জাহীদ রেজা নূর
তাতাকে হয়তো আমরা কেউ চিনি না। রাজ্যের উদ্ভট সব গল্প বলে যে মানুষটা আমাদের ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ করেছেন, তাঁর নাম যে তাতা হতে পারে, সে কথা কে আর জানবে? এবং এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে যে তথ্যটি দেওয়া দরকার, তা হলো, তাতা নামটা এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ নামের উপন্যাস থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। সেখানে ছিল দুটি চরিত্র, হাসি আর তাতা।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর মেয়ে সুখলতার ডাক নাম রাখলেন হাসি, ছেলে সুকুমারের ডাক নাম রাখলেন তাতা। সেই তাতাই পরে আমাদের পাগলা দাশু দিয়ে মাতালো, হযবরল দিয়ে মাতালো, আবোলতাবোল দিয়ে মাতালো। মার্ক টোয়েনে ঢোকার বহু আগে, লুইস ক্যারলে ঢোকারও আগে সুকুমার রায়ই তো প্রথম আমাদের চিনিয়ে দেন ননসেন্সের পথ।
ননসেন্স
‘ননসেন্স’ শব্দটি একটা গালি হিসেবেই আমাদের সমাজে প্রচলিত। একসময় কলকাতার সিনেমায় ড্রেসিং গাউন শরীরে জড়িয়ে পাইপ টানতে টানতে ‘ননসেন্স’ ‘স্কাউন্ড্রেল’ ইত্যাদি বলে অভিজাত বৃদ্ধদের মুখে গালি দিতে শোনা যেত। সিনেমার প্রভাবে মধ্যবিত্ত সমাজেও ছড়িয়ে গিয়েছিল গালিটি। কিন্তু ননসেন্সের যে অন্য মানেও হয়, সেটা বুঝতে ঢের দেরি করে ফেলেছিলাম আমরা। নইলে ‘সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার’, ‘হাতে রইল পেন্সিল’, কিংবা ‘চন্দ্রবিন্দুর চ’, ‘বেড়ালের তালব্য শ’, ‘রুমালের মা—হলো চশমা’—এই কথাগুলো কি বোঝা যেত এত সহজে!
ননসেন্স তো ননসেন্স নয়। সেন্স আছে তাতে।
দেখা যাক।
‘হাসতে থাকা জন্তুটা বলছে, ‘এই গেল গেল, নাড়িভুঁড়ি সব ফেটে গেল।’
ও এ রকম সাংঘাতিকভাবে হাসছিল কেন, সে প্রশ্ন করায় জন্তুটি বলল, ‘কেন হাসছি শুনবে? মনে কর, পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হতো, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তার মধ্যে ধপাধপ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে—হোঃ হোঃ হোঃ’ এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল!’
এর পর কুলপি আর টিকটিকি নিয়ে বলা গল্পেও তার হাসি থামানো যায় না। উদ্ভট ভাবনায় তার যেন জুড়ি নেই।
সেই থেকে ননসেন্স আমার প্রিয় বিষয়। সুকুমার রায়ের হৃদয়জুড়ে তথাকথিত ননসেন্সদেরই অবাধ যাতায়াত। সেই থেকে ছাব্বিশ ইঞ্চির ফের আমার আর কাটে না।
সে তো আমার কথা। আরও কত শত, হাজার, লক্ষ, কোটি মানুষ এই হিজিবিজবিজদের জগৎকে আপন করে নিয়েছিলেন, তার কি শেষ আছে?
একটু ধীরে এগোই এবার। এবং পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করি সুকুমার রায়ের একেবারে পাশের বেঞ্চিটার কাছে, যেন তাকালেই তাঁকে দেখা যায়, চোখে চোখ রাখলেই যেন পড়া যায় তাঁর হৃদয়টা।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালে ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে যে নাট্যদলটি গড়েছিলেন, সে বিষয়েও যে কেউ পড়ে নিতে পারেন। আর বলে রাখা ভালো, এই ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখা কাগজ, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা!’
হাস্যরসে ভরপুর লেখালেখির শুরু কিন্তু এই ‘সাড়ে বত্রিশভাজা’য়। এই ক্লাবের জন্যই তিনি লিখেছিলেন দুটি অসাধারণ নাটক, ‘ঝালাপালা’, আর ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। নির্মেদ হাস্যরসাত্মক নাটক যে কেমন হতে পারে, তার সন্ধান করতে হলে এ দুটো পড়া থাকলেই চলবে।
সে সময় ননসেন্স ক্লাবের নাটক দেখার জন্য শুধু কমবয়সীরাই ভিড় জমাত না, ভিড় জমানোর দলে থাকত বুড়োরাও।
সে সময় যারা অভিনয় করত ননসেন্স দলে, তারা নিজেরা অভিনয় করে যেমন আনন্দ পেত, তেমনি তারা অন্যদের আনন্দও দিতে পারত। হাঁদারামের চরিত্র অনবদ্য অভিনয় করতেন স্বয়ং সুকুমার রায়। আরও একটা দারুণ খবর: এই নাটকে বাধা কোনো মঞ্চ ছিল না, সাজসজ্জা বা মেকআপও তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু অভিনয়ের মুন্সিয়ানায়, সংলাপ প্রক্ষেপণের সুরে, ভঙ্গিতে, ভাবে তা ফুটিয়ে তোলা হতো নিখুঁতভাবে।
হাসি আর হইহুল্লোড়
রবীন্দ্রনাথ আর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন বন্ধু মানুষ। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার শান্তিনিকেতনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন তাঁর নিজের ধরনেই।
একটা মজার কথা এখানে বলে রাখি। একটা সময় ছিল, যখন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ছিল খুব অভাব। পয়সার টানাটানি লেগেই আছে। তখন শালপাতায় নুন রেখে কাঁকরভরা চাল ডাল খেতে হতো। আর এ রকম সময় যখন সবার মন ব্যাজার হওয়ার কথা, তখন সুকুমারের মুখে হাসির ফোয়ারা। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’, এই গানটিই হয়ে উঠল সুকুমারের এক্সপেরিমেন্টের বিষয়। তিনি এই গানের আদলে লিখলেন, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায়!’
ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, এই লোকটি জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিলেন। জীবনের ক্লেদ, দারিদ্র্য, কষ্ট—নানা কিছুই তো সঙ্গী ছিল তাঁর, কিন্তু তিনি বাঁচার মতো বেঁচেছিলেন।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথদের মধ্যে যেমন হই–হুল্লোড়, নাটক ইত্যাদির আসর বসত, ঠিক সে রকমই সুকুমার রায়দের মধ্যেও তা ছিল। ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে সাংস্কৃতিক এই মিলটি ছিল বলে মনে হয়।
একটু আগে থেকে
ব্রাহ্ম পরিবারে সুকুমারের জন্ম—এ কথা সবাই জানে। কলকাতাতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। তাঁদের আদি বাড়ি কোথায়, সেটাও তাঁর ছেলে সত্যজিৎ রায়ের পরিচিতির কারণে সবাই জানে। তবে তা ময়মনসিংহ বলেই খ্যাত। আমরা ময়মনসিংহের (এখন তা কিশোরগঞ্জের মধ্যে পড়েছে) ভিতরে মসূয়া গ্রামটিতে যাব। কারণ, এই গ্রামটিতেই ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের ভিটেবাড়ি। সুকুমার রায়ের জন্ম হয়েছিল এই গ্রামেই, সেটা ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর। সুকুমাররা ছিলেন ২ ভাই, ৩ বোন। সুবিনয়, সুবিমল, সুখলতা পর্যন্ত ‘সু’ দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি নিজের সন্তানদের সবার নামের সঙ্গে ‘সু’ যোগ করতে চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী? পরে ভুলে গেছেন সে কথা? তাই পরের দুই মেয়ের নাম রেখেছেন, পূণ্যলতা ও শান্তিলতা?
এটাও আসলে কু-তর্ক। ওই ননসেন্সের প্রভাব। সুকুমারে ঢুকেছি, আর নিজে একটু সেই ভুবনে ঘুরে বেড়াব না, তা কি হয়? যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষ, আমার এই বোকা বিশ্লেষণের বিপরীতে বলতে পারবেন, ‘আরে, তিন বোনের নাম যে “লতা” দিয়ে শেষ হচ্ছে, সেটা দেখতে পাওনি?
দেখতে তো পেয়েছি, কিন্তু সুকুমারের হযবরল-এর মতোই তো আমার পায়ের তলায় সরষে। কোথাও থামার নিয়ম নেই, এমনকি রুমাল থেকে ফ্যাঁচফ্যাচে হাসির মালিক সেই লাল বেড়ালটাও বকাবকি করে আমাকে কোথাও দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না। আমি ঠিকই চোখ খুলে ওর পালিয়ে যাওয়া দেখতে পাব।
পরিবারের সবার নামই তো বলে ফেললাম, কিন্তু ওই ননসেন্সের পাল্লায় পড়েই বাদ রয়ে গেল মায়ের নাম। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রধান সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।
সুকুমার রায় যে ছেলেবেলা থেকেই মুখে মুখে ছড়া রচনা করতেন, সে কথা সবাই জানে। সঙ্গে এ কথাও জানে, তিনি ছিলেন সর্দার ধরনের। যেকোনো আসরের মধ্যমণি ছিলেন। সুতার্কিক হয়ে ওঠায় ছেলেবেলা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন সুকুমার, তাই শুধু বন্ধুমহলেই নয়, বড়দের মধ্যেও তাঁর প্রতি আগ্রহ ছিল।
লেখা আর পড়া, এবং সন্দেশ!
যিনি বাচ্চাদের জন্য গড়ে দেবেন কল্পনার এক বিশাল জগৎ, তিনি তো পড়ালেখা করবেন সাহিত্য নিয়েই! সে রকমটাই তো হওয়ার কথা! কিন্তু সেটা হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। এই ব্যক্তির মগজটা আমাদের অনেকের মতো গোবর পোরা ছিল না। পরিষ্কার ছিল তাঁর ভাবনা। তাই পড়াশোনাটাকেও নিলেন নিজের মতো করে। কলকাতার সিটি স্কুল থেকে তিনি পাস করেছিলেন এন্ট্রান্স। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় পাস করেন অনার্স। সেটা ১৯০৬ সাল। এর পর তিনি ১৯১১ সালে বিলেতে চলে যান উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। সেখানে তিনি শেখেন ফটোগ্রাফি, আর মুদ্রণ প্রযুক্তি। ছেলে সত্যজিতের শখ কেন চলচ্চিত্রের দিকে গিয়েছিল, তা বাবা সুকুমারের আগ্রহগুলোর দিকে তাকালেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
সুকুমার যখন ইংল্যান্ডের পড়ুয়া, তখন তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপন করেন। আমরা তো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অনেকগুলো মনকাড়া বই পড়েছি, তার মধ্যে ‘টুনটুনির বই’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘ছেলেদের রামায়ণ’ পড়তে বসলে বোঝা যায়, কঠিন কঠিন বিষয়কে কী অসাধারণ নান্দনিকতায় পুরে বিষয়গুলো বুনেছেন তিনি! প্রেস যখন হলো, তখন আরও বেশি বেশি লেখালেখি, আর ছাপাছাপির কথাও তো এসে পড়ল। কিন্তু বিধি বাম! ১৯১৩ সালে সুকুমার যখন ফিরলেন বিলেত থেকে, তার কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলেন। বাবা বের করছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। সেটা বের করার দায়িত্ব বর্তাল সুকুমার রায়ের ওপর।
এখানেই শুরু হলো সুকুমার রায়ের সৃষ্টিছাড়া শিশুসাহিত্য নির্মাণের কাজ। খুব কম সময়ের মধ্যেই খুদে পাঠকদের প্রাণভোমরা হয়ে উঠলেন সুকুমার রায়। আর হ্যাঁ, খুলে বলতেই হয়, আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীরমুখো বড়রাও প্রকাশ্যে বা আড়ালে পড়তে লাগলেন সুকুমার রায়ের লেখা।
এই দায়িত্ব তিনি পালন করেন বাবার মৃত্যুর ৮ বছর পর পর্যন্ত। তার পর তাঁর দায়িত্বভার সম্পূর্ণভাবে দিয়ে দেন ছোট ভাইয়ের ওপর।
পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন যার ছিল পড়ার বিষয়, তিনি তো বিজ্ঞান নিয়ে লিখবেনই। কিন্তু কেমন হবে সেই লেখা? খটমটে? দেখা যাক। ‘বেগের কথা’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ বের হয়েছিল ১৩২৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায়। তিনি বেগ ও বল বোঝাচ্ছিলেন এভাবে: ‘তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্র মাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে, তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারা গাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উপর হইতে পড়িতে থাকে, তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে…।’
বোঝা গেল?
বিলেতফেরত সুকুমার রায় ‘মনডে ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব খুলেছিলেন। এটাও ছিল ননসেন্স ক্লাবের মতোই। তবে এখানে সাপ্তাহিক একটা সমাবেশ হতো এবং এই সমাবেশে সদস্যেরা নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন।
ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর তরুণ নেতা ছিলেন সুকুমার রায়। তিনি সরল ভাষায় ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন ‘অতীতের কথা’ নামের কাব্যে।
বিয়ে
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার দু মাসের মধ্যেই সুকুমার রায়ের বিয়ে হয়। কন্যা: সুপ্রভা দেবী। তিনি ছিলেন নজগৎচন্দ্র দাশের মেজ মেয়ে। ডাক নাম ছিল টুলু।
এই বিয়েতে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আমন্ত্রিত। কিন্তু বিশেষ জমিদারি কাজে শিলাইদহতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই জানিয়েছিলেন বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসেছিলেন তিনি।
মৃত্যু
মাত্র ৩৬ বছর আয়ু ছিল তাঁর। মারা যান ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে।
এবার একটু আবোলতাবোল কথা
এতক্ষণ শুধু প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস বলে যাওয়া হয়েছে। শুকনো চিড়ে তো ভিজবে না তাতে। এবার চিড়ে ভেজানোর বন্দোবস্ত করি।
‘আবোলতাবোল’ নামে যে ছড়ার বইটি আছে, তা যে এককথায় বিস্ময়কর সৃষ্টি, সে কথা শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আগেই তো বলেছি, লুইস ক্যারল, মার্ক টোয়েনের সঙ্গে সুকুমার রায়ের নাম এক পঙ্ক্তিতেই লেখা হবে। ভরসা দিলে বলতে পারি, কাজের বৈচিত্র্যে তিনি কখনো কখনো এদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল।
ইচ্ছে করছে, পুরো আবোলতাবোলটাই এখানে রেখে যাই। কিন্তু সে তো হবে না, পত্রিকা কেন এত বড় দায়ভার নেবে? তাই একটু একটু করে এগোই।
জালা আর কুঁজোকে নিয়ে যে ছড়াটি, সেটার দিকে চোখ রাখি:
পেটমোটা জালা কয়, ‘হেসে আমি মরিরে
কুঁজো তোর হেন গলা, এতটুকু শরীরে!
কুঁজো কয়, ‘কথা কস আপনারে না চিনে
ভূঁড়িখানা দেখে তোর কেঁদে আর বাঁচিনে।’
সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’ ছড়াটা এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। এখনকার শিশুরা ছড়া পড়ে কিনা, পড়লে কোন ছড়াগুলো পড়ে, সে বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। তবে ‘শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে/ তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে/ গঙ্গারামকে পাত্র পেলে/ জানতে চাও সে কেমন ছেলে?’
সুকুমার রায়ের সেন্স অব হিউমার বুঝতে হলে আবোলতাবোলের কাছেই ফিরে আসতে হবে।
‘পাগলা দাশু’ বইয়ের গল্পগুলো একটির চেয়ে অন্যটি বেশি মজার। ‘দাশুর খ্যাপামি’, ‘চীনেপট্কা’, ‘দাশুর কীর্তি’সহ একের পর এক নামগুলো বলে গেলে বোঝাই যাবে না, কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে। পড়তে হবে। এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই এই কিশোর গল্পগুলোর মধ্যে ঢোকার।
আমি অন্য একটি লেখার কথা বলব এখন। সম্ভবত শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ নামের কিশোর উপন্যাসের কোনো এক চরিত্রের মুখে ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র কথা প্রথম শুনেছিলাম। এখান থেকেই ‘চিল্লানোরাস’ নামটি দেওয়া হয়েছিল একটি চরিত্রকে, সম্ভবত সে চরিত্রটি ছিল নিকুঞ্জ পাকড়াশি বা মুৎসুদ্দি। সন্দেশে জীবজন্তুদের সম্পর্কে নানা কথা ছাপানো হয়েছে, কিন্তু হেশোরামের অদ্ভুত শিকার কাহিনির কোনো কথাই নেই। তাই তিনি গোস্বা করেছেন। তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু অংশ উদ্ধার করে ছাপা হয়েছিল।
এ এক অনন্য কাহিনি। এখানেই আমরা পরিচিত হই হ্যাংলাথেরিয়াম, ল্যাগব্যাগর্নিস, গোমরাথেরিয়াম, বেচারাথেরিয়ামের সঙ্গে।
হযবরল নিয়েই আরেকটু কথা বলে আজকের মতো ইতি টানি।
সম্ভবত ১৯৮২ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে শিশু-কিশোরদের একটি নাট্যোৎসব হয়েছিল। সম্ভবত মোট আটটি নাটক প্রদর্শিত হয়েছিল। আট দিনে আট নাটক। তার একটি ছিল হযবরল। এখনো সে অভিনয় চোখে লেগে আছে। শ্রীকাকেশ্বর কুঁচকুঁচে, হিজিবিজবিজসহ আরও আরও চরিত্ররা আমার কল্পনাকে সুখময় করে তুলেছিল। আর হ্যাঁ, সেই নাটকের একটি গান এখনো সুরসমেত আমার কাছে ফিরে ফিরে আসে—
‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু
আজকে হেতায় চামচিকে আর প্যাঁচারা
আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।’
ব্যাস! এখানেই আমার জ্ঞান শেষ। এরপরও যে পঙ্ক্তিগুলো আছে, তা আর আমার মুখস্থ নেই। কিন্তু যেটুকু আছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, সব সময়ই আমি ননসেন্স হয়ে থাকতে চাই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দিতে চাই লাফ। সেখানেও একটুক্ষণ স্থির থেকে আবার দৌড়ে যাই নতুনের সন্ধানে।
সুকুমার রায় আসলে আমাদের সেই দামি জগৎটার সন্ধানই দিয়েছেন আমাদের, যা জাগতিক জটিলতা থেকে মনকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর সেই দূরত্ব থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে ভালোটাই চোখে পড়ে শুধু।
আরও পড়ুন:
তাতাকে হয়তো আমরা কেউ চিনি না। রাজ্যের উদ্ভট সব গল্প বলে যে মানুষটা আমাদের ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ করেছেন, তাঁর নাম যে তাতা হতে পারে, সে কথা কে আর জানবে? এবং এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে যে তথ্যটি দেওয়া দরকার, তা হলো, তাতা নামটা এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ নামের উপন্যাস থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। সেখানে ছিল দুটি চরিত্র, হাসি আর তাতা।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর মেয়ে সুখলতার ডাক নাম রাখলেন হাসি, ছেলে সুকুমারের ডাক নাম রাখলেন তাতা। সেই তাতাই পরে আমাদের পাগলা দাশু দিয়ে মাতালো, হযবরল দিয়ে মাতালো, আবোলতাবোল দিয়ে মাতালো। মার্ক টোয়েনে ঢোকার বহু আগে, লুইস ক্যারলে ঢোকারও আগে সুকুমার রায়ই তো প্রথম আমাদের চিনিয়ে দেন ননসেন্সের পথ।
ননসেন্স
‘ননসেন্স’ শব্দটি একটা গালি হিসেবেই আমাদের সমাজে প্রচলিত। একসময় কলকাতার সিনেমায় ড্রেসিং গাউন শরীরে জড়িয়ে পাইপ টানতে টানতে ‘ননসেন্স’ ‘স্কাউন্ড্রেল’ ইত্যাদি বলে অভিজাত বৃদ্ধদের মুখে গালি দিতে শোনা যেত। সিনেমার প্রভাবে মধ্যবিত্ত সমাজেও ছড়িয়ে গিয়েছিল গালিটি। কিন্তু ননসেন্সের যে অন্য মানেও হয়, সেটা বুঝতে ঢের দেরি করে ফেলেছিলাম আমরা। নইলে ‘সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার’, ‘হাতে রইল পেন্সিল’, কিংবা ‘চন্দ্রবিন্দুর চ’, ‘বেড়ালের তালব্য শ’, ‘রুমালের মা—হলো চশমা’—এই কথাগুলো কি বোঝা যেত এত সহজে!
ননসেন্স তো ননসেন্স নয়। সেন্স আছে তাতে।
দেখা যাক।
‘হাসতে থাকা জন্তুটা বলছে, ‘এই গেল গেল, নাড়িভুঁড়ি সব ফেটে গেল।’
ও এ রকম সাংঘাতিকভাবে হাসছিল কেন, সে প্রশ্ন করায় জন্তুটি বলল, ‘কেন হাসছি শুনবে? মনে কর, পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হতো, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তার মধ্যে ধপাধপ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে—হোঃ হোঃ হোঃ’ এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল!’
এর পর কুলপি আর টিকটিকি নিয়ে বলা গল্পেও তার হাসি থামানো যায় না। উদ্ভট ভাবনায় তার যেন জুড়ি নেই।
সেই থেকে ননসেন্স আমার প্রিয় বিষয়। সুকুমার রায়ের হৃদয়জুড়ে তথাকথিত ননসেন্সদেরই অবাধ যাতায়াত। সেই থেকে ছাব্বিশ ইঞ্চির ফের আমার আর কাটে না।
সে তো আমার কথা। আরও কত শত, হাজার, লক্ষ, কোটি মানুষ এই হিজিবিজবিজদের জগৎকে আপন করে নিয়েছিলেন, তার কি শেষ আছে?
একটু ধীরে এগোই এবার। এবং পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করি সুকুমার রায়ের একেবারে পাশের বেঞ্চিটার কাছে, যেন তাকালেই তাঁকে দেখা যায়, চোখে চোখ রাখলেই যেন পড়া যায় তাঁর হৃদয়টা।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালে ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে যে নাট্যদলটি গড়েছিলেন, সে বিষয়েও যে কেউ পড়ে নিতে পারেন। আর বলে রাখা ভালো, এই ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখা কাগজ, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা!’
হাস্যরসে ভরপুর লেখালেখির শুরু কিন্তু এই ‘সাড়ে বত্রিশভাজা’য়। এই ক্লাবের জন্যই তিনি লিখেছিলেন দুটি অসাধারণ নাটক, ‘ঝালাপালা’, আর ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। নির্মেদ হাস্যরসাত্মক নাটক যে কেমন হতে পারে, তার সন্ধান করতে হলে এ দুটো পড়া থাকলেই চলবে।
সে সময় ননসেন্স ক্লাবের নাটক দেখার জন্য শুধু কমবয়সীরাই ভিড় জমাত না, ভিড় জমানোর দলে থাকত বুড়োরাও।
সে সময় যারা অভিনয় করত ননসেন্স দলে, তারা নিজেরা অভিনয় করে যেমন আনন্দ পেত, তেমনি তারা অন্যদের আনন্দও দিতে পারত। হাঁদারামের চরিত্র অনবদ্য অভিনয় করতেন স্বয়ং সুকুমার রায়। আরও একটা দারুণ খবর: এই নাটকে বাধা কোনো মঞ্চ ছিল না, সাজসজ্জা বা মেকআপও তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু অভিনয়ের মুন্সিয়ানায়, সংলাপ প্রক্ষেপণের সুরে, ভঙ্গিতে, ভাবে তা ফুটিয়ে তোলা হতো নিখুঁতভাবে।
হাসি আর হইহুল্লোড়
রবীন্দ্রনাথ আর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন বন্ধু মানুষ। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার শান্তিনিকেতনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন তাঁর নিজের ধরনেই।
একটা মজার কথা এখানে বলে রাখি। একটা সময় ছিল, যখন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ছিল খুব অভাব। পয়সার টানাটানি লেগেই আছে। তখন শালপাতায় নুন রেখে কাঁকরভরা চাল ডাল খেতে হতো। আর এ রকম সময় যখন সবার মন ব্যাজার হওয়ার কথা, তখন সুকুমারের মুখে হাসির ফোয়ারা। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’, এই গানটিই হয়ে উঠল সুকুমারের এক্সপেরিমেন্টের বিষয়। তিনি এই গানের আদলে লিখলেন, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায়!’
ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, এই লোকটি জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিলেন। জীবনের ক্লেদ, দারিদ্র্য, কষ্ট—নানা কিছুই তো সঙ্গী ছিল তাঁর, কিন্তু তিনি বাঁচার মতো বেঁচেছিলেন।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথদের মধ্যে যেমন হই–হুল্লোড়, নাটক ইত্যাদির আসর বসত, ঠিক সে রকমই সুকুমার রায়দের মধ্যেও তা ছিল। ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে সাংস্কৃতিক এই মিলটি ছিল বলে মনে হয়।
একটু আগে থেকে
ব্রাহ্ম পরিবারে সুকুমারের জন্ম—এ কথা সবাই জানে। কলকাতাতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। তাঁদের আদি বাড়ি কোথায়, সেটাও তাঁর ছেলে সত্যজিৎ রায়ের পরিচিতির কারণে সবাই জানে। তবে তা ময়মনসিংহ বলেই খ্যাত। আমরা ময়মনসিংহের (এখন তা কিশোরগঞ্জের মধ্যে পড়েছে) ভিতরে মসূয়া গ্রামটিতে যাব। কারণ, এই গ্রামটিতেই ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের ভিটেবাড়ি। সুকুমার রায়ের জন্ম হয়েছিল এই গ্রামেই, সেটা ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর। সুকুমাররা ছিলেন ২ ভাই, ৩ বোন। সুবিনয়, সুবিমল, সুখলতা পর্যন্ত ‘সু’ দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি নিজের সন্তানদের সবার নামের সঙ্গে ‘সু’ যোগ করতে চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী? পরে ভুলে গেছেন সে কথা? তাই পরের দুই মেয়ের নাম রেখেছেন, পূণ্যলতা ও শান্তিলতা?
এটাও আসলে কু-তর্ক। ওই ননসেন্সের প্রভাব। সুকুমারে ঢুকেছি, আর নিজে একটু সেই ভুবনে ঘুরে বেড়াব না, তা কি হয়? যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষ, আমার এই বোকা বিশ্লেষণের বিপরীতে বলতে পারবেন, ‘আরে, তিন বোনের নাম যে “লতা” দিয়ে শেষ হচ্ছে, সেটা দেখতে পাওনি?
দেখতে তো পেয়েছি, কিন্তু সুকুমারের হযবরল-এর মতোই তো আমার পায়ের তলায় সরষে। কোথাও থামার নিয়ম নেই, এমনকি রুমাল থেকে ফ্যাঁচফ্যাচে হাসির মালিক সেই লাল বেড়ালটাও বকাবকি করে আমাকে কোথাও দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না। আমি ঠিকই চোখ খুলে ওর পালিয়ে যাওয়া দেখতে পাব।
পরিবারের সবার নামই তো বলে ফেললাম, কিন্তু ওই ননসেন্সের পাল্লায় পড়েই বাদ রয়ে গেল মায়ের নাম। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রধান সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।
সুকুমার রায় যে ছেলেবেলা থেকেই মুখে মুখে ছড়া রচনা করতেন, সে কথা সবাই জানে। সঙ্গে এ কথাও জানে, তিনি ছিলেন সর্দার ধরনের। যেকোনো আসরের মধ্যমণি ছিলেন। সুতার্কিক হয়ে ওঠায় ছেলেবেলা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন সুকুমার, তাই শুধু বন্ধুমহলেই নয়, বড়দের মধ্যেও তাঁর প্রতি আগ্রহ ছিল।
লেখা আর পড়া, এবং সন্দেশ!
যিনি বাচ্চাদের জন্য গড়ে দেবেন কল্পনার এক বিশাল জগৎ, তিনি তো পড়ালেখা করবেন সাহিত্য নিয়েই! সে রকমটাই তো হওয়ার কথা! কিন্তু সেটা হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। এই ব্যক্তির মগজটা আমাদের অনেকের মতো গোবর পোরা ছিল না। পরিষ্কার ছিল তাঁর ভাবনা। তাই পড়াশোনাটাকেও নিলেন নিজের মতো করে। কলকাতার সিটি স্কুল থেকে তিনি পাস করেছিলেন এন্ট্রান্স। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় পাস করেন অনার্স। সেটা ১৯০৬ সাল। এর পর তিনি ১৯১১ সালে বিলেতে চলে যান উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। সেখানে তিনি শেখেন ফটোগ্রাফি, আর মুদ্রণ প্রযুক্তি। ছেলে সত্যজিতের শখ কেন চলচ্চিত্রের দিকে গিয়েছিল, তা বাবা সুকুমারের আগ্রহগুলোর দিকে তাকালেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
সুকুমার যখন ইংল্যান্ডের পড়ুয়া, তখন তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপন করেন। আমরা তো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অনেকগুলো মনকাড়া বই পড়েছি, তার মধ্যে ‘টুনটুনির বই’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘ছেলেদের রামায়ণ’ পড়তে বসলে বোঝা যায়, কঠিন কঠিন বিষয়কে কী অসাধারণ নান্দনিকতায় পুরে বিষয়গুলো বুনেছেন তিনি! প্রেস যখন হলো, তখন আরও বেশি বেশি লেখালেখি, আর ছাপাছাপির কথাও তো এসে পড়ল। কিন্তু বিধি বাম! ১৯১৩ সালে সুকুমার যখন ফিরলেন বিলেত থেকে, তার কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলেন। বাবা বের করছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। সেটা বের করার দায়িত্ব বর্তাল সুকুমার রায়ের ওপর।
এখানেই শুরু হলো সুকুমার রায়ের সৃষ্টিছাড়া শিশুসাহিত্য নির্মাণের কাজ। খুব কম সময়ের মধ্যেই খুদে পাঠকদের প্রাণভোমরা হয়ে উঠলেন সুকুমার রায়। আর হ্যাঁ, খুলে বলতেই হয়, আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীরমুখো বড়রাও প্রকাশ্যে বা আড়ালে পড়তে লাগলেন সুকুমার রায়ের লেখা।
এই দায়িত্ব তিনি পালন করেন বাবার মৃত্যুর ৮ বছর পর পর্যন্ত। তার পর তাঁর দায়িত্বভার সম্পূর্ণভাবে দিয়ে দেন ছোট ভাইয়ের ওপর।
পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন যার ছিল পড়ার বিষয়, তিনি তো বিজ্ঞান নিয়ে লিখবেনই। কিন্তু কেমন হবে সেই লেখা? খটমটে? দেখা যাক। ‘বেগের কথা’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ বের হয়েছিল ১৩২৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায়। তিনি বেগ ও বল বোঝাচ্ছিলেন এভাবে: ‘তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্র মাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে, তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারা গাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উপর হইতে পড়িতে থাকে, তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে…।’
বোঝা গেল?
বিলেতফেরত সুকুমার রায় ‘মনডে ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব খুলেছিলেন। এটাও ছিল ননসেন্স ক্লাবের মতোই। তবে এখানে সাপ্তাহিক একটা সমাবেশ হতো এবং এই সমাবেশে সদস্যেরা নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন।
ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর তরুণ নেতা ছিলেন সুকুমার রায়। তিনি সরল ভাষায় ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন ‘অতীতের কথা’ নামের কাব্যে।
বিয়ে
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার দু মাসের মধ্যেই সুকুমার রায়ের বিয়ে হয়। কন্যা: সুপ্রভা দেবী। তিনি ছিলেন নজগৎচন্দ্র দাশের মেজ মেয়ে। ডাক নাম ছিল টুলু।
এই বিয়েতে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আমন্ত্রিত। কিন্তু বিশেষ জমিদারি কাজে শিলাইদহতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই জানিয়েছিলেন বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসেছিলেন তিনি।
মৃত্যু
মাত্র ৩৬ বছর আয়ু ছিল তাঁর। মারা যান ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে।
এবার একটু আবোলতাবোল কথা
এতক্ষণ শুধু প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস বলে যাওয়া হয়েছে। শুকনো চিড়ে তো ভিজবে না তাতে। এবার চিড়ে ভেজানোর বন্দোবস্ত করি।
‘আবোলতাবোল’ নামে যে ছড়ার বইটি আছে, তা যে এককথায় বিস্ময়কর সৃষ্টি, সে কথা শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আগেই তো বলেছি, লুইস ক্যারল, মার্ক টোয়েনের সঙ্গে সুকুমার রায়ের নাম এক পঙ্ক্তিতেই লেখা হবে। ভরসা দিলে বলতে পারি, কাজের বৈচিত্র্যে তিনি কখনো কখনো এদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল।
ইচ্ছে করছে, পুরো আবোলতাবোলটাই এখানে রেখে যাই। কিন্তু সে তো হবে না, পত্রিকা কেন এত বড় দায়ভার নেবে? তাই একটু একটু করে এগোই।
জালা আর কুঁজোকে নিয়ে যে ছড়াটি, সেটার দিকে চোখ রাখি:
পেটমোটা জালা কয়, ‘হেসে আমি মরিরে
কুঁজো তোর হেন গলা, এতটুকু শরীরে!
কুঁজো কয়, ‘কথা কস আপনারে না চিনে
ভূঁড়িখানা দেখে তোর কেঁদে আর বাঁচিনে।’
সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’ ছড়াটা এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। এখনকার শিশুরা ছড়া পড়ে কিনা, পড়লে কোন ছড়াগুলো পড়ে, সে বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। তবে ‘শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে/ তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে/ গঙ্গারামকে পাত্র পেলে/ জানতে চাও সে কেমন ছেলে?’
সুকুমার রায়ের সেন্স অব হিউমার বুঝতে হলে আবোলতাবোলের কাছেই ফিরে আসতে হবে।
‘পাগলা দাশু’ বইয়ের গল্পগুলো একটির চেয়ে অন্যটি বেশি মজার। ‘দাশুর খ্যাপামি’, ‘চীনেপট্কা’, ‘দাশুর কীর্তি’সহ একের পর এক নামগুলো বলে গেলে বোঝাই যাবে না, কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে। পড়তে হবে। এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই এই কিশোর গল্পগুলোর মধ্যে ঢোকার।
আমি অন্য একটি লেখার কথা বলব এখন। সম্ভবত শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ নামের কিশোর উপন্যাসের কোনো এক চরিত্রের মুখে ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’র কথা প্রথম শুনেছিলাম। এখান থেকেই ‘চিল্লানোরাস’ নামটি দেওয়া হয়েছিল একটি চরিত্রকে, সম্ভবত সে চরিত্রটি ছিল নিকুঞ্জ পাকড়াশি বা মুৎসুদ্দি। সন্দেশে জীবজন্তুদের সম্পর্কে নানা কথা ছাপানো হয়েছে, কিন্তু হেশোরামের অদ্ভুত শিকার কাহিনির কোনো কথাই নেই। তাই তিনি গোস্বা করেছেন। তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু অংশ উদ্ধার করে ছাপা হয়েছিল।
এ এক অনন্য কাহিনি। এখানেই আমরা পরিচিত হই হ্যাংলাথেরিয়াম, ল্যাগব্যাগর্নিস, গোমরাথেরিয়াম, বেচারাথেরিয়ামের সঙ্গে।
হযবরল নিয়েই আরেকটু কথা বলে আজকের মতো ইতি টানি।
সম্ভবত ১৯৮২ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে শিশু-কিশোরদের একটি নাট্যোৎসব হয়েছিল। সম্ভবত মোট আটটি নাটক প্রদর্শিত হয়েছিল। আট দিনে আট নাটক। তার একটি ছিল হযবরল। এখনো সে অভিনয় চোখে লেগে আছে। শ্রীকাকেশ্বর কুঁচকুঁচে, হিজিবিজবিজসহ আরও আরও চরিত্ররা আমার কল্পনাকে সুখময় করে তুলেছিল। আর হ্যাঁ, সেই নাটকের একটি গান এখনো সুরসমেত আমার কাছে ফিরে ফিরে আসে—
‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু
আজকে হেতায় চামচিকে আর প্যাঁচারা
আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।’
ব্যাস! এখানেই আমার জ্ঞান শেষ। এরপরও যে পঙ্ক্তিগুলো আছে, তা আর আমার মুখস্থ নেই। কিন্তু যেটুকু আছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, সব সময়ই আমি ননসেন্স হয়ে থাকতে চাই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দিতে চাই লাফ। সেখানেও একটুক্ষণ স্থির থেকে আবার দৌড়ে যাই নতুনের সন্ধানে।
সুকুমার রায় আসলে আমাদের সেই দামি জগৎটার সন্ধানই দিয়েছেন আমাদের, যা জাগতিক জটিলতা থেকে মনকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর সেই দূরত্ব থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে ভালোটাই চোখে পড়ে শুধু।
আরও পড়ুন:
ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি ছিলেন জন কিটস। কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছরের। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত। মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তাঁর কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমালোচকদের দ্বারা কিটসের কবিতা খুব একটা আলোচিত হয়নি। তবে মৃত্য
৬ ঘণ্টা আগেত্রিশের দশকের রবীন্দ্রকাব্যধারাবিরোধী পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে অন্যতম একজন কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর জন্ম ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতীবাগানে। তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন দার্শনিক। আর স্ত্রী ছিলেন প্রসিদ্ধ গায়িকা রাজেশ্বরী বাসুদেব।
১ দিন আগেসিলভিয়া প্লাথ ছিলেন একজন মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি নারীবাদী কবি হিসেবেও পরিচিত। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং নারীর পরিচয়-সংকট নিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় সাজিয়েছেন স্পষ্টভাবে।
৪ দিন আগেবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি কৌতুকমিশ্রিত গল্পের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। নামের মিল থাকলেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর তিনি কিন্তু আলাদা ব্যক্তি।
৭ দিন আগে