হাসান মামুন
এই নিবন্ধ প্রকাশের পরদিন ৫ নভেম্বর হাসিনা সরকারের পতনের তিন মাস পূর্ণ হবে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি ঘিরে এমন একটা বলদর্পী সরকারের পতনই ঘটে যাবে, সেটা সত্যি বলতে কেউ বিশ্বাস করেনি। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরাও নন। তাঁরা পদত্যাগের ‘এক দফা দাবি’ ঘোষণা করেছিলেন সরকার পতনের মাত্র দুই দিন আগে, ৩ আগস্ট। এর পরদিন আরও বেশি রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে দেশজুড়ে।
আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের ধারাবাহিক ও নিষ্ঠুর দমন অভিযানের জেরে সিরাজগঞ্জের একটি থানায় সেদিন নিহত হন ১৪ জন পুলিশ সদস্য। পরদিনই ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। পরিস্থিতি চলে যায় সরকার টিকে থাকার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত ছাত্র-জনতার বিজয়কে সহজ করে দেয়। ৫ আগস্ট দুপুরের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার। সঙ্গে তাঁর বোন শেখ রেহানাও ছিলেন। কোনো সরকারি বা দলীয় পদে না থাকলেও রেহানার বিরুদ্ধে রয়েছে হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। আর শেখ হাসিনার ওপর শেষতক চাপে ‘গণহত্যা’র অভিযোগও। ইতিমধ্যে এর বিচারও শুরু হয়েছে তাঁরই রেখে যাওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে।
অর্থশাস্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যথার্থই বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার একাগ্র বাসনা দেশে কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা আমরা দেখেছি। শুধু নির্বাচন ঠিকভাবে করলে শেখ হাসিনাকে পালাতে হতো না। তিনি এই দেশেই থাকতে পারতেন।’ এর আগে নব্বইয়েও একটি গণ-আন্দোলন হয় দেশে এবং তাতে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। সেনাশাসক হওয়ায় স্বভাবতই নানা অপকৌশলে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন এইচ এম এরশাদ।
কিন্তু রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ছাত্র-জনতা একত্র হয়ে আন্দোলনে নামলে অনেক কম রক্তক্ষয়ের মধ্যেই তিনি ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের অভিনব উপায়ও বের করা হয়। পদত্যাগ করে দেশেই থাকেন তিনি; পরে জেলে যান। দেশে প্রথমবারের মতো গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয় তাঁর দল। প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে গিয়ে ৩৫টি আসন পায়। এরশাদ জয়ী হন সর্বোচ্চ পাঁচ আসনে। এদিকে, শেখ হাসিনা ছিলেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
২০১৪ এবং এর পরবর্তী নির্বাচনগুলো বাদ দিলেও বলতে হয়, তাঁর নেতৃত্বাধীন দল জয়ী হয়েছিল দুবার—১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে। অথচ তাঁর পরিণতি হলো এরশাদের চেয়েও খারাপ। তাঁর নেতৃত্বাধীন দলটিও হলো চরমভাবে বিপর্যস্ত, সেই সঙ্গে দলের সহযোগী গোষ্ঠীগুলো। টানা তিন মেয়াদে পুলিশসহ প্রশাসনের নজিরবিহীন দলীয়করণ হওয়ায় এরও বড় অংশ পড়েছে চাকরিচ্যুতি, গ্রেপ্তার ও গুরুতর মামলায়। হাসিনা গংয়ের এমন পতন ছিল বলতে গেলে অবিশ্বাস্য।
একের পর এক ভুয়া নির্বাচন করে টিকে যাওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দল কোনো ‘কার্যকর আন্দোলন’ গড়ে তুলতে না পারায় হাসিনা সরকারের এমন ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল যে, তারা অজেয়! ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা অবশ্য প্রমাণ করে দিল—কেউ অজেয় নয়, আর কোনো কিছুই নয় অসম্ভব। এ জন্য অবশ্য নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে যেতে হয়েছে তাদের।
ত্মাহুতি দিতে হয়েছে অকাতরে। কেবল উপর্যুপরি ভুয়া নির্বাচন করে নয়; নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলন দমনের মাধ্যমেও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনীও তাঁর ইচ্ছাপূরণে পুলিশের মতো গুলি চালাক, এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা পরিপালন করা হয়নি। শেষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রীতিমাফিক পদত্যাগেরও সুযোগ পাননি হাসিনা। ছাত্র-জনতা ঢুকে পড়ে ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে দখল করে রাখা তাঁর গণভবনে। শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটায় তারা। ‘বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা হবে না’ ইত্যাদি কত কথাই না তাঁরা বলতেন! কিন্তু শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ পরিণতি যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা ভেবে উঠতে পারেননি।
শ্রীলঙ্কার গণবিদ্রোহের মূলে ছিল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাজনিত সংকট। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক অনাচারও ছিল মানুষের রাজপথে নেমে আসার কারণ। প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বেরও প্রয়োজন হয়নি সে ক্ষেত্রে। মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি ঝুলে থাকা দাবি নিয়ে সরকার অতিচালাকি ও বাড়াবাড়ি করায় পরিস্থিতি ঘোলা হতে হতে শেষে ঘটনাটি চলে যায় সরকার পতনের দিকে।
আর সরকারটি ছিল তিনবারের ভুয়া নির্বাচনে জয়ী এবং অব্যাহত অপশাসনে জনবিচ্ছিন্ন। জনগণকে বিভক্ত ও ভীত করে রাখার নীতি ব্যর্থ হলেই এ ধরনের সরকার বিপদে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সেটাই ঘটে হাসিনা সরকারের ক্ষেত্রে। সরকারটি অবশ্য ওই যাত্রায় বেঁচে যেতে পারত একের পর এক গোঁয়ার্তুমিপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিয়ে সমঝোতায় চলে এলে। সে ক্ষেত্রে এত রক্তক্ষয়ও হতো না। এক পক্ষের রক্তক্ষয় তো বিপরীত পক্ষের রক্তক্ষয় ডেকে আনে। গণ-অভ্যুত্থান সফল, এমনকি তাদের সমর্থনে সরকার গঠনের পরও বেদনাদায়ক সেই অধ্যায় কিন্তু সহজে থামেনি!
কোনো দল বা পক্ষেরই তাই উচিত নয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া কিংবা সেটি চর্চার পথ বন্ধ করে দেওয়া। দেশের মালিক জনগণের ইচ্ছাকে তুচ্ছ করে শেখ হাসিনার দল কেন সেই পথটাই বেছে নিয়েছিল এবং সেখান থেকে ফেরার সুযোগ হাতছাড়া করেছিল ২০১৮ সালে—এর জবাব কী? বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলকে ন্যূনতম সম্মানজনক আসনেও জিততে দেওয়া হয়নি সেই নির্বাচনে। দেশে-বিদেশে সেটি পরিচিতি পায় ‘রাতের ভোট’ হিসেবে। নজিরবিহীন দলীয়করণের শিকার পুলিশের পক্ষ থেকে নাকি ওইভাবে ভোট সেরে ফেলার বুদ্ধি বাতলে দেওয়া হয়েছিল। আর সেটির প্রয়োগ মেনে নেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’! এর ভেতর দিয়ে আন্দোলনের ধারায় গড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগ পুলিশ তথা প্রশাসনে বিলীন হয়ে গিয়েছিল বলেও কথা ওঠে।
অতঃপর ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর শাসন কায়েম হয় আওয়ামী লীগের নামে—যাদের উদগ্র ইচ্ছা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রেখে তার অপব্যবহার করে যাওয়া। ব্যাংক, জ্বালানি, মেগা প্রকল্প ও আইসিটি খাতের ব্যাপক লুণ্ঠনে আমরা এর প্রতিফলন উত্তরোত্তর বেশি করে দেখেছি হাসিনার আমলে। এর বিপরীতে শেষ দুই বছর দেশের সিংহভাগ মানুষ পুড়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আগুনে।
সেই আগুন শেষতক অবশ্য লেগে গিয়েছিল সরকারের পুচ্ছে। গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপশাসনের ধারায় থাকা একটি সরকারের তো এমন পরিণতিই হওয়ার কথা। সেই বিশ্বাস অবশ্য হারিয়ে যাচ্ছিল; কেননা, সরকারটি টিকে যাচ্ছিল বারবার অব্যাহত অপকৌশলে। এ ক্ষেত্রে একটি আঞ্চলিক শক্তিকে ব্যবহার করে ‘সংকট মোকাবিলা’ করতেও তাঁর এতটুকু বাধেনি। জনমনে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং এতে করে কী হতে পারে দলটির পরিণতি, সে বিষয়েও তাদের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা হয়নি পরিলক্ষিত।
হাসিনা সরকারের পতনের পর কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, সেটা নিয়ে অবশ্য নানা মত রয়েছে। বিএনপিসহ মাঠে এখন নানা পক্ষ সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও একটি পক্ষ। তাদের কজন সরকারে আছেন বলে সেটা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। সেনাবাহিনীও এই পরিবর্তনের অংশীজন বলে মনে করা হচ্ছে। এলোমেলো প্রশাসনে তারা করে যাচ্ছে পুলিশের কাজও। জরুরি সংস্কার সেরে ইউনূস সরকার নির্বাচনের পথেই এগোবে বলে প্রতিশ্রুত। এতে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাব বলেই প্রত্যাশা। সেটা কতখানি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কি এতে অংশ নিতে পারবে? তার সহযোগী ১৪ দল আর জাতীয় পার্টি? এদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই প্রশ্নে ‘উদার অবস্থান’ নিতে। এর মধ্য দিয়ে দলটি উঠে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। অথচ বিএনপিকেও মাইনাস করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’ দেশ গড়তে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ! নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এর নেত্রী। এটাই ছিল তাঁর মূল অপরাধ। গণহত্যার দায় তো চেপেছে অনেক পরে। আর এতে যেন অনিবার্যভাবেই জড়াতে হয়েছে তাঁকে! শুভবুদ্ধি লোপ পেলে বুঝি এমনটাই ঘটে থাকে।
এখন এর চড়া মাশুল দিতে হবে হাসিনা গংকে। এর মধ্য দিয়ে জাতি যদি সঠিক দিশা পায়, তাতেই খুঁজতে হবে সান্ত্বনা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেটুকু সংস্কার হবে, সেটা আরও এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার থাকতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর। গণতন্ত্র ও সুশাসনের পক্ষে নেওয়া সংস্কারগুলো টেকসই না হলে কিন্তু চব্বিশের এত আত্মদানের মর্যাদা থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলোকেও বড় করে দেখতে হবে দেশটাকে। শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই যা কিছু অর্জন করতে হবে। এর ক্ষেত্রটি রক্ষা করতে না পারলে কিন্তু হবে না।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
এই নিবন্ধ প্রকাশের পরদিন ৫ নভেম্বর হাসিনা সরকারের পতনের তিন মাস পূর্ণ হবে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি ঘিরে এমন একটা বলদর্পী সরকারের পতনই ঘটে যাবে, সেটা সত্যি বলতে কেউ বিশ্বাস করেনি। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরাও নন। তাঁরা পদত্যাগের ‘এক দফা দাবি’ ঘোষণা করেছিলেন সরকার পতনের মাত্র দুই দিন আগে, ৩ আগস্ট। এর পরদিন আরও বেশি রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে দেশজুড়ে।
আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের ধারাবাহিক ও নিষ্ঠুর দমন অভিযানের জেরে সিরাজগঞ্জের একটি থানায় সেদিন নিহত হন ১৪ জন পুলিশ সদস্য। পরদিনই ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। পরিস্থিতি চলে যায় সরকার টিকে থাকার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত ছাত্র-জনতার বিজয়কে সহজ করে দেয়। ৫ আগস্ট দুপুরের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার। সঙ্গে তাঁর বোন শেখ রেহানাও ছিলেন। কোনো সরকারি বা দলীয় পদে না থাকলেও রেহানার বিরুদ্ধে রয়েছে হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। আর শেখ হাসিনার ওপর শেষতক চাপে ‘গণহত্যা’র অভিযোগও। ইতিমধ্যে এর বিচারও শুরু হয়েছে তাঁরই রেখে যাওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে।
অর্থশাস্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যথার্থই বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার একাগ্র বাসনা দেশে কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা আমরা দেখেছি। শুধু নির্বাচন ঠিকভাবে করলে শেখ হাসিনাকে পালাতে হতো না। তিনি এই দেশেই থাকতে পারতেন।’ এর আগে নব্বইয়েও একটি গণ-আন্দোলন হয় দেশে এবং তাতে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। সেনাশাসক হওয়ায় স্বভাবতই নানা অপকৌশলে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন এইচ এম এরশাদ।
কিন্তু রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ছাত্র-জনতা একত্র হয়ে আন্দোলনে নামলে অনেক কম রক্তক্ষয়ের মধ্যেই তিনি ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের অভিনব উপায়ও বের করা হয়। পদত্যাগ করে দেশেই থাকেন তিনি; পরে জেলে যান। দেশে প্রথমবারের মতো গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয় তাঁর দল। প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে গিয়ে ৩৫টি আসন পায়। এরশাদ জয়ী হন সর্বোচ্চ পাঁচ আসনে। এদিকে, শেখ হাসিনা ছিলেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
২০১৪ এবং এর পরবর্তী নির্বাচনগুলো বাদ দিলেও বলতে হয়, তাঁর নেতৃত্বাধীন দল জয়ী হয়েছিল দুবার—১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে। অথচ তাঁর পরিণতি হলো এরশাদের চেয়েও খারাপ। তাঁর নেতৃত্বাধীন দলটিও হলো চরমভাবে বিপর্যস্ত, সেই সঙ্গে দলের সহযোগী গোষ্ঠীগুলো। টানা তিন মেয়াদে পুলিশসহ প্রশাসনের নজিরবিহীন দলীয়করণ হওয়ায় এরও বড় অংশ পড়েছে চাকরিচ্যুতি, গ্রেপ্তার ও গুরুতর মামলায়। হাসিনা গংয়ের এমন পতন ছিল বলতে গেলে অবিশ্বাস্য।
একের পর এক ভুয়া নির্বাচন করে টিকে যাওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দল কোনো ‘কার্যকর আন্দোলন’ গড়ে তুলতে না পারায় হাসিনা সরকারের এমন ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল যে, তারা অজেয়! ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা অবশ্য প্রমাণ করে দিল—কেউ অজেয় নয়, আর কোনো কিছুই নয় অসম্ভব। এ জন্য অবশ্য নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে যেতে হয়েছে তাদের।
ত্মাহুতি দিতে হয়েছে অকাতরে। কেবল উপর্যুপরি ভুয়া নির্বাচন করে নয়; নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলন দমনের মাধ্যমেও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনীও তাঁর ইচ্ছাপূরণে পুলিশের মতো গুলি চালাক, এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা পরিপালন করা হয়নি। শেষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রীতিমাফিক পদত্যাগেরও সুযোগ পাননি হাসিনা। ছাত্র-জনতা ঢুকে পড়ে ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে দখল করে রাখা তাঁর গণভবনে। শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটায় তারা। ‘বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা হবে না’ ইত্যাদি কত কথাই না তাঁরা বলতেন! কিন্তু শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ পরিণতি যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা ভেবে উঠতে পারেননি।
শ্রীলঙ্কার গণবিদ্রোহের মূলে ছিল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাজনিত সংকট। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক অনাচারও ছিল মানুষের রাজপথে নেমে আসার কারণ। প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বেরও প্রয়োজন হয়নি সে ক্ষেত্রে। মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি ঝুলে থাকা দাবি নিয়ে সরকার অতিচালাকি ও বাড়াবাড়ি করায় পরিস্থিতি ঘোলা হতে হতে শেষে ঘটনাটি চলে যায় সরকার পতনের দিকে।
আর সরকারটি ছিল তিনবারের ভুয়া নির্বাচনে জয়ী এবং অব্যাহত অপশাসনে জনবিচ্ছিন্ন। জনগণকে বিভক্ত ও ভীত করে রাখার নীতি ব্যর্থ হলেই এ ধরনের সরকার বিপদে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সেটাই ঘটে হাসিনা সরকারের ক্ষেত্রে। সরকারটি অবশ্য ওই যাত্রায় বেঁচে যেতে পারত একের পর এক গোঁয়ার্তুমিপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিয়ে সমঝোতায় চলে এলে। সে ক্ষেত্রে এত রক্তক্ষয়ও হতো না। এক পক্ষের রক্তক্ষয় তো বিপরীত পক্ষের রক্তক্ষয় ডেকে আনে। গণ-অভ্যুত্থান সফল, এমনকি তাদের সমর্থনে সরকার গঠনের পরও বেদনাদায়ক সেই অধ্যায় কিন্তু সহজে থামেনি!
কোনো দল বা পক্ষেরই তাই উচিত নয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া কিংবা সেটি চর্চার পথ বন্ধ করে দেওয়া। দেশের মালিক জনগণের ইচ্ছাকে তুচ্ছ করে শেখ হাসিনার দল কেন সেই পথটাই বেছে নিয়েছিল এবং সেখান থেকে ফেরার সুযোগ হাতছাড়া করেছিল ২০১৮ সালে—এর জবাব কী? বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলকে ন্যূনতম সম্মানজনক আসনেও জিততে দেওয়া হয়নি সেই নির্বাচনে। দেশে-বিদেশে সেটি পরিচিতি পায় ‘রাতের ভোট’ হিসেবে। নজিরবিহীন দলীয়করণের শিকার পুলিশের পক্ষ থেকে নাকি ওইভাবে ভোট সেরে ফেলার বুদ্ধি বাতলে দেওয়া হয়েছিল। আর সেটির প্রয়োগ মেনে নেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’! এর ভেতর দিয়ে আন্দোলনের ধারায় গড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগ পুলিশ তথা প্রশাসনে বিলীন হয়ে গিয়েছিল বলেও কথা ওঠে।
অতঃপর ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীর শাসন কায়েম হয় আওয়ামী লীগের নামে—যাদের উদগ্র ইচ্ছা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রেখে তার অপব্যবহার করে যাওয়া। ব্যাংক, জ্বালানি, মেগা প্রকল্প ও আইসিটি খাতের ব্যাপক লুণ্ঠনে আমরা এর প্রতিফলন উত্তরোত্তর বেশি করে দেখেছি হাসিনার আমলে। এর বিপরীতে শেষ দুই বছর দেশের সিংহভাগ মানুষ পুড়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আগুনে।
সেই আগুন শেষতক অবশ্য লেগে গিয়েছিল সরকারের পুচ্ছে। গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপশাসনের ধারায় থাকা একটি সরকারের তো এমন পরিণতিই হওয়ার কথা। সেই বিশ্বাস অবশ্য হারিয়ে যাচ্ছিল; কেননা, সরকারটি টিকে যাচ্ছিল বারবার অব্যাহত অপকৌশলে। এ ক্ষেত্রে একটি আঞ্চলিক শক্তিকে ব্যবহার করে ‘সংকট মোকাবিলা’ করতেও তাঁর এতটুকু বাধেনি। জনমনে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং এতে করে কী হতে পারে দলটির পরিণতি, সে বিষয়েও তাদের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা হয়নি পরিলক্ষিত।
হাসিনা সরকারের পতনের পর কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, সেটা নিয়ে অবশ্য নানা মত রয়েছে। বিএনপিসহ মাঠে এখন নানা পক্ষ সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও একটি পক্ষ। তাদের কজন সরকারে আছেন বলে সেটা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। সেনাবাহিনীও এই পরিবর্তনের অংশীজন বলে মনে করা হচ্ছে। এলোমেলো প্রশাসনে তারা করে যাচ্ছে পুলিশের কাজও। জরুরি সংস্কার সেরে ইউনূস সরকার নির্বাচনের পথেই এগোবে বলে প্রতিশ্রুত। এতে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাব বলেই প্রত্যাশা। সেটা কতখানি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কি এতে অংশ নিতে পারবে? তার সহযোগী ১৪ দল আর জাতীয় পার্টি? এদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই প্রশ্নে ‘উদার অবস্থান’ নিতে। এর মধ্য দিয়ে দলটি উঠে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। অথচ বিএনপিকেও মাইনাস করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’ দেশ গড়তে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ! নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এর নেত্রী। এটাই ছিল তাঁর মূল অপরাধ। গণহত্যার দায় তো চেপেছে অনেক পরে। আর এতে যেন অনিবার্যভাবেই জড়াতে হয়েছে তাঁকে! শুভবুদ্ধি লোপ পেলে বুঝি এমনটাই ঘটে থাকে।
এখন এর চড়া মাশুল দিতে হবে হাসিনা গংকে। এর মধ্য দিয়ে জাতি যদি সঠিক দিশা পায়, তাতেই খুঁজতে হবে সান্ত্বনা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেটুকু সংস্কার হবে, সেটা আরও এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার থাকতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর। গণতন্ত্র ও সুশাসনের পক্ষে নেওয়া সংস্কারগুলো টেকসই না হলে কিন্তু চব্বিশের এত আত্মদানের মর্যাদা থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলোকেও বড় করে দেখতে হবে দেশটাকে। শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই যা কিছু অর্জন করতে হবে। এর ক্ষেত্রটি রক্ষা করতে না পারলে কিন্তু হবে না।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের জনাকয়েক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনকালে বিএনপিসহ অন্য নেতাদের যেভাবে হেলমেট পরিয়ে জেলখানা থেকে আদালতে হাজির করা হতো, এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের একই কায়দায়
১৯ ঘণ্টা আগেপ্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দিন যত যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। প্রশ্নগুলো যে গভীরতর রাজনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট, তা বলাই বাহুল্য। অনেক সময়ই প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে সংবাদ সম্মেলন বা সংবাদ ব্রিফিং করে বিষয়গুলো খোলাসার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও জনমনে আস্থার সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১৯ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
১ দিন আগে