Ajker Patrika

বড় শিরোপা জেতার এখনই সময়

মাশরাফি বিন মুর্তজা
আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৩: ৪৬
বড় শিরোপা জেতার এখনই সময়

আমাদের একটা স্পোর্টিং নেশন হয়ে উঠতে হলে অনেক কিছুতে উন্নতি করতে হবে। যদি সংক্ষেপে বলি,  সবার আগে পেশাদার হতে হবে। খেলোয়াড়,  অ্যাথলেটরা ভালো করছে। অনেক জায়গায় নারী ফুটবল ভালো করতে শুরু করেছে। ক্রিকেট একটা জায়গায় এসেছে। আগে হকি ভালো করেছে। অলিম্পিক সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। এখানে ভালো করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এখানে ফ্যাসিলিটিজ বা সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এটা বাড়লে ফল পেতে থাকবেন। যেহেতু আমি ক্রিকেটের মানুষ, এখানে আলোচনাটা ক্রিকেট নিয়েই থাকুক।

ক্রিকেট যেভাবে বড় হয়ে উঠেছে
এখানে দর্শকের ভূমিকা বিরাট। শুরুর দিকে ক্রিকেটে তো ওভাবে সাফল্য ছিল না। অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি। এখানে দর্শককে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে। তারা এই খেলার সঙ্গে ছিল বলেই ক্রিকেট এত দূর এসেছে। ফুটবলেও কিন্তু প্রচুর দর্শক আছে। গ্রামগঞ্জে যেকোনো জায়গায় দেখেন, একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হলে কতসংখ্যক দর্শক হয়। বিশ্বের বিভিন্ন ক্লাব দেখুন, কী ফ্যাসিলিটিজ তাদের। আমাদের জায়গা পাওয়া নিয়ে সমস্যা আছে। তবু যে করেই হোক ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে হবে। এটা বাড়লে খেলায় উন্নতি হবে। ক্রিকেটে যতটুকু হয়েছে, ফ্যাসিলিটিজ বাড়ানোর কারণেই। বাইরের দিকে যদি তাকাই, আমাদের আরও বাড়ানো উচিত ক্রিকেট, ফুটবল—সব খেলাতেই। অলিম্পিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শর্টকাটে ভালো ফল আশা করলে হবে না। ভালো ফল সব সময়ই দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা সব সময়ই ছোট ছোট প্রকল্পে এগোই। মানুষকে ধৈর্যও রাখতে হবে। রাতারাতি ফল আশা করলে হবে না।  

ঢাকাকেন্দ্রিক দেশের ক্রিকেট
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আমাদের যেসব প্রতিভাবান ক্রিকেটার উঠে আসে, একে আমি বলব ‘ঠুকো উঠে আসা’। আমাদের সৌভাগ্য যে ঠুকো কিছু খেলোয়াড় আমরা পেয়ে যাই। আছে না, একজন খেলোয়াড়কে তৈরি করে আনা। প্রাকৃতিকভাবে যখন আমরা একজন লেগ স্পিনার পাচ্ছি না, তখন তৈরি করতে হবে। আর এটা করতে হলে ক্রিকেটের সুযোগ-সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। ধরুন, খুলনার যে খেলোয়াড় আছে, তাদের জন্য খুলনার স্টেডিয়াম সব সময় তৈরি রাখা। ওখানে প্রশিক্ষণের সব সুযোগ দেওয়া যেমন—জিম, ট্রেনার রাখা। বিসিবির বেতনভুক্ত জনবল থাকবে ক্রিকেটীয় কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে। যারা জাতীয় দলের বাইরে আছে, যারা পাইপলাইনে আছে, তারা যেন নিজের এলাকায় নিজেদের কাজটা করতে পারে। জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে যে কোচরা আছেন, তাঁদের কাজ দিয়ে দেওয়া যে খেলোয়াড়দের এভাবে তত্ত্বাবধান করবেন। ঠিক সময়ে প্র্যাকটিস কিংবা অন্যান্য কাজ কীভাবে করছে, সে সব ফলোআপ করা। এগুলো চাইলেই করা যায়। ভারতে দেখুন, রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটকাঠামো কত শক্তিশালী। রাজ্যভিত্তিক কত বড় টুর্নামেন্ট খেলে তাদের ক্রিকেটাররা। আমাদের সাতটা বিভাগের অধীনে কত জেলা। বিভাগীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়নরা যদি জাতীয় পর্যায়ে আসে, তাহলে তো পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেট অন্য উচ্চতায় চলে যায়। এই কাজগুলো বিসিবি ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়।

টেস্টে এখনো হোঁচট খাওয়া
একাধিকবার আমার হাঁটুর অস্ত্রোপচার করাতে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হয়েছে। সেখানে বাবু ভাইয়ের (অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ইকরাম বাবু) কাছেই থেকেছি। তাঁর ছেলেটা স্কুল ক্রিকেট খেলে। সেখানে দেখেছি, স্কুল ক্রিকেটেই বাচ্চারা দুই দিনের ম্যাচ খেলে। এই পর্যায়েই তারা সাদা ও লাল বলের ক্রিকেট খেলছে। স্কুল ক্রিকেট থেকেই তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘টেস্ট ক্রিকেটই হচ্ছে মাদার ক্রিকেট’। সেভাবেই একজন খুদে ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে। তাহলে চিন্তা করুন, তারা কোথায় আর আমরা কোথায়।  

তিন অধিনায়কের বাংলাদেশ
যে তিন অধিনায়ক এখন বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম অভিজ্ঞ দলই এখন আমরা। খেলোয়াড় ধরে ধরে যদি বয়সও দেখেন, তাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার দেখেন, এখন বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দলই আমরা। একটা বড় শিরোপা জেতার এখনই সময়। আরও বড় দিকে এগোনোর সময়। টেস্ট ক্রিকেটে আমরা ২২ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। ২২ বছরে এসে আমাদের আরও ভালো ক্রিকেট খেলা উচিত। এটা আসলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হলে ভালো করা কঠিন। আমাদের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই টেস্ট খেলতে চায় না। আমরা সেভাবে টেস্ট খেলোয়াড় তৈরি করতে পারছি না। ভালো মানের ব্যাটার, বোলার তৈরিই হবে লঙ্গার ভার্সন দিয়ে। যে টেস্ট ক্রিকেট ভালো খেলে, সে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতেও ভালো করবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক,  টি-টোয়েন্টি একটু ভিন্ন ধরনের খেলা। তবে ওয়ানডেতে ভালো করার সুযোগ বাড়বে। ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিসের মতো বোলার তো আর এমনি এমনি জন্ম হয়নি। তাঁদের নিয়ে আমাদের গবেষণা করতে হবে। যারা খেলোয়াড় তৈরি করছে, তাদের উৎস কতটা শক্তশালী, সেটা অনেক বড় ব্যাপার। বাংলাদেশের কয়টা কোচ বিশ্বমানের? আমাদের ভালো মানের ফিজিও নেই, ট্রেনার নেই,  কোচ নেই। সংখ্যা বলছি না, বলছি মানের কথা।

খেলা বেড়েছে, ভালো মানের খেলোয়াড় কম
এক সাকিব আল হাসান, এক মুশফিকুর রহিম, এক তামিম ইকবাল, এক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে আর কত লিখবেন পত্রপত্রিকায়? এভাবে আর কত দিন চলবেন বিশ্ব ক্রিকেটে? পাইপলাইন তো সমৃদ্ধ হতে হবে। বর্তমানে যে সিরিজটা খেলছে বাংলাদেশ, এ ধরনের সিরিজ হারলে কী হয়, সামনে ধরুন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ আছে। এখানে হারলে বিপদ, মূল দলটা ওখানেও পাঠাবেন। এত ভয় থাকলে হবে না। ভারতকে দেখুন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে গেল। যে সিরিজে ওদের বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, জসপ্রিত বুমরা নেই। ওদের মিডিয়া কিংবা দর্শক তো আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তারা কীভাবে পাইপলাইনের খেলোয়াড়দের দিয়ে খেলানোর সাহস পায়? এবং এই দলটাই সিরিজ শেষ পর্যন্ত তাদের ২-২ হয়েছে। ভারত তো গত বছরেই দেখলাম একসঙ্গে দুটো জাতীয় দল করে দুই সংস্করণে ক্রিকেট খেলেছে। ইংল্যান্ড-নেদারল্যান্ডস সিরিজের দিকেই তাকান। ইংল্যান্ড টেস্ট খেলছে। আবার ওদের ওয়ানডে দল কতটা শক্তিশালী, ৪৯৮ রান করে ফেলে। তারা একসঙ্গে টেস্ট ও ওয়ানডের জন্য দুটো দল করছে। এর পরও অনেক খেলোয়াড় স্কোয়াডের বাইরে আছে। তার মানে, তাদের সংস্করণ অনুযায়ী শক্তিশালী দল করে ফেলেছে। তারা কি এটা এক দিনে করেছে? ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ ইংল্যান্ড অধিনায়ক এউইন মরগানের (বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়েছিল) দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমাদের দেশে এই ব্যর্থতার জন্য তাকে কী করা হতো? একবার ভাবুন। একটু ধৈর্যও ধরতে হবে আমাদের। এটা এমনি এমনি হবে না। তারা কিন্তু ওই ব্যর্থতার পর মরগানকে সরিয়ে দেয়নি। তার ওপর আস্থা রেখেছে। মরগান ঠিকই পরের বিশ্বকাপটা জিতেছে। মানুষের কথায় দল করা, নিজস্ব চিন্তায় যদি কিছু না করেন, আমাকে একবার বাংলাদেশ দলে মেন্টর হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো। কথা হচ্ছে, এটা কি আপনাদের মাথা থেকে আসছে? নাকি আইডিয়া চুরি করেছেন? নিজের বুদ্ধি দিয়ে কিছু করুন। সেটা হোক খারাপ। আপনার ভাবনা-পরিকল্পনা যদি বিকাশ না ঘটে, আপনার দলও বিকশিত হবে না। যারা খেলোয়াড় তৈরি করে, তারা যদি সেটআপে না থাকে, তখন ভালো মানের খেলোয়াড় আসবে না। এখানে যদি কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে দেখবেন সেই একইভাবে চলছে। বরং আরও খারাপ হতে পারে। কারণ,  সাকিব-তামিম-মুশফিক একে একে বিদায় নেবে এই সময়ে।

পাঁচ সিনিয়রের পর কী অপেক্ষা করছে
এই সময়ে জস বাটলারের চেয়ে আমাদের তামিমের রেকর্ড অনেক ভালো। তবু তামিমকে আমরা বড় খেলোয়াড় হিসেবে মানতে পারি না কেন জানেন? কারণ, আমরা একটা বিশ্বকাপ জিততে পারিনি। আমরা একটা এশিয়া কাপ জিততে পারিনি। বড় বড় টুর্নামেন্ট জিততে পারিনি। কিন্তু বাটলাররা বড় টুর্নামেন্ট জিতেছে। এ কারণে ওদের একটি-দুটি ইনিংসও আমাদের চোখে লেগে থাকে। তামিমের পাঁচটা ভালো ইনিংস খেলার পর দুটো শূন্য রানে আউট হলে ওই দুটো শূন্য রানই আমাদের চোখে লেগে থাকে। দল ভালো না করলে এককভাবে কখনো বড় খেলোয়াড় হওয়া যায় না। সব মিলিয়ে একটা ভালো দল হতে হলে আপনার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। না হলে নিউজিল্যান্ডে বা যে টেস্ট মাঝেমধ্যে জেতেন, সেই সব ফ্লুক হয়ে থাকবে।

লেখক: সাবেক অধিনায়ক, জাতীয় ক্রিকেট দল ও বর্তমানে সংসদ সদস্য

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত