আশিকুর রিমেল
রাজধানীতে দেশের নানা প্রান্তের মানুষের বাস। এই শহরের অলিগলিতে চলতে কানে পড়ে একেক অঞ্চলের ভাষার স্বর। ভাষার মাস, তাই ভাষা নিয়ে ভাবনাটা চলছিল বেশ কয়েক দিন ধরেই। মনে পড়ছিল গ্রামে ফেলে আসা মায়ের মুখের ভাষা। শৈশব, কৈশোরের সব স্মৃতি যে ভাষায় গাঁথা, হাজার কাজের মাঝে ফুরসত মিললেই সে ভাষায় একটু কথা বলার জন্য কার না মন পোড়ে!
এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথে বেরিয়ে ধরা দিল বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ আধার— আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।
গতকাল সোমবার সকালে অফিসে আসার জন্য রিকশায় উঠেছি। অভ্যাসবশত চালকের কাছে জানতে চাইলাম বাড়ি কোথায়? বললেন—গাইবান্দা (গাইবান্ধা)। বৃহত্তর রংপুরে ‘র’ স্বরের বড় আকাল! সে কথা বলতেই হাসিমুখে তিনি স্বীকার করে নিলেন।
ধারণা করলাম, এমন শ্রেণির মানুষের ভাষায় তো দূষণের মাত্রা কম। তাঁর কাছ থেকে প্রায় অক্ষত আঞ্চলিক ভাষার শুনতে পারার আশা নিয়ে আবদার করলাম, এলাকার ভাষায় একটু কথা বলেন তো শুনি। রিকশাচালক মাসুদ মিয়া (৩৮) বললেন, ‘কি কমো কন?’ এরপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই আঞ্চলিক ভাষায় আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন—‘১৫ বসসর হইলো ঢাকাত রিশক্যা চলাই। এটি গ্যারেজের সাতে একটা ঘর ভরা নিয়া থাকি। বউ, বেটা-বেটি গ্রামত থাকে। প্রতি মাসে একবার করি বাড়িত যাই, সপ্তায় সপ্তায় বাড়িত ট্যাকা পাটাই। এলাকার ভাষাত কতা কওয়ার শান্তিই আলাদা বাহে।’
গাইবান্ধা জেলার আঞ্চলিক ভাষায় মাসুদ মিয়ার এই আলাপ, আমার আগ্রহ বাড়িয়েই দিল। ভাবছিলাম অন্য কোনো অঞ্চলের কারও সঙ্গে একটু কথা বলি।
রিকশা থেকে নেমে অফিসের দিকে এগোতেই ভ্রাম্যমাণ পান-সিগারেটের দোকানিকে পেয়ে গেলাম। অশীতিপর বৃদ্ধ। তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করব এমন সময় একজন গ্রাহক এসে বললেন, ‘ওই মামা এখটা রয়্যাল সিগারেঠ দ্যাও।’
শ্রবণ আনন্দের খোরাক তো পেয়ে গেলাম, কিন্তু ভাষাটা কোন অঞ্চলের হতে পারে? অনুমানই ঠিক হলো। সিগারেট কিনতে আসা ওই যুবকের বাড়ি সিলেটে। তাঁর নাম লিটন, বয়স ২২ বছর। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রহরীর কাজ করেন। এই তথ্যগুলো তিনি দিচ্ছিলেন চলিত রীতিতে।
পড়ে আমার আগ্রহ দেখেই শুরু করলেন তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা। কিছু কথার উত্তরে লিটন বললেন—‘আমি যেখানো কাজ করি এখেবারে সিলেডি কুনো লুক নাই। হটাৎ করি কুনো সিলেডি মানুষ ফাইলে কুব বালো লাগে। সিলেডি বাষাই আমার মাতৃবাষা।’
লিটনও বললেন, নিজেদের অঞ্চলের ভাষায় কথা বলার একটা অন্যরকম তৃপ্তি আছে। তিনি এমন কাউকে সব সময় খোঁজেন যে তাঁর প্রাণ খুলে কথা বলার ক্ষুধা মেটাতে পারবেন।
আমার এক বন্ধুর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। এই অঞ্চলের ভাষাটার মধ্যে বৈচিত্র্য একটু বেশিই। আমার অফিস এলাকাতেই সে থাকে। মনে হলো ওর সঙ্গে একটু কথা বলি, তাই অফিসে আসতেই তাঁকে ডেকে নিলাম। যদিও সে পুরোদস্তুর প্রমিত বাংলায় কথা বলে। তবুও ডেকেছি, অনুরোধ শুনে সংকোচ ভেঙে বলতে শুরু করল—‘জীবনে চইলতে যাই বাংলা চলিত ভাষার কথা কনই লাগে। হড়ালেয়ার লাই হেডা শিখসিও। কিন্তু যে ভাষায় কতা কই লেদাকাল কাটসে হেয়ারলাই মায় অইন্য রকম। এলাকাত গেলে অনো হেই ভাষাতই কতা কই। আঁর মাতৃভাষা বাংলা। জন্মের হরতাই যে ভাষায় কতা কইসি হেইডাই আঁর মাতৃভাষা।’
অফিসে ঢুকছিলাম এই বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখা হলো সহকর্মী ঝিলিকের সঙ্গে। বললাম, তোমার বাড়ি তো রংপুরে না? শান্ত প্রকৃতির সেই সহকর্মী স্বভাবসুলভ ছোট্ট উত্তর দিল—‘হ্যাঁ’।
তাকে বললাম, তোমার মাতৃভাষায় কিছু কথা বলো। হেসে দিয়ে আমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে সে বলতে শুরু করল—‘হামার কাছোত হামার অম্পুরের ভাষাই বেশি ভান্নাগে। হামার যদি এলা কন যে ভালো কই কথা কও, হামরা সেটাও কবার পামো। ওটাও হামরা পাই। হামরা ন্যাকাপড়া কচ্চি, হামরা কত কোনা ইংরেজিও জানি।’
একপর্যায়ে ঝিলিক নিজের মনেই বলল, ‘তয় যদি কন, সুন্দর করি মনের কতা কইতে—তাইলে হামার কাছে হামার অঞ্চলের ভাসাত কতা কওয়াই বেশি ভান্নাগে। হামার মাও-বাপ, দাদা-দাদির কাছোত হামরা যেই ভাষা শুনচি, সেই ভাষাই হামার কাছোত বেশি ভান্নাগে। আঞ্চলিক হউক আর প্রমিত ভাষা হউক ভাষা তো ভাষাই হয় নাকি? সউগে বাংলা ভাষা, হামার প্রাণের ভাষা।’
ঝিলিকের কথায় স্পষ্ট, রংপুরের ভাষায় ‘র’ স্বরের বড় অভাব! তবে এ পর্যন্ত আলাচারিতায় যেই উপলব্ধি হলো সেটি হলো— আমাদের সব অঞ্চলের ভাষা সত্যিই সুন্দর। এইটুকু দেশে ভাষার এত বৈচিত্র্য, সবই মধুর!
রাজধানীতে দেশের নানা প্রান্তের মানুষের বাস। এই শহরের অলিগলিতে চলতে কানে পড়ে একেক অঞ্চলের ভাষার স্বর। ভাষার মাস, তাই ভাষা নিয়ে ভাবনাটা চলছিল বেশ কয়েক দিন ধরেই। মনে পড়ছিল গ্রামে ফেলে আসা মায়ের মুখের ভাষা। শৈশব, কৈশোরের সব স্মৃতি যে ভাষায় গাঁথা, হাজার কাজের মাঝে ফুরসত মিললেই সে ভাষায় একটু কথা বলার জন্য কার না মন পোড়ে!
এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথে বেরিয়ে ধরা দিল বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ আধার— আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা।
গতকাল সোমবার সকালে অফিসে আসার জন্য রিকশায় উঠেছি। অভ্যাসবশত চালকের কাছে জানতে চাইলাম বাড়ি কোথায়? বললেন—গাইবান্দা (গাইবান্ধা)। বৃহত্তর রংপুরে ‘র’ স্বরের বড় আকাল! সে কথা বলতেই হাসিমুখে তিনি স্বীকার করে নিলেন।
ধারণা করলাম, এমন শ্রেণির মানুষের ভাষায় তো দূষণের মাত্রা কম। তাঁর কাছ থেকে প্রায় অক্ষত আঞ্চলিক ভাষার শুনতে পারার আশা নিয়ে আবদার করলাম, এলাকার ভাষায় একটু কথা বলেন তো শুনি। রিকশাচালক মাসুদ মিয়া (৩৮) বললেন, ‘কি কমো কন?’ এরপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই আঞ্চলিক ভাষায় আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন—‘১৫ বসসর হইলো ঢাকাত রিশক্যা চলাই। এটি গ্যারেজের সাতে একটা ঘর ভরা নিয়া থাকি। বউ, বেটা-বেটি গ্রামত থাকে। প্রতি মাসে একবার করি বাড়িত যাই, সপ্তায় সপ্তায় বাড়িত ট্যাকা পাটাই। এলাকার ভাষাত কতা কওয়ার শান্তিই আলাদা বাহে।’
গাইবান্ধা জেলার আঞ্চলিক ভাষায় মাসুদ মিয়ার এই আলাপ, আমার আগ্রহ বাড়িয়েই দিল। ভাবছিলাম অন্য কোনো অঞ্চলের কারও সঙ্গে একটু কথা বলি।
রিকশা থেকে নেমে অফিসের দিকে এগোতেই ভ্রাম্যমাণ পান-সিগারেটের দোকানিকে পেয়ে গেলাম। অশীতিপর বৃদ্ধ। তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করব এমন সময় একজন গ্রাহক এসে বললেন, ‘ওই মামা এখটা রয়্যাল সিগারেঠ দ্যাও।’
শ্রবণ আনন্দের খোরাক তো পেয়ে গেলাম, কিন্তু ভাষাটা কোন অঞ্চলের হতে পারে? অনুমানই ঠিক হলো। সিগারেট কিনতে আসা ওই যুবকের বাড়ি সিলেটে। তাঁর নাম লিটন, বয়স ২২ বছর। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রহরীর কাজ করেন। এই তথ্যগুলো তিনি দিচ্ছিলেন চলিত রীতিতে।
পড়ে আমার আগ্রহ দেখেই শুরু করলেন তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা। কিছু কথার উত্তরে লিটন বললেন—‘আমি যেখানো কাজ করি এখেবারে সিলেডি কুনো লুক নাই। হটাৎ করি কুনো সিলেডি মানুষ ফাইলে কুব বালো লাগে। সিলেডি বাষাই আমার মাতৃবাষা।’
লিটনও বললেন, নিজেদের অঞ্চলের ভাষায় কথা বলার একটা অন্যরকম তৃপ্তি আছে। তিনি এমন কাউকে সব সময় খোঁজেন যে তাঁর প্রাণ খুলে কথা বলার ক্ষুধা মেটাতে পারবেন।
আমার এক বন্ধুর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। এই অঞ্চলের ভাষাটার মধ্যে বৈচিত্র্য একটু বেশিই। আমার অফিস এলাকাতেই সে থাকে। মনে হলো ওর সঙ্গে একটু কথা বলি, তাই অফিসে আসতেই তাঁকে ডেকে নিলাম। যদিও সে পুরোদস্তুর প্রমিত বাংলায় কথা বলে। তবুও ডেকেছি, অনুরোধ শুনে সংকোচ ভেঙে বলতে শুরু করল—‘জীবনে চইলতে যাই বাংলা চলিত ভাষার কথা কনই লাগে। হড়ালেয়ার লাই হেডা শিখসিও। কিন্তু যে ভাষায় কতা কই লেদাকাল কাটসে হেয়ারলাই মায় অইন্য রকম। এলাকাত গেলে অনো হেই ভাষাতই কতা কই। আঁর মাতৃভাষা বাংলা। জন্মের হরতাই যে ভাষায় কতা কইসি হেইডাই আঁর মাতৃভাষা।’
অফিসে ঢুকছিলাম এই বিষয়গুলো ভাবতে ভাবতেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখা হলো সহকর্মী ঝিলিকের সঙ্গে। বললাম, তোমার বাড়ি তো রংপুরে না? শান্ত প্রকৃতির সেই সহকর্মী স্বভাবসুলভ ছোট্ট উত্তর দিল—‘হ্যাঁ’।
তাকে বললাম, তোমার মাতৃভাষায় কিছু কথা বলো। হেসে দিয়ে আমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে সে বলতে শুরু করল—‘হামার কাছোত হামার অম্পুরের ভাষাই বেশি ভান্নাগে। হামার যদি এলা কন যে ভালো কই কথা কও, হামরা সেটাও কবার পামো। ওটাও হামরা পাই। হামরা ন্যাকাপড়া কচ্চি, হামরা কত কোনা ইংরেজিও জানি।’
একপর্যায়ে ঝিলিক নিজের মনেই বলল, ‘তয় যদি কন, সুন্দর করি মনের কতা কইতে—তাইলে হামার কাছে হামার অঞ্চলের ভাসাত কতা কওয়াই বেশি ভান্নাগে। হামার মাও-বাপ, দাদা-দাদির কাছোত হামরা যেই ভাষা শুনচি, সেই ভাষাই হামার কাছোত বেশি ভান্নাগে। আঞ্চলিক হউক আর প্রমিত ভাষা হউক ভাষা তো ভাষাই হয় নাকি? সউগে বাংলা ভাষা, হামার প্রাণের ভাষা।’
ঝিলিকের কথায় স্পষ্ট, রংপুরের ভাষায় ‘র’ স্বরের বড় অভাব! তবে এ পর্যন্ত আলাচারিতায় যেই উপলব্ধি হলো সেটি হলো— আমাদের সব অঞ্চলের ভাষা সত্যিই সুন্দর। এইটুকু দেশে ভাষার এত বৈচিত্র্য, সবই মধুর!
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শ্রমজীবীদের হাটে জড়ো হন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা এই হাটে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। তবে দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষ
২৬ অক্টোবর ২০২৪ফেলুদার দার্জিলিং জমজমাট বইয়ে প্রথম পরিচয় দার্জিলিংয়ের সঙ্গে। তারপর অঞ্জন দত্তের গানসহ আরও নানাভাবে হিল স্টেশনটির প্রতি এক ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই প্রথমবার ভারত সফরে ওটি, শিমলা, মসুরির মতো লোভনীয় হিল স্টেশনগুলোকে বাদ দিয়ে দার্জিলিংকেই বেছে নেই। অবশ্য আজকের গল্প পুরো দার্জিলিং ভ্রমণের নয়, বরং তখন পরিচয়
২৩ অক্টোবর ২০২৪কথায় আছে না—‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি...
২৬ মে ২০২৪প্রতিদিন ভোরে ট্রেনের হুইসেলে ঘুম ভাঙে রাকিব হাসানের। একটু একটু করে গড়ে ওঠা রেলপথ নির্মাণকাজ তাঁর চোখে দেখা। এরপর রেলপথে ট্রেন ছুটে চলা, ট্রেন ছুঁয়ে দেখা—সবই হলো; কিন্তু এখনো হয়নি চড়া। রাকিবের মুখে তাই ভারতীয় সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বিখ্যাত গান। ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪