চিররঞ্জন সরকার
‘তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা’ কত শত সাকিনা, হরিদাসীর কপাল ভাঙল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অবশেষে স্বাধীনতা মিলল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়েছিল প্রায় সোয়া দুই শ বছর আগে। তারপর ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-জুলুম-নির্যাতন।
সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। জন্ম হয়েছিল এমন এক রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লড়াকু মানুষ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা।
১৯৭১ থেকে ২০২৪। আমাদের স্বাধীনতার ৫৩ বছর। ৫৩ বছর আগে আমরা পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-জুলুম-নির্যাতনের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এ স্বাধীনতা নিছক ঘরে বসে পাওয়া যায়নি। পেতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াই করে। হারাতে হয়েছে বাংলা মায়ের অনেক বীর সন্তানকে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লেগে রয়েছে লাখো মানুষের ত্যাগ, সংগ্রাম ও আত্মদানের উজ্জ্বল চিহ্ন। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, স্বাধীনতার প্রকৃত মানে আসলে কী? স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতাই কি ‘স্বাধীনতা’? আমরা কি সেদিন দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছিলাম? সদ্যস্বাধীন দেশের প্রতিটি কোনায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল, তখন শরণার্থীশিবির থেকে কোটি মানুষ নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে যখন স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিল, তাদের সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর পুনর্নির্মাণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল কি?
স্বাধীন হওয়ার পর গত পাঁচ দশকে আমরা কী অর্জন করলাম? আমরা কতটুকু এগোলাম? দেশের সব মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছে? সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? পাকিস্তানিরা এ দেশ থেকে চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বঞ্চনা কি বন্ধ হয়েছে? দেশের দুর্বলতর শ্রেণির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সবারই জানা। আর এটাই আজকের দিনে সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক দিক। এ কথা ঠিক যে আর্থিক ও উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা অনেক দিক থেকেই এগিয়েছি। কিন্তু আরও যেসব ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, আমরা সেখানে সেভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। দেশের অগ্রগতি বা নাগরিকের অগ্রগতি বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো হয়, শুধু সেই বস্তুগত অগ্রগতি হলেই কিন্তু চলে না। মূল্যবোধ, চিন্তাধারারও অগ্রগতি জরুরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা করতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, এখনো সামাজিক স্বাধীনতা আসেনি। আমাদের সংবিধান বাক্স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের দেশে সেই বাক্স্বাধীনতা অনেকটাই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ইচ্ছাধীন। তারা অন্যায় করলেও কথা বলা যায় না। তাদের সমস্ত অনাচার-অবিচারকে মুখ বুজে মেনে নিতে হয়।
স্বাধীনতার অর্থ দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের ওপরে দাঁড় করানো; দেশের মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাসযোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলা। মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা, বিজ্ঞান ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা।
স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে মানুষের দ্বারা তৈরি নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, কর্তব্যপরায়ণ হওয়া। নিয়মনীতি মেনে চলা। অন্যের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া। স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য দেশের জনগণের ন্যূনতম প্রকৃত শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে, অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। দেশের মানুষের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার আলো জ্বালাতে না পারলে সব স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার বোধও খুব একটা স্পষ্ট নয়। স্বাধীনতা কোনো মাটির পুতুল, কাঠের চেয়ার বা দলের পতাকা নয়। একে হাত দিয়ে ধরা যায় না। ঘরে এনে সাজিয়ে রাখা যায় না। একে কাঁধে তুলে মিছিল করা যায় না। স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। কারও কাছে সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, কারও কাছে সামাজিক আবার কারও কাছে সেটা হতেই পারে একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার।
৫৩ বছর আগে আমরা পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। আজ কিন্তু অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এ রকম একের পর এক সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে। পাকিস্তানি শাসনকালের মতোই দেশে অন্যায়-অবিচার ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ‘স্বাধীনতা’ শব্দের অবমাননা করা হচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর অদ্ভুতভাবে পাল্টে যাচ্ছে! যারা শক্তিশালী, ক্ষমতাবান তারাই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে! তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তারা বের করে ফেলছে দাঁত-নখ। মানুষকে ভয় দেখিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়াটা যেন ক্রমেই একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠছে!
সীমাহীনভাবে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা। দিন দিন ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। নানা ছুঁতোয় কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু মানুষজনের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় টিপ্পনী, বাঁকা কথা, শ্লেষ হজম করতে করতে একধরনের নেতিবাচক পরিবেশে বাস করে। তার ওপর বৈষম্য আর বঞ্চনা তাদের আরও বেশি অস্থির বানিয়ে ফেলে। কোনো কোনো জায়গায় তাদের জন্য বাসা ভাড়া মেলে না। চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেও এই সমস্যা রয়েছে। যদিও কেউ তা স্বীকার করে না। চাকরির আবেদনপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে দেখা যায়, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। যোগ্যতার অন্যান্য মাপকাঠি গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই ধরনের সমস্যা হয়। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ব্যাংকের কর্মীরা ঋণ দিতে অস্বীকার করেন বা আগ্রহ দেখান না—এমন ঘটনাও ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও খাতা-কলমে এমন বৈষম্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। অথচ সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির মানুষ মিলেই আমরা একাত্তরে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম! ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমাদের সংবিধানের চার মূল নীতির মধ্যে স্থান দিয়েছিলাম।
সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের বা প্রশাসনের নয়, সহ-নাগরিকদেরও। মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস ছাড়া স্বাধীনতা স্থায়ী হয় না।
আমরা ক্রমেই ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠছি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যদি নিজের মতো থাকার অধিকার খর্ব হয়, তাহলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেশের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা হবেই। কারণ, আমরা একসময় চলে গেলেও আমাদের সন্তান-সন্ততিরা এ দেশেই থেকে যাবে। তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত ও স্বাধীন করার কথাও আমাদেরই ভেবে যেতে হবে।
স্বাধীনতা শুধু স্বশাসন নয়, নয় পতাকা কিংবা ইট-কাঠ-পাথর, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা! সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সে-ও যে দেশের ভালো চায়, নানা কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার! অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! আর স্বাধীনতা কিন্তু একবারে পেয়ে যাওয়ার কোনো বস্তু নয়। এটা সারা জীবন ধরে চর্চার বিষয়। অর্থাৎ, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তা রক্ষা করে চলাটাও সমান জরুরি।
বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি দুঃশাসন বা পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে বিজয় দিবস বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। নানা পরিবর্তনের পথ ধরে বর্তমানে আবার পাকিস্তানি ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নতুন করে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এবারের বিজয় দিবস এই দেশবিরোধী শক্তি ও ধ্যান-ধারণার কবর রচনার জন্য নতুন লড়াইয়ের শপথ গ্রহণের দিন।
‘তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা’ কত শত সাকিনা, হরিদাসীর কপাল ভাঙল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অবশেষে স্বাধীনতা মিলল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়েছিল প্রায় সোয়া দুই শ বছর আগে। তারপর ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-জুলুম-নির্যাতন।
সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। জন্ম হয়েছিল এমন এক রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লড়াকু মানুষ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা।
১৯৭১ থেকে ২০২৪। আমাদের স্বাধীনতার ৫৩ বছর। ৫৩ বছর আগে আমরা পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-জুলুম-নির্যাতনের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এ স্বাধীনতা নিছক ঘরে বসে পাওয়া যায়নি। পেতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াই করে। হারাতে হয়েছে বাংলা মায়ের অনেক বীর সন্তানকে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লেগে রয়েছে লাখো মানুষের ত্যাগ, সংগ্রাম ও আত্মদানের উজ্জ্বল চিহ্ন। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, স্বাধীনতার প্রকৃত মানে আসলে কী? স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতাই কি ‘স্বাধীনতা’? আমরা কি সেদিন দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছিলাম? সদ্যস্বাধীন দেশের প্রতিটি কোনায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল, তখন শরণার্থীশিবির থেকে কোটি মানুষ নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে যখন স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিল, তাদের সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর পুনর্নির্মাণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল কি?
স্বাধীন হওয়ার পর গত পাঁচ দশকে আমরা কী অর্জন করলাম? আমরা কতটুকু এগোলাম? দেশের সব মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছে? সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? পাকিস্তানিরা এ দেশ থেকে চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বঞ্চনা কি বন্ধ হয়েছে? দেশের দুর্বলতর শ্রেণির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সবারই জানা। আর এটাই আজকের দিনে সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক দিক। এ কথা ঠিক যে আর্থিক ও উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা অনেক দিক থেকেই এগিয়েছি। কিন্তু আরও যেসব ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, আমরা সেখানে সেভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। দেশের অগ্রগতি বা নাগরিকের অগ্রগতি বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো হয়, শুধু সেই বস্তুগত অগ্রগতি হলেই কিন্তু চলে না। মূল্যবোধ, চিন্তাধারারও অগ্রগতি জরুরি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা করতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, এখনো সামাজিক স্বাধীনতা আসেনি। আমাদের সংবিধান বাক্স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের দেশে সেই বাক্স্বাধীনতা অনেকটাই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ইচ্ছাধীন। তারা অন্যায় করলেও কথা বলা যায় না। তাদের সমস্ত অনাচার-অবিচারকে মুখ বুজে মেনে নিতে হয়।
স্বাধীনতার অর্থ দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের ওপরে দাঁড় করানো; দেশের মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাসযোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলা। মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা, বিজ্ঞান ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা।
স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে মানুষের দ্বারা তৈরি নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, কর্তব্যপরায়ণ হওয়া। নিয়মনীতি মেনে চলা। অন্যের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া। স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য দেশের জনগণের ন্যূনতম প্রকৃত শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে, অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। দেশের মানুষের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার আলো জ্বালাতে না পারলে সব স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার বোধও খুব একটা স্পষ্ট নয়। স্বাধীনতা কোনো মাটির পুতুল, কাঠের চেয়ার বা দলের পতাকা নয়। একে হাত দিয়ে ধরা যায় না। ঘরে এনে সাজিয়ে রাখা যায় না। একে কাঁধে তুলে মিছিল করা যায় না। স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। কারও কাছে সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, কারও কাছে সামাজিক আবার কারও কাছে সেটা হতেই পারে একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার।
৫৩ বছর আগে আমরা পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। আজ কিন্তু অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এ রকম একের পর এক সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে। পাকিস্তানি শাসনকালের মতোই দেশে অন্যায়-অবিচার ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ‘স্বাধীনতা’ শব্দের অবমাননা করা হচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর অদ্ভুতভাবে পাল্টে যাচ্ছে! যারা শক্তিশালী, ক্ষমতাবান তারাই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে! তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তারা বের করে ফেলছে দাঁত-নখ। মানুষকে ভয় দেখিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়াটা যেন ক্রমেই একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠছে!
সীমাহীনভাবে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা। দিন দিন ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। নানা ছুঁতোয় কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু মানুষজনের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় টিপ্পনী, বাঁকা কথা, শ্লেষ হজম করতে করতে একধরনের নেতিবাচক পরিবেশে বাস করে। তার ওপর বৈষম্য আর বঞ্চনা তাদের আরও বেশি অস্থির বানিয়ে ফেলে। কোনো কোনো জায়গায় তাদের জন্য বাসা ভাড়া মেলে না। চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেও এই সমস্যা রয়েছে। যদিও কেউ তা স্বীকার করে না। চাকরির আবেদনপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে দেখা যায়, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। যোগ্যতার অন্যান্য মাপকাঠি গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই ধরনের সমস্যা হয়। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ব্যাংকের কর্মীরা ঋণ দিতে অস্বীকার করেন বা আগ্রহ দেখান না—এমন ঘটনাও ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও খাতা-কলমে এমন বৈষম্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। অথচ সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির মানুষ মিলেই আমরা একাত্তরে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম! ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমাদের সংবিধানের চার মূল নীতির মধ্যে স্থান দিয়েছিলাম।
সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের বা প্রশাসনের নয়, সহ-নাগরিকদেরও। মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস ছাড়া স্বাধীনতা স্থায়ী হয় না।
আমরা ক্রমেই ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠছি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যদি নিজের মতো থাকার অধিকার খর্ব হয়, তাহলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেশের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা হবেই। কারণ, আমরা একসময় চলে গেলেও আমাদের সন্তান-সন্ততিরা এ দেশেই থেকে যাবে। তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত ও স্বাধীন করার কথাও আমাদেরই ভেবে যেতে হবে।
স্বাধীনতা শুধু স্বশাসন নয়, নয় পতাকা কিংবা ইট-কাঠ-পাথর, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা! সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সে-ও যে দেশের ভালো চায়, নানা কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার! অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! আর স্বাধীনতা কিন্তু একবারে পেয়ে যাওয়ার কোনো বস্তু নয়। এটা সারা জীবন ধরে চর্চার বিষয়। অর্থাৎ, স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তা রক্ষা করে চলাটাও সমান জরুরি।
বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি দুঃশাসন বা পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে বিজয় দিবস বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। নানা পরিবর্তনের পথ ধরে বর্তমানে আবার পাকিস্তানি ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নতুন করে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এবারের বিজয় দিবস এই দেশবিরোধী শক্তি ও ধ্যান-ধারণার কবর রচনার জন্য নতুন লড়াইয়ের শপথ গ্রহণের দিন।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া একটি পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি
১৩ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ নিয়ে দলের বক্তব্য স্পষ্ট ক
১৩ ঘণ্টা আগেডিসেম্বর মাসে এসে বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপ সেভাবে কাজ করছে না। বহু খবরই তখন প্রকাশিত হচ্ছিল অবরুদ্ধ নগরীর সংবাদপত্রে। ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন কিংবা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি একই দিনে প্রকাশিত হলো। সেদিন ইত্তেফাক ‘পিটুনি কর’ বিষয়ক রিপোর্টটির যে শিরোনাম করেছিল,
১৩ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে গণহত্যা কিংবা জেনোসাইড কম হয়নি। যত যুদ্ধের যত গণকবর রয়েছে, সেগুলো বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে নিহত মানুষের গণকবর যেমন সাক্ষ্য দেয়, রুয়ান্ডার নিয়াবারোঙ্গো নদীও সাক্ষ্য দেয়, তার বুক দিয়ে ভেসে গেছে রক্তস্নাত মানুষের লাশ। তবে বর্বরতার চরম মাত্রা মনে
১৩ ঘণ্টা আগে