যেখানে রাতের বেলা রংধনুর দেখা মেলে

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৩ জুন ২০২৩, ১২: ০১
Thumbnail image

রংধনুর সঙ্গে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। বৃষ্টির পর আকাশে এই আশ্চর্য সাত রঙের খেলায় মুগ্ধ হই আমরা। আর দিনের বেলায়ই এই সৌন্দর্য উপভোগের সৌভাগ্য হয় আমাদের। কিন্তু শুনে অবাক হবেন, এর ব্যাতিক্রমও আছে। রাতের বেলায়ও পৃথিবীর কোথাও কোথাও রংধনুর দেখা মেলে।

রাতের বেলায় দেখা যাওয়া এই রংধনু অবশ্য রেইনবোর বদলে মুনবো নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে সরাসরি সূর্যের আলোর বদলে চাঁদের আলো রংধনুর রংগুলোর জোগান দেয়। এ কারণে এটি লুনার রেইনবো বা কোথাও কোথাও হোয়াইট রংধনু বা সাদা রেইনবো নামেও পরিচিত। তবে প্রকৃতিতে এ ধরনের রংধনু সাধারণত দিনের রংধনু বা রামধনুর তুলনায় বিরল। এ ধরনের রংধনু দেখা যাওয়ার জন্য যেসব জায়গা বিখ্যাত, তার উল্লেখযোগ্য জিম্বাবুয়ে ও জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত।

এখন রংধনু সম্পর্কে মোটামুটি আমাদের সবার জানা থাকলেও দু-একটি বিষয়ে জ্ঞানটা একটু ঝালাই করে নেওয়া যাক। সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় নানা পদার্থ যেমন—গ্যাস, ধুলোবালু অতিক্রম করে আসতে হয়। এতে আলো কিছুটা বেঁকে যায়। এই বেঁকে যাওয়াকে বলে আলোর প্রতিসরণ। বৃষ্টির কথা যদি বলি, বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার মনে হলেও কিছু কিছু পানির কণা ঠিকই বাতাসে ভাসতে থাকে। অর্থাৎ বৃষ্টির পর রোদ উঠলেও এ সময় আলো চলার পথে পানির ফোঁটা বা জলীয়বাষ্প থাকে অনেক বেশি। ফলে সূর্যের আলোর প্রতিসরণও বেশি হয়।

মুনবো খুব ভালো দেখা যায় ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের আশপাশে। ছবি: ফেসবুকঅন্য সময় বেঁকে যাওয়াটা খুব বেশি পরিমাণে হয় না বলে আলোর সব রং আলাদাভাবে দেখা যায় না। যে রংটা বেশি বাঁকে, সেটাই দেখতে পাই আমরা। কিন্তু বৃষ্টির পর প্রতিসরণ বেশি হওয়ায় সূর্যরশ্মিতে থাকা সাতটা রং বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লালকে আলাদাভাবে দেখা যায়। অবশ্য রংধনুর জন্য সব সময় বৃষ্টি হওয়া জরুরি নয়, জলপ্রপাতের আশপাশেও পানির কণা ও জলীয় বাষ্পের বেশি উপস্থিতির কারণে রংধনু সৃষ্টি হতে পারে।

এখন মুনবো নামে পরিচিত রংধনুও জলপ্রপাতের জলে আলো পড়েই হয়, আর দিনে সৃষ্টি হওয়া রংধনুর তুলনায় এটি অনেক মৃদু। এর কারণ চাঁদ থেকে কম পরিমাণ আলো প্রতিফলিত হয়। তাই এতে রংগুলো হয় হালকা। এ কারণে রঙের পার্থক্য বোঝাটা দর্শকদের জন্য কঠিনই হয়। অনেক সময় সাদাটে দেখায় এই রং, তাই একে হোয়াইট রেইনবো বা সাদা রেইনবোও বলেন কেউ কেউ। সাধারত পূর্ণিমার আশপাশের সময়, আকাশ যখন মেঘমুক্ত থাকে তখন এই রংধনু বেশি দেখা যায়। সূর্যের বিপরীতে যেমন দিনের রংধনু দেখা যায়, তেমনি রাতের আকাশে চাঁদের বিপরীত দিকে জন্ম হয় এই রংধনুর। 

ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতে রাতের রংধনু তৈরির আদর্শ সময় তৈরির আদর্শ সময় জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস। ছবি: ফেসবুকস্বাভাবিকভাবেই জলপ্রপাতের কাছে এমন রংধনু দেখা সহজ। জলপ্রপাতের পানি কুয়াশার একটি পাতলা পরত তৈরি করে লুনার রংধনু সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে। এ ধরনের রংধনু সাধারণ পর্যটক তো বটেই, আলোকচিত্রীদেরও খুব আরাধ্য জিনিস। 

আগেই বলেছি, এমন রংধনু দেখার জন্য দারুণ এক জায়গা আফ্রিকা মহাদেশের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। পূর্ণিমার সময় জিম্বাবুয়ে কিংবা জাম্বিয়ার বৃষ্টি অরণ্য বা রেইন ফরেস্ট ধরে পৌঁছে যেতে পারবেন জলপ্রপাতের কাছে। ওই সময় সন্ধ্যার পরে মুনবো দেখানোর জন্য ট্যুর কোম্পানিগুলো বিশেষ আয়োজন করে। 

প্রায় ১ হাজার ৭০৮ মিটার চওড়া ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত পৃথিবীর বিখ্যাত জলপ্রপাতগুলোর একটি। আর এতে পানির পতন ঘটে ১০৮ মিটার উচ্চতা থেকে। বুঝতেই পারছেন বিশাল জায়গা নিয়ে ছড়ানো জলপ্রপাতটি থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি পড়ে। এতে জলকণার কারণে সব সময়ই প্রচুর কুয়াশা তৈরি হয়। আর এ কারণেই চন্দ্রালোকিত রাতে এখানে সহজেই জন্ম হয় অসাধারণ এক দৃশ্যের, রাতের রংধনু। মজার ঘটনা জলপ্রপাতটিতে ঘুরতে যাওয়া অনেক পর্যটকই এখানকার এই আশ্চর্য বিষয়টির কথা জানেনই না। 

আকাশ যখন মেঘমুক্ত থাকে তখন এই রংধনু বেশি দেখা যায়। ছবি: জাম্বিয়া ট্যুরিজমএখন আপনার মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, বছরের কোন সময়টা রাতের রংধনু দেখার জন্য উপযোগী? ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রচুর পানি থাকলেও মেঘের আনাগোনা থাকে বেশি। এপ্রিল ও মেতে পানির প্রবাহ থাকে প্রচুর, এটা মুনবোর জন্য ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু এ সময় জলকণার পরিমাণ অত্যধিক থাকায় যে ঘন কুয়াশার পর্দা তৈরি হয় তা কখনো কখনো চাঁদের আলো আসতেই বাধা দেয়। এদিকে শুকনো মৌসুম মানে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে পানি কম থাকায় ভেসে বেড়ানো জলকণাও থাকে কম। ফলে নির্দিষ্ট দু-একটি ভিউ পয়েন্ট ছাড়া রংধনুর দেখা পাওয়া কঠিন। 

মোটের ওপর, রাতের রংধনু সৃষ্টির সব শর্ত মেনে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতে এটি তৈরির আদর্শ সময় হলো জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস। অর্থাৎ, এ সময় পূর্ণিমা ও এর ঠিক আগে-পড়ে জলপ্রপাত এলাকায় হাজির হয়ে গেলেই খুব ভালো সম্ভাবনা অসাধারণ সেই দৃশ্য, মানে মুনবো চাক্ষুষ করার। 

রাতের কোন সময়টায় এর দেখা পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তবে সাধারণত সূর্যাস্তের কয়েক ঘণ্টা পর ও সূর্যোদয়ের দু-তিন ঘণ্টা আগে সম্ভাবনাটা থাকে বেশি। 

জলপ্রপাতের পানি কুয়াশার একটি পাতলা পরত তৈরি করে লুনার রংধনু সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে। ছবি: ফেসবুকএকসময় নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় এ ধরনের রংধনু দেখা ছিল নিয়মিত এক ব্যাপার। তবে এর আশপাশের এলাকায় উন্নয়নের কারণে কৃত্রিম আলো বেড়ে যাওয়ায় এখন এর দেখা পাওয়া ভার। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসমাইট ফলস, হাওয়াইয়ের কিহেই জলপ্রপাত, কাম্বারল্যান্ড জলপ্রপাত ও ওয়াইমিয়া ক্যানিয়ন স্টেট পার্ক, আইসল্যান্ডের স্কোগাফসে চমৎকার মুনবোর দেখা মেলে। 

আবার এ ধরনের মুনবো নিয়মিতই চোখে পড়ে কোস্টারিকার মেঘে ঢাকা অরণ্য ও মন্টেভার্দে কিংবা সান্তা এলেনার মতো পাহাড়ি শহরগুলোতে। ক্যারিবিয়ান সাগর থেকে ভেসে আসা কুয়াশার মেঘ এই মুনবো সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখে। চাঁদের আলোয় তখন আকাশে জন্ম হয় কিছুটা ভিন্ন ধরনের এক মুনবোর। এতে ডোরা ডোরা আলোকছটা ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। স্প্যানিশে যা পরিচিত পেলো দে গেতে (বিড়ালের চুল) নামে। কোস্টারিকার এই অঞ্চলে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি পূর্ণিমা এবং এর আশপাশের সময়ই এই রংধনুর দেখা পাবেন। 

সূত্র: আউটলুক ইন্ডিয়া ডট কম, দ্য আফ্রিকা ইনসাইডার ডট কম, ডিসকভার ভিক্টোরিয়া ফলস ডট কম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত