শ্রীবৃদ্ধি করা গেলেও চোখের নজর কমে গেলে, কাজলে দৃষ্টিবিভ্রম দূরীভূত হয় না। সুতরাং চোখের যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে বা বয়স চল্লিশের বেশি হলে অবশ্যই চালশের কথা ভাবতে হবে এবং সময়মতো চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: রাজীব কুমার সাহা

আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপাচার্যের সঙ্গে ‘বাগ্‌বিতণ্ডা,’ ঢাবি ছাত্রদলের ৪ নেতাকে শোকজ

এবার কোহলির আউট নিয়ে বিতর্ক, এখানেও বাংলাদেশি আম্পায়ার

৬ জানুয়ারি ফরিদপুরে সমাবেশ করবেন সারজিস-হাসনাত

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই এবার আফগানের রেকর্ড ভাঙলেন আফগান ক্রিকেটার

ফরিদপুরে আজকের পত্রিকার সাংবাদিক সৌগত বসুর বাড়িতে হামলা, বাবা-মাকে কুপিয়ে জখম

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত