নূরুননবী শান্ত

১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিয়েই আবৃত্তি সংগঠন স্বননে সম্পৃক্ত হলাম। ১৯৮১ সালে এই সংগঠনের গোড়াপত্তনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন হাসান আজিজুল হক। স্বনন নামটি তাঁরই দেওয়া।
স্বনন সূত্রেই হাসান স্যারের সান্নিধ্য লাভ। মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের ১৩৭ নম্বর কক্ষটি ছিল হাসান স্যারের বসার ঘর। স্বননের প্রধান পুরুষ নাজিম মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর আমরা স্বননের বসার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সন্ত্রস্ত। স্বননের কার্যক্রমসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিবিধ বাধা আসছিল প্রশাসনের তরফ থেকে। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের হলে ফেরা বাধ্যতামূলক করা হলো। আড্ডা ও গানের শব্দ পেলেই প্রক্টরের বাহিনী এমনকি প্রক্টর নিজেও ধমক ও হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। স্বনন বসার জায়গা হারাল। এমনকি আমাদের প্রিয় শিক্ষকগণ কবিতা পড়ার জন্য একটু জায়গা আমাদের দিতে পারছিলেন না ভয়ে। সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ক্যাম্পাসে হাসান স্যার তাঁর মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের নিজ কক্ষের একটি চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যত দিন আমি আছি, আমার ঘরে বসবে তোমরা, আমি কাউকে ভয় পাই না।’
কেবল স্বনন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি থিয়েটার গ্রুপ থেকে শুরু করে সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি। সে সময়কার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভয়াবহ হুমকিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরম প্রেরণা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের। তাঁর বন্ধুদের অনেক সময়ই তাঁর বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি। তাঁরা মনে করতেন, হাসান এসব করতে গিয়ে লেখালেখির পেছনে কম সময় দিচ্ছেন! হ্যাঁ, কথা ঠিক। তবে তাঁর পরম বন্ধু নাজিম মাহমুদকে বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব থেকে সরে গেছে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানবিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তা বিস্তারের বিকল্প প্রতিষ্ঠান করে তুলতে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, শহিদুল ইসলাম, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আনোয়ার, জুলফিকার মতিন, জাহেদুল হক টুকু, সনৎ কুমার সাহা, মলয় ভৌমিক, মোহাম্মদ নাসের প্রমুখ শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
সত্যি বলতে কি হাসান আজিজুল ছিলেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর পথ প্রদর্শক। নতুন প্রজন্মকে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পথ দেখাতে যত রকম বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন, সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন হাসান আজিজুল হক ও তাঁর সতীর্থগণ। তাঁর ডাকনাম ‘কালো’। ওদিকে নাজিম মাহমুদের ডাকনাম ‘আলো’। নাজিম মাহমুদই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খান সারোয়ার মুরশিদকে অনুরোধ করে হাসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তত দিনে হাসান তাঁর ‘শকুন’ গল্পের জন্য বিদ্বৎমহলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া খান সারোয়ার মুরশিদ জানতেন তরুণ হাসানের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে। কেননা, খুলনায় হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, খালেদ রশিদ গুরু, সাধন সরকারসহ এক ঝাঁক যুবক সন্দীপন নামক সংগঠনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের আগে থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। নাজিম মাহমুদ ও আবুবকর সিদ্দিক আগুনঝরা গান লিখছেন তখন, আর সাধন সরকার সুর করছেন। হাসান আজিজুল হক, খালেদ রশিদ গুরু বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন—এসবই জানতেন খান সারোয়ার মুরশিদ। এ রকম মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আপনা থেকেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। হাসানকে খুলনার ফুলতলা কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে তিনি আর দেরি করেননি।
হ্যাঁ, কেবল ঘরে বসে সাহিত্য করে সন্তুষ্ট থাকেননি হাসান স্যার। তিনি সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কর্মসাধনা করে গেছেন।
একদিন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান স্যার। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার দুজন স্থানীয় ব্যক্তির ঝগড়া শুনছেন ও দেখছেন মন দিয়ে। ঝগড়া করতে করতে তাঁরা পরস্পরকে এমন সব গালি দিচ্ছিলেন যে, স্যারের সামনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘দেখ, মানুষ রেগে গেলে কেমন অঙ্গভঙ্গি করে, গালিগুলো শুনছ তো, আহা, শব্দ তো নয় যেন মুখ থেকে মধু ঝরছে। সবকিছু থেকেই শেখার আছে, বুঝলে!’ বলেই তাঁর আইকনিক হাসি ছড়িয়ে দিলেন কাজলা গেটের ওপারে। স্যারের সঙ্গে এক মিনিট বাক্য বিনিময় করলেও, তা সে যত সিরিয়াস বিষয়েই হোক, তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে হাসিয়ে ছাড়বেন। অথচ, সাহিত্যে তিনি একেবারেই উল্টো। স্যারের ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ার পর একবার আমার ক্লাস টেনের এক ছাত্রী বইটা ফেরত দেওয়ার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলল—এত সুন্দর ভাষায় এমন ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা পড়ে ঠিক থাকতে পারছি না! এই তো হাসান আজিজুল হক।
আমরা অনেকেই জানি না, অনেক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী ছিলেন হাসান স্যার। নাটক করেছেন মনোজ মিত্রের, রবীন্দ্রনাথের, নাজিম মাহমুদের। কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নির্দেশনাও দিয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন সাবলীল। নাজিম মাহমুদের চেতনার সৈকতে অ্যালবামে ভূমিকা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পরম উৎকর্ষের ছাপ। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে শিখিয়েছেন কীভাবে শব্দ ও বাক্যের অর্থ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়!
হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা যারা একবার হলেও শুনেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর কথায় কখনো পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ছিল না। আমরা সবাই তাঁর প্রতিটি শব্দ বুঝতাম। সেগুলো এমনই সরস যে, আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম, রাগে জ্বলে উঠতাম। তবে তাঁর বক্তব্যে কোথাও কোনো সস্তা আবেগ ছিল না। হাস্যকৌতুকের উপমায় মৌলবাদীদের পিঠের ওপর শক্ত চাবুক চালাতেন তিনি অকুতোভয় যোদ্ধার মতো। যোদ্ধাই ছিলেন তিনি। কেবল তাঁর কথা শোনার জন্য নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বাদ দিয়ে দর্শনের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সময়ের অনেকেই করত কাজটা।
একবার অধ্যাপক আব্দুল খালেক যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খালেক স্যারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কাজি নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। হাসান আজিজুল হক সে অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা মাপা শুরু হয়েছে, সেটা দিয়েই ওঁকেও (আব্দুল খালেক) মাপামাপি করতে হবে। দাঁড়িপাল্লায় ত্রুটি থাকলে যত সৎ ব্যবসায়ীই হোন, জিনিস ঠিকঠাক মাপতে পারবেন না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন।’
খালেক স্যার ও হাসান স্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু ঘনিষ্ঠজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তেলতেলে বক্তব্য দিয়ে হাততালি নিচ্ছিলেন, হাসান আজিজুল হক বেশ কঠোর বার্তাই দিয়েছিলেন সেদিনের নতুন উপাচার্যের বরাবর। তাঁর এসব প্রতিবাদী ও পথনির্দেশনামূলক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছুটে যেতেন দেশের যেকোনো জেলা শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, আদিবাসী পল্লিতে—সর্বত্র রয়েছে হাসান স্যারের উদ্দীপনাময় পদচ্ছাপ। কথাসাহিত্যিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের উচ্চতাই শেষ কথা নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কয়েক প্রজন্মের মানস গঠনে। মাঝেমধ্যে অবাক লাগত, এই যে এত সব কাজে জড়িয়ে থাকতেন, হই-হুল্লোড়-আড্ডায় মেতে থাকতেন, লিখতেন কখন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁকে লিখতে হতো অসংখ্য স্মরণিকা, লিফলেট, শুভেচ্ছা বার্তা, নতুন লেখকদের বইয়ের ভূমিকা, আরও কত কী, তার হিসেব নেই। এ রকম মানুষ এ দেশে আর কি দ্বিতীয়টি ছিলেন, যিনি রাজধানীর মোহে আকৃষ্ট হননি, অথচ প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর বাংলাকে! বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে যিনিই গিয়েছেন, তাঁকেই তিনি সময় দিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। বাংলাদেশের প্রথম থিয়েটার ওয়ার্কশপটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বলেই জানি। সে ওয়ার্কশপের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন হাসান স্যার। যত দূর জানা যায়, নাট্যজন মলয় ভৌমিক এবং অনুশীলন নাট্যদল সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপেরই ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর স্যার নিজের বাড়ি তৈরি করলেন শহর থেকে বেশ দূরে, বিহাস আবাসিক এলাকায়। বাড়ির নাম দিলেন উজান। জানতে পেরে কলকাতার বন্ধুরা (সুশীল সাহার উদ্যোগে) উজান নামে একটি স্যুভেনির ছাপিয়ে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কি মহাশ্বেতা দেবী (আজ আর স্পষ্ট মনে করতে পারছি না) লিখেছেন, ‘হাসানের বাড়ি হলো মানে আমাদেরই বাড়ি হলো। আমাদের সবার আশ্রয় হলো!’ সুবিশাল ছিল হাসানের ভালোবাসার পরিসর।
হাসান স্যার নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। আমরা একবার জানতে পারলাম (সম্ভবত ১৯৯৪) হাসান স্যারের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি। স্বনন আয়োজন করল তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হাসান স্যারকে দেখলাম স্যুট-টাই পরেছেন। জন্মদিনের বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। তিনি জানালেন, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন মনে রাখার সংস্কৃতি ছিল না। তাঁর জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি কি-না, তা তিনি নিশ্চিত নন। তবে যেহেতু লিখতে হয়, তাই এই তারিখটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। আর বললেন, ডাকনাম ‘কালো’ হলেও গাঁয়ে আমাকে ‘কেলো’ বলে ডাকত।
হাসানের লাখো ভক্তের কাছে একটি সংবাদ অবিদিতই ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে এই যে, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘ওসব কিছু হয়নি’ বলে কখনো প্রকাশ করেননি। বড় ভাই কবি মোহাম্মদ কামালের সৌজন্যেই সম্ভবত হাসান আজিজুল হকের কবিতার খাতা আমাদের হস্তগত হয়। সরাসরি স্যারের খাতা থেকে আমার ডায়েরিতে একটি কবিতা টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না। সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
কি কি বদলে নেওয়া যায় না?
আপন জন্ম আর অন্যের যৌবন
কপালের একেবারে ভিতরের দিকে
খোদাই করা খুদে খুদে অক্ষর
দুই চোখের পাশে চামড়ার উপর
কাকের পায়ের ছাপ
হয়তো আরও আছে
আঁকাবাঁকা আঙুল, ফাটা পায়ের ভিতরে শুকনো হাড়
ফিরে পাওয়া যায় না
মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন
ফেরা যায় না উৎস-মুখে—
পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়
এরা সবই একমুখে বয়ে যায়
শূন্য থেকে শূন্যে।
এই কবিতাকে কি প্রকাশের অযোগ্য বলা সম্ভব! ‘ফিরে পাওয়া যায় না/ মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন/ ফেরা যায় না উৎস-মুখে—/ পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়...।’ ভাবতে হয়। কিন্তু তিনি কবিতা প্রকাশ করার সামান্য উৎসাহও বোধ করেননি। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। সেটি কে তৈরি করেছিলেন ভুলে গেছি। তবে হাসানের জন্মজগৎ চেনার জন্য তথ্যচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। বাংলাদেশে তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
হাসান স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা করতে গিয়ে কড়া বকা খেয়েছি। আদিবাসীদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সুলতানা কামাল আপাসহ রাজশাহী থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুলতানা আপাও রাজি হলেন। উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি তো আমার ছেলের মতোই, আমার কোনো সমালোচনা করতে হলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারতে। অলক্ষ্যে সমালোচনা করা, আর পেছন থেকে ছুরি মারা তো একই কথা।’ আমি লজ্জা পেলাম। আমার মনে পড়ল, প্রথম আলোয় স্যারের একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। যেটি গল্পকার হাসানের মানের নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। ওনাকে সরাসরি না বলে ফেসবুকে লেখায় স্যার রাগ করেছিলেন। স্যার নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করেছিলেন। চা না খেয়ে তো আসতে দেননি। স্যারের কাছে এই শিক্ষা আমি নিয়েছি—কাউকে যদি কিছু বলার থাকে, সরাসরি তাকে বলাই সংগত।
স্যার, সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করেছে যে, ‘হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন’। খুব কান্না পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসান আজিজুল হক মারা যেতে পারেন না। স্বার্থহীন সৃষ্টিশীল প্রাণ অমর। আপনি থাকছেন বাঙালির অন্তরে।
নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, অনুবাদক

১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিয়েই আবৃত্তি সংগঠন স্বননে সম্পৃক্ত হলাম। ১৯৮১ সালে এই সংগঠনের গোড়াপত্তনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন হাসান আজিজুল হক। স্বনন নামটি তাঁরই দেওয়া।
স্বনন সূত্রেই হাসান স্যারের সান্নিধ্য লাভ। মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের ১৩৭ নম্বর কক্ষটি ছিল হাসান স্যারের বসার ঘর। স্বননের প্রধান পুরুষ নাজিম মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর আমরা স্বননের বসার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সন্ত্রস্ত। স্বননের কার্যক্রমসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিবিধ বাধা আসছিল প্রশাসনের তরফ থেকে। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের হলে ফেরা বাধ্যতামূলক করা হলো। আড্ডা ও গানের শব্দ পেলেই প্রক্টরের বাহিনী এমনকি প্রক্টর নিজেও ধমক ও হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। স্বনন বসার জায়গা হারাল। এমনকি আমাদের প্রিয় শিক্ষকগণ কবিতা পড়ার জন্য একটু জায়গা আমাদের দিতে পারছিলেন না ভয়ে। সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ক্যাম্পাসে হাসান স্যার তাঁর মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের নিজ কক্ষের একটি চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যত দিন আমি আছি, আমার ঘরে বসবে তোমরা, আমি কাউকে ভয় পাই না।’
কেবল স্বনন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি থিয়েটার গ্রুপ থেকে শুরু করে সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি। সে সময়কার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভয়াবহ হুমকিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরম প্রেরণা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের। তাঁর বন্ধুদের অনেক সময়ই তাঁর বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি। তাঁরা মনে করতেন, হাসান এসব করতে গিয়ে লেখালেখির পেছনে কম সময় দিচ্ছেন! হ্যাঁ, কথা ঠিক। তবে তাঁর পরম বন্ধু নাজিম মাহমুদকে বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব থেকে সরে গেছে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানবিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তা বিস্তারের বিকল্প প্রতিষ্ঠান করে তুলতে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, শহিদুল ইসলাম, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আনোয়ার, জুলফিকার মতিন, জাহেদুল হক টুকু, সনৎ কুমার সাহা, মলয় ভৌমিক, মোহাম্মদ নাসের প্রমুখ শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
সত্যি বলতে কি হাসান আজিজুল ছিলেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর পথ প্রদর্শক। নতুন প্রজন্মকে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পথ দেখাতে যত রকম বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন, সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন হাসান আজিজুল হক ও তাঁর সতীর্থগণ। তাঁর ডাকনাম ‘কালো’। ওদিকে নাজিম মাহমুদের ডাকনাম ‘আলো’। নাজিম মাহমুদই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খান সারোয়ার মুরশিদকে অনুরোধ করে হাসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তত দিনে হাসান তাঁর ‘শকুন’ গল্পের জন্য বিদ্বৎমহলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া খান সারোয়ার মুরশিদ জানতেন তরুণ হাসানের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে। কেননা, খুলনায় হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, খালেদ রশিদ গুরু, সাধন সরকারসহ এক ঝাঁক যুবক সন্দীপন নামক সংগঠনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের আগে থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। নাজিম মাহমুদ ও আবুবকর সিদ্দিক আগুনঝরা গান লিখছেন তখন, আর সাধন সরকার সুর করছেন। হাসান আজিজুল হক, খালেদ রশিদ গুরু বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন—এসবই জানতেন খান সারোয়ার মুরশিদ। এ রকম মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আপনা থেকেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। হাসানকে খুলনার ফুলতলা কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে তিনি আর দেরি করেননি।
হ্যাঁ, কেবল ঘরে বসে সাহিত্য করে সন্তুষ্ট থাকেননি হাসান স্যার। তিনি সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কর্মসাধনা করে গেছেন।
একদিন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান স্যার। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার দুজন স্থানীয় ব্যক্তির ঝগড়া শুনছেন ও দেখছেন মন দিয়ে। ঝগড়া করতে করতে তাঁরা পরস্পরকে এমন সব গালি দিচ্ছিলেন যে, স্যারের সামনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘দেখ, মানুষ রেগে গেলে কেমন অঙ্গভঙ্গি করে, গালিগুলো শুনছ তো, আহা, শব্দ তো নয় যেন মুখ থেকে মধু ঝরছে। সবকিছু থেকেই শেখার আছে, বুঝলে!’ বলেই তাঁর আইকনিক হাসি ছড়িয়ে দিলেন কাজলা গেটের ওপারে। স্যারের সঙ্গে এক মিনিট বাক্য বিনিময় করলেও, তা সে যত সিরিয়াস বিষয়েই হোক, তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে হাসিয়ে ছাড়বেন। অথচ, সাহিত্যে তিনি একেবারেই উল্টো। স্যারের ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ার পর একবার আমার ক্লাস টেনের এক ছাত্রী বইটা ফেরত দেওয়ার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলল—এত সুন্দর ভাষায় এমন ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা পড়ে ঠিক থাকতে পারছি না! এই তো হাসান আজিজুল হক।
আমরা অনেকেই জানি না, অনেক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী ছিলেন হাসান স্যার। নাটক করেছেন মনোজ মিত্রের, রবীন্দ্রনাথের, নাজিম মাহমুদের। কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নির্দেশনাও দিয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন সাবলীল। নাজিম মাহমুদের চেতনার সৈকতে অ্যালবামে ভূমিকা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পরম উৎকর্ষের ছাপ। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে শিখিয়েছেন কীভাবে শব্দ ও বাক্যের অর্থ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়!
হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা যারা একবার হলেও শুনেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর কথায় কখনো পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ছিল না। আমরা সবাই তাঁর প্রতিটি শব্দ বুঝতাম। সেগুলো এমনই সরস যে, আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম, রাগে জ্বলে উঠতাম। তবে তাঁর বক্তব্যে কোথাও কোনো সস্তা আবেগ ছিল না। হাস্যকৌতুকের উপমায় মৌলবাদীদের পিঠের ওপর শক্ত চাবুক চালাতেন তিনি অকুতোভয় যোদ্ধার মতো। যোদ্ধাই ছিলেন তিনি। কেবল তাঁর কথা শোনার জন্য নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বাদ দিয়ে দর্শনের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সময়ের অনেকেই করত কাজটা।
একবার অধ্যাপক আব্দুল খালেক যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খালেক স্যারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কাজি নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। হাসান আজিজুল হক সে অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা মাপা শুরু হয়েছে, সেটা দিয়েই ওঁকেও (আব্দুল খালেক) মাপামাপি করতে হবে। দাঁড়িপাল্লায় ত্রুটি থাকলে যত সৎ ব্যবসায়ীই হোন, জিনিস ঠিকঠাক মাপতে পারবেন না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন।’
খালেক স্যার ও হাসান স্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু ঘনিষ্ঠজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তেলতেলে বক্তব্য দিয়ে হাততালি নিচ্ছিলেন, হাসান আজিজুল হক বেশ কঠোর বার্তাই দিয়েছিলেন সেদিনের নতুন উপাচার্যের বরাবর। তাঁর এসব প্রতিবাদী ও পথনির্দেশনামূলক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছুটে যেতেন দেশের যেকোনো জেলা শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, আদিবাসী পল্লিতে—সর্বত্র রয়েছে হাসান স্যারের উদ্দীপনাময় পদচ্ছাপ। কথাসাহিত্যিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের উচ্চতাই শেষ কথা নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কয়েক প্রজন্মের মানস গঠনে। মাঝেমধ্যে অবাক লাগত, এই যে এত সব কাজে জড়িয়ে থাকতেন, হই-হুল্লোড়-আড্ডায় মেতে থাকতেন, লিখতেন কখন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁকে লিখতে হতো অসংখ্য স্মরণিকা, লিফলেট, শুভেচ্ছা বার্তা, নতুন লেখকদের বইয়ের ভূমিকা, আরও কত কী, তার হিসেব নেই। এ রকম মানুষ এ দেশে আর কি দ্বিতীয়টি ছিলেন, যিনি রাজধানীর মোহে আকৃষ্ট হননি, অথচ প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর বাংলাকে! বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে যিনিই গিয়েছেন, তাঁকেই তিনি সময় দিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। বাংলাদেশের প্রথম থিয়েটার ওয়ার্কশপটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বলেই জানি। সে ওয়ার্কশপের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন হাসান স্যার। যত দূর জানা যায়, নাট্যজন মলয় ভৌমিক এবং অনুশীলন নাট্যদল সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপেরই ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর স্যার নিজের বাড়ি তৈরি করলেন শহর থেকে বেশ দূরে, বিহাস আবাসিক এলাকায়। বাড়ির নাম দিলেন উজান। জানতে পেরে কলকাতার বন্ধুরা (সুশীল সাহার উদ্যোগে) উজান নামে একটি স্যুভেনির ছাপিয়ে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কি মহাশ্বেতা দেবী (আজ আর স্পষ্ট মনে করতে পারছি না) লিখেছেন, ‘হাসানের বাড়ি হলো মানে আমাদেরই বাড়ি হলো। আমাদের সবার আশ্রয় হলো!’ সুবিশাল ছিল হাসানের ভালোবাসার পরিসর।
হাসান স্যার নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। আমরা একবার জানতে পারলাম (সম্ভবত ১৯৯৪) হাসান স্যারের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি। স্বনন আয়োজন করল তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হাসান স্যারকে দেখলাম স্যুট-টাই পরেছেন। জন্মদিনের বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। তিনি জানালেন, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন মনে রাখার সংস্কৃতি ছিল না। তাঁর জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি কি-না, তা তিনি নিশ্চিত নন। তবে যেহেতু লিখতে হয়, তাই এই তারিখটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। আর বললেন, ডাকনাম ‘কালো’ হলেও গাঁয়ে আমাকে ‘কেলো’ বলে ডাকত।
হাসানের লাখো ভক্তের কাছে একটি সংবাদ অবিদিতই ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে এই যে, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘ওসব কিছু হয়নি’ বলে কখনো প্রকাশ করেননি। বড় ভাই কবি মোহাম্মদ কামালের সৌজন্যেই সম্ভবত হাসান আজিজুল হকের কবিতার খাতা আমাদের হস্তগত হয়। সরাসরি স্যারের খাতা থেকে আমার ডায়েরিতে একটি কবিতা টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না। সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
কি কি বদলে নেওয়া যায় না?
আপন জন্ম আর অন্যের যৌবন
কপালের একেবারে ভিতরের দিকে
খোদাই করা খুদে খুদে অক্ষর
দুই চোখের পাশে চামড়ার উপর
কাকের পায়ের ছাপ
হয়তো আরও আছে
আঁকাবাঁকা আঙুল, ফাটা পায়ের ভিতরে শুকনো হাড়
ফিরে পাওয়া যায় না
মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন
ফেরা যায় না উৎস-মুখে—
পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়
এরা সবই একমুখে বয়ে যায়
শূন্য থেকে শূন্যে।
এই কবিতাকে কি প্রকাশের অযোগ্য বলা সম্ভব! ‘ফিরে পাওয়া যায় না/ মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন/ ফেরা যায় না উৎস-মুখে—/ পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়...।’ ভাবতে হয়। কিন্তু তিনি কবিতা প্রকাশ করার সামান্য উৎসাহও বোধ করেননি। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। সেটি কে তৈরি করেছিলেন ভুলে গেছি। তবে হাসানের জন্মজগৎ চেনার জন্য তথ্যচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। বাংলাদেশে তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
হাসান স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা করতে গিয়ে কড়া বকা খেয়েছি। আদিবাসীদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সুলতানা কামাল আপাসহ রাজশাহী থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুলতানা আপাও রাজি হলেন। উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি তো আমার ছেলের মতোই, আমার কোনো সমালোচনা করতে হলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারতে। অলক্ষ্যে সমালোচনা করা, আর পেছন থেকে ছুরি মারা তো একই কথা।’ আমি লজ্জা পেলাম। আমার মনে পড়ল, প্রথম আলোয় স্যারের একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। যেটি গল্পকার হাসানের মানের নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। ওনাকে সরাসরি না বলে ফেসবুকে লেখায় স্যার রাগ করেছিলেন। স্যার নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করেছিলেন। চা না খেয়ে তো আসতে দেননি। স্যারের কাছে এই শিক্ষা আমি নিয়েছি—কাউকে যদি কিছু বলার থাকে, সরাসরি তাকে বলাই সংগত।
স্যার, সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করেছে যে, ‘হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন’। খুব কান্না পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসান আজিজুল হক মারা যেতে পারেন না। স্বার্থহীন সৃষ্টিশীল প্রাণ অমর। আপনি থাকছেন বাঙালির অন্তরে।
নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, অনুবাদক
নূরুননবী শান্ত

১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিয়েই আবৃত্তি সংগঠন স্বননে সম্পৃক্ত হলাম। ১৯৮১ সালে এই সংগঠনের গোড়াপত্তনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন হাসান আজিজুল হক। স্বনন নামটি তাঁরই দেওয়া।
স্বনন সূত্রেই হাসান স্যারের সান্নিধ্য লাভ। মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের ১৩৭ নম্বর কক্ষটি ছিল হাসান স্যারের বসার ঘর। স্বননের প্রধান পুরুষ নাজিম মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর আমরা স্বননের বসার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সন্ত্রস্ত। স্বননের কার্যক্রমসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিবিধ বাধা আসছিল প্রশাসনের তরফ থেকে। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের হলে ফেরা বাধ্যতামূলক করা হলো। আড্ডা ও গানের শব্দ পেলেই প্রক্টরের বাহিনী এমনকি প্রক্টর নিজেও ধমক ও হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। স্বনন বসার জায়গা হারাল। এমনকি আমাদের প্রিয় শিক্ষকগণ কবিতা পড়ার জন্য একটু জায়গা আমাদের দিতে পারছিলেন না ভয়ে। সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ক্যাম্পাসে হাসান স্যার তাঁর মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের নিজ কক্ষের একটি চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যত দিন আমি আছি, আমার ঘরে বসবে তোমরা, আমি কাউকে ভয় পাই না।’
কেবল স্বনন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি থিয়েটার গ্রুপ থেকে শুরু করে সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি। সে সময়কার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভয়াবহ হুমকিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরম প্রেরণা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের। তাঁর বন্ধুদের অনেক সময়ই তাঁর বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি। তাঁরা মনে করতেন, হাসান এসব করতে গিয়ে লেখালেখির পেছনে কম সময় দিচ্ছেন! হ্যাঁ, কথা ঠিক। তবে তাঁর পরম বন্ধু নাজিম মাহমুদকে বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব থেকে সরে গেছে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানবিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তা বিস্তারের বিকল্প প্রতিষ্ঠান করে তুলতে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, শহিদুল ইসলাম, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আনোয়ার, জুলফিকার মতিন, জাহেদুল হক টুকু, সনৎ কুমার সাহা, মলয় ভৌমিক, মোহাম্মদ নাসের প্রমুখ শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
সত্যি বলতে কি হাসান আজিজুল ছিলেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর পথ প্রদর্শক। নতুন প্রজন্মকে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পথ দেখাতে যত রকম বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন, সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন হাসান আজিজুল হক ও তাঁর সতীর্থগণ। তাঁর ডাকনাম ‘কালো’। ওদিকে নাজিম মাহমুদের ডাকনাম ‘আলো’। নাজিম মাহমুদই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খান সারোয়ার মুরশিদকে অনুরোধ করে হাসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তত দিনে হাসান তাঁর ‘শকুন’ গল্পের জন্য বিদ্বৎমহলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া খান সারোয়ার মুরশিদ জানতেন তরুণ হাসানের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে। কেননা, খুলনায় হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, খালেদ রশিদ গুরু, সাধন সরকারসহ এক ঝাঁক যুবক সন্দীপন নামক সংগঠনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের আগে থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। নাজিম মাহমুদ ও আবুবকর সিদ্দিক আগুনঝরা গান লিখছেন তখন, আর সাধন সরকার সুর করছেন। হাসান আজিজুল হক, খালেদ রশিদ গুরু বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন—এসবই জানতেন খান সারোয়ার মুরশিদ। এ রকম মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আপনা থেকেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। হাসানকে খুলনার ফুলতলা কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে তিনি আর দেরি করেননি।
হ্যাঁ, কেবল ঘরে বসে সাহিত্য করে সন্তুষ্ট থাকেননি হাসান স্যার। তিনি সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কর্মসাধনা করে গেছেন।
একদিন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান স্যার। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার দুজন স্থানীয় ব্যক্তির ঝগড়া শুনছেন ও দেখছেন মন দিয়ে। ঝগড়া করতে করতে তাঁরা পরস্পরকে এমন সব গালি দিচ্ছিলেন যে, স্যারের সামনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘দেখ, মানুষ রেগে গেলে কেমন অঙ্গভঙ্গি করে, গালিগুলো শুনছ তো, আহা, শব্দ তো নয় যেন মুখ থেকে মধু ঝরছে। সবকিছু থেকেই শেখার আছে, বুঝলে!’ বলেই তাঁর আইকনিক হাসি ছড়িয়ে দিলেন কাজলা গেটের ওপারে। স্যারের সঙ্গে এক মিনিট বাক্য বিনিময় করলেও, তা সে যত সিরিয়াস বিষয়েই হোক, তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে হাসিয়ে ছাড়বেন। অথচ, সাহিত্যে তিনি একেবারেই উল্টো। স্যারের ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ার পর একবার আমার ক্লাস টেনের এক ছাত্রী বইটা ফেরত দেওয়ার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলল—এত সুন্দর ভাষায় এমন ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা পড়ে ঠিক থাকতে পারছি না! এই তো হাসান আজিজুল হক।
আমরা অনেকেই জানি না, অনেক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী ছিলেন হাসান স্যার। নাটক করেছেন মনোজ মিত্রের, রবীন্দ্রনাথের, নাজিম মাহমুদের। কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নির্দেশনাও দিয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন সাবলীল। নাজিম মাহমুদের চেতনার সৈকতে অ্যালবামে ভূমিকা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পরম উৎকর্ষের ছাপ। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে শিখিয়েছেন কীভাবে শব্দ ও বাক্যের অর্থ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়!
হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা যারা একবার হলেও শুনেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর কথায় কখনো পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ছিল না। আমরা সবাই তাঁর প্রতিটি শব্দ বুঝতাম। সেগুলো এমনই সরস যে, আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম, রাগে জ্বলে উঠতাম। তবে তাঁর বক্তব্যে কোথাও কোনো সস্তা আবেগ ছিল না। হাস্যকৌতুকের উপমায় মৌলবাদীদের পিঠের ওপর শক্ত চাবুক চালাতেন তিনি অকুতোভয় যোদ্ধার মতো। যোদ্ধাই ছিলেন তিনি। কেবল তাঁর কথা শোনার জন্য নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বাদ দিয়ে দর্শনের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সময়ের অনেকেই করত কাজটা।
একবার অধ্যাপক আব্দুল খালেক যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খালেক স্যারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কাজি নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। হাসান আজিজুল হক সে অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা মাপা শুরু হয়েছে, সেটা দিয়েই ওঁকেও (আব্দুল খালেক) মাপামাপি করতে হবে। দাঁড়িপাল্লায় ত্রুটি থাকলে যত সৎ ব্যবসায়ীই হোন, জিনিস ঠিকঠাক মাপতে পারবেন না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন।’
খালেক স্যার ও হাসান স্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু ঘনিষ্ঠজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তেলতেলে বক্তব্য দিয়ে হাততালি নিচ্ছিলেন, হাসান আজিজুল হক বেশ কঠোর বার্তাই দিয়েছিলেন সেদিনের নতুন উপাচার্যের বরাবর। তাঁর এসব প্রতিবাদী ও পথনির্দেশনামূলক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছুটে যেতেন দেশের যেকোনো জেলা শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, আদিবাসী পল্লিতে—সর্বত্র রয়েছে হাসান স্যারের উদ্দীপনাময় পদচ্ছাপ। কথাসাহিত্যিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের উচ্চতাই শেষ কথা নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কয়েক প্রজন্মের মানস গঠনে। মাঝেমধ্যে অবাক লাগত, এই যে এত সব কাজে জড়িয়ে থাকতেন, হই-হুল্লোড়-আড্ডায় মেতে থাকতেন, লিখতেন কখন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁকে লিখতে হতো অসংখ্য স্মরণিকা, লিফলেট, শুভেচ্ছা বার্তা, নতুন লেখকদের বইয়ের ভূমিকা, আরও কত কী, তার হিসেব নেই। এ রকম মানুষ এ দেশে আর কি দ্বিতীয়টি ছিলেন, যিনি রাজধানীর মোহে আকৃষ্ট হননি, অথচ প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর বাংলাকে! বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে যিনিই গিয়েছেন, তাঁকেই তিনি সময় দিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। বাংলাদেশের প্রথম থিয়েটার ওয়ার্কশপটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বলেই জানি। সে ওয়ার্কশপের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন হাসান স্যার। যত দূর জানা যায়, নাট্যজন মলয় ভৌমিক এবং অনুশীলন নাট্যদল সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপেরই ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর স্যার নিজের বাড়ি তৈরি করলেন শহর থেকে বেশ দূরে, বিহাস আবাসিক এলাকায়। বাড়ির নাম দিলেন উজান। জানতে পেরে কলকাতার বন্ধুরা (সুশীল সাহার উদ্যোগে) উজান নামে একটি স্যুভেনির ছাপিয়ে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কি মহাশ্বেতা দেবী (আজ আর স্পষ্ট মনে করতে পারছি না) লিখেছেন, ‘হাসানের বাড়ি হলো মানে আমাদেরই বাড়ি হলো। আমাদের সবার আশ্রয় হলো!’ সুবিশাল ছিল হাসানের ভালোবাসার পরিসর।
হাসান স্যার নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। আমরা একবার জানতে পারলাম (সম্ভবত ১৯৯৪) হাসান স্যারের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি। স্বনন আয়োজন করল তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হাসান স্যারকে দেখলাম স্যুট-টাই পরেছেন। জন্মদিনের বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। তিনি জানালেন, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন মনে রাখার সংস্কৃতি ছিল না। তাঁর জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি কি-না, তা তিনি নিশ্চিত নন। তবে যেহেতু লিখতে হয়, তাই এই তারিখটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। আর বললেন, ডাকনাম ‘কালো’ হলেও গাঁয়ে আমাকে ‘কেলো’ বলে ডাকত।
হাসানের লাখো ভক্তের কাছে একটি সংবাদ অবিদিতই ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে এই যে, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘ওসব কিছু হয়নি’ বলে কখনো প্রকাশ করেননি। বড় ভাই কবি মোহাম্মদ কামালের সৌজন্যেই সম্ভবত হাসান আজিজুল হকের কবিতার খাতা আমাদের হস্তগত হয়। সরাসরি স্যারের খাতা থেকে আমার ডায়েরিতে একটি কবিতা টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না। সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
কি কি বদলে নেওয়া যায় না?
আপন জন্ম আর অন্যের যৌবন
কপালের একেবারে ভিতরের দিকে
খোদাই করা খুদে খুদে অক্ষর
দুই চোখের পাশে চামড়ার উপর
কাকের পায়ের ছাপ
হয়তো আরও আছে
আঁকাবাঁকা আঙুল, ফাটা পায়ের ভিতরে শুকনো হাড়
ফিরে পাওয়া যায় না
মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন
ফেরা যায় না উৎস-মুখে—
পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়
এরা সবই একমুখে বয়ে যায়
শূন্য থেকে শূন্যে।
এই কবিতাকে কি প্রকাশের অযোগ্য বলা সম্ভব! ‘ফিরে পাওয়া যায় না/ মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন/ ফেরা যায় না উৎস-মুখে—/ পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়...।’ ভাবতে হয়। কিন্তু তিনি কবিতা প্রকাশ করার সামান্য উৎসাহও বোধ করেননি। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। সেটি কে তৈরি করেছিলেন ভুলে গেছি। তবে হাসানের জন্মজগৎ চেনার জন্য তথ্যচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। বাংলাদেশে তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
হাসান স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা করতে গিয়ে কড়া বকা খেয়েছি। আদিবাসীদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সুলতানা কামাল আপাসহ রাজশাহী থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুলতানা আপাও রাজি হলেন। উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি তো আমার ছেলের মতোই, আমার কোনো সমালোচনা করতে হলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারতে। অলক্ষ্যে সমালোচনা করা, আর পেছন থেকে ছুরি মারা তো একই কথা।’ আমি লজ্জা পেলাম। আমার মনে পড়ল, প্রথম আলোয় স্যারের একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। যেটি গল্পকার হাসানের মানের নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। ওনাকে সরাসরি না বলে ফেসবুকে লেখায় স্যার রাগ করেছিলেন। স্যার নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করেছিলেন। চা না খেয়ে তো আসতে দেননি। স্যারের কাছে এই শিক্ষা আমি নিয়েছি—কাউকে যদি কিছু বলার থাকে, সরাসরি তাকে বলাই সংগত।
স্যার, সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করেছে যে, ‘হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন’। খুব কান্না পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসান আজিজুল হক মারা যেতে পারেন না। স্বার্থহীন সৃষ্টিশীল প্রাণ অমর। আপনি থাকছেন বাঙালির অন্তরে।
নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, অনুবাদক

১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিয়েই আবৃত্তি সংগঠন স্বননে সম্পৃক্ত হলাম। ১৯৮১ সালে এই সংগঠনের গোড়াপত্তনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন হাসান আজিজুল হক। স্বনন নামটি তাঁরই দেওয়া।
স্বনন সূত্রেই হাসান স্যারের সান্নিধ্য লাভ। মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের ১৩৭ নম্বর কক্ষটি ছিল হাসান স্যারের বসার ঘর। স্বননের প্রধান পুরুষ নাজিম মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর আমরা স্বননের বসার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সন্ত্রস্ত। স্বননের কার্যক্রমসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিবিধ বাধা আসছিল প্রশাসনের তরফ থেকে। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের হলে ফেরা বাধ্যতামূলক করা হলো। আড্ডা ও গানের শব্দ পেলেই প্রক্টরের বাহিনী এমনকি প্রক্টর নিজেও ধমক ও হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। স্বনন বসার জায়গা হারাল। এমনকি আমাদের প্রিয় শিক্ষকগণ কবিতা পড়ার জন্য একটু জায়গা আমাদের দিতে পারছিলেন না ভয়ে। সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ক্যাম্পাসে হাসান স্যার তাঁর মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের নিজ কক্ষের একটি চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘যত দিন আমি আছি, আমার ঘরে বসবে তোমরা, আমি কাউকে ভয় পাই না।’
কেবল স্বনন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি থিয়েটার গ্রুপ থেকে শুরু করে সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি। সে সময়কার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভয়াবহ হুমকিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরম প্রেরণা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের। তাঁর বন্ধুদের অনেক সময়ই তাঁর বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি। তাঁরা মনে করতেন, হাসান এসব করতে গিয়ে লেখালেখির পেছনে কম সময় দিচ্ছেন! হ্যাঁ, কথা ঠিক। তবে তাঁর পরম বন্ধু নাজিম মাহমুদকে বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব থেকে সরে গেছে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানবিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তা বিস্তারের বিকল্প প্রতিষ্ঠান করে তুলতে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, শহিদুল ইসলাম, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আনোয়ার, জুলফিকার মতিন, জাহেদুল হক টুকু, সনৎ কুমার সাহা, মলয় ভৌমিক, মোহাম্মদ নাসের প্রমুখ শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
সত্যি বলতে কি হাসান আজিজুল ছিলেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর পথ প্রদর্শক। নতুন প্রজন্মকে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পথ দেখাতে যত রকম বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন, সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন হাসান আজিজুল হক ও তাঁর সতীর্থগণ। তাঁর ডাকনাম ‘কালো’। ওদিকে নাজিম মাহমুদের ডাকনাম ‘আলো’। নাজিম মাহমুদই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খান সারোয়ার মুরশিদকে অনুরোধ করে হাসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তত দিনে হাসান তাঁর ‘শকুন’ গল্পের জন্য বিদ্বৎমহলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া খান সারোয়ার মুরশিদ জানতেন তরুণ হাসানের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে। কেননা, খুলনায় হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, খালেদ রশিদ গুরু, সাধন সরকারসহ এক ঝাঁক যুবক সন্দীপন নামক সংগঠনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের আগে থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। নাজিম মাহমুদ ও আবুবকর সিদ্দিক আগুনঝরা গান লিখছেন তখন, আর সাধন সরকার সুর করছেন। হাসান আজিজুল হক, খালেদ রশিদ গুরু বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন—এসবই জানতেন খান সারোয়ার মুরশিদ। এ রকম মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আপনা থেকেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। হাসানকে খুলনার ফুলতলা কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে তিনি আর দেরি করেননি।
হ্যাঁ, কেবল ঘরে বসে সাহিত্য করে সন্তুষ্ট থাকেননি হাসান স্যার। তিনি সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কর্মসাধনা করে গেছেন।
একদিন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান স্যার। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার দুজন স্থানীয় ব্যক্তির ঝগড়া শুনছেন ও দেখছেন মন দিয়ে। ঝগড়া করতে করতে তাঁরা পরস্পরকে এমন সব গালি দিচ্ছিলেন যে, স্যারের সামনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘দেখ, মানুষ রেগে গেলে কেমন অঙ্গভঙ্গি করে, গালিগুলো শুনছ তো, আহা, শব্দ তো নয় যেন মুখ থেকে মধু ঝরছে। সবকিছু থেকেই শেখার আছে, বুঝলে!’ বলেই তাঁর আইকনিক হাসি ছড়িয়ে দিলেন কাজলা গেটের ওপারে। স্যারের সঙ্গে এক মিনিট বাক্য বিনিময় করলেও, তা সে যত সিরিয়াস বিষয়েই হোক, তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে হাসিয়ে ছাড়বেন। অথচ, সাহিত্যে তিনি একেবারেই উল্টো। স্যারের ‘একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা’ আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ার পর একবার আমার ক্লাস টেনের এক ছাত্রী বইটা ফেরত দেওয়ার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলল—এত সুন্দর ভাষায় এমন ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা পড়ে ঠিক থাকতে পারছি না! এই তো হাসান আজিজুল হক।
আমরা অনেকেই জানি না, অনেক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী ছিলেন হাসান স্যার। নাটক করেছেন মনোজ মিত্রের, রবীন্দ্রনাথের, নাজিম মাহমুদের। কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নির্দেশনাও দিয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন সাবলীল। নাজিম মাহমুদের চেতনার সৈকতে অ্যালবামে ভূমিকা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পরম উৎকর্ষের ছাপ। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে শিখিয়েছেন কীভাবে শব্দ ও বাক্যের অর্থ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়!
হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা যারা একবার হলেও শুনেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর কথায় কখনো পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ছিল না। আমরা সবাই তাঁর প্রতিটি শব্দ বুঝতাম। সেগুলো এমনই সরস যে, আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম, রাগে জ্বলে উঠতাম। তবে তাঁর বক্তব্যে কোথাও কোনো সস্তা আবেগ ছিল না। হাস্যকৌতুকের উপমায় মৌলবাদীদের পিঠের ওপর শক্ত চাবুক চালাতেন তিনি অকুতোভয় যোদ্ধার মতো। যোদ্ধাই ছিলেন তিনি। কেবল তাঁর কথা শোনার জন্য নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বাদ দিয়ে দর্শনের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সময়ের অনেকেই করত কাজটা।
একবার অধ্যাপক আব্দুল খালেক যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খালেক স্যারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কাজি নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। হাসান আজিজুল হক সে অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা মাপা শুরু হয়েছে, সেটা দিয়েই ওঁকেও (আব্দুল খালেক) মাপামাপি করতে হবে। দাঁড়িপাল্লায় ত্রুটি থাকলে যত সৎ ব্যবসায়ীই হোন, জিনিস ঠিকঠাক মাপতে পারবেন না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন।’
খালেক স্যার ও হাসান স্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু ঘনিষ্ঠজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তেলতেলে বক্তব্য দিয়ে হাততালি নিচ্ছিলেন, হাসান আজিজুল হক বেশ কঠোর বার্তাই দিয়েছিলেন সেদিনের নতুন উপাচার্যের বরাবর। তাঁর এসব প্রতিবাদী ও পথনির্দেশনামূলক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছুটে যেতেন দেশের যেকোনো জেলা শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, আদিবাসী পল্লিতে—সর্বত্র রয়েছে হাসান স্যারের উদ্দীপনাময় পদচ্ছাপ। কথাসাহিত্যিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের উচ্চতাই শেষ কথা নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কয়েক প্রজন্মের মানস গঠনে। মাঝেমধ্যে অবাক লাগত, এই যে এত সব কাজে জড়িয়ে থাকতেন, হই-হুল্লোড়-আড্ডায় মেতে থাকতেন, লিখতেন কখন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁকে লিখতে হতো অসংখ্য স্মরণিকা, লিফলেট, শুভেচ্ছা বার্তা, নতুন লেখকদের বইয়ের ভূমিকা, আরও কত কী, তার হিসেব নেই। এ রকম মানুষ এ দেশে আর কি দ্বিতীয়টি ছিলেন, যিনি রাজধানীর মোহে আকৃষ্ট হননি, অথচ প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর বাংলাকে! বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে যিনিই গিয়েছেন, তাঁকেই তিনি সময় দিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। বাংলাদেশের প্রথম থিয়েটার ওয়ার্কশপটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বলেই জানি। সে ওয়ার্কশপের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন হাসান স্যার। যত দূর জানা যায়, নাট্যজন মলয় ভৌমিক এবং অনুশীলন নাট্যদল সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপেরই ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর স্যার নিজের বাড়ি তৈরি করলেন শহর থেকে বেশ দূরে, বিহাস আবাসিক এলাকায়। বাড়ির নাম দিলেন উজান। জানতে পেরে কলকাতার বন্ধুরা (সুশীল সাহার উদ্যোগে) উজান নামে একটি স্যুভেনির ছাপিয়ে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কি মহাশ্বেতা দেবী (আজ আর স্পষ্ট মনে করতে পারছি না) লিখেছেন, ‘হাসানের বাড়ি হলো মানে আমাদেরই বাড়ি হলো। আমাদের সবার আশ্রয় হলো!’ সুবিশাল ছিল হাসানের ভালোবাসার পরিসর।
হাসান স্যার নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। আমরা একবার জানতে পারলাম (সম্ভবত ১৯৯৪) হাসান স্যারের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি। স্বনন আয়োজন করল তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হাসান স্যারকে দেখলাম স্যুট-টাই পরেছেন। জন্মদিনের বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। তিনি জানালেন, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন মনে রাখার সংস্কৃতি ছিল না। তাঁর জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি কি-না, তা তিনি নিশ্চিত নন। তবে যেহেতু লিখতে হয়, তাই এই তারিখটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। আর বললেন, ডাকনাম ‘কালো’ হলেও গাঁয়ে আমাকে ‘কেলো’ বলে ডাকত।
হাসানের লাখো ভক্তের কাছে একটি সংবাদ অবিদিতই ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে এই যে, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘ওসব কিছু হয়নি’ বলে কখনো প্রকাশ করেননি। বড় ভাই কবি মোহাম্মদ কামালের সৌজন্যেই সম্ভবত হাসান আজিজুল হকের কবিতার খাতা আমাদের হস্তগত হয়। সরাসরি স্যারের খাতা থেকে আমার ডায়েরিতে একটি কবিতা টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না। সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
কি কি বদলে নেওয়া যায় না?
আপন জন্ম আর অন্যের যৌবন
কপালের একেবারে ভিতরের দিকে
খোদাই করা খুদে খুদে অক্ষর
দুই চোখের পাশে চামড়ার উপর
কাকের পায়ের ছাপ
হয়তো আরও আছে
আঁকাবাঁকা আঙুল, ফাটা পায়ের ভিতরে শুকনো হাড়
ফিরে পাওয়া যায় না
মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন
ফেরা যায় না উৎস-মুখে—
পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়
এরা সবই একমুখে বয়ে যায়
শূন্য থেকে শূন্যে।
এই কবিতাকে কি প্রকাশের অযোগ্য বলা সম্ভব! ‘ফিরে পাওয়া যায় না/ মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন/ ফেরা যায় না উৎস-মুখে—/ পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়...।’ ভাবতে হয়। কিন্তু তিনি কবিতা প্রকাশ করার সামান্য উৎসাহও বোধ করেননি। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। সেটি কে তৈরি করেছিলেন ভুলে গেছি। তবে হাসানের জন্মজগৎ চেনার জন্য তথ্যচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। বাংলাদেশে তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
হাসান স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা করতে গিয়ে কড়া বকা খেয়েছি। আদিবাসীদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সুলতানা কামাল আপাসহ রাজশাহী থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুলতানা আপাও রাজি হলেন। উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি তো আমার ছেলের মতোই, আমার কোনো সমালোচনা করতে হলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারতে। অলক্ষ্যে সমালোচনা করা, আর পেছন থেকে ছুরি মারা তো একই কথা।’ আমি লজ্জা পেলাম। আমার মনে পড়ল, প্রথম আলোয় স্যারের একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। যেটি গল্পকার হাসানের মানের নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। ওনাকে সরাসরি না বলে ফেসবুকে লেখায় স্যার রাগ করেছিলেন। স্যার নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করেছিলেন। চা না খেয়ে তো আসতে দেননি। স্যারের কাছে এই শিক্ষা আমি নিয়েছি—কাউকে যদি কিছু বলার থাকে, সরাসরি তাকে বলাই সংগত।
স্যার, সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করেছে যে, ‘হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন’। খুব কান্না পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। হাসান আজিজুল হক মারা যেতে পারেন না। স্বার্থহীন সৃষ্টিশীল প্রাণ অমর। আপনি থাকছেন বাঙালির অন্তরে।
নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, অনুবাদক

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৮ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

অধ্যাপক আব্দুল খালেক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুনন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দে
১৬ নভেম্বর ২০২১
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক আব্দুল খালেক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুনন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দে
১৬ নভেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৮ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

অধ্যাপক আব্দুল খালেক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুনন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দে
১৬ নভেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৮ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক আব্দুল খালেক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে, প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুনন রাতারাতি পাল্টে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এ দে
১৬ নভেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৮ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে