জাহীদ রেজা নূর
ভাষা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। একজন অসাধারণ সংগঠক হিসেবে বন্ধুদের শ্রদ্ধা-আস্থাও অর্জন করেছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মোহাম্মদ সুলতানের কীর্তির যে সন্ধান পেয়েছি, তা অনন্য। প্রগতিশীল এই মানুষকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন—
১.১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির গভীর রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি, যেখানে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২.২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের নাম লিখে রাখার দায়িত্ব পালন এবং স্কুলের ছাত্রদের সংগঠিত করে সভা প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা।
৩.২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের একজন হওয়া।
৪.১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশক হওয়া।
ভাষা আন্দোলনের মূল রূপকারদের একজন হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ সুলতানকে কখনোই রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি। একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের স্থান হলেও মোহাম্মদ সুলতান থেকেছেন ব্রাত্য হয়ে। অথচ মোহাম্মদ সুলতান হচ্ছেন সেই বিরল প্রজাতির মানুষ, যাদের পুরো জীবন কেটেছে সংগ্রামে সংগ্রামে। প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যাঁরা ব্যক্তিগত জীবনকেও উপেক্ষা করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বসে আসলে গত শতাব্দীর আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সংগ্রামকে অনুভব করা যাবে না। নতুন যুগের মানুষ সেই সময়টিকে ইউটোপিয়া বলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। নতুন প্রজন্মের কাছে রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, মার্কস, লেনিন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, চে গুয়েভারা, কিউবা বিপ্লব ইত্যাদি আর অনুপ্রেরণার আধার নয়। তাই মোহাম্মদ সুলতানের আত্মত্যাগকে অনেকেই অকারণ হাস্যকর বিভ্রান্তি বলে মনে করতে পারে। মনে করতে পারে মরীচীকার পেছনে ছুটে জীবন নষ্ট করেছেন তিনি। অথচ বিগত শতাব্দীর সাতটি দশক সারা পৃথিবীর প্রগতিশীল মানুষের স্বপ্নই ছিল শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার। তিনি ছিলেন সে স্বপ্নপূরণের এক অদম্য সৈনিক।
এ কথা নিশ্চয় নতুন নয় যে,১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে ওঠার কিছুকালের মধ্যেই পাকিস্তানে ভাষা প্রসঙ্গটি বড় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কার্জন হলের ছাত্রসভায়ও একই কথা উচ্চারণ করেন তিনি। ঢাকার ছাত্র-জনতা এই ঘোষণা মেনে নেয়নি। তারা ‘নো’ ‘নো’ বলে তখনকার ‘কায়েদে আজম’-এর ঘোষণার প্রতিবাদ করে। মোহাম্মদ সুলতান তখন রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ছেন। ১১ মার্চ রাজশাহীতে যারা মিছিল, সভা ও ধর্মঘট পালনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। তবে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহীতে এলে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয় এবং স্লোগান তোলা হয়, ‘গো ব্যাক লিয়াকত আলী’।
১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৪৮ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ ছিল। এর আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন নামেই খ্যাতি পেয়েছেন তিনি)। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে প্রগতিশীল একটি সংগঠনের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান হন তার যুগ্ম সম্পাদক। ভাষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন যখন আবার উর্দুর পক্ষে কথা বলেন, তখন শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের নতুন পর্যায়। এ সময়টিকে ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বদরুদ্দীন উমর। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের পক্ষ থেকে সে সভায় প্রতিনিধিত্ব করেন মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রশ্ন ওঠে, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেওয়া হবে কি-না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে রাখলে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জনের বৈঠকের কথাটি বলা হচ্ছে, তার গুরুত্ব বোঝা যাবে। এর আগে এটাও বলে রাখা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অঙ্গীকার করেছিলেন। বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রত্যয়ী সিদ্ধান্তের কারণেই পরবর্তী দিনটি এ রকম বলিষ্ঠতা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওই ১১ জন ছাত্রের বৈঠকটি আলাদাভাবে উল্লেখের প্রয়োজন এই কারণে যে, সেই বৈঠকের অন্তত চারজন আমতলার সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরা হলেন গাজীউল হক, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল ও মোহাম্মদ সুলতান।
মোহাম্মদ সুলতানের চরিত্রের একটি দিক নিয়ে কথা বলতেই হয়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান যাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন চীনপন্থী রাজনীতিবিদ। এদের অনেকেই মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু সে সময় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের কাছে হাত পাতেননি। একটু নতজানু হলেই তিনি নির্ভার জীবন ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারতেন। এ বিষয়ের প্রতি মোহগ্রস্ত হননি সুলতান। বরং আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেই তিনি জীবনের শেষদিনটিও পার করেছেন। শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার শৈশবে, সেই ভাবনাকেই পুঁজি করে কাটিয়ে গেছেন সারাটা জীবন।
মোহাম্মদ সুলতান ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ দুটি ভিন্ন স্রোত নয়। একটি অপরটিকে রক্ষা করে, একটি অপরটিকে লালন করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত হয়। এ দুটি ধারাতেই ক্যানসারের কীট অনুপ্রবেশ করেছে। পুনরায় আজ ১৯৫০,৫২, ৬৯ বা একাত্তরের সাংবাদিক হতে হবে আমাদের সাংবাদিকদের। সংবাদ, আজাদ ও ইত্তেফাকের টেবিলে শুয়ে থাকা সাংবাদিক বন্ধুদের দেখেছি সেই আমলে। তাঁদের কলম থেকে যে শোণিত ধারা প্রবাহিত হয়েছে, আজ তা নিস্তেজ। সেই বহমান ও বেগবান ধারার উৎসমুখ জনগণের পক্ষে মুক্ত হতেই হবে। তবেই গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চালু হওয়া সম্ভব। সংলাপে বা রাজপ্রাসাদের চক্রান্তে জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় না, প্রাসাদ ও সুদৃশ্য প্রেস ক্লাবের সৌন্দর্য বিভাসিত বা সোফাসেটের আড়ম্বরে সাংবাদিকতা নয়, শোষিত নিপীড়িত নয় কোটি বাঙালির ক্ষেতে খামারে, কলকারখানায় জনগণের মাঝে সফল সাংবাদিকতার জন্ম, উৎস ও বিস্তার। সাংবাদিকদের সেই আদি পথের দিকেই নজর ফেরাতে হবে।’ —এখানেই গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা তথা যে দর্শন তিনি মানতেন, তা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে।
একজন প্রগতিশীল প্রকাশক হিসেবে মোহাম্মদ সুলতানের অবদান অসামান্য। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শের বই প্রকাশের প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। এ ধরনের বই প্রকাশ করলে তা লাভজনক হবে না জেনেও তিনি সরে আসেননি। সত্যেন সেনের ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’, ‘অভিশপ্ত নগরী’, মাওলানা ভাসানীর ‘মাও সেতুংয়ের দেশে’, অজয় ভট্টাচার্যের ‘নীড়’, ‘নানকার বিদ্রোহ’, আবদুল হকের ‘ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র’, ফজলে লোহানীর ‘মহীরূহের প্রান্তর’, সাদেকুর রহমান সম্পাদিত ‘যত রক্ত তত ডলার’ উল্লেখযোগ্য।
বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, একুশের সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’-এর কথা। ১৯৫৩ সালের মার্চে যখন সংকলনটি প্রকাশিত হয়, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই প্রগতিশীল আন্দোলনের অনুকূল ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমান সংকলনটি সম্পাদনা করেন। যারা সে সংকলনে লিখেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই পরে সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় এ রকম একটি সংকলনের প্রকাশকের দায়িত্ব নেওয়া সহজ কাজ ছিল না। সংকলনটির ব্যয়ভার বহন করা হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমানের বাড়ির জমি বিক্রি করে। কিন্তু পুঁথিপত্র প্রকাশন থেকেই তা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশের পরপরই তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মোহাম্মদ সুলতানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়।
‘পুঁথিপত্র প্রকাশনী’ ছিল মার্কসবাদী বইয়ের দোকান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই দেখে দোকানটির নামকরণ করা হয়। মোহাম্মদ সুলতান ও এম আর আখতার মুকুল মিলে শুরু করেন দোকানটি, যা ছিল বকশীবাজারে। ছোট্ট একটি দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই পরামর্শদাতা হিসেবে যোগ দেন হাসান হাফিজুর রহমান। এম আর আখতার মুকুল বেশি দিন যুক্ত ছিলেন না প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। প্রকাশিত হওয়ার ২১ দিনের মধ্যেই পূর্ববঙ্গ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেছিল। বইটি বাজেয়াপ্ত করতে গিয়ে পুলিশ পুঁথিপত্র প্রকাশনী তছনছ করে দিয়েছিল। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটি নিয়ে সুসাহিত্যিক আনিস চৌধুরীর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য, ‘একুশের চেতনা নিয়ে এ যাবৎ অনেক কিছুই বলা হয়েছে। অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। কিন্তু বাহান্ন সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পর পর একুশে সংকলনের মতো একটি দুঃসাহসিক বই বের করার কৃতিত্ব সুলতান ভাই ভিন্ন আর কারও হয়নি।...হাসান হাফিজুর রহমানের ওই ঐতিহাসিক সংকলনটি শুধু একটি বই ছিল না, সেদিনের জাগ্রত যৌবনের প্রতিবাদী একটি অমূল্য দলিল। প্রকাশনার দায়িত্ব সুলতান ভাই নিয়েছিলেন। ব্যবসায়িক কারণে নয়, বরং প্রতিটি লেখায় রাজনৈতিক ছাপ বা কোনটিতে প্রচলিত সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা থাকার ফলে যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তাঁকে।’
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক লিখছেন, ‘...ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের চেতনাধৃত কবিতা, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে মূর্তজা বশীরের স্কেচশোভিত এ সংকলন নানা দিক বিচারে ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। আর এ সংকলনে প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে, সম্ভবত প্রকাশক হিসেবে যুবলীগ নেতার সংশ্লিষ্টতার কারণে, সর্বোপরি এর পাঠকপ্রিয়তার কারণে যথারীতি প্রকাশকের আস্তানায় পুলিশের তল্লাশি এবং শেষ পর্যন্ত সংকলনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।’
১৯২৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর মোহাম্মদ সুলতানের জন্ম, দিনাজপুর জেলার বোদা থানার মাঝগ্রামে। বাবা শমসের আলী আহমেদ চাকরি করতেন পুলিশে। মা গুলজাননেসা। সুলতানের জন্ম হয়েছিল গ্রামের বাড়িতেই। সুলতানের মা গুলজাননেসা যখন মারা যান, তখন সুলতান ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। আট ভাইবোনের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন পঞ্চম এবং ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ। তিন বোনই ছিলেন সুলতানের ছোট। ফলে সন্তানদের কথা ভেবে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। সুলতান প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন ১৯৪২ সালে। স্কুলজীবনে তিনি একজন একনিষ্ঠ বয় স্কাউট ছিলেন। শৈশবের সেই নিয়মানুবর্তিতাই পরবর্তী জীবনে তাঁকে যুক্তিবাদী ও নিয়মানুবর্তী করে তুলেছিল। প্রবেশিকা পাসের পর সুলতান যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজে ভর্তি হন। বাবার বদলির কারণে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর পর সুলতানের পড়াশোনায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। অনিবার্য কারণে কলকাতার কাছেই কালীপুর এআরপিতে পোস্ট ওয়ার্ডেনের চাকরি নেন সুলতান। এর পর সেই চাকরি ছেড়ে খড়দেহে সার্কিন এয়ার ডিপার্টমেন্টে স্টোর কিপারের চাকরি করেন। চাকরির সঞ্চয় দিয়ে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে আইএ পরীক্ষা দেন। রাজশাহীর অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে সে সময় থেকেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুবনেতাদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন গঠিত হয়। রাজশাহীতেও ১৯৪৮ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি একটি যুব সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২ ফেব্রুয়ারি একদিনেই সম্মেলনের কাজ শেষ হয়। সম্মেলনের অধিবেশন হয় ভুবনমোহান পার্কে। ভিয়েতনাম থেকে মাই-থি চাউ প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। সভার সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ সুলতান।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ সুলতান তাঁর অসমাপ্ত ডায়েরিতে বিশদ লিখেছেন, ‘মোহাম্মদ সুলতানের অসমাপ্ত ডায়েরিতে তাঁর জীবনের বিভিন্ন বাঁকের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি তৎকালীন সমাজচিত্র বোঝার জন্য একটি আয়নাবিশেষ।’ ডায়েরির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ‘১৮৭২ সনে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজে এই প্রথম ১৯৪৬ সনে একজন মুসলিম অধ্যক্ষ এলেন। ১৯৩৬ সনে কলেজ ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের আন্দোলন শুরু হলো কলেজ ইউনিয়ন নির্বাচন দেওয়ার জন্য। ড. মমতাজউদ্দিন এসেই ঢাকার চক্রান্ত, ঢাকার বিভেদ এবং শাসনব্যবস্থার প্রচলন করলেন। তিনি বেছে নিলেন মুসলিম লীগ দলীয় ছাত্রনেতাদের একাংশ। কলেজ ইউনিয়নে আমরা অসাম্প্রদায়িক একটি প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিনিধি দল প্রেরণের জন্য সংগঠন গড়ে তুললাম। আমাদের মনোনীত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত জনাব গোলাম রহমান। সেটি ছিল ১৯৪৭ সনের ঘটনা। কিন্তু আমাদের তরফ থেকে একমাত্র চতুর্থ বর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ও দ্বিতীয় বর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে একরামুল হক নির্বাচিত হলেন। বাকি সব ড. মমতাজউদ্দিনের নিজস্ব নির্বাচিতজনেরা। তাদের মধ্য থেকে অবশ্য হাস্না বেগম আমাদের সঙ্গে ছিলেন নির্বাচিত হওয়ার পর।
‘কলেজে আন্দোলন নতুন মোড় নিল। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করলাম। পাকিস্তানী শাসকবর্গ ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজশাহীর গণতান্ত্রিক ছাত্রসমাজের উপর। অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হলো। বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলো। কাউকে কাউকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো। ছাত্রাবাসের উপ-সুপারিনটেনডেন্ট রব সাহেব ছাত্রদের খাবারের টাকার হিসাব দিতে না পারায় বার্ষিক ভোজ দাওয়াত করতে তাকে বাধা দেওয়ার কারণে আমাকে আর গোলাম তাওয়াবকে (পরবর্তীকালে এয়ার ভাইস মার্শাল) এক হোস্টেলে এক রুমে থাকার বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা হলো। পরিশেষে আমাদের দুজনকে বহিষ্কার করা হলো। উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাত দিনের মধ্যেই আমাদের কলেজে প্রবেশের পুনঃনির্দেশ প্রদান করা হলো। ফিরে এলাম কলেজে। কিন্তু নতুন করে আক্রমণ শুরু হলো আমাদের উপর। এবার তৎকালীন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা আজিজুর রহমান গোপনে রাজশাহীতে এসে বিষোদ্গার করে গেলেন।
‘কয়েকদিন পর রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জেলা কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আমরা কতিপয় ছাত্র আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। পুলিশ-প্রহরায় ভস্মীভূত কমিউনিস্ট অফিস রক্ষা করতে পারলাম না। প্রতিশোধস্বরূপ রাজশাহী শহরে অবস্থিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দফতর আমরাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। একই স্থানে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলনের দফতর আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।...
‘রাজশাহী কলেজ তখন উত্তরবঙ্গের উদীয়মান প্রগতিশীল ছাত্রদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ইতিমধ্যে শাহ আজিজ-বিরোধীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গড়ে উঠেছে। নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান, নৈমুদ্দিন ও দবিরুল ইসলাম প্রমুখ। তখন রাজশাহীতে বসে আমরা কিছু একটা শুরু করার কথা ভাবছি। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে সবচাইতে প্রগতিশীল অংশ ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে রাজশাহীতে উত্তরবঙ্গ ছাত্র যুব সম্মেলন ও একটি বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠন গঠন করার প্রচেষ্টা নিলাম। একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হলো। ঢাকা থেকে আসার জন্য নৈমুদ্দিন আহমদকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হলো। আমাকে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হলো সদ্য সমাপ্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুব সমাবেশ থেকে যে কোনো প্রতিনিধিকে রাজশাহী ছাত্র সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এবং কোলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রগতিশীল মুসলমান সমাজের পত্রিকা দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদকে আনবার জন্য। কোলকাতায় গিয়ে উভয় প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ভিয়েতনাম থেকে আগত প্রতিনিধি মাই-থি-চাও আনন্দের সঙ্গে আমাদের সম্মেলনে যোগদানের সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। পরদিন সকালের ট্রেনে মাই থি চাও ও আবুল মনসুর সাহেবকে নিয়ে রওনা হবার প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিকেলে খবর পাওয়া গেল নাথুরাম গডসে গান্ধীজীকে হত্যা করেছে। সমস্ত কোলকাতা নীরব। আবুল মনসুর সাহেব জরুরি অবস্থার অজুহাতে আসতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করলেন। মাই-থি-চাওকে নিয়ে রাত ৮টায় রাজশাহী রেল স্টেশনে পৌঁছাতেই খবর পেলাম পুরো সম্মেলন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সার্কিট হাউস গিয়ে দেখলাম, ঢাকার বন্ধুবর্গ পৌঁছে গেছেন। সারারাত ধরে ঘরোয়া বৈঠক হলো। বিকেলে সব বিপদের ঝুঁকি নিয়েই গোবিন্দ পার্কে (ভুবন মোহন পার্কে হবে-লেখক) সভা করলাম। মাই-থি-চাও জনগণকে আহ্বান করে ভিয়েতনামের সংগ্রামী কাহিনী বলে চললেন। সভা হলো, কিন্তু সম্মেলন হলো না। আমরা সংগঠন গঠন করতে পারলাম না। কিন্তু বহু বাধা বিপত্তির মাঝেও এর চার-পাঁচ বছর পর ঢাকায় পুনরায় সংগঠিত হয়েছিলাম। জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের।...’
ডায়েরির এই অংশটুকু পড়লেই বোঝা যায়, বামপন্থী রাজনীতিবিদ হওয়ার পথে তাঁর প্রস্তুতির দিকটি। কত পরিশ্রমে এবং দুরদৃষ্টির কারণে তিনি এই পথ পাড়ি দিতে পেরেছিলেন, সেটিও আর অজ্ঞাত থাকে না।
রাজশাহীর যুবকর্মী সম্মেলনে বাংলাকে শিক্ষার বাহন ও অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের গণ পরিষদে ভাষার দাবির বিরোধিতা করা হয় এবং দাবি উত্থাপনকারীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। গণপরিষদে সরকারি দলের এই ভূমিকা ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বভাবতই সে ঢেউ রাজশাহীতেও আছড়ে পড়ে। মোহাম্মদ সুলতান তখন রাজশাহী কলেজের বিএ-এর ছাত্র। মোহাম্মদ সুলতান, গোলাম রহমান, একরামুল হক, গোলাম তাওয়াবের নেতৃত্বে শহরের স্কুল-কলেজে প্রতিবাদী বৈঠক চলতে থাকে। ১১ মার্চ রাজশাহীতে হরতাল আহ্বান করলেন তাঁরা। হরতাল শেষে যে মিছিল বের হয়, সে মিছিলে আক্রমণ চালায় মুসলীম লীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা। মোহাম্মদ সুলতান আহত হন। এর পরপরই ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। এই সভার সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান।
১৯৫১ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। সম্মেলনে মাহমুদ আলী সভাপতি, অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদক, মোহাম্মদ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালেই মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি নেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের শিক্ষক।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা শহর আওয়ামী পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হলে তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬২ সালে কারামুক্তির পর মোহাম্মদ সুলতান ঢাকায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে জড়ান। ১৯৬৬ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি ভাসানীর প্রতি আস্থা রাখেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনকালে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ সুলতানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কয়েকজন বন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করলে তিনি তাঁদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহাম্মদ সুলতান আর রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির সহসভাপতি ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।
মোহাম্মদ সুলতান বিয়ে করেছিলেন দেরিতে, ৩৭ বছর বয়সে। ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর বগুড়ার সুলতানগঞ্জ পাড়ার নূরজাহান বেগমকে। তাঁদের ৪ সন্তান; দুই মেয়ে, দুই ছেলে।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত মোহাম্মদ সুলতান ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। মাঝে দুবার কারাভোগও করতে হয়। জেল এড়ানোর জন্য এক বছর আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে বিনা বিচারে তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর থেকেই অবশ্য তাঁর স্কুলে চাকরির সমাপ্তি ঘটে। ৬২ সালে কারামুক্তির পর প্রায় ৪ বছর তিনি টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকায় বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন এ সময়, ছিলেন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তবে ১৯৫২ সালে ‘পুঁথিপত্র’ নামে যে বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এবং প্রকাশনা শুরু করেছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বই প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্মও হয়েছিল ২৭ / ৬ বকশীবাজারের পুঁথিপত্রের এই ঘরেই। ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হয়। মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন ছাত্র সংগঠনটির প্রথম সভাপতি।
মোহাম্মদ সুলতানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশের বিশিষ্টজনেরা যা লিখেছেন, তা এখানে বলা সংগত। তাতে ব্যক্তি সুলতানের অনমনীয় আদর্শিক রূপটিও ফুটে উঠেছে।
মোহাম্মদ সুলতান হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বাম রাজনীতির পথে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিই তাঁকে এমন অনমনীয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছিল। এরই কিছু উদাহরণ দিলে অন্যায় হবে না। ১৯৪৮ সালে রাজশাহী কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন, এ কথা আগেও বলা হয়েছে। রাজশাহীর তুখোড় ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। এ বছরটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক উত্তপ্ত বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতন ভোগকারী কর্মচারীরা তখন ধর্মঘট করেছিলেন। তাঁরা যে বেতন পেতেন, তাতে তাঁদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো। বেতন বৃদ্ধি, আবাসন সুবিধা, চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষার দাবি নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ একেবারেই সেদিকে দৃষ্টি দেয়নি। কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করেন ৩ মার্চ। ক্লাস বর্জন করেন তাঁরা। ৫ মার্চ ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থনপুষ্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগের উদ্যোগে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। যত দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেবে না, তত দিন ছাত্ররা কর্মচারীদের সমর্থনে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পূর্ববঙ্গে তখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছিল। এমনই একটি সময় ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও খাদ্যের দাবিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শেষে ছিল ভুখা মিছিল। সে ভুখা মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। তাতে শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ১২ অক্টোবর ভুখা মিছিল করার অপরাধে ভাসানী, শেখ মুজিব ও শামসুল হককে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মোহাম্মদ সুলতানের ঢাকা আগমন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে শিক্ষাগ্রহণ শুরু।
মোহাম্মদ সুলতান ভেবেছিলেন, নিরিবিলি কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা শেষ করবেন দুবছরের মধ্যে। এর পর করবেন অধ্যাপনা। কিন্তু তা আর হলো না। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে মুস্তাফা নূর উল ইসলাম হলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রার্থী। অলি আহাদ, কেজি মুস্তাফা এবং অন্য প্রগতিশীল ছাত্রদের অনুরোধে মোহাম্মদ সুলতান সক্রিয় সমর্থন দিলেন মুস্তাফা নূর উল ইসলামকে। আর এভাবেই আবারও ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এলেন। এর পর দাঙ্গা। ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় ও পরোক্ষ সমর্থনে এই দাঙ্গা সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ছাত্রদের দাঙ্গাবিরোধী মিছিল বের হয়। ইকবাল হল থেকে যে ছাত্র মিছিল বেরিয়ে আসে, তার নেতৃত্বে ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান ও মোহাম্মদ সুলতান। মিছিলটি আকারে ছিল ছোট, কিন্তু তার গুরুত্ব ছিল বেশি। কারণ সেদিন ওই একটি মিছিলই পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনে গিয়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে আসে। নূরুল আমীন দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এই প্রতিশ্রুতি আদায় করেই মিছিলটি হলে ফেরে।
ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের মূল্যায়ন: সুলতান সাহেবকে মনে পড়ে। মাটির মানুষ। তাঁর বইয়ের দোকান পুঁথিপত্রের মাটিতে বসে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম তখনকার দিনে। তাঁর বই-এর দোকান পুঁথিপত্র, বই তো নয়। বই-এর আকারে গোলা-বারুদে ঠাসা একটা ছোট ঘর। সুলতান সাহেব শুধু স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না। রাজনীতি শিক্ষা প্রদানের কাজও তিনি করতেন। সে রাজনীতির পাঠ গণমানুষের রাজনীতির পাঠ। স্কুলে কিংবা পাঠচক্রে সুলতান সাহেব ছিলেন এক নিরলস শিক্ষক।
এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অলি আহাদের মূল্যায়নও জরুরি: এমনি স্থির, নীরব কর্মী হাজারে একটা পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, পেশায় তিনি ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের শিক্ষক। খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। বহু ছাত্রকে প্রগতিশীল আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অমায়িক ব্যবহার ও বন্ধু বাৎসল্য আদর্শপ্রাণতা ও নীতিপরায়ণতা, সত্যপ্রীতি, আত্মত্যাগ—এসবই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন, মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি কাজ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে এ দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মোহাম্মদ সুলতানের অবদান ছিল অনন্যসাধারণ। ষাটের দশকেও তাঁর প্রেরণা ছিল ক্রিয়াশীল। যদিও তখন আর তিনি আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন না। যৌবনদীপ্ত অকুতোভয় আপোষহীন সংগ্রামী সুলতান আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে বেঁচে থাকবেন।
রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন লিখেছেন, ‘সুলতান ভাই প্রকাশক হয়েছিলেন রাজনীতির জন্য। শেষ পর্যন্ত সেটাই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাস আর প্রয়োজনেই তিনি প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। এই প্রকাশনার জীবন তাঁকে আর্থিক সংগতি দেয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর দেনা শুধতে বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হয়েছে। নিজের ছেলেমেয়েদের জন্যও তিনি কিছু রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু রেখে গেছেন একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসের জ্বলন্ত উদাহরণ। যাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই প্রথম সুযোগেই সেই রাজনৈতিক বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে আপোষের নৌকায় পাল তুলেছে। ওই রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে এখানে-ওখানে সেখানে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থাও করে নিয়েছে। সুলতান ভাই তাঁর প্রথম জীবনের বিশ্বাস নিয়েই জীবনের ইতি টেনেছেন। একটুকু আপোষ করতে রাজি হননি। বাম প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিভক্তি, বিভ্রান্তি, সহকর্মী বন্ধুদের ষড়যন্ত্র পদস্খলন তাঁর হৃদয়াবেগকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। প্রবল দুঃখবোধে তিনি সক্রিয় ও প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।...
...আমাদের জন্য গোটা ষাটের দশক ছিল উত্তাল আন্দোলনের যুগ। এ দেশের বাম প্রগতিশীল চিন্তার দ্রুত বিকাশের যুগ। হাজার হাজার তরুণ এগিয়ে আসছে। বিপ্লবের দীক্ষামন্ত্র নিতে সমাজ পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই তারুণ্যকে সেদিন যাঁরা পথনির্দেশ করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন, তাকে আপোষহীন সংগ্রামের পথে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করেছেন, সুলতান ভাই তাঁদের একজন।’
সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘তরুণ বয়সে বামপন্থী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু আদর্শের জন্য ত্যাগ ও কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করা, কোনো অবস্থাতেই কারুর ওপর কোনো অভিযোগ না করে নিজের কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল এবং নিষ্ঠা, সুলতানের মতো খুব কম তরুণের মধ্যে লক্ষ্য করেছি সমসাময়িককালে। বাম রাজনীতিতে যখন বিভেদ দেখা দিল, তখন অনেকের মধ্যে বন্ধুত্বের চিড় ধরেছে। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ আর কুৎসা আদর্শগত দ্বন্দ্বের আড়ালে চলেছে। সেখানে মোহাম্মদ সুলতান ছিল আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
এ রকম মন্তব্য শুনলে বলবেন, এ ধরনের মনোভাব তো আরও অনেকের মধ্যে দেখা গেছে। অবশ্যই দেখা গেছে, সেখানে রাজনৈতিক কার্যকারণ ছিল এ ধরনের সম্পর্কের নিয়ামক। আর সুলতানের ক্ষেত্রে তা ছিল স্বভাবজাত। রাজনীতিগতভাবে ভিন্নমতের কারণে অপরের সবকিছুই বাঁকা চোখে দেখার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না। সততা ও চরিত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তার সংজ্ঞা এ যুগে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাম রাজনীতির বিভেদের যুগে দেখা গেল মোহাম্মদ সুলতান ক্রমেই যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। রাজনীতির নামে ব্যক্তিস্বার্থের উদ্ধার কিংবা নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য আপোষ যেমন সে করেনি, তেমনি তার সংগ্রামী মনোভাব কাউকে হেয় জ্ঞানে দূরে ঠেলেনি।’
১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
ভাষা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। একজন অসাধারণ সংগঠক হিসেবে বন্ধুদের শ্রদ্ধা-আস্থাও অর্জন করেছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মোহাম্মদ সুলতানের কীর্তির যে সন্ধান পেয়েছি, তা অনন্য। প্রগতিশীল এই মানুষকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন—
১.১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির গভীর রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি, যেখানে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২.২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের নাম লিখে রাখার দায়িত্ব পালন এবং স্কুলের ছাত্রদের সংগঠিত করে সভা প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা।
৩.২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের একজন হওয়া।
৪.১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশক হওয়া।
ভাষা আন্দোলনের মূল রূপকারদের একজন হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ সুলতানকে কখনোই রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি। একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের স্থান হলেও মোহাম্মদ সুলতান থেকেছেন ব্রাত্য হয়ে। অথচ মোহাম্মদ সুলতান হচ্ছেন সেই বিরল প্রজাতির মানুষ, যাদের পুরো জীবন কেটেছে সংগ্রামে সংগ্রামে। প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যাঁরা ব্যক্তিগত জীবনকেও উপেক্ষা করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বসে আসলে গত শতাব্দীর আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সংগ্রামকে অনুভব করা যাবে না। নতুন যুগের মানুষ সেই সময়টিকে ইউটোপিয়া বলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। নতুন প্রজন্মের কাছে রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, মার্কস, লেনিন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, চে গুয়েভারা, কিউবা বিপ্লব ইত্যাদি আর অনুপ্রেরণার আধার নয়। তাই মোহাম্মদ সুলতানের আত্মত্যাগকে অনেকেই অকারণ হাস্যকর বিভ্রান্তি বলে মনে করতে পারে। মনে করতে পারে মরীচীকার পেছনে ছুটে জীবন নষ্ট করেছেন তিনি। অথচ বিগত শতাব্দীর সাতটি দশক সারা পৃথিবীর প্রগতিশীল মানুষের স্বপ্নই ছিল শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার। তিনি ছিলেন সে স্বপ্নপূরণের এক অদম্য সৈনিক।
এ কথা নিশ্চয় নতুন নয় যে,১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে ওঠার কিছুকালের মধ্যেই পাকিস্তানে ভাষা প্রসঙ্গটি বড় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কার্জন হলের ছাত্রসভায়ও একই কথা উচ্চারণ করেন তিনি। ঢাকার ছাত্র-জনতা এই ঘোষণা মেনে নেয়নি। তারা ‘নো’ ‘নো’ বলে তখনকার ‘কায়েদে আজম’-এর ঘোষণার প্রতিবাদ করে। মোহাম্মদ সুলতান তখন রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ছেন। ১১ মার্চ রাজশাহীতে যারা মিছিল, সভা ও ধর্মঘট পালনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। তবে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহীতে এলে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয় এবং স্লোগান তোলা হয়, ‘গো ব্যাক লিয়াকত আলী’।
১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৪৮ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ ছিল। এর আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন নামেই খ্যাতি পেয়েছেন তিনি)। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে প্রগতিশীল একটি সংগঠনের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান হন তার যুগ্ম সম্পাদক। ভাষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন যখন আবার উর্দুর পক্ষে কথা বলেন, তখন শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের নতুন পর্যায়। এ সময়টিকে ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বদরুদ্দীন উমর। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের পক্ষ থেকে সে সভায় প্রতিনিধিত্ব করেন মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রশ্ন ওঠে, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেওয়া হবে কি-না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে রাখলে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জনের বৈঠকের কথাটি বলা হচ্ছে, তার গুরুত্ব বোঝা যাবে। এর আগে এটাও বলে রাখা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অঙ্গীকার করেছিলেন। বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রত্যয়ী সিদ্ধান্তের কারণেই পরবর্তী দিনটি এ রকম বলিষ্ঠতা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওই ১১ জন ছাত্রের বৈঠকটি আলাদাভাবে উল্লেখের প্রয়োজন এই কারণে যে, সেই বৈঠকের অন্তত চারজন আমতলার সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরা হলেন গাজীউল হক, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল ও মোহাম্মদ সুলতান।
মোহাম্মদ সুলতানের চরিত্রের একটি দিক নিয়ে কথা বলতেই হয়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান যাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন চীনপন্থী রাজনীতিবিদ। এদের অনেকেই মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু সে সময় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের কাছে হাত পাতেননি। একটু নতজানু হলেই তিনি নির্ভার জীবন ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারতেন। এ বিষয়ের প্রতি মোহগ্রস্ত হননি সুলতান। বরং আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেই তিনি জীবনের শেষদিনটিও পার করেছেন। শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার শৈশবে, সেই ভাবনাকেই পুঁজি করে কাটিয়ে গেছেন সারাটা জীবন।
মোহাম্মদ সুলতান ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ দুটি ভিন্ন স্রোত নয়। একটি অপরটিকে রক্ষা করে, একটি অপরটিকে লালন করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত হয়। এ দুটি ধারাতেই ক্যানসারের কীট অনুপ্রবেশ করেছে। পুনরায় আজ ১৯৫০,৫২, ৬৯ বা একাত্তরের সাংবাদিক হতে হবে আমাদের সাংবাদিকদের। সংবাদ, আজাদ ও ইত্তেফাকের টেবিলে শুয়ে থাকা সাংবাদিক বন্ধুদের দেখেছি সেই আমলে। তাঁদের কলম থেকে যে শোণিত ধারা প্রবাহিত হয়েছে, আজ তা নিস্তেজ। সেই বহমান ও বেগবান ধারার উৎসমুখ জনগণের পক্ষে মুক্ত হতেই হবে। তবেই গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চালু হওয়া সম্ভব। সংলাপে বা রাজপ্রাসাদের চক্রান্তে জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় না, প্রাসাদ ও সুদৃশ্য প্রেস ক্লাবের সৌন্দর্য বিভাসিত বা সোফাসেটের আড়ম্বরে সাংবাদিকতা নয়, শোষিত নিপীড়িত নয় কোটি বাঙালির ক্ষেতে খামারে, কলকারখানায় জনগণের মাঝে সফল সাংবাদিকতার জন্ম, উৎস ও বিস্তার। সাংবাদিকদের সেই আদি পথের দিকেই নজর ফেরাতে হবে।’ —এখানেই গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা তথা যে দর্শন তিনি মানতেন, তা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে।
একজন প্রগতিশীল প্রকাশক হিসেবে মোহাম্মদ সুলতানের অবদান অসামান্য। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শের বই প্রকাশের প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। এ ধরনের বই প্রকাশ করলে তা লাভজনক হবে না জেনেও তিনি সরে আসেননি। সত্যেন সেনের ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’, ‘অভিশপ্ত নগরী’, মাওলানা ভাসানীর ‘মাও সেতুংয়ের দেশে’, অজয় ভট্টাচার্যের ‘নীড়’, ‘নানকার বিদ্রোহ’, আবদুল হকের ‘ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র’, ফজলে লোহানীর ‘মহীরূহের প্রান্তর’, সাদেকুর রহমান সম্পাদিত ‘যত রক্ত তত ডলার’ উল্লেখযোগ্য।
বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, একুশের সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’-এর কথা। ১৯৫৩ সালের মার্চে যখন সংকলনটি প্রকাশিত হয়, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই প্রগতিশীল আন্দোলনের অনুকূল ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমান সংকলনটি সম্পাদনা করেন। যারা সে সংকলনে লিখেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই পরে সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় এ রকম একটি সংকলনের প্রকাশকের দায়িত্ব নেওয়া সহজ কাজ ছিল না। সংকলনটির ব্যয়ভার বহন করা হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমানের বাড়ির জমি বিক্রি করে। কিন্তু পুঁথিপত্র প্রকাশন থেকেই তা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশের পরপরই তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মোহাম্মদ সুলতানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়।
‘পুঁথিপত্র প্রকাশনী’ ছিল মার্কসবাদী বইয়ের দোকান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই দেখে দোকানটির নামকরণ করা হয়। মোহাম্মদ সুলতান ও এম আর আখতার মুকুল মিলে শুরু করেন দোকানটি, যা ছিল বকশীবাজারে। ছোট্ট একটি দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই পরামর্শদাতা হিসেবে যোগ দেন হাসান হাফিজুর রহমান। এম আর আখতার মুকুল বেশি দিন যুক্ত ছিলেন না প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। প্রকাশিত হওয়ার ২১ দিনের মধ্যেই পূর্ববঙ্গ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেছিল। বইটি বাজেয়াপ্ত করতে গিয়ে পুলিশ পুঁথিপত্র প্রকাশনী তছনছ করে দিয়েছিল। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইটি নিয়ে সুসাহিত্যিক আনিস চৌধুরীর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য, ‘একুশের চেতনা নিয়ে এ যাবৎ অনেক কিছুই বলা হয়েছে। অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। কিন্তু বাহান্ন সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পর পর একুশে সংকলনের মতো একটি দুঃসাহসিক বই বের করার কৃতিত্ব সুলতান ভাই ভিন্ন আর কারও হয়নি।...হাসান হাফিজুর রহমানের ওই ঐতিহাসিক সংকলনটি শুধু একটি বই ছিল না, সেদিনের জাগ্রত যৌবনের প্রতিবাদী একটি অমূল্য দলিল। প্রকাশনার দায়িত্ব সুলতান ভাই নিয়েছিলেন। ব্যবসায়িক কারণে নয়, বরং প্রতিটি লেখায় রাজনৈতিক ছাপ বা কোনটিতে প্রচলিত সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা থাকার ফলে যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তাঁকে।’
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক লিখছেন, ‘...ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের চেতনাধৃত কবিতা, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে মূর্তজা বশীরের স্কেচশোভিত এ সংকলন নানা দিক বিচারে ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। আর এ সংকলনে প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে, সম্ভবত প্রকাশক হিসেবে যুবলীগ নেতার সংশ্লিষ্টতার কারণে, সর্বোপরি এর পাঠকপ্রিয়তার কারণে যথারীতি প্রকাশকের আস্তানায় পুলিশের তল্লাশি এবং শেষ পর্যন্ত সংকলনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।’
১৯২৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর মোহাম্মদ সুলতানের জন্ম, দিনাজপুর জেলার বোদা থানার মাঝগ্রামে। বাবা শমসের আলী আহমেদ চাকরি করতেন পুলিশে। মা গুলজাননেসা। সুলতানের জন্ম হয়েছিল গ্রামের বাড়িতেই। সুলতানের মা গুলজাননেসা যখন মারা যান, তখন সুলতান ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। আট ভাইবোনের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন পঞ্চম এবং ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ। তিন বোনই ছিলেন সুলতানের ছোট। ফলে সন্তানদের কথা ভেবে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। সুলতান প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন ১৯৪২ সালে। স্কুলজীবনে তিনি একজন একনিষ্ঠ বয় স্কাউট ছিলেন। শৈশবের সেই নিয়মানুবর্তিতাই পরবর্তী জীবনে তাঁকে যুক্তিবাদী ও নিয়মানুবর্তী করে তুলেছিল। প্রবেশিকা পাসের পর সুলতান যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজে ভর্তি হন। বাবার বদলির কারণে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর পর সুলতানের পড়াশোনায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। অনিবার্য কারণে কলকাতার কাছেই কালীপুর এআরপিতে পোস্ট ওয়ার্ডেনের চাকরি নেন সুলতান। এর পর সেই চাকরি ছেড়ে খড়দেহে সার্কিন এয়ার ডিপার্টমেন্টে স্টোর কিপারের চাকরি করেন। চাকরির সঞ্চয় দিয়ে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে আইএ পরীক্ষা দেন। রাজশাহীর অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে সে সময় থেকেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুবনেতাদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন গঠিত হয়। রাজশাহীতেও ১৯৪৮ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি একটি যুব সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২ ফেব্রুয়ারি একদিনেই সম্মেলনের কাজ শেষ হয়। সম্মেলনের অধিবেশন হয় ভুবনমোহান পার্কে। ভিয়েতনাম থেকে মাই-থি চাউ প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। সভার সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ সুলতান।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ সুলতান তাঁর অসমাপ্ত ডায়েরিতে বিশদ লিখেছেন, ‘মোহাম্মদ সুলতানের অসমাপ্ত ডায়েরিতে তাঁর জীবনের বিভিন্ন বাঁকের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি তৎকালীন সমাজচিত্র বোঝার জন্য একটি আয়নাবিশেষ।’ ডায়েরির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ‘১৮৭২ সনে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজে এই প্রথম ১৯৪৬ সনে একজন মুসলিম অধ্যক্ষ এলেন। ১৯৩৬ সনে কলেজ ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের আন্দোলন শুরু হলো কলেজ ইউনিয়ন নির্বাচন দেওয়ার জন্য। ড. মমতাজউদ্দিন এসেই ঢাকার চক্রান্ত, ঢাকার বিভেদ এবং শাসনব্যবস্থার প্রচলন করলেন। তিনি বেছে নিলেন মুসলিম লীগ দলীয় ছাত্রনেতাদের একাংশ। কলেজ ইউনিয়নে আমরা অসাম্প্রদায়িক একটি প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিনিধি দল প্রেরণের জন্য সংগঠন গড়ে তুললাম। আমাদের মনোনীত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত জনাব গোলাম রহমান। সেটি ছিল ১৯৪৭ সনের ঘটনা। কিন্তু আমাদের তরফ থেকে একমাত্র চতুর্থ বর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ও দ্বিতীয় বর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে একরামুল হক নির্বাচিত হলেন। বাকি সব ড. মমতাজউদ্দিনের নিজস্ব নির্বাচিতজনেরা। তাদের মধ্য থেকে অবশ্য হাস্না বেগম আমাদের সঙ্গে ছিলেন নির্বাচিত হওয়ার পর।
‘কলেজে আন্দোলন নতুন মোড় নিল। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করলাম। পাকিস্তানী শাসকবর্গ ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজশাহীর গণতান্ত্রিক ছাত্রসমাজের উপর। অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হলো। বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলো। কাউকে কাউকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো। ছাত্রাবাসের উপ-সুপারিনটেনডেন্ট রব সাহেব ছাত্রদের খাবারের টাকার হিসাব দিতে না পারায় বার্ষিক ভোজ দাওয়াত করতে তাকে বাধা দেওয়ার কারণে আমাকে আর গোলাম তাওয়াবকে (পরবর্তীকালে এয়ার ভাইস মার্শাল) এক হোস্টেলে এক রুমে থাকার বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা হলো। পরিশেষে আমাদের দুজনকে বহিষ্কার করা হলো। উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাত দিনের মধ্যেই আমাদের কলেজে প্রবেশের পুনঃনির্দেশ প্রদান করা হলো। ফিরে এলাম কলেজে। কিন্তু নতুন করে আক্রমণ শুরু হলো আমাদের উপর। এবার তৎকালীন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা আজিজুর রহমান গোপনে রাজশাহীতে এসে বিষোদ্গার করে গেলেন।
‘কয়েকদিন পর রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জেলা কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আমরা কতিপয় ছাত্র আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। পুলিশ-প্রহরায় ভস্মীভূত কমিউনিস্ট অফিস রক্ষা করতে পারলাম না। প্রতিশোধস্বরূপ রাজশাহী শহরে অবস্থিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দফতর আমরাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। একই স্থানে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলনের দফতর আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।...
‘রাজশাহী কলেজ তখন উত্তরবঙ্গের উদীয়মান প্রগতিশীল ছাত্রদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ইতিমধ্যে শাহ আজিজ-বিরোধীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গড়ে উঠেছে। নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান, নৈমুদ্দিন ও দবিরুল ইসলাম প্রমুখ। তখন রাজশাহীতে বসে আমরা কিছু একটা শুরু করার কথা ভাবছি। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে সবচাইতে প্রগতিশীল অংশ ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে রাজশাহীতে উত্তরবঙ্গ ছাত্র যুব সম্মেলন ও একটি বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠন গঠন করার প্রচেষ্টা নিলাম। একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হলো। ঢাকা থেকে আসার জন্য নৈমুদ্দিন আহমদকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হলো। আমাকে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হলো সদ্য সমাপ্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুব সমাবেশ থেকে যে কোনো প্রতিনিধিকে রাজশাহী ছাত্র সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এবং কোলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রগতিশীল মুসলমান সমাজের পত্রিকা দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদকে আনবার জন্য। কোলকাতায় গিয়ে উভয় প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ভিয়েতনাম থেকে আগত প্রতিনিধি মাই-থি-চাও আনন্দের সঙ্গে আমাদের সম্মেলনে যোগদানের সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। পরদিন সকালের ট্রেনে মাই থি চাও ও আবুল মনসুর সাহেবকে নিয়ে রওনা হবার প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিকেলে খবর পাওয়া গেল নাথুরাম গডসে গান্ধীজীকে হত্যা করেছে। সমস্ত কোলকাতা নীরব। আবুল মনসুর সাহেব জরুরি অবস্থার অজুহাতে আসতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করলেন। মাই-থি-চাওকে নিয়ে রাত ৮টায় রাজশাহী রেল স্টেশনে পৌঁছাতেই খবর পেলাম পুরো সম্মেলন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সার্কিট হাউস গিয়ে দেখলাম, ঢাকার বন্ধুবর্গ পৌঁছে গেছেন। সারারাত ধরে ঘরোয়া বৈঠক হলো। বিকেলে সব বিপদের ঝুঁকি নিয়েই গোবিন্দ পার্কে (ভুবন মোহন পার্কে হবে-লেখক) সভা করলাম। মাই-থি-চাও জনগণকে আহ্বান করে ভিয়েতনামের সংগ্রামী কাহিনী বলে চললেন। সভা হলো, কিন্তু সম্মেলন হলো না। আমরা সংগঠন গঠন করতে পারলাম না। কিন্তু বহু বাধা বিপত্তির মাঝেও এর চার-পাঁচ বছর পর ঢাকায় পুনরায় সংগঠিত হয়েছিলাম। জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের।...’
ডায়েরির এই অংশটুকু পড়লেই বোঝা যায়, বামপন্থী রাজনীতিবিদ হওয়ার পথে তাঁর প্রস্তুতির দিকটি। কত পরিশ্রমে এবং দুরদৃষ্টির কারণে তিনি এই পথ পাড়ি দিতে পেরেছিলেন, সেটিও আর অজ্ঞাত থাকে না।
রাজশাহীর যুবকর্মী সম্মেলনে বাংলাকে শিক্ষার বাহন ও অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের গণ পরিষদে ভাষার দাবির বিরোধিতা করা হয় এবং দাবি উত্থাপনকারীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। গণপরিষদে সরকারি দলের এই ভূমিকা ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বভাবতই সে ঢেউ রাজশাহীতেও আছড়ে পড়ে। মোহাম্মদ সুলতান তখন রাজশাহী কলেজের বিএ-এর ছাত্র। মোহাম্মদ সুলতান, গোলাম রহমান, একরামুল হক, গোলাম তাওয়াবের নেতৃত্বে শহরের স্কুল-কলেজে প্রতিবাদী বৈঠক চলতে থাকে। ১১ মার্চ রাজশাহীতে হরতাল আহ্বান করলেন তাঁরা। হরতাল শেষে যে মিছিল বের হয়, সে মিছিলে আক্রমণ চালায় মুসলীম লীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা। মোহাম্মদ সুলতান আহত হন। এর পরপরই ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। এই সভার সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান।
১৯৫১ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। সম্মেলনে মাহমুদ আলী সভাপতি, অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদক, মোহাম্মদ সুলতান ও ইমাদুল্লাহ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালেই মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি নেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের শিক্ষক।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা শহর আওয়ামী পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হলে তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬২ সালে কারামুক্তির পর মোহাম্মদ সুলতান ঢাকায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে জড়ান। ১৯৬৬ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি ভাসানীর প্রতি আস্থা রাখেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনকালে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ সুলতানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কয়েকজন বন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করলে তিনি তাঁদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহাম্মদ সুলতান আর রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির সহসভাপতি ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।
মোহাম্মদ সুলতান বিয়ে করেছিলেন দেরিতে, ৩৭ বছর বয়সে। ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর বগুড়ার সুলতানগঞ্জ পাড়ার নূরজাহান বেগমকে। তাঁদের ৪ সন্তান; দুই মেয়ে, দুই ছেলে।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত মোহাম্মদ সুলতান ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। মাঝে দুবার কারাভোগও করতে হয়। জেল এড়ানোর জন্য এক বছর আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে বিনা বিচারে তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর থেকেই অবশ্য তাঁর স্কুলে চাকরির সমাপ্তি ঘটে। ৬২ সালে কারামুক্তির পর প্রায় ৪ বছর তিনি টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকায় বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন এ সময়, ছিলেন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তবে ১৯৫২ সালে ‘পুঁথিপত্র’ নামে যে বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এবং প্রকাশনা শুরু করেছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বই প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্মও হয়েছিল ২৭ / ৬ বকশীবাজারের পুঁথিপত্রের এই ঘরেই। ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের যাত্রা শুরু হয়। মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন ছাত্র সংগঠনটির প্রথম সভাপতি।
মোহাম্মদ সুলতানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশের বিশিষ্টজনেরা যা লিখেছেন, তা এখানে বলা সংগত। তাতে ব্যক্তি সুলতানের অনমনীয় আদর্শিক রূপটিও ফুটে উঠেছে।
মোহাম্মদ সুলতান হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বাম রাজনীতির পথে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিই তাঁকে এমন অনমনীয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছিল। এরই কিছু উদাহরণ দিলে অন্যায় হবে না। ১৯৪৮ সালে রাজশাহী কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন, এ কথা আগেও বলা হয়েছে। রাজশাহীর তুখোড় ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। এ বছরটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক উত্তপ্ত বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতন ভোগকারী কর্মচারীরা তখন ধর্মঘট করেছিলেন। তাঁরা যে বেতন পেতেন, তাতে তাঁদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো। বেতন বৃদ্ধি, আবাসন সুবিধা, চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষার দাবি নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ একেবারেই সেদিকে দৃষ্টি দেয়নি। কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করেন ৩ মার্চ। ক্লাস বর্জন করেন তাঁরা। ৫ মার্চ ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থনপুষ্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগের উদ্যোগে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। যত দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেবে না, তত দিন ছাত্ররা কর্মচারীদের সমর্থনে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পূর্ববঙ্গে তখন দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছিল। এমনই একটি সময় ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও খাদ্যের দাবিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শেষে ছিল ভুখা মিছিল। সে ভুখা মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। তাতে শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ১২ অক্টোবর ভুখা মিছিল করার অপরাধে ভাসানী, শেখ মুজিব ও শামসুল হককে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মোহাম্মদ সুলতানের ঢাকা আগমন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে শিক্ষাগ্রহণ শুরু।
মোহাম্মদ সুলতান ভেবেছিলেন, নিরিবিলি কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা শেষ করবেন দুবছরের মধ্যে। এর পর করবেন অধ্যাপনা। কিন্তু তা আর হলো না। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে মুস্তাফা নূর উল ইসলাম হলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রার্থী। অলি আহাদ, কেজি মুস্তাফা এবং অন্য প্রগতিশীল ছাত্রদের অনুরোধে মোহাম্মদ সুলতান সক্রিয় সমর্থন দিলেন মুস্তাফা নূর উল ইসলামকে। আর এভাবেই আবারও ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এলেন। এর পর দাঙ্গা। ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় ও পরোক্ষ সমর্থনে এই দাঙ্গা সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ছাত্রদের দাঙ্গাবিরোধী মিছিল বের হয়। ইকবাল হল থেকে যে ছাত্র মিছিল বেরিয়ে আসে, তার নেতৃত্বে ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান ও মোহাম্মদ সুলতান। মিছিলটি আকারে ছিল ছোট, কিন্তু তার গুরুত্ব ছিল বেশি। কারণ সেদিন ওই একটি মিছিলই পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনে গিয়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে আসে। নূরুল আমীন দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এই প্রতিশ্রুতি আদায় করেই মিছিলটি হলে ফেরে।
ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের মূল্যায়ন: সুলতান সাহেবকে মনে পড়ে। মাটির মানুষ। তাঁর বইয়ের দোকান পুঁথিপত্রের মাটিতে বসে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম তখনকার দিনে। তাঁর বই-এর দোকান পুঁথিপত্র, বই তো নয়। বই-এর আকারে গোলা-বারুদে ঠাসা একটা ছোট ঘর। সুলতান সাহেব শুধু স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না। রাজনীতি শিক্ষা প্রদানের কাজও তিনি করতেন। সে রাজনীতির পাঠ গণমানুষের রাজনীতির পাঠ। স্কুলে কিংবা পাঠচক্রে সুলতান সাহেব ছিলেন এক নিরলস শিক্ষক।
এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অলি আহাদের মূল্যায়নও জরুরি: এমনি স্থির, নীরব কর্মী হাজারে একটা পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, পেশায় তিনি ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের শিক্ষক। খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। বহু ছাত্রকে প্রগতিশীল আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অমায়িক ব্যবহার ও বন্ধু বাৎসল্য আদর্শপ্রাণতা ও নীতিপরায়ণতা, সত্যপ্রীতি, আত্মত্যাগ—এসবই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন, মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি কাজ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে এ দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মোহাম্মদ সুলতানের অবদান ছিল অনন্যসাধারণ। ষাটের দশকেও তাঁর প্রেরণা ছিল ক্রিয়াশীল। যদিও তখন আর তিনি আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন না। যৌবনদীপ্ত অকুতোভয় আপোষহীন সংগ্রামী সুলতান আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে বেঁচে থাকবেন।
রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন লিখেছেন, ‘সুলতান ভাই প্রকাশক হয়েছিলেন রাজনীতির জন্য। শেষ পর্যন্ত সেটাই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাস আর প্রয়োজনেই তিনি প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। এই প্রকাশনার জীবন তাঁকে আর্থিক সংগতি দেয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর দেনা শুধতে বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হয়েছে। নিজের ছেলেমেয়েদের জন্যও তিনি কিছু রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু রেখে গেছেন একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসের জ্বলন্ত উদাহরণ। যাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই প্রথম সুযোগেই সেই রাজনৈতিক বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে আপোষের নৌকায় পাল তুলেছে। ওই রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে এখানে-ওখানে সেখানে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থাও করে নিয়েছে। সুলতান ভাই তাঁর প্রথম জীবনের বিশ্বাস নিয়েই জীবনের ইতি টেনেছেন। একটুকু আপোষ করতে রাজি হননি। বাম প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিভক্তি, বিভ্রান্তি, সহকর্মী বন্ধুদের ষড়যন্ত্র পদস্খলন তাঁর হৃদয়াবেগকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। প্রবল দুঃখবোধে তিনি সক্রিয় ও প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।...
...আমাদের জন্য গোটা ষাটের দশক ছিল উত্তাল আন্দোলনের যুগ। এ দেশের বাম প্রগতিশীল চিন্তার দ্রুত বিকাশের যুগ। হাজার হাজার তরুণ এগিয়ে আসছে। বিপ্লবের দীক্ষামন্ত্র নিতে সমাজ পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই তারুণ্যকে সেদিন যাঁরা পথনির্দেশ করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন, তাকে আপোষহীন সংগ্রামের পথে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করেছেন, সুলতান ভাই তাঁদের একজন।’
সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘তরুণ বয়সে বামপন্থী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু আদর্শের জন্য ত্যাগ ও কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করা, কোনো অবস্থাতেই কারুর ওপর কোনো অভিযোগ না করে নিজের কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল এবং নিষ্ঠা, সুলতানের মতো খুব কম তরুণের মধ্যে লক্ষ্য করেছি সমসাময়িককালে। বাম রাজনীতিতে যখন বিভেদ দেখা দিল, তখন অনেকের মধ্যে বন্ধুত্বের চিড় ধরেছে। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ আর কুৎসা আদর্শগত দ্বন্দ্বের আড়ালে চলেছে। সেখানে মোহাম্মদ সুলতান ছিল আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
এ রকম মন্তব্য শুনলে বলবেন, এ ধরনের মনোভাব তো আরও অনেকের মধ্যে দেখা গেছে। অবশ্যই দেখা গেছে, সেখানে রাজনৈতিক কার্যকারণ ছিল এ ধরনের সম্পর্কের নিয়ামক। আর সুলতানের ক্ষেত্রে তা ছিল স্বভাবজাত। রাজনীতিগতভাবে ভিন্নমতের কারণে অপরের সবকিছুই বাঁকা চোখে দেখার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না। সততা ও চরিত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তার সংজ্ঞা এ যুগে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাম রাজনীতির বিভেদের যুগে দেখা গেল মোহাম্মদ সুলতান ক্রমেই যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। রাজনীতির নামে ব্যক্তিস্বার্থের উদ্ধার কিংবা নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য আপোষ যেমন সে করেনি, তেমনি তার সংগ্রামী মনোভাব কাউকে হেয় জ্ঞানে দূরে ঠেলেনি।’
১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি ছিলেন জন কিটস। কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছরের। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত। মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তাঁর কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমালোচকদের দ্বারা কিটসের কবিতা খুব একটা আলোচিত হয়নি। তবে মৃত্য
৬ ঘণ্টা আগেত্রিশের দশকের রবীন্দ্রকাব্যধারাবিরোধী পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে অন্যতম একজন কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর জন্ম ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতীবাগানে। তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন দার্শনিক। আর স্ত্রী ছিলেন প্রসিদ্ধ গায়িকা রাজেশ্বরী বাসুদেব।
১ দিন আগেসিলভিয়া প্লাথ ছিলেন একজন মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি নারীবাদী কবি হিসেবেও পরিচিত। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং নারীর পরিচয়-সংকট নিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় সাজিয়েছেন স্পষ্টভাবে।
৪ দিন আগেবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি কৌতুকমিশ্রিত গল্পের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। নামের মিল থাকলেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর তিনি কিন্তু আলাদা ব্যক্তি।
৭ দিন আগে