আনোয়ারুল হক
বিরোধী দলবিহীন দুটি ভোট ও একটি নৈশ ভোটের ‘বিশাল জয়ে’ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে শেখ হাসিনা দিব্যি কর্তৃত্ববাদী পন্থায় এবং এক ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন। আর পারিষদবর্গ ছিলেন স্তুতিতে মুখর। একদিকে তাঁদের ছিল জেদ ও দম্ভ, অন্যদিকে বিত্তশালী হয়ে ওঠার আলাদিনের চেরাগ। মানুষের মধ্যেও ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘উন্নয়নের’ চরম শিখরে পৌঁছার স্বার্থে এটাই বোধ হয় ভবিতব্য। বিরোধী রাজনৈতিক দল ডান, বাম বা মধ্যপন্থার অনুসারী কেউই মাঝেমধ্যে মাঠ গরম করা ছাড়া উন্মত্ত ক্ষমতাকে জুতসই পন্থায় চ্যালেঞ্জ করতে পারছিল না। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সংকট রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামোকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের আগে-পরে ছাত্রনেতাদের কথায় এবং ড. ইউনূসের কথায় মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর স্বপ্ন তো সিনেমার মতো নয় যে সামনের পর্দাটা সরে গেলেই সিনেমা শুরু হয়ে গেল। আসলে মনোজগতে সৃষ্ট আবেগ থেকেই স্বপ্নের সৃষ্টি হয়। এবারের আন্দোলনে তারুণ্যের জাগরণ মানুষের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সেই আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আন্দোলন বিজয়ী হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দুর্বল হবে আর সমতা শক্তিশালী হবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে, দেশে আবার ভোট হবে এবং পছন্দমতো প্রার্থী বা মার্কায় ভোট দেওয়া যাবে। বহুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন পথযাত্রায় দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ হবে। মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুবিচার নিশ্চিত হবে। নারী-পুরুষ, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে সম-অধিকার ভোগ করবে। বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। আশা জেগেছিল দেশ ইনসাফের পথে অগ্রসর হবে।
গণ-অভ্যুত্থানের ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ধীরগতির কাজে মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের ভেতর হতাশা দানা বাঁধছে। যে রিকশাওয়ালা রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে সেদিন ছাত্রদের মিছিলকে স্যালুট দিয়েছিলেন বা যে দিনমজুর তাঁর দৈনিক কাজ বাদ দিয়ে ছাত্রদের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন, দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে আজ তাঁদের মুখের সুরটা কিছুটা ভিন্ন। পোশাকশিল্পে ন্যায্য পারিশ্রমিক আর বকেয়া পারিশ্রমিকের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তো লেগেই আছে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, পতিত সরকার যেমন বিক্ষোভ দেখলেই বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেত, ঠিক তেমনি অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন ছাত্রনেতারা সবকিছুর মধ্যেই ‘আওয়ামী ষড়যন্ত্র’ খোঁজার চেষ্টা করেন। অবশ্য জুলাই অভ্যুত্থানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্ররাও তাঁদের প্রতি চিকিৎসায় অবহেলা এবং সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোনো খোঁজখবর না রাখার প্রতিবাদে এবং সুচিকিৎসার দাবিতে হাসপাতালের বিছানা থেকে যখন রাস্তায় নেমে এলেন, তখন নিশ্চয়ই ছাত্রনেতারা ও উপদেষ্টারা বুঝেছেন সবকিছুই পতিত শক্তির ষড়যন্ত্র নয়। সরকারে থাকলে ‘গরমে উলের টুপি পরা বুদ্ধিজীবীর’ মতো সারাক্ষণ ‘ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ’ যপ করে পার পাওয়া যায় না। গণ-অভ্যুত্থান যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা বাস্তবায়নে সরকার কী করছে এবং কতটা দ্রুততার সঙ্গে করছে, দেশবাসী আগ্রহভরে তার প্রতি লক্ষ রাখছে।
দেশবাসী সবচেয়ে বেশি হতাশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। হাট-বাজার, দোকানপাট, হকারদের কেন্দ্র, ডিস ও ইন্টারনেট লাইন সরবরাহ, গণপরিবহনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষেত্রেই আগের মতোই নতুন মুখের দখলদারত্ব ও চাঁদাবাজি চলছে। ইদানীং চুরি-ডাকাতিও বেড়েছে। ঢালাও খুনের মামলা নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্য তো সর্বজনবিদিত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সরকারের উপদেষ্টা বা সচিব পদে নিয়োগের জন্য খুনের মামলাবিহীন লোক পাওয়া যাচ্ছে না! অথচ দেশবাসী চায় শিশু, কিশোর, ছাত্র গণহত্যার কুশীলবদের বিচার হোক। কিন্তু পাইকারি হারে ৩০০-৪০০ জনের নামে একেকটি খুনের মামলা হচ্ছে, বাদী বলছেন আসামি কাদের করা হয়েছে না জেনেই তিনি অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছেন। যতই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল হোক না কেন, এসব করে গণহত্যার মতো অপরাধকে হালকা করে ফেলা হচ্ছে। অথচ এ বেপরোয়া মামলা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে গণতন্ত্রে উত্তরণে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা না থাকায় এবং এ বিষয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রনেতাদের বক্তব্য রাজনীতিতে ধীরে ধীরে সংশয় ও উত্তাপ সৃষ্টি করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে শুধু বলেছেন নির্বাচনী ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু কবে তা স্টেশনে পৌঁছাবে, তা তিনি বলতে পারছেন না। এটা সুস্পষ্ট যে বিজয়ী ছাত্র-তরুণ নেতারা সবখানেই প্রতিনিধিত্ব চান। ড. ইউনূসের সরকার সম্ভবমতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা নিশ্চিতই করেছেন। ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রিত্ব করতে হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। সেটাও তাঁরা জানেন।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরাজিত হলেও এবং হত্যাযজ্ঞের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে তাদের রাজনীতির মাঠে নামার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লেও আওয়ামী রাজনীতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থকদের মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা নেই। নিজেরা বিশ্বাস না করলেও বাইরে সবার মুখে এক কথা—সেই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’! অথচ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পডুয়া সন্তানেরা পরিবারের সম্মতিতেই কোটা সংস্কারের আন্দোলনে শামিল ছিলেন। তারপরেও এই হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের বিচারের দাবি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই না ওঠায় দলের জনবিচ্ছিন্নতা আরও বেড়েছে। তারপরেও সারা দেশে গ্রামপর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংগঠন এবং অসংখ্য কর্মী-সমর্থকেরা রয়েছেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত আন্দোলনে বিএনপি সারা দেশে সুসংগঠিত হয়। ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের পরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দখলদারত্ব, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্যসহ নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ায় তাঁদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সারা দেশে বিএনপির জনসমর্থন ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালী অবস্থায় আছে।
এক মাসের ছাত্র-গণ-আন্দোলনের প্রভাবে বা ছয় মাস-এক বছর ক্ষমতায় থেকেও দ্বিদলীয় রাজনীতির যে ধারা আমাদের সমাজে শিকড় গেড়ে বসেছিল, তা থেকে সমাজকে মুক্ত করা সহজ হবে না। এটা নতুন ছাত্র বা তরুণ নেতারা বোঝেন। তাই তাঁরা চান তরুণ নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দল নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও বিজয়ের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সময় নিতে। কিন্তু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আনুকূল্যে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা ছাড়া সব দলই সরকারকে সমর্থন করছে এবং একই সঙ্গে প্রায় সব দলই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে, যা উপেক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুরও দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। কিন্তু ছাত্রনেতারা এটা মানতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাই তাঁরাই এখন নানা ইস্যু সামনে আনছেন—যা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সব থেকে বড় ও রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এবারের সংগ্রামের মূল কথাই তো ছিল বৈষম্যবিরোধিতা এবং এমন ব্যবস্থা, যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, প্রত্যেকেই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুতি হয়েছে, তা পুনঃস্থাপিত হবে সমাজে, রাষ্ট্রে এবং সংবিধানে। গড়ে তোলা হবে সম্ভবমতো এক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা নির্মাণে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হতে পারে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে গঠিত জাতীয় সংসদ। তাহলে এবারের আন্দোলনে বিজয়ী তারুণ্যের শক্তিসহ কম-বেশি সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, ‘উইনারস টেক অল’ ব্যবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়বে। তারুণ্যের শক্তিসহ রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিসমূহের অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত হবে, যা শুধু নির্বাচনে নয়, সবখানেই তরুণদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করবে।
এবারের অভ্যুত্থানে যে দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, হাজারে হাজারে আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাতে ছাত্র, শ্রমিক, পথচারী, নারী, শিশু—কোন শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই? সমন্বয়কেরা ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাম প্রগতিশীল সংগঠনের বা চিন্তাধারার ছাত্র কর্মীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আন্দোলন বেগবান করতে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তাই আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে সবার প্রতিনিধিত্বশীল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় এবং পরে দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়, সেখানে বৈষম্যহীন এক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন আঁকে আমাদের নতুন প্রজন্ম। এ স্বপ্ন দেখতে তো ভুল নেই! অন্তর্বর্তী সরকার এ স্বপ্ন পূরণের পথে কী ভূমিকা রেখে গণতন্ত্রে উত্তরণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন
করে, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে স্বপ্ন দেখার সার্থকতা।
লেখক: সাবেক সভাপতি ছাত্র ইউনিয়ন
বিরোধী দলবিহীন দুটি ভোট ও একটি নৈশ ভোটের ‘বিশাল জয়ে’ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে শেখ হাসিনা দিব্যি কর্তৃত্ববাদী পন্থায় এবং এক ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন। আর পারিষদবর্গ ছিলেন স্তুতিতে মুখর। একদিকে তাঁদের ছিল জেদ ও দম্ভ, অন্যদিকে বিত্তশালী হয়ে ওঠার আলাদিনের চেরাগ। মানুষের মধ্যেও ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘উন্নয়নের’ চরম শিখরে পৌঁছার স্বার্থে এটাই বোধ হয় ভবিতব্য। বিরোধী রাজনৈতিক দল ডান, বাম বা মধ্যপন্থার অনুসারী কেউই মাঝেমধ্যে মাঠ গরম করা ছাড়া উন্মত্ত ক্ষমতাকে জুতসই পন্থায় চ্যালেঞ্জ করতে পারছিল না। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সংকট রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামোকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের আগে-পরে ছাত্রনেতাদের কথায় এবং ড. ইউনূসের কথায় মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর স্বপ্ন তো সিনেমার মতো নয় যে সামনের পর্দাটা সরে গেলেই সিনেমা শুরু হয়ে গেল। আসলে মনোজগতে সৃষ্ট আবেগ থেকেই স্বপ্নের সৃষ্টি হয়। এবারের আন্দোলনে তারুণ্যের জাগরণ মানুষের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সেই আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আন্দোলন বিজয়ী হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দুর্বল হবে আর সমতা শক্তিশালী হবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে, দেশে আবার ভোট হবে এবং পছন্দমতো প্রার্থী বা মার্কায় ভোট দেওয়া যাবে। বহুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন পথযাত্রায় দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ হবে। মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুবিচার নিশ্চিত হবে। নারী-পুরুষ, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে সম-অধিকার ভোগ করবে। বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। আশা জেগেছিল দেশ ইনসাফের পথে অগ্রসর হবে।
গণ-অভ্যুত্থানের ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ধীরগতির কাজে মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের ভেতর হতাশা দানা বাঁধছে। যে রিকশাওয়ালা রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে সেদিন ছাত্রদের মিছিলকে স্যালুট দিয়েছিলেন বা যে দিনমজুর তাঁর দৈনিক কাজ বাদ দিয়ে ছাত্রদের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন, দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে আজ তাঁদের মুখের সুরটা কিছুটা ভিন্ন। পোশাকশিল্পে ন্যায্য পারিশ্রমিক আর বকেয়া পারিশ্রমিকের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তো লেগেই আছে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, পতিত সরকার যেমন বিক্ষোভ দেখলেই বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেত, ঠিক তেমনি অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন ছাত্রনেতারা সবকিছুর মধ্যেই ‘আওয়ামী ষড়যন্ত্র’ খোঁজার চেষ্টা করেন। অবশ্য জুলাই অভ্যুত্থানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্ররাও তাঁদের প্রতি চিকিৎসায় অবহেলা এবং সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোনো খোঁজখবর না রাখার প্রতিবাদে এবং সুচিকিৎসার দাবিতে হাসপাতালের বিছানা থেকে যখন রাস্তায় নেমে এলেন, তখন নিশ্চয়ই ছাত্রনেতারা ও উপদেষ্টারা বুঝেছেন সবকিছুই পতিত শক্তির ষড়যন্ত্র নয়। সরকারে থাকলে ‘গরমে উলের টুপি পরা বুদ্ধিজীবীর’ মতো সারাক্ষণ ‘ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ’ যপ করে পার পাওয়া যায় না। গণ-অভ্যুত্থান যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা বাস্তবায়নে সরকার কী করছে এবং কতটা দ্রুততার সঙ্গে করছে, দেশবাসী আগ্রহভরে তার প্রতি লক্ষ রাখছে।
দেশবাসী সবচেয়ে বেশি হতাশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। হাট-বাজার, দোকানপাট, হকারদের কেন্দ্র, ডিস ও ইন্টারনেট লাইন সরবরাহ, গণপরিবহনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষেত্রেই আগের মতোই নতুন মুখের দখলদারত্ব ও চাঁদাবাজি চলছে। ইদানীং চুরি-ডাকাতিও বেড়েছে। ঢালাও খুনের মামলা নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্য তো সর্বজনবিদিত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সরকারের উপদেষ্টা বা সচিব পদে নিয়োগের জন্য খুনের মামলাবিহীন লোক পাওয়া যাচ্ছে না! অথচ দেশবাসী চায় শিশু, কিশোর, ছাত্র গণহত্যার কুশীলবদের বিচার হোক। কিন্তু পাইকারি হারে ৩০০-৪০০ জনের নামে একেকটি খুনের মামলা হচ্ছে, বাদী বলছেন আসামি কাদের করা হয়েছে না জেনেই তিনি অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছেন। যতই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল হোক না কেন, এসব করে গণহত্যার মতো অপরাধকে হালকা করে ফেলা হচ্ছে। অথচ এ বেপরোয়া মামলা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে গণতন্ত্রে উত্তরণে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা না থাকায় এবং এ বিষয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রনেতাদের বক্তব্য রাজনীতিতে ধীরে ধীরে সংশয় ও উত্তাপ সৃষ্টি করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে শুধু বলেছেন নির্বাচনী ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু কবে তা স্টেশনে পৌঁছাবে, তা তিনি বলতে পারছেন না। এটা সুস্পষ্ট যে বিজয়ী ছাত্র-তরুণ নেতারা সবখানেই প্রতিনিধিত্ব চান। ড. ইউনূসের সরকার সম্ভবমতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা নিশ্চিতই করেছেন। ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রিত্ব করতে হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। সেটাও তাঁরা জানেন।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরাজিত হলেও এবং হত্যাযজ্ঞের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে তাদের রাজনীতির মাঠে নামার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লেও আওয়ামী রাজনীতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থকদের মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা নেই। নিজেরা বিশ্বাস না করলেও বাইরে সবার মুখে এক কথা—সেই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’! অথচ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পডুয়া সন্তানেরা পরিবারের সম্মতিতেই কোটা সংস্কারের আন্দোলনে শামিল ছিলেন। তারপরেও এই হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের বিচারের দাবি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই না ওঠায় দলের জনবিচ্ছিন্নতা আরও বেড়েছে। তারপরেও সারা দেশে গ্রামপর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংগঠন এবং অসংখ্য কর্মী-সমর্থকেরা রয়েছেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত আন্দোলনে বিএনপি সারা দেশে সুসংগঠিত হয়। ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের পরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দখলদারত্ব, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্যসহ নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ায় তাঁদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সারা দেশে বিএনপির জনসমর্থন ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালী অবস্থায় আছে।
এক মাসের ছাত্র-গণ-আন্দোলনের প্রভাবে বা ছয় মাস-এক বছর ক্ষমতায় থেকেও দ্বিদলীয় রাজনীতির যে ধারা আমাদের সমাজে শিকড় গেড়ে বসেছিল, তা থেকে সমাজকে মুক্ত করা সহজ হবে না। এটা নতুন ছাত্র বা তরুণ নেতারা বোঝেন। তাই তাঁরা চান তরুণ নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দল নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও বিজয়ের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সময় নিতে। কিন্তু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আনুকূল্যে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা ছাড়া সব দলই সরকারকে সমর্থন করছে এবং একই সঙ্গে প্রায় সব দলই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে, যা উপেক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুরও দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। কিন্তু ছাত্রনেতারা এটা মানতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাই তাঁরাই এখন নানা ইস্যু সামনে আনছেন—যা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সব থেকে বড় ও রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এবারের সংগ্রামের মূল কথাই তো ছিল বৈষম্যবিরোধিতা এবং এমন ব্যবস্থা, যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, প্রত্যেকেই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুতি হয়েছে, তা পুনঃস্থাপিত হবে সমাজে, রাষ্ট্রে এবং সংবিধানে। গড়ে তোলা হবে সম্ভবমতো এক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা নির্মাণে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হতে পারে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে গঠিত জাতীয় সংসদ। তাহলে এবারের আন্দোলনে বিজয়ী তারুণ্যের শক্তিসহ কম-বেশি সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, ‘উইনারস টেক অল’ ব্যবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়বে। তারুণ্যের শক্তিসহ রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিসমূহের অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত হবে, যা শুধু নির্বাচনে নয়, সবখানেই তরুণদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করবে।
এবারের অভ্যুত্থানে যে দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, হাজারে হাজারে আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাতে ছাত্র, শ্রমিক, পথচারী, নারী, শিশু—কোন শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই? সমন্বয়কেরা ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাম প্রগতিশীল সংগঠনের বা চিন্তাধারার ছাত্র কর্মীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আন্দোলন বেগবান করতে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তাই আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে সবার প্রতিনিধিত্বশীল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় এবং পরে দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়, সেখানে বৈষম্যহীন এক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন আঁকে আমাদের নতুন প্রজন্ম। এ স্বপ্ন দেখতে তো ভুল নেই! অন্তর্বর্তী সরকার এ স্বপ্ন পূরণের পথে কী ভূমিকা রেখে গণতন্ত্রে উত্তরণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন
করে, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে স্বপ্ন দেখার সার্থকতা।
লেখক: সাবেক সভাপতি ছাত্র ইউনিয়ন
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন থেকেই বিভিন্ন মহল সরকারের কাছে নানা দাবিদাওয়া উত্থাপন করে আসছে। এসব দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ রাষ্ট্রীয় দপ্তর, রাজপথ ইত্যাদি ঘেরাওয়ের একটি প্রবণতাও বেশ জোরেশোরেই লক্ষ করা যাচ্ছে
২ ঘণ্টা আগেওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এক সংগীত আবহে বড় হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারের সদস্য তিনি। সেই ধারা তাঁরা এখনো বজায় রেখে চলছেন। তাঁর বাবা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান...
৩ ঘণ্টা আগেছোট একটি প্রচারপত্র। তাতে খানিকটা বড় করে লেখা—লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার করব, বিনা সুদে পুঁজি নেব। অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন এই দাবিতে জনসমাবেশের আহ্বান জানায়। সোমবার সকাল ১০টায় রাজধানীর শাহবাগে উপস্থিত থাকতে বলা হলেও রোববার দিবাগত রাত থেকেই বিভিন্ন...
৩ ঘণ্টা আগেপাকিস্তানের জাতির পিতা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আমরা তাঁকে ভুলে যেতে চাইব। কেননা মৃতের সঙ্গে ঝগড়া নেই। জুলিয়াস সিজার প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের মার্ক অ্যান্টর্নি যে বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায়, মৃতের ভালো কাজগুলো প্রায় সবই কবরে মিশে যায়, খারাপ কাজগুলোই বেঁচে থাকে, সেই কথা ঘুরিয়ে দিয়ে আমরা...
১ দিন আগে