বহু বাঁকে এক আবৃত্তিশিল্পী

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪, ০৮: ৪৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের এক শেডের নিচে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর অপেক্ষায়। ঘড়িতে তখন বেলা তিনটা ছুঁই ছুঁই। ইনস্টিটিউটের গেট দিয়ে একটা রিকশা ভবনের ছাউনিতে এসে থামল। রিকশা থেকে নামলেন রূপা চক্রবর্তী। তিনি এই ইনস্টিটিউটের একজন সহযোগী অধ্যাপক। বলে রাখা ভালো, তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পীও বটে। যাঁকে এ বছর সম্মানিত করা হয়েছে একুশে পদকে। 

আমরা ঠিক করলাম, কলাভবনের সামনের মাঠে বসে হবে আলাপ। সেই রিকশা চেপেই চলে গেলাম গন্তব্যে। পেছনে হলুদ ফুল আর পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। কোথাও একটা পাখি ডাকছে। আলাপচারিতার শুরুতেই রূপা চক্রবর্তী বললেন, ‘আমি নিজেকে আবৃত্তিশিল্পী বলছি না। আমি আবৃত্তি করতে ভালোবাসি, তাই বলতে পারেন, আমি একজন আবৃত্তিকার।’ আবৃত্তিশিল্পের জন্যই যাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে, এ কথা তাঁর বিনয় বটে। 

সেই সব পুরোনো কথা
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের যে অনুষ্ঠান হয়েছিল সিলেটে, দুই মাস ধরে তার রিহার্সাল হয়েছিল রূপা চক্রবর্তীদের সিলেটের বাড়িতে। সেখানে শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়েছিলেন কলিম শরাফী। ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রাখী চক্রবর্তী। রূপা চক্রবর্তীর বড় ভাই ফুটবল-ক্রিকেট—দুই খেলাতেই ছিলেন পারদর্শী। সিলেটের যে বাড়িতে বড় হয়েছেন, সেখানে বড় কাকার ঘরের দেয়ালজুড়ে ছিল তাঁর হাতে আঁকা ছবি। সেজ কাকা সঞ্জয় মজুমদার ছিলেন সংগীতজ্ঞ সুবিনয় রায়ের ছাত্র। এমন এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকে শিল্পীসত্তা গড়ে উঠেছিল রূপার মধ্যে। ফলে তিনিও যে শিল্পের কোনো না কোনো শাখার চর্চা করবেন, সেটা যেন ধরাই ছিল হিসাবে। 

নতুন মাধ্যম, নতুন প্রচেষ্টা
গোলাম মুস্তাফা, সৈয়দ হাসান ইমাম, আশরাফুল আলম, সেলিনা বাহার জামান, কাজী মদিনার মতো আবৃত্তিশিল্পীরা মঞ্চে আলো ছড়াতেন তখন। সেই সময়, গত শতকের আশির দশক থেকে দলীয়ভাবে আবৃত্তি চর্চা শুরু করেন রূপা। 

১৯৮১ সালে বিটিভির ‘বাংলার মুখ’ নামের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টেলিভিশনে আবৃত্তিজীবনের শুরু রূপা চক্রবর্তীর। আশির দশকের শেষে তিনি আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বনন’-এর মাধ্যমে শিশুদের আবৃত্তি শেখানো শুরু করেন। সংগঠনটি আন্তস্কুল আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ধীরে ধীরে সংগঠনটি বড় হয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ৩৯ বছর পূর্ণ করবে আবৃত্তি সংগঠন স্বনন। দলটি আবৃত্তিশিল্পে স্বাতন্ত্র্য তৈরি করেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’কে বহুভাবে তুলে ধরেছে মানুষের সামনে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত চিঠিও আবৃত্তি করে দলটি। ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশন করেছে জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস। 

বরাবরই আবৃত্তি নিয়ে ভিন্নধর্মী কাজ করেছেন রূপা চক্রবর্তী—সেটা দেশে হোক কিংবা বিদেশে। ২০০৮ সালে লন্ডনে পিএইচডি করতে গিয়ে সেখানকার বাঙালি আবৃত্তিশিল্পীদের সংঘবদ্ধ করেন তিনি। বিদেশের মাটিতে নিজের আবৃত্তির ডুয়েট অ্যালবাম প্রকাশের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে কবিতার সঙ্গে নাচের মেলবন্ধন করেছিলেন তিনি। 

সংকেত সম্পাদনা
লন্ডনে থাকাকালীন নারীদের নিয়ে একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন রূপা চক্রবর্তী। স্বামীর সঙ্গে লন্ডন শহরে গিয়ে সংসার ও সন্তান পালন ছাড়া তেমন কিছুই করতেন না তখনকার লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালি নারীরা। কখনো কোনো আড্ডায় তাঁদের সেসব অভিমানভরা কথা বেরিয়ে আসত। সেসব কথাকেই তিনি গল্প কিংবা কবিতা আকারে লিখতে অনুপ্রাণিত করতেন তাঁদের। অপরিপক্ব হাতের সেই লেখাগুলো জমাতে শুরু করলেন রূপা চক্রবর্তী। পরে লেখাগুলো সম্পাদনা করে ছাপিয়ে দিলেন ‘সংকেত’ নামের পত্রিকায়। এই ত্রৈমাসিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন রূপা চক্রবর্তী। তাতে শুভেচ্ছাবাণী লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। এ ছাড়া নারীরা সেখানে হাতের কাজও করতেন। সেসব কারুপণ্য নিয়ে একপর্যায়ে একটি মেলা করা হয় সেখানে। তার আয়োজনও করেছিলেন রূপা চক্রবর্তী। 

উত্তাল নব্বই
সারা দেশ উত্তাল। স্বৈরাচার হটাও আন্দোলন চলছে। শিল্পীরা নিজেদের জায়গা থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সেই সময় রূপা চক্রবর্তী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সে অবস্থায়ও বসে থাকেননি তিনি। টুল বেয়ে উঠে গেছেন ট্রাকে। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেছেন গলা ছেড়ে। সবাই তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু রূপা ছিলেন অনড়। জানতেন, তাঁর মতো আরও একজন হিমালয়ের মতো দৃঢ়চেতা নারী আছেন—জাহানারা ইমাম। 

কখনো জোয়ার, কখনো ভাটায় চলতে থাকে জীবন। রূপা চক্রবর্তীও তার ব্যতিক্রম নন। সিলেট থেকে ঢাকা, সেখান থেকে লন্ডন। আবৃত্তিই ছিল তাঁর আদরের ধন। বাকি জীবন একে নিয়েই যে কাটবে রূপা চক্রবর্তীর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত