Ajker Patrika

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছর: বাংলাদেশে শ্রমনীতি ও বাস্তবতা

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ৪৬
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির জীবনমান ও অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি দেওয়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের মন্তব্য একটি গভীর বাস্তবতার দরজা খুলে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এ মন্ত্রণালয়ে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কেউই মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি; বরং সবাই মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। এই বক্তব্য শুধু সমসাময়িক একটি প্রতিক্রিয়া নয়, আমাদের রাষ্ট্রের একটি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার স্বীকৃতি।

শ্রম মন্ত্রণালয়: রক্ষক না ভক্ষক?

বাংলাদেশের শ্রম মন্ত্রণালয়, সংবিধান অনুসারে, শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। অথচ বাস্তবে এটি দীর্ঘদিন ধরে শিল্পমালিকদের স্বার্থরক্ষার ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা রক্ষা—এসব মৌলিক দায়িত্ব উপেক্ষিত থেকেছে বারবার।

একজন উপদেষ্টার মুখে যখন এই স্বীকারোক্তি আসে যে, ‘আমি শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, তাই মালিকেরা আমার ওপর খ্যাপা,’ তখন বিষয়টি আর গোপন কিছু থাকে না। স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্রের ভেতরেই আছে এক বিরাট দ্বন্দ্ব—যেখানে একদিকে রয়েছে মালিক শ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বলয়, অন্যদিকে শ্রমিকের দুর্বল অবস্থান।

৮৫% শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ তথ্য—বাংলাদেশে ৮৫% শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং তাঁদের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। তাঁরা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারেন না, মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না, ন্যূনতম মজুরি বা ওভারটাইম বেতন পান না, আর কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমেও তাঁদের নাম নেই।

এই শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী, যাঁদের প্রতি বৈষম্য বহুগুণ বেশি। ৯০% নারী শ্রমিক মাতৃত্বকালীন সময়ে কোনো বেতন পান না। এই অনিয়ম শুধু একটি নীতিহীন শ্রমনীতির ফসল নয়, বরং এটি একটি অসম রাষ্ট্রকাঠামোর বহিঃপ্রকাশ।

রাষ্ট্রের শ্রেণিস্বার্থ ও মালিকপক্ষের দাপট

এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—রাষ্ট্র কীভাবে এত বছর ধরে মালিকদের পক্ষে অবস্থান করল? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমাদের রাজনীতির অর্থায়নে। শিল্পমালিকেরা রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অর্থদাতা। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার মতো সদিচ্ছা বা সাহস অধিকাংশ সময়েই রাষ্ট্রীয় স্তরে দেখা যায় না। অধিকাংশ শ্রমমন্ত্রী ও সচিব মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সিদ্ধান্ত নেন, যাতে শ্রমিক নন, উৎপাদন ও মুনাফা মুখ্য হয়ে ওঠে।

শ্রমিকদের স্বার্থে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় ‘টাকা নেই’ বলা হলেও মালিকের বিলাসবহুল জীবনযাপন, বিদেশ ভ্রমণ, ব্যাংকঋণ খেলাপ—এসব প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। এই দ্বৈতনীতি শ্রমিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ: বাস্তবায়ন হবে কি

শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো:

  • শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা স্কিম চালু করা
  • ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সব শ্রমক্ষেত্রে কার্যকর করা
  • অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় শ্রমনীতি হালনাগাদ করা
  • নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে শক্ত আইন প্রয়োগ,

কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে একাধিক প্রতিবন্ধকতা। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, সরকার নিজেই এই সংস্কারের পৃষ্ঠপোষক নয়। শ্রমিকবান্ধব সংস্কার মানে হলো মালিকের কিছুটা ছাড় দেওয়া এবং সেটাই এই রাষ্ট্রযন্ত্রে অস্বস্তির কারণ। এমনকি কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের ওয়েবসাইটে বা জাতীয় আলোচনায় দৃশ্যমানও নয়।

আইনি সুরক্ষার কৌশলী ফাঁকফোকর

শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৮-তে কিছু প্রগতিশীল ধারা থাকলেও তা প্রয়োগে রয়েছে মারাত্মক অনিচ্ছা ও দুর্বলতা। যেমন, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ৩০% কর্মীর সম্মতি লাগার বিধানটি বহুক্ষেত্রেই ইউনিয়ন গঠনের পথে বড় বাধা।

একই সঙ্গে শ্রম আদালতের কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রতা, পক্ষপাতদুষ্টতা ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ। শ্রমিকদের কাছে আইনি প্রতিকার পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী এনজিও বা অ্যাকটিভিস্টদের প্রতিও রয়েছে নজরদারি ও দমন।

এভাবে রাষ্ট্র আইনের ফাঁক দিয়ে মালিকদের নিরাপদ রাখে, আর শ্রমিকের জন্য আইন একটি ভয় আর নিরাশার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

রাষ্ট্র কি মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে?

প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক হলেও এর উত্তর মূলত রাষ্ট্রের শ্রেণিগত অবস্থানে নিহিত। বাংলাদেশে যেহেতু রাষ্ট্রীয় রাজনীতি মূলত ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক বলয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করাটা হয়ে দাঁড়ায় একধরনের কল্পনা।

তবে রাষ্ট্র যদি সত্যিই শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়াতে চায়, তাহলে তাকে করতে হবে—

  • শ্রম আদালতকে স্বাধীন, দ্রুত ও স্বচ্ছ করা
  • মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে আপসহীন মনোভাব
  • শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করা, যেকোনো খাতে
  • অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনা

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা কোথা থেকে আসবে?

শ্রমনীতি কি শুধু কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়?

বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ‘জাতীয় শ্রমনীতি’ ঘোষণা করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নীতির অধিকাংশ ধারা অপ্রয়োগযোগ্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শ্রমিকেরা জানেনই না এই নীতির অস্তিত্ব, আর মালিকেরা জানলেও মানেন না।

যেসব কারখানায় বড় দুর্ঘটনা ঘটে (যেমন তাজরীন গার্মেন্টস বা রানা প্লাজা), সেগুলোর মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। বরং কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা রাজনীতিতে, শিল্পপতিদের সংগঠনে বা এমনকি সংসদে জায়গা করে নিয়েছেন।

এই সংস্কৃতি আমাদের বুঝিয়ে দেয়—শ্রমনীতি যতটা না শ্রমিকের জন্য, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক শোপিস।

কেমন হতে পারত বিকল্প শ্রমনীতি?

একটি বাস্তবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমনীতি কেবল শিল্প উৎপাদন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক মানবিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি বিকল্প শ্রমনীতি কেমন হতে পারত?

১. ‘লিভিং ওয়েজ’–ভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি

কেবল বেঁচে থাকার ন্যূনতম নয়, বরং সম্মানজনক জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি নির্ধারণ জরুরি। এটি নির্ধারিত হবে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদনসহ জীবনমানের ভিত্তিতে—শুধু বাজারমূল্য দিয়ে নয়।

২. শ্রমিকের অংশীদারত্ব ও সিদ্ধান্তে সম্পৃক্ততা

শ্রমিকেরা শুধু কর্মী নয়, তারা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই মালিকানায় তাদের অন্তর্ভুক্তি যেমন co-operative ownership, profit sharing, বা works council প্রথা চালু করা যেত।

৩. অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের সুরক্ষা

বাসার গৃহকর্মী, রিকশাচালক, হকার, কৃষিশ্রমিক—যাদের জন্য আজও কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই—তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারত রাষ্ট্র।

৪. ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনৈতিক দালালি থেকে মুক্ত করে বাস্তবিক শক্তি দেওয়া

আজকের ইউনিয়নগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিক কিংবা রাজনৈতিক দলের হাতের পুতুল। কিন্তু যদি শ্রমিকেরা সরাসরি প্রতিনিধিত্ব পায়, স্বচ্ছ নেতৃত্ব আসে, তাহলে তা প্রকৃতপক্ষেই একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপ নিতে পারে।

৫. কারখানার নিরাপত্তা ও মনিটরিং ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ ও শ্রমিকের অংশগ্রহণমূলক করা

আজকের যান্ত্রিক ও কেন্দ্রীয় মনিটরিং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ। এর বিকল্প হতে পারে, শ্রমিকদের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে স্থানীয় পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদারকি।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও আইএলওর সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের শ্রমনীতিকে আইএলওর (International Labour Organization) কনভেনশন ও সুপারিশ অনুযায়ী ঢেলে সাজানো যেতে পারত। যদিও সরকার আইএলওর সদস্য এবং কিছু কনভেনশন অনুমোদনও করেছে, বাস্তবে তার বাস্তবায়ন দুঃস্বপ্নের মতো।

আইএলও যেসব বিষয় জোর দিয়ে বলেছে:

  • জোরপূর্বক শ্রম বন্ধ
  • শিশু শ্রম নির্মূল
  • ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের নিশ্চয়তা
  • নিরাপদ কর্মপরিবেশ

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ও মালিকগোষ্ঠী—এই দুটি পক্ষই আন্তর্জাতিক চাপের বাইরে খুব কম কিছু মানতে চায়। পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোও অনেক সময় দ্বিমুখী চরিত্রে আচরণ করে—দরিদ্র শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় না।

সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শ্রমনীতির নতুন কাঠামো

‘শ্রমনীতি’ কেবল একটি প্রশাসনিক দলিল নয়, এটি একটি নৈতিক প্রশ্ন—সমাজ কাকে গুরুত্ব দেবে: কেবল পুঁজি ও মুনাফা নাকি শ্রম, মানুষ ও ন্যায্যতা?

একটি সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক কাঠামোর মূল স্তম্ভ হতে পারত:

  • শ্রমিককে মানুষ হিসেবে দেখা, উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে নয়
  • লিঙ্গসমতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে শ্রমনীতির কেন্দ্রে রাখা
  • রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ
  • শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল
  • শ্রমজীবী মানুষের জন্য অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি—cooperative, community-owned enterprises

এই কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার। এর জন্য দরকার—

  • শ্রমিকদের ঐক্য
  • নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকা
  • আন্তর্জাতিক সংহতি
  • রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পুনঃস্থাপন

রানা প্লাজার পরে কী বদলেছে?

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধস শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্যোগ। ১ হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে যান। পুরো বিশ্ব হতবাক হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর বাস্তবিক পরিবর্তন কী হয়েছে?

১. আন্তর্জাতিক চাপ ও কিছু উদ্যোগ

  • Accord on Fire and Building Safety in Bangladesh (ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগ) এবং Alliance for Bangladesh Worker Safety (আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোর উদ্যোগ) চালু হয়।
  • এসব চুক্তির ফলে কিছু কারখানায় ভবন পরিদর্শন, নিরাপত্তা জোরদার ও শ্রমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

২. কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই উদ্যোগগুলোর স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ

  • ২০১৮ সালের পর এসব উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় এবং প্রক্রিয়া অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়ে।
  • মালিকপক্ষ ও সরকারের মধ্যে ‘জাতীয় নিরাপত্তা মনিটরিং কমিটি’ গঠিত হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে।

৩. ট্রেড ইউনিয়নের দমন-পীড়ন বহাল

  • ২০১৩-২৩ সময়কালে যেসব শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন, তার মধ্যে ৬০-৭০% আবেদন সরকার বাতিল করেছে।
  • কোথাও কোথাও শ্রমিকদের গ্রেপ্তার, হুমকি, এমনকি গুমের ঘটনাও ঘটেছে।

৪. ন্যূনতম মজুরি নিয়ে তামাশা

  • সরকার ২০২৩ সালের শেষে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে ১২,৫০০ টাকা। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি ছিল ২৩-২৫ হাজার টাকা।
  • ফলাফল? দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস এলাকায় ভয়াবহ শ্রমিক আন্দোলন, পুলিশের গুলি, প্রাণহানি।

৫. অভ্যন্তরীণ মিডিয়া ও রাজনৈতিক বয়ান পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে

  • আন্দোলনের সময় প্রায়শই বলা হয় ‘উসকানিমূলক’, ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ কিংবা ‘দেশবিরোধী’। এর ফলে শ্রমিকের ন্যায্যদাবি আর রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ প্রায় এক হয়ে যায়।

মালিক শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে মালিকদের দুই মুখ—একদিকে তারা এফবিসিসিআই, বিজিএমইএর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি; অন্যদিকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, বা দলের বড় অনুগামী।

এই দ্বৈত পরিচয়ের ফলে—

  • তারা সরকারকে নীতিগতভাবে প্রভাবিত করতে পারে
  • শ্রমিকের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে পার পেয়ে যায়
  • তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নিপীড়নের অভিযোগের বিচার হয় না
  • রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন’ বয়ানে তারাই নায়ক হয়ে ওঠে

এখানে ন্যায্য প্রশ্ন:

শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়ে গড়া শিল্পের মালিকানা কি কেবল কিছু রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর থাকবে?

ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা

যদি আমরা চাই একটি মানবিক ও টেকসই শিল্পব্যবস্থা—তাহলে নিচের কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি:

১. স্বাধীন ও সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন নিশ্চিত করা

২. শ্রমিকদের জন্য ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি ফান্ড’ তৈরি করা—যাতে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়

৩. সব কারখানায় শ্রমিক প্রতিনিধি ও হেলথ অ্যান্ড সেফটি কমিটি বাধ্যতামূলক করা

৪. নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক নিরাপত্তা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু করা

৫. রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক মালিকানা বা লাভ-ভাগাভাগির ব্যবস্থাকে উৎসাহ দেওয়া

৬. ‘লেবার কোর্ট’-এর সংস্কার করে দ্রুত, কার্যকর ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা

এগুলো বাস্তবায়ন শুধু শ্রমিকের নয়, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। কারণ—

একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয়, যখন তার সবচেয়ে পরিশ্রমী নাগরিকেরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পায়।

গণতন্ত্র ও শ্রমিক অধিকার: একটি পারস্পরিক সম্পর্ক

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত হলো—সবার মতপ্রকাশ, সংগঠনের অধিকার ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু যখন শ্রমিক সংগঠনগুলো হয় অবরুদ্ধ, আন্দোলনে পুলিশি দমন হয় নিয়মিত, আর ন্যায্য মজুরির দাবিও রাষ্ট্রদ্রোহ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়—তখন সেটা কেবল শ্রমনীতি নয়, গণতন্ত্রের পরিপন্থীও বটে।

শ্রমিকের ন্যায্য দাবি মানেই যদি হয় ‘অরাজকতা’ বা ’উসকানি’, তাহলে যে রাষ্ট্র তা বলে, সে আসলে নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের ছায়াতলে একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা লালন করে।

এভাবে শ্রমিকের কণ্ঠ রুদ্ধ করা মানে গণতন্ত্রেরই গলা টিপে ধরা।

দারিদ্র্য, বৈষম্য ও আধুনিক দাসত্বের ছায়া

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গর্বগাথা প্রায়শই ‘রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট’–নির্ভর উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনে যে শ্রমিকের জীবনভর নিঃস্বতা, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তা নিয়ে আলোচনা হয় না।

এ একপ্রকার ‘নতুন ধরনের দাসত্ব’—

  • যেখানে শ্রমিক কাজ করে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যতের মালিক নয়।
  • যেখানে নারী শ্রমিক ১০ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাটিয়ে পায় মাসে ১২ হাজার টাকা, অথচ তার বানানো পোশাক বিক্রি হয় হাজার ডলারে।
  • যেখানে শ্রমিকের সন্তানের জন্য নেই গুণগত শিক্ষা, নেই নিরাপদ ভবিষ্যৎ।

এ পরিস্থিতিকে দারিদ্র্যের পুনরুৎপাদন বলা যায়—এক প্রজন্মের নিপীড়ন আরেক প্রজন্মের নিয়তি বানিয়ে ফেলে।

একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা যদি সত্যিই এগিয়ে যেতে চায়, তবে কেবল রপ্তানি বাড়ানো নয়, শ্রমিককে মানুষ হিসেবে দেখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। এজন্য—

১. রাষ্ট্রকে ‘গার্মেন্টসবান্ধব’ না হয়ে ’শ্রমিকবান্ধব’ হতে হবে।

২. নীতিনির্ধারক, বিশেষত সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা গার্মেন্টস মালিক, তাদের স্বার্থসংঘাত চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে।

৩. রাষ্ট্রীয় প্রচারে শ্রমিকের অবদানকে তুলে ধরতে হবে, ‘উন্নয়নের সেনানী’ হিসেবে।

৪. শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো, বাসস্থান, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা—সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘হোলিস্টিক’ নীতি তৈরি করতে হবে।

৫. শ্রমিকের আত্মমর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

যে রাষ্ট্র তার শ্রমিকদের কথা শোনে না, সে দীর্ঘ মেয়াদে নাগরিকের ভালোবাসাও পায় না। উন্নয়ন তখন কেবল সংখ্যা হয়, গল্প হয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩২

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। ‌এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।

কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?

এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।

গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।

এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।

মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?

একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।

এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?

ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।

সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?

এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।

জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।

যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

আজাদুর রহমান চন্দন
এখানেই দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। ছবি: আজকের পত্রিকা
এখানেই দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।

অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।

হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!

হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’

এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।

এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?

এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।

জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।

এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা

সম্পাদকীয়
রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।

আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।

দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

শহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।

সেলিম জাহান 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৭
বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।

পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।

তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয‍্যা।

পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।

একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।

শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আনিস আলমগীর, শাওনসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় অভিযোগ

হাদির জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রা দুপুরে

আজকের রাশিফল: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠকানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গী ঘরের কাজ করিয়ে নেবে

আনিস আলমগীর এখনো ডিবি কার্যালয়ে

অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে হামলায় নিহত বেড়ে ১৫, আহত ৪০ জনেরও বেশি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত