আব্দুর রাজ্জাক
ভারতবর্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মোটা দাগে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান—এটাই ছিল সেই সময় ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মূল প্রতিপাদ্য।
আজকের লেখার বিষয়বস্তু ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়েছে সে ব্যাপারে নয়, বরং একাত্তর সালের পরে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে। পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল—পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। আমাদেরটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। শাসনব্যবস্থায়, সমাজব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। বিভিন্ন অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমের বিরুদ্ধে ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ বলে প্রতিষ্ঠা পেল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। আমরা এই বাংলাদেশের মানুষেরাই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা আরম্ভ করেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
এই শাসনব্যবস্থার বিপরীতে বিভিন্ন মত ও পথের অনেক দল, অনেক মানুষ অবস্থান নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান যেসব রাজনৈতিক শক্তি অবস্থান নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি। আরও হয়তো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু গোষ্ঠী বা শক্তি ছিল। এখানে দেখার বিষয়, যাদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো, তাদের মূল বক্তব্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এখানে যাঁরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের মূলনীতি কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থার মতোই। সমাজতন্ত্র হলে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে, সেখানেও এক পার্টি ক্ষমতায় থাকবে—যেটা ছিল সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে। স্বাধীনতার পরবর্তী সাড়ে তিন বছর এভাবেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছিল আমাদের দেশ।
আপনারা অনেকেই হয়তো দেখেছেন, তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমানের কাছে কর্নেল রশিদ যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সামান্য রেষারেষি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কয়েকজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার মন-মেজাজের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলকে উৎখাত করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করে রাষ্ট্র পরিচালনা আরম্ভ হয়। সেই সময়ে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন, তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের অর্থ দাঁড় করিয়েছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার। কিছু মানুষ মেনেও নিয়েছিলেন, আবার বিরোধিতা ছিল, কিন্তু স্থায়ী রূপ পেল না এই শাসনব্যবস্থারও।
সেই শাসনব্যবস্থা উৎখাত করে, সেই সময়ের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে আরেকটা পরিবর্তন হলো। এই শাসনব্যবস্থায় আগের নীতিগুলো ঠিক থাকলেও এখানে ধর্মীয় লেবাস দেওয়া হলো, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করল। আবার আমরা এই দেশেরই মানুষ, এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাম, ’৯১ সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটালাম। বিলুপ্ত হলো সেই শাসনব্যবস্থা। ’৮২ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত যে শাসনব্যবস্থা ছিল, তাকে আমরা আখ্যায়িত করলাম স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু স্বৈরাচারের বীজ থেকে গেল, সমূলে বিনাশ হলো না।
’৯২ সালে আবার ফিরে এল জাতীয়তাবাদী ধারার দল। মানুষ তখন বুকে আশা বেঁধেছিল—এবার বোধ হয় স্থায়ী সমাজব্যবস্থার একটি রূপ দেখা যাবে, জনগণের ইচ্ছায় ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হবে, পরবর্তী সময়ে জনগণের সদিচ্ছাতেই আবার সরকার পরিবর্তন হবে—এ রকমই ধারণা করেছিল এ দেশের মানুষ অর্থাৎ বেশির ভাগ শান্তিকামী মানুষ।
এই সরকার পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছে প্রায় নির্বিঘ্নে। কিছু ত্রুটি থাকলেও পাঁচ বছর মোটামুটি তাদের সময়কাল অতিক্রম করেছিল ঝামেলাহীনভাবে। পরবর্তী সময়ে আবার পালা পরিবর্তন হলো। এই পালা পরিবর্তন করতে গিয়ে আবার আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজপথ গরম হলো, রক্ত ঝরল। ফিরে এল সেই একাত্তর-পরবর্তী শাসনব্যবস্থার ধারা।
ভালোই চলছিল ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। পালা পরিবর্তন হলো শান্তিপূর্ণভাবে, মোটা দাগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যেভাবে দেশ পরিচালনা হচ্ছিল তাতে সবাই মনে করেছিল বোধ হয় শাসনব্যবস্থার একটি মোটামুটি স্থায়ী রূপ পাওয়া গেছে। এই ২০০১ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে জাতীয় জীবনে দুটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। একটি হলো
২১ আগস্টের তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, অন্যটি ছিল বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নিজেদের পূর্বেকার দলীয় ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা।
এই দুর্ভাগা জাতি, স্থায়ী কোনো শাসনব্যবস্থা সেদিনও বজায় রাখতে পারেনি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো, দুই বছর শাসন করল। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে এল আবার সেই ’৭১ থেকে ’৭৫-এর যে শাসনব্যবস্থা, সেই রকম একটি ব্যবস্থার সরকার। সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ এই সরকার দেশ পরিচালনা করছিল। এখানেও বিচ্যুতি দেখা গেল, আস্থা ছিল না বিরোধী দলের ওপর, বিরোধী দলও আস্থা রাখতে পারেনি সরকারি দলের ওপর। দুটি নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ অনেক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সরকারি দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই রকম প্রশ্নবিদ্ধ শাসনব্যবস্থা যে বেশি দিন টিকে থাকে না, এটা গত সাড়ে ১৫ বছরের সরকার, অর্থাৎ আওয়ামী সরকার বুঝে উঠতে পারেনি। এখানে এই আগের মতোই সমস্যা তৈরি হলো—স্থায়ী কোনো পরিকাঠামো তৈরি হলো না রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। ৫৩ বছরের একটি রাষ্ট্রে যদি বারবার মূলনীতির পরিবর্তন হয়, মূল লক্ষ্য অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার স্থায়ী কোনো কাঠামো তৈরি না হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে, এই ব্যাপারটি নিয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে পারেন।
গত ৫ আগস্ট সাড়ে ১৫ বছরের সরকারব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হলো। সামনে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে, পরিচালনার মূল ভিত্তি কী হবে—সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সঠিক ধারণা এ দেশের জনগণ জানে না। একটা জাতি ৫৩ বছর এই রকম স্থায়ী কাঠামো ছাড়া অতিক্রম করল! ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনায় স্থায়ী কোনো রূপ পাওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারেও সবাই সন্দিহান। অথচ যে ভারত থেকে আমরা ভাগ হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই দেশে কিন্তু সেই ’৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্র পরিচালনার একটি স্থায়ী অবকাঠামো আছে। রাষ্ট্র চালনার মূলনীতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচন নিয়ে সেখানে তেমন প্রশ্ন ওঠে না। নিজেদের মধ্যে আন্তদলীয় কিছু মতানৈক্য থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে সরকার ও বিরোধী দল মোটামুটি একটি মতৈক্যে পৌঁছেছে। রাষ্ট্র নিয়ে যাঁরা একটু চিন্তাভাবনা করেন, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি নিয়ে জ্ঞানচর্চা করেন, সেইসব গুণীজন নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, বর্তমানেও সবার মতামত নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার স্থায়ী কোনো অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডের মানুষ যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থায়ী কোনো ভিত্তি না দাঁড় করিয়ে অনিশ্চয়তার দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঠেলে দেব?
জাতি হিসেবে আমরা এত বহু ভাগে বিভক্ত, আমাদের মধ্যে এত মতপার্থক্য, একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা—এ রকম বোধ হয় খুব কম জাতি আছে পৃথিবীতে। আমাদের এখনই উচিত, দলমত-নির্বিশেষে দেশের কল্যাণের স্বার্থে ১৮ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, রুটিরুজির জন্য একটি ঐকমত্যে চলে আসা। আমরা আমাদের এই মাতৃভূমিকে নিজেরাই শাসন করতে চাই এবং স্থায়ীভাবে শাসনব্যবস্থার রূপরেখা দাঁড় করিয়ে আমাদের এই দেশকে পরিচালনা করতে চাই। সরকার কাঠামোর ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা স্থায়ী রূপ দেখতে চাই।
আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী
ভারতবর্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মোটা দাগে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান—এটাই ছিল সেই সময় ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মূল প্রতিপাদ্য।
আজকের লেখার বিষয়বস্তু ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়েছে সে ব্যাপারে নয়, বরং একাত্তর সালের পরে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে। পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল—পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। আমাদেরটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। শাসনব্যবস্থায়, সমাজব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। বিভিন্ন অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমের বিরুদ্ধে ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ বলে প্রতিষ্ঠা পেল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। আমরা এই বাংলাদেশের মানুষেরাই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা আরম্ভ করেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
এই শাসনব্যবস্থার বিপরীতে বিভিন্ন মত ও পথের অনেক দল, অনেক মানুষ অবস্থান নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান যেসব রাজনৈতিক শক্তি অবস্থান নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি। আরও হয়তো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু গোষ্ঠী বা শক্তি ছিল। এখানে দেখার বিষয়, যাদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো, তাদের মূল বক্তব্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এখানে যাঁরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের মূলনীতি কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থার মতোই। সমাজতন্ত্র হলে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে, সেখানেও এক পার্টি ক্ষমতায় থাকবে—যেটা ছিল সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে। স্বাধীনতার পরবর্তী সাড়ে তিন বছর এভাবেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছিল আমাদের দেশ।
আপনারা অনেকেই হয়তো দেখেছেন, তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমানের কাছে কর্নেল রশিদ যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সামান্য রেষারেষি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কয়েকজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার মন-মেজাজের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলকে উৎখাত করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করে রাষ্ট্র পরিচালনা আরম্ভ হয়। সেই সময়ে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন, তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের অর্থ দাঁড় করিয়েছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার। কিছু মানুষ মেনেও নিয়েছিলেন, আবার বিরোধিতা ছিল, কিন্তু স্থায়ী রূপ পেল না এই শাসনব্যবস্থারও।
সেই শাসনব্যবস্থা উৎখাত করে, সেই সময়ের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে আরেকটা পরিবর্তন হলো। এই শাসনব্যবস্থায় আগের নীতিগুলো ঠিক থাকলেও এখানে ধর্মীয় লেবাস দেওয়া হলো, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করল। আবার আমরা এই দেশেরই মানুষ, এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাম, ’৯১ সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটালাম। বিলুপ্ত হলো সেই শাসনব্যবস্থা। ’৮২ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত যে শাসনব্যবস্থা ছিল, তাকে আমরা আখ্যায়িত করলাম স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু স্বৈরাচারের বীজ থেকে গেল, সমূলে বিনাশ হলো না।
’৯২ সালে আবার ফিরে এল জাতীয়তাবাদী ধারার দল। মানুষ তখন বুকে আশা বেঁধেছিল—এবার বোধ হয় স্থায়ী সমাজব্যবস্থার একটি রূপ দেখা যাবে, জনগণের ইচ্ছায় ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হবে, পরবর্তী সময়ে জনগণের সদিচ্ছাতেই আবার সরকার পরিবর্তন হবে—এ রকমই ধারণা করেছিল এ দেশের মানুষ অর্থাৎ বেশির ভাগ শান্তিকামী মানুষ।
এই সরকার পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছে প্রায় নির্বিঘ্নে। কিছু ত্রুটি থাকলেও পাঁচ বছর মোটামুটি তাদের সময়কাল অতিক্রম করেছিল ঝামেলাহীনভাবে। পরবর্তী সময়ে আবার পালা পরিবর্তন হলো। এই পালা পরিবর্তন করতে গিয়ে আবার আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজপথ গরম হলো, রক্ত ঝরল। ফিরে এল সেই একাত্তর-পরবর্তী শাসনব্যবস্থার ধারা।
ভালোই চলছিল ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। পালা পরিবর্তন হলো শান্তিপূর্ণভাবে, মোটা দাগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যেভাবে দেশ পরিচালনা হচ্ছিল তাতে সবাই মনে করেছিল বোধ হয় শাসনব্যবস্থার একটি মোটামুটি স্থায়ী রূপ পাওয়া গেছে। এই ২০০১ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে জাতীয় জীবনে দুটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। একটি হলো
২১ আগস্টের তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, অন্যটি ছিল বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নিজেদের পূর্বেকার দলীয় ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা।
এই দুর্ভাগা জাতি, স্থায়ী কোনো শাসনব্যবস্থা সেদিনও বজায় রাখতে পারেনি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো, দুই বছর শাসন করল। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে এল আবার সেই ’৭১ থেকে ’৭৫-এর যে শাসনব্যবস্থা, সেই রকম একটি ব্যবস্থার সরকার। সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ এই সরকার দেশ পরিচালনা করছিল। এখানেও বিচ্যুতি দেখা গেল, আস্থা ছিল না বিরোধী দলের ওপর, বিরোধী দলও আস্থা রাখতে পারেনি সরকারি দলের ওপর। দুটি নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ অনেক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সরকারি দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই রকম প্রশ্নবিদ্ধ শাসনব্যবস্থা যে বেশি দিন টিকে থাকে না, এটা গত সাড়ে ১৫ বছরের সরকার, অর্থাৎ আওয়ামী সরকার বুঝে উঠতে পারেনি। এখানে এই আগের মতোই সমস্যা তৈরি হলো—স্থায়ী কোনো পরিকাঠামো তৈরি হলো না রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। ৫৩ বছরের একটি রাষ্ট্রে যদি বারবার মূলনীতির পরিবর্তন হয়, মূল লক্ষ্য অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার স্থায়ী কোনো কাঠামো তৈরি না হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে, এই ব্যাপারটি নিয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে পারেন।
গত ৫ আগস্ট সাড়ে ১৫ বছরের সরকারব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হলো। সামনে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে, পরিচালনার মূল ভিত্তি কী হবে—সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সঠিক ধারণা এ দেশের জনগণ জানে না। একটা জাতি ৫৩ বছর এই রকম স্থায়ী কাঠামো ছাড়া অতিক্রম করল! ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনায় স্থায়ী কোনো রূপ পাওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারেও সবাই সন্দিহান। অথচ যে ভারত থেকে আমরা ভাগ হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই দেশে কিন্তু সেই ’৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্র পরিচালনার একটি স্থায়ী অবকাঠামো আছে। রাষ্ট্র চালনার মূলনীতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচন নিয়ে সেখানে তেমন প্রশ্ন ওঠে না। নিজেদের মধ্যে আন্তদলীয় কিছু মতানৈক্য থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে সরকার ও বিরোধী দল মোটামুটি একটি মতৈক্যে পৌঁছেছে। রাষ্ট্র নিয়ে যাঁরা একটু চিন্তাভাবনা করেন, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি নিয়ে জ্ঞানচর্চা করেন, সেইসব গুণীজন নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, বর্তমানেও সবার মতামত নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার স্থায়ী কোনো অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডের মানুষ যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থায়ী কোনো ভিত্তি না দাঁড় করিয়ে অনিশ্চয়তার দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঠেলে দেব?
জাতি হিসেবে আমরা এত বহু ভাগে বিভক্ত, আমাদের মধ্যে এত মতপার্থক্য, একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা—এ রকম বোধ হয় খুব কম জাতি আছে পৃথিবীতে। আমাদের এখনই উচিত, দলমত-নির্বিশেষে দেশের কল্যাণের স্বার্থে ১৮ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, রুটিরুজির জন্য একটি ঐকমত্যে চলে আসা। আমরা আমাদের এই মাতৃভূমিকে নিজেরাই শাসন করতে চাই এবং স্থায়ীভাবে শাসনব্যবস্থার রূপরেখা দাঁড় করিয়ে আমাদের এই দেশকে পরিচালনা করতে চাই। সরকার কাঠামোর ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা স্থায়ী রূপ দেখতে চাই।
আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী
এই ভূখণ্ডের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি সেই সব সংগ্রামের সাফল্য বা বিজয় বেহাত হওয়ার ইতিহাসও কম দীর্ঘ নয়। এক ইংরেজ শাসনামলেই এখানকার মানুষের সাহসী ও প্রবল সংগ্রামের তিন-চারটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের কাছে নবাব সি
১৩ ঘণ্টা আগেউজ্জয়িনীর সম্রাট ছিলেন বিক্রমাদিত্য। সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা ছিল। সেই সময়কার বিখ্যাত ৯ জন পণ্ডিত এই সভাকে অলংকৃত করতেন। সম্রাট বিক্রমাদিত্য এই নবরত্নদের আদেশ-উপদেশ মেনে রাজ্য পরিচালনা করতেন। নবরত্নদের মধ্যে ছিলেন অমর সিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক, আর্যভট্ট, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বররুচি, বেতাল ভট্ট
১৩ ঘণ্টা আগেযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ নগরীতে সাংবাদিকতা করা ছিল কঠিন। তবে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর তাঁবেদারি করেছে, তারা তখন কোনো ধরনের সমস্যায় পড়েনি বরং পাকিস্তানি সরকারের সুনজরে ছিল।
১৩ ঘণ্টা আগেগত শনিবার আজকের পত্রিকায় ‘বৃদ্ধ বাবাকে জঙ্গলে ফেলে গেলেন মেয়ে ও জামাতা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটি আমাদের সমাজের এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। একটি সমাজের প্রকৃত মেরুদণ্ড হলো তার মানবিকতা। সেই মানবিকতা তখনই বেশি প্রাসঙ্গিক হয়, যখন সমাজের সবচেয়ে দুর্বল কোনো মানুষ বিপদে পড়ে।
১৩ ঘণ্টা আগে