চা ও চা-বাগানের গল্প

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৩, ১১: ০০
আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৬: ০৬

গল্পটা বেশ কয়েক বছর আগের। দুই বন্ধুসহ মৌলভীবাজারের জুড়ি থেকে যাচ্ছিলাম লাঠিটিলার জঙ্গলের দিকে। পথের মাঝামাঝি আসতেই চা-বাগান ঘেরা আশ্চর্য সুন্দর এক জায়গায় আবিষ্কার করলাম নিজেদের। রাস্তা চলে গেছে সেতু হয়ে ছড়ার ওপর দিয়ে। সবুজ টিলায় চা-বাগান, সমতলের ধানি জমি, মাঝখানের এই রাস্তা—সব মিলিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ি সৌন্দর্যে। গাড়িটা ওখানে দাঁড় করাই। বেশ কতকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি জায়গাটিতে। বর্ষায় চা-বাগান এভাবেই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে আমাকে।

আজ ৪ জুন, জাতীয় চা দিবস। তৃতীয়বারের মতো চা দিবস হিসেবে দিনটি উদ্‌যাপিত হচ্ছে দেশে। অবশ্য আন্তর্জাতিকভাবে চা দিবস হিসেবে পালিত হয় ২১ মে তারিখটা। তাই চা, চা-বাগান ও বাগান এলাকায় একসময় ঘুরে বেড়ানো বন্যপ্রাণীদের গল্প বলব আজ। এক কাপ চা হাতে যোগ দিতে পারেন চাইলে আমাদের সঙ্গে।

আবার চা-বাগানের রাজ্যে প্রবেশের আগে চা নিয়ে কয়েকটি তথ্য দিয়ে নিই। কিংবদন্তি অনুসারে চা প্রথম আবিষ্কার করেন চীনা সম্রাট শেন নাং, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে। ওই সময় তাঁর গরম পানির পাত্রে বুনো গাছের কিছু পাতা পড়ে, তিনি যেটি পান করলেন সেটাই চা।

পানিকে বাদ দিলে পৃথিবীতে বেশি পান করা পানীয় চা।পৃথিবীতে কত জাতের চা আছে শুনলে চমকে উঠবেন। সংখ্যাটা আনুমানিক ৩০০০। পানিকে বাদ দিলে এটি হলো পৃথিবীতে বেশি পান করা পানীয়। ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি, হোয়াইট টি, ওলং টি—সব ধরনের চা আসে ক্যামেলিয়া সিনেসিস নামের উদ্ভিদ থেকে। তাদের স্বাদ, চেহারা আর গন্ধে ভিন্নতার কারণ প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা।

চা-বাগানের প্রথম স্মৃতিটা কিন্তু আমার চা-রাজ্য শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জে নয়। নয় সিলেটেও! বরং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। জিপে করে ঘুরেছিলাম ফটিকছড়ির এক চা-বাগানে। তখন বাগানটার কাজ শেষ হয়নি, বড় অংশ নিয়েই জঙ্গল। মুগ্ধ চোখে চা-বাগান দেখার ফাঁকে টি স্টেটের ম্যানেজারের কথা গিলছিলাম। বলছিলেন জঙ্গল সাফ করে বাগান করা হয়েছে। এখনো মায়া হরিণ, ভালুক এমনকি সাম্বারও আছে এই চা-গাছের রাজ্যে। এই কথা শোনার পর চা-গাছের চেয়ে আশপাশের জঙ্গলের দিকেই আমার নজর ছিল বেশি। আহ! একটা ভালুক কিংবা সাম্বারের দেখা যদি পেয়ে যেতাম!

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর চা-বাগানে এক নারী শ্রমিকআমাদের দেশের অনেক চা-বাগানই তৈরি হয়েছে পাহাড়ের মাঝে, জঙ্গল সাফ করে। আবার চা-বাগান লগোয়া জঙ্গলও আগে ছিল অনেক বেশি। কোনো কোনো চা-বাগানের নিজস্ব জঙ্গলের কথাও শুনেছি। একসময় চা-বাগানগুলো তাই ছিল চিতা বাঘসহ নানা বুনো প্রাণের আড্ডাখানা।

আবারও বেশ অনেকগুলো বছর পেছনে চলে যাই। লক্কড়ঝক্কড় এক বাসে চেপে রওনা দিয়েছি। হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার কাছাকাছি ভূপ্রকৃতি বদলে গেল, রাস্তার দুই পাশে গাছপালা, ছোট ছোট টিলা। তার পরই ঢুকে পড়লাম আশ্চর্য সুন্দর এক চা-বাগান এলাকায়। সিজন না, তাই হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে বাগানে কাজ করা এক-দুজন মানুষ। ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ছড়া। তবে বর্ষার মৌসুম না হওয়ায় পানি কম, কোথাও বালুর রাজ্য। বাগানের ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পড়েছে সরু পথ। চা-বাগানের এক নারী কর্মীকে হেঁটে যেতে দেখলাম। বাসে বসেই ইচ্ছা হচ্ছিল হারিয়ে যেতে সুদূরে, ওই মাটির পথ ধরে। পাশে বসা এক বুড়ো আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘এইডা সুরমা চা-বাগান। পাশেরটা সাতছড়ি চা-বাগান।’

মালয়েশিয়ার ক্যামেরন ভ্যালি টি নামের চা-বাগানের মাঝখানে একটি বাংলোচা-বাগানে ভ্রমণ থেকে বের হয়ে আবারও কিছু তথ্য দেওয়া যাক। এখন পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে চা জন্মে। সবচেয়ে বয়স্ক গাছ আছে চীনে, বয়স প্রায় ৩ হাজার ২০০ বছর। পানীয় হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে চা ব্যবহার হতো ওষুধ হিসেবে।  চায়ের পাতা কিন্তু মশা প্রতিরোধে সাহায্য করে। ব্যবহৃত চা-পাতা শুকিয়ে পোড়ালে যে ধোঁয়া হয়, তা মশাকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।

চা-পাতা নিয়ে এবার একটা টিপস। চা-পাতা তার চারপাশের সৌরভ শোষণ করতে পারে। তাই রুম টেম্পারেচারে বায়ুশূন্য একটি পাত্রে চা-পাতা সংরক্ষণ করুন। না হলে আর্দ্রতা শোষণ করে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

গ্রিন টি, ইয়েলো টি, ওলং টি ও ব্ল্যাক টিএবার বরং দেশ ছাড়িয়ে একটু ভিনদেশি চা-বাগানের রাজ্যে ভ্রমণ হয়ে যাক। দার্জিলিংয়ের হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেট, প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ প্ল্যান্টাররা। বছর কয়েক আগে যাওয়া হয়েছিল সুন্দর ওই চা-বাগানে। শুরুতেই চা-বাগানের রেস্তোরাঁয় মজা করে চা পান করেছিলাম। তারপর হাঁটতে শুরু করি বাগানের মাঝখানের সরু, ঢালু পথ ধরে। সিলেট, চট্টগ্রামে চা-বাগান দেখেছি বিস্তর, তবে এর বিশেষত্ব উচ্চতায়, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চা-বাগানগুলোর একটি এটি। ওপর থেকে পাহাড়ের গায়ে বাগানগুলো দেখতে ভারি সুন্দর লাগছিল। এখানে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো কিছু চা-ঝাড় আছে। আমার মেয়ে ওয়াফিকা তো ভারি অবাক, অন্য দেশেও চা-বাগান থাকতে পারে কল্পনাও করেনি। বলল, ‘বাপি, ইন্ডিয়ায়ও চা-বাগান আছে!’

ভারতের বাইরে আর চা-বাগান ভ্রমণ হয়েছে মালয়েশিয়ায়। সেটি ক্যামেরন হাইল্যান্ডের ‘ক্যামেরন ভ্যালি টি’। পাহাড়ের গায়ে সবুজ চা-বাগান, বাগানের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ছড়া আর সবুজের মাঝখানে ছোট্ট এক বাংলো বাড়ি মিলিয়ে অসাধারণ লেগেছিল জায়গাটি। চাও পান করেছিলাম চা-বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে। আরও আনন্দ পাই যখন জানতে পারি বাগানের দুই গার্ডের বাড়ি সিলেটে।

সিলেটের কানাইঘাটের লোভাছড়া চা-বাগান। ছবি: লেখকএবার মালয়েশিয়ার চা-বাগান থেকে চীনের চায়ের গল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি চায়ের একটি চীনের ডা হাং পাও। এই ব্ল্যাক টির দাম একই ওজনের সোনার চেয়ে বেশ কয়েক গুণ। এক গ্রামের জন্য গুনতে হবে ১ হাজার ৪০০ ডলার। কারণ এই চা-পাতা যে গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেগুলো ৩০০ বছরের বেশি বয়সী, জন্মে দুর্গম পাহাড়ে। দামি চায়ের তালিকায় ওপরের দিকে থাকা আরেকটি চা পান্ডা ডাং টি। একে সিভেটের মল থেকে তৈরি বিখ্যাত কপি লুয়াক কফির ‘চা সংস্করণ’ বলতে পারেন। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে চা-পাতার পুষ্টি বাড়াতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় পান্ডার মল। প্রতি পাউন্ড চা-পাতার দাম পড়বে ৩৫ হাজার পাউন্ড।

জঙ্গল-পাহাড় আমার ভারি পছন্দ। তেমনি টানে চা-বাগানও। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, হবিগঞ্জের নয়াপাড়া-সাতছড়ি, সিলেটের জাফলং, লালাখাল, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ির ফটিকছড়ি-মানিকছড়ি, রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কত চা-বাগানে যে ঘুরেছি। চা-বাগানে ঘুরতে গিয়ে এর রূপে মজে গিয়েও কখনো কখনো একটু বিষণ্ন তাও আঁকড়ে ধরে। আহহা, একটা সময় চা-বাগানগুলোয় চিতা বাঘেরা কী মহানন্দে ঘুরে বেড়াত! আসলে তখন চা-বাগানগুলো ঘেঁষেই ছিল গহিন অরণ্য। চিতা বাঘসহ নানা বন্যপ্রাণী বিচরণের জায়গা ছিল চা-বাগান।

দার্জিলিংয়ের হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেটএনায়েত মাওলার ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে মৌলভীবাজারের রত্না ও সাগরনাল চা-বাগান এলাকায় চিতা বাঘ শিকারের রোমাঞ্চকর কাহিনির বর্ণনা মেলে। বাংলাদেশের চা-বাগান থেকে হলুদ-কালোর মিশেলের আশ্চর্য সুন্দর এই প্রাণীরা কি একেবারেই হারিয়ে গেছে? যদি মৌলভীবাজার, সিলেট কিংবা চট্টগ্রামের কোনো চা-বাগানে ঘুরে বেড়ানোর সময় হঠাৎ একটা হাজির হয়ে যেত সামনে! কী মজাটাই না হতো!

বাংলাদেশের বেশির ভাগ চা-বাগানেই এখন আর চিতা বাঘদের দেখা না গেলেও ভারতের অনেক চা-বাগানেই এদের নিয়মিত হাজির হতে দেখা যায়। বছর কয়েক আগে যেমন শুনলাম, দার্জিলিংয়ের ম্যালের মাত্র দুই মাইলের মধ্যে হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেটে চিতা বাঘ দেখা যাওয়ায় রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন বন্যপ্রাণীপ্রেমী পর্যটকেরা। তেমনি ভারতের ডুয়ার্সের চা-বাগান রাজ্যেও আনাগোনা আছে চিতা বাঘেদের।

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি চাগুলোর একটি চীনের ডা হাং পাওঅন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা চা-বাগানে পা পড়েছে আমার। এর মধ্যে সবচেয়ে পছন্দের চা-বাগান বাছতে দিলে বিপদে পড়ব। তবে শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জে যাওয়ার লাউয়াছড়ার পথটা না ধরে চা-বাগান রাজ্যের  নুরজাহান টি স্টেটের ভেতরের পথটা যদি ধরেন, মুগ্ধ হয়ে যাবেন সন্দেহ নেই। শ্রীমঙ্গলে গেলে ওই পথ দিয়ে একবার যাওয়া চাই আমার। লালাখাল চা-বাগানটার কথাও বড় বেশি মনে পড়ছে। তেমনি সিলেটের কানাইঘাটের লোভাছড়া চা-বাগান, মৌলভীবাজারের জুড়ির চা-বাগানগুলো কোনটা রেখে কোনটার কথা বলব। আবার সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার পথে দুই পাশে যে চায়ের রাজ্যকে রেখে যেতে হয়, সেগুলোরও জুড়ি মেলা ভার। উনিশ শতকের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠিত সিলেটের মালনীছড়া কিংবা তার কাছের লাক্কাতুরা চা-বাগানের কথাও বা কীভাবে ভুলি!

কমলগঞ্জের একটি চা-বাগানভোর হয়েছে সাজেকের পাহাড়রাজ্যে। রিসোর্টের বারান্দাটা এমন, মনে হয় যেন পাহাড়ের ওপর ঝুলে আছে। ওখানে বসে বসে মিজোরামের পাহাড়রাজ্য দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম আমাদের কাসালং-সাজেক আর ওদিকে ডাম্পা টাইগার রিজার্ভসহ ভারতের  মিজোরাম অংশ মিলিয়ে এখনো কি দুই-চারটি বাঘ টিকে আছে? হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই দেখলাম রিসোর্টে চাকরি করা মারমা তরুণ দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা দুটো চায়ের কাপ। তারপর, হাতে কাপটা নিয়ে চলে এলাম বারান্দায়। মেঘের রাজ্যে গরম ধোঁয়া ওঠা চা পান করতে করতে বুঁদ হয়ে গেলাম রহস্যময় পাহাড়রাজ্য দর্শনে। আসলেই চা এমন এক পানীয়, যা আপনার শরীর-মন দুটিকেই চনমনে করে দেবে।

সাজেকের রিসোর্টে এক কাপ চাকী পাঠক, লেখাটি পড়ে চায়ের তৃষ্ণা পেয়ে বসেছে? একটু পরেই হয়তো আপনার হাতে থাকবে এক কাপ চা, আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে শুরু করবেন চা-বাগান ভ্রমণের পরিকল্পনা!

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত