বাংলাদেশে আমার আর ফেরা হবে না

নাজিম আল শমষের, ঢাকা
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৩, ১০: ৪৭
Thumbnail image

আজ ভোরে বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন পল স্মলি। তাঁর সম্ভাব্য গন্তব্য মালদ্বীপ। সাত বছরে দুই মেয়াদে কাজ করা বাফুফের এই ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে নিয়ে আছে অনেক সমালোচনা আর বিতর্ক। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগে সব প্রশ্নের জবাব দিতে গতকাল চারজন সাংবাদিককে ডেকেছিলেন স্মলি। সেখানে ছিলেন আজকের পত্রিকার নাজিম আল শমষেরও। স্মলির সঙ্গে কথোপকথন থাকল এখানে—

প্রশ্ন: বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের পদ থেকে আপনার সরে দাঁড়ানোর কারণ যদি ব্যাখ্যা করতেন। 
পল স্মলি: বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে তিন-চার সপ্তাহ ধরে এ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। ফিফা থেকে বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে নিষিদ্ধ করার পর আমি হতাশা থেকে বাফুফেকে কয়েকটি বিষয় পরিবর্তন করতে বলেছিলাম। যেমন সারা দেশে ফুটবলের উন্নয়ন নিয়ে ফেডারেশনের যে অবস্থান...আমার মতে কিছু কিছু বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনতেই হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সভাপতি সিদ্ধান্ত দিতে সময় নিচ্ছিলেন। তখন আমার মনে হলো, এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো। গতকাল (পরশু) সভাপতিকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। সভাপতি অবশ্যই আমাকে থেকে যেতে বলেছেন। এখানে অনেক ইতিবাচকতাই আছে। কিন্তু দিন শেষে সবকিছুই বৃথা যেত। যেমন টেকনিক্যাল বিভাগের পুরো কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। ফেডারেশনের সব কটি বিভাগের কাজের মানসিকতায় পরিবর্তন করতে হবে। লিগের দলগুলোকে একাডেমি করতে হবে। তরুণ ফুটবলার তুলে আনার দায়িত্বটা তাদেরই নিতে হবে। কোচ, খেলোয়াড়, জামাল-সাবিনা, ফেডারেশনের কর্মকর্তারা আমাকে যে সমর্থন দিয়েছেন, সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে, এখন সরে দাঁড়ানোর সময়। 

প্রশ্ন: টেকনিক্যাল বিভাগে কী সমস্যা ছিল? 
স্মলি: আমাদের অনেক জনবলের দরকার ছিল, যারা ঢাকার বাইরে জেলা-বিভাগগুলোতে ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করবে। বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় ইচ্ছা থাকার পরও আমরা ঢাকার বাইরে দেশজুড়ে ফুটবলের কারিগরি দিক ও অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারিনি। সভাপতি আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। বলেছেন, আমরা যা করতে পারিনি, ভবিষ্যতে সেটা অবশ্যই করার চেষ্টা করব। আর ফেডারেশন এই কাজটা করতে পারেনি মূলত প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায়। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। কারণ, জাতীয় দল সাফল্য পাচ্ছে। একাডেমির মেয়েরা দেশকে সাফ এনে দিয়েছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, উন্নয়নের ইচ্ছাকে একটু ভিন্নভাবে পরিচালনা করতে হবে। 

প্রশ্ন: টেকনিক্যাল বিভাগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কি ঠিকঠাক কাজ করতেন না? 
স্মলি: আমাদের টেকনিক্যাল বিভাগে সঠিক কোনো কাঠামোই ছিল না। হ্যাঁ, আমি ছিলাম, আরও কয়েকজন ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় আমাদের বিশেষ কিছু পদের দরকার ছিল। আমার দায়িত্ব বৈচিত্র্যে ভরা ছিল। আমি একাডেমির সঙ্গে কাজ করেছি, মেয়েদের একাডেমির সঙ্গে ছিলাম। ছেলে-মেয়েদের বয়সভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন দলের সঙ্গেও কাজ করেছি। এখন যেখানে আছি, আমাদের সেখান থেকে এগোতে হবে। সেটা করতে হলে আমাদের পর্যাপ্ত মানবসম্পদের দরকার হবে। এসব ছাড়া এগোনো সম্ভবই হবে না। 

প্রশ্ন: বেতন-ভাতা নিয়ে কি কোনো সমস্যা ছিল? 
স্মলি: আমি বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো কথাই বলিনি। আপনাদের কয়েকজন সাংবাদিক সহকর্মী প্রতিবেদন করেছেন যে আমি কৌশলে বেতন বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। এমনটা মোটেও ঘটেনি। আমি সভাপতির সঙ্গে যা নিয়ে সব সময় বলেছি, সেটা হলো কীভাবে ফেডারেশনের আরও উন্নতি করা যায়, কীভাবে নারী-পুরুষ জাতীয় দলকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়া যায়। কীভাবে আমরা একাডেমির উন্নয়ন করতে পারি, কীভাবে কোচদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে পারি। 

প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, নারী দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের সঙ্গে আপনার সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক। এটা নিয়ে কী বলবেন? 
স্মলি: অভিযোগ? এটা কিন্তু গুরুতর একটা শব্দ! মোটেও এমনটা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ ভুল ও অসত্য অভিযোগ। তাঁর (ছোটন) সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের মতো। সব দলের সঙ্গেই আমি সহায়ক একজন ব্যক্তির মতো কাজ করেছি। আপনারা সবাই জানেন, বয়সভিত্তিক ফুটবলে আমার ভূমিকা কেমন ছিল। আমি জানি না, তিনি আমার সম্পর্কে কী বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার মোটেও এমন সম্পর্ক ছিল না। 

প্রশ্ন: আপনি নাকি বাফুফের পেশাদারি নিয়ে হতাশ ছিলেন? এটা কি আপনার সরে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ? 
স্মলি: আমি কোথাও অপেশাদার শব্দটা ব্যবহার করিনি। ফেডারেশনের কোথায় কোন পরিবর্তনটা প্রয়োজন, সেটা সব সময় বলার চেষ্টা করেছি। আমার কী কী চাহিদা ছিল, সেটা আপনাদের আগেই বলেছি। ফিফার প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে। আমি সেসব বিষয় পরিবর্তন করে যেটা করণীয় দরকার ছিল, সেটাই করতে চেয়েছি। সভাপতি আমাকে বলেছেন, তোমার কথা ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে এসব এখনই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তখনই আমি বলেছি, ঠিক আছে, আমি তাহলে সরে যাচ্ছি। 

প্রশ্ন: আবু নাঈম সোহাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর সালাউদ্দিনকে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন? 
স্মলি: ফিফা আর্থিক অনিয়ম নিয়ে যেসব অভিযোগ করেছে, সেসব নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, ফেডারেশনে পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকাভিত্তিক ফুটবল থেকে খেলাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। কীভাবে ভালো খেলোয়াড় নির্বাচন করতে হবে, সেটাও আমাদের চিন্তায় ছিল। 

প্রশ্ন: বাফুফের সদস্যরা কি কখনো আপনার কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে? তাঁদের সমালোচনা সম্পর্কে কী বলবেন? 
স্মলি: না, কোনো সমস্যা হয়নি। হয়তো কিছু সমালোচনা ছিল, তবে মেনে নিয়েই কাজ করেছি। যেসব সমালোচনা ইতিবাচক ছিল, সেসব আমি মাথা পেতেই নিয়েছি। এটা অনেক সময় উপকারই করেছে। এসব সমালোচনা থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় ছিল। আমার চুক্তিতেই বলা ছিল, আমি সরাসরি সভাপতির অধীনে কাজ করব। কমিটির কাছে আমার কোনো জবাবদিহি ছিল না। 

প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, আপনি এএফসি প্রো লাইসেন্সে কোচিংয়ে মাত্র একজনকে উত্তীর্ণ করিয়েছেন। বড় কয়েকটি নাম এখন পর্যন্ত আটকে আছে। কয়েকজন উত্তীর্ণই হতে পারেননি। যাঁরা আটকে আছেন, আপনি চলে গেলে তাঁদের কী হবে? 
স্মলি: প্রথমে বলি, যা হয়েছে, সেটা পেশাদারিভাবেই হয়েছে। আরেকটি বিষয় বলি, এ বিষয়ে কিছু ভুল ও নেতিবাচক প্রতিবেদন হয়েছে। যাঁরা দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন, তাঁদের সমান চোখেই দেখা হয়েছে। এএফসি-ফিফার নির্দেশনায় বলাই আছে, লাইসেন্স পেতে হলে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। আমি বা আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা ফিফার নির্দেশনা মেনেই করেছি। 

প্রশ্ন: চলে যাওয়ার মুহূর্তে বাফুফের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ? 
স্মলি: আমি আমার পরিকল্পনাগুলো রেখে যাচ্ছি। কোথায় কোথায় পরিবর্তন করতে হবে, সেটা আমি সভাপতিকে বলে গেছি। যদি এসব বিষয়ে পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে আপনারা যেমন ফুটবল দেখতে চান, তেমন ফুটবল দেখা সত্যিই কঠিন। জিততে হলে, উন্নতি করতে হলে এসব পরিবর্তন সত্যিকার অর্থে জরুরি। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কি আর ফেরার সম্ভাবনা আছে? 
স্মলি: কোথায় যাচ্ছি, সেটা এখনই বলতে চাইছি না। বাংলাদেশে দারুণ সময় কাটিয়েছি। তবে বলতেই হচ্ছে, বাংলাদেশে আমার আর ফেরা হবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত