ফজলুল কবির
এক স্কুলে রচনা লিখতে দেওয়া হলো, ‘যদি আমি এক দিনের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতাম’।
-গাধা নাকি! কী করে এ ধরনের প্রশ্ন মাথায় আসে এদের? রাশিয়ায় কি কেউ এক দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হয়? দেখাতে পারবে কেউ সে রকম প্রেসিডেন্ট?
(রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর)
ওপরের এই কল্পিত রচনা প্রতিযোগিতার বিষয় এবং তাতে ঊহ্য শিক্ষার্থীর প্রতিক্রিয়া নিছক কৌতুক। কিন্তু একে কি নিছক কৌতুক বলা যায়? দেশটি যখন রাশিয়া, তখন কৌতুকের প্রশ্নটি কার উদ্দেশে, তা তো আর বলে দিতে হবে না। ভ্লাদিমির পুতিন—এই সময়ের অন্যতম কর্তৃত্ববাদী শাসক, যিনি কবে থেকে রাশিয়া শাসন করছেন, তা অনেকে ভুলে গেছেন; আর কত দিন শাসন করবেন, তা-ও কেউ জানে না।
আরেকটি কৌতুক শোনা যাক, ‘সাবধান, গাড়িটি উল্টো পথে যাচ্ছে।’ কী, বোঝা গেল কিছু? এবার তাহলে প্রেক্ষাপটটি বলা যাক। এটি ২০১৮ সালে চীনের এক কলামিস্টের করা মন্তব্য। অনলাইনে এই বাক্য সে সময় বেশ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ আর কিছুই নয়, এর কিছুদিন আগেই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপর একে একে এ ধরনের ছোট ছোট মন্তব্য, কৌতুক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদি যতই নিয়ন্ত্রণ করা হোক না কেন, মানুষ ঠিকই তার মতটি দিয়ে দিচ্ছে—সরাসরি নয়, কৌতুকের মাধ্যমে।
এটি শুধু রাশিয়া বা চীনের বাস্তবতা নয়, সারা বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসন যত বাড়ছে, মানুষের মধ্যে কৌতুকপ্রবণতা তত বাড়ছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ অনায়াসে দেওয়া যায়। না, দেশটি সে অর্থে গণতন্ত্রের পথ থেকে পিছলে যায়নি। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তাঁকে নিয়ে যে পরিমাণ কৌতুক, কার্টুন, স্ট্যান্ড-আপ কমেডি হয়েছে, তেমনটি আর কখনো দেখা যায়নি।
কোনো এক নির্বোধকে উপমা ধরে বা কোনো কল্পিত নির্বোধকে হাজির করে তাকে ক্রমাগত হেনস্তা করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যে মজা বা কৌতুক উপস্থাপন করা হয়, তাকে যতই নিরীহ মনে হোক, তার মধ্যে বারুদস্বভাব আছে। এই বারুদের অস্তিত্ব সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে বুঝুক না বুঝুক, কর্তৃত্ববাদী শাসক ঠিকই বোঝে। যেমন হংকংয়ের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সম্প্রচারমাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘হেডলাইনার’ নামের শো। ৩১ বছর ধরে এই শো রম্য-রসের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেছে; ছিল জনপ্রিয়ও। শুধু তা-ই নয়, এর উপস্থাপকদের হংকং ছেড়ে তাইওয়ান ও ব্রিটেনে পাড়ি জমাতে হয়েছে। প্রেক্ষাপটটি বোঝা যাবে হংকংয়ে গত কয়েক বছরে চলমান অস্থিতিশীলতা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে তাকালে।
শুধু হংকং নয়, ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় র্যাপার ও কমেডিয়ান প্রিটিপলসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিছুদিন আগে। অপরাধ—তিনি মালয় ও ভারতীয় সংখ্যালঘুদের উপস্থাপনের জন্য নিজের মুখে বাদামি রং করে একটি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন। চীনা সংখ্যাগুরু অভিজাত শ্রেণি দ্বারা শাসিত সিঙ্গাপুরের শাসকদের বর্ণবাদী মনোভাবই তিনি হয়তো ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথচ নিজেদের বর্ণবাদী আচরণ ও শাসনপন্থা নিয়ে সেখানকার প্রশাসন একেবারে চুপ।
না, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা সব সময় কৌতুক, রঙ্গরস বা রম্যের ওপর চড়াও হন না। তাঁরা শুধু একটা সীমা টেনে দেন—এটুকু করা যাবে; এর বাইরে নয়। চীনে যেমন এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশিত হয়। কিন্তু সেখানে কোনো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কৌতুক করা যায় না। কথা হলো ‘সংবেদনশীল’-এর সংজ্ঞাটি কে নির্ধারণ করে? উত্তর—অবশ্যই শাসক।
এতে কি থামানো যাচ্ছে? না, যাচ্ছে না। সারা বিশ্বেই স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চীনেই যেমন সাংহাই বা বেইজিংয়ে মানুষ টিকিট কেটে কৌতুক শুনতে যাচ্ছে। অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম টেনসেন্টে ‘রক অ্যান্ড রোস্ট’ নামের শোয়ের দর্শকসংখ্যার দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। সেখানে রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু নানা সামাজিক সংকট সামনে এনে এমন এমন কৌতুক পরিবেশন করা হয়, যেখানে লক্ষ্যবস্তুটি প্রচ্ছন্ন থাকে। ভারতে ‘কপিল শর্মা শো’ তো রীতিমতো রাজত্ব করছে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের টিভি চ্যানেলগুলোতেও আছে এ ধরনের আলাদা আলাদা শো। কলকাতার ‘মীরাক্কেল’-এর কথাই-বা বাদ যাবে কেন? ইউটিউবে এসব অনুষ্ঠানের একেকটি পর্বের ভিডিওর দর্শকসংখ্যার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে—কতটা হাঁসফাঁস করছে মানুষ।
কৌতুকে মানুষ কখন এতটা ডুবে যায়? উত্তর—যখন মানুষ বিদ্যমান বাস্তবতায় আর টিকতে পারে না, আবার এই না পারার কথাটিও বলতে পারে না মুখ ফুটে, যখন যাবতীয় অভাব-অভিযোগ, দাবি ইত্যাদি কর্তৃপক্ষীয় মারের মুখে স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন তারা কৌতুকের পথে হাঁটে। নিজের অপারগতা নিয়ে নিজেকেই উপহাস করে। প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রান্তকেই হেয় করে। শাসকের নামটি মুখে নিয়ে বা না নিয়েই চলে এই কৌতুক। শাসকের নামটি ঊহ্য থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রটি কতটা কর্তৃত্বপরায়ণ হলো, তার ওপর।
ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, কাজাখস্তান থেকে ভিয়েতনাম, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এশিয়ার দেশগুলোতে কার্টুন এ ক্ষেত্রে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে। এ জন্য কার্টুনিস্টদেরও কম হেনস্তা হতে হচ্ছে না—কখনো সরকার সরাসরি, কখনো তাদের দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে এ হেনস্তার শিকার হতে হয়। মিয়ানমারে যেমন জনপ্রিয় কমেডিয়ান জারগানারকে ২০০৮ সালে ৫৯ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিন বছর কারাভোগ করে তিনি মুক্তি পান। তবে ২০২১ সালে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এখন আবার তিনি মুক্ত। দেশটির বহু কমেডিয়ান, কার্টুনিস্ট এখন গোপনে তাঁদের কাজ চালাচ্ছেন।
বাদ নেই ভারতও। দেশটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জন্য মুনাওয়ার ফারুকী কমেডি শো করা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে এক মাসের মতো কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক তাঁর শো বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কারণ হিসেবে বলা হয়—তিনি ‘বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব’। গত বছরের জানুয়ারিতে কট্টর ডানপন্থী নেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এত সব হেনস্তার পর তিনি তাঁর শো চালিয়ে যেতে চাননি।
হাস্যরস বা রম্য কিংবা কৌতুক ইত্যাদি নিয়ে জলঘোলাও কম হয় না। দার্শনিকেরা এই ধারাটি নিয়ে কখনোই তেমন আগ্রহ দেখাননি। লিখেছেনও খুব কম। খুব কম দার্শনিকই বিষয়টিকে জরুরি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্লেটো তো হাসি-তামাশাকে রাষ্ট্রনেতাদের জন্য নিষিদ্ধই করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, এটি যুক্তিবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আরেকটি কারণে তিনি এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন—এটি অন্যকে হেনস্তার একটি কৌশল।
এই দ্বিতীয় কারণটিই এখানে মুখ্য। কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ কোনো কিছুতে পেরে না উঠে মুখের বচনে, অঙ্গভঙ্গিতে, এঁকে বা লিখে শাসককে হেনস্তার কৌশলটিই নেয়। এতে শাসকের হয়তো কিছু আসে-যায় না; কিন্তু তারা বিচলিত হয়। কারণ কে না জানে—কাউকে ধসিয়ে দিতে শক্তিতে না কুলালে ‘হাস্যকর’ বানিয়ে দেওয়াই দস্তুর। এতে ভেতর থেকে তার শক্তিতে চিড় ধরে। তার প্রশ্নহীন শৌর্যবীর্যই তখন কৌতুকের বিষয় হয়ে ওঠে। এটি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শেষ অস্ত্র, যা বিস্ফোরণের আগে প্রয়োগ করা হয়। ফলে কোনো দেশে বা অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুখোড়, নিরীহ বা অতিনিরীহ—যেকোনো ধরনের কৌতুকপ্রবণতার বাড়বাড়ন্ত দেখলে তার রাষ্ট্রকাঠামোটির দিকেই তাকানো জরুরি। বলা তো যায় না, কৌতুকপ্রবণতা দিয়েই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রটি হয়তো বোঝা সম্ভব হবে।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
এক স্কুলে রচনা লিখতে দেওয়া হলো, ‘যদি আমি এক দিনের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতাম’।
-গাধা নাকি! কী করে এ ধরনের প্রশ্ন মাথায় আসে এদের? রাশিয়ায় কি কেউ এক দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হয়? দেখাতে পারবে কেউ সে রকম প্রেসিডেন্ট?
(রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর)
ওপরের এই কল্পিত রচনা প্রতিযোগিতার বিষয় এবং তাতে ঊহ্য শিক্ষার্থীর প্রতিক্রিয়া নিছক কৌতুক। কিন্তু একে কি নিছক কৌতুক বলা যায়? দেশটি যখন রাশিয়া, তখন কৌতুকের প্রশ্নটি কার উদ্দেশে, তা তো আর বলে দিতে হবে না। ভ্লাদিমির পুতিন—এই সময়ের অন্যতম কর্তৃত্ববাদী শাসক, যিনি কবে থেকে রাশিয়া শাসন করছেন, তা অনেকে ভুলে গেছেন; আর কত দিন শাসন করবেন, তা-ও কেউ জানে না।
আরেকটি কৌতুক শোনা যাক, ‘সাবধান, গাড়িটি উল্টো পথে যাচ্ছে।’ কী, বোঝা গেল কিছু? এবার তাহলে প্রেক্ষাপটটি বলা যাক। এটি ২০১৮ সালে চীনের এক কলামিস্টের করা মন্তব্য। অনলাইনে এই বাক্য সে সময় বেশ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ আর কিছুই নয়, এর কিছুদিন আগেই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপর একে একে এ ধরনের ছোট ছোট মন্তব্য, কৌতুক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদি যতই নিয়ন্ত্রণ করা হোক না কেন, মানুষ ঠিকই তার মতটি দিয়ে দিচ্ছে—সরাসরি নয়, কৌতুকের মাধ্যমে।
এটি শুধু রাশিয়া বা চীনের বাস্তবতা নয়, সারা বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসন যত বাড়ছে, মানুষের মধ্যে কৌতুকপ্রবণতা তত বাড়ছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ অনায়াসে দেওয়া যায়। না, দেশটি সে অর্থে গণতন্ত্রের পথ থেকে পিছলে যায়নি। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তাঁকে নিয়ে যে পরিমাণ কৌতুক, কার্টুন, স্ট্যান্ড-আপ কমেডি হয়েছে, তেমনটি আর কখনো দেখা যায়নি।
কোনো এক নির্বোধকে উপমা ধরে বা কোনো কল্পিত নির্বোধকে হাজির করে তাকে ক্রমাগত হেনস্তা করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যে মজা বা কৌতুক উপস্থাপন করা হয়, তাকে যতই নিরীহ মনে হোক, তার মধ্যে বারুদস্বভাব আছে। এই বারুদের অস্তিত্ব সাধারণ মানুষ সচেতনভাবে বুঝুক না বুঝুক, কর্তৃত্ববাদী শাসক ঠিকই বোঝে। যেমন হংকংয়ের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সম্প্রচারমাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘হেডলাইনার’ নামের শো। ৩১ বছর ধরে এই শো রম্য-রসের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেছে; ছিল জনপ্রিয়ও। শুধু তা-ই নয়, এর উপস্থাপকদের হংকং ছেড়ে তাইওয়ান ও ব্রিটেনে পাড়ি জমাতে হয়েছে। প্রেক্ষাপটটি বোঝা যাবে হংকংয়ে গত কয়েক বছরে চলমান অস্থিতিশীলতা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে তাকালে।
শুধু হংকং নয়, ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় র্যাপার ও কমেডিয়ান প্রিটিপলসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিছুদিন আগে। অপরাধ—তিনি মালয় ও ভারতীয় সংখ্যালঘুদের উপস্থাপনের জন্য নিজের মুখে বাদামি রং করে একটি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন। চীনা সংখ্যাগুরু অভিজাত শ্রেণি দ্বারা শাসিত সিঙ্গাপুরের শাসকদের বর্ণবাদী মনোভাবই তিনি হয়তো ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথচ নিজেদের বর্ণবাদী আচরণ ও শাসনপন্থা নিয়ে সেখানকার প্রশাসন একেবারে চুপ।
না, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা সব সময় কৌতুক, রঙ্গরস বা রম্যের ওপর চড়াও হন না। তাঁরা শুধু একটা সীমা টেনে দেন—এটুকু করা যাবে; এর বাইরে নয়। চীনে যেমন এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশিত হয়। কিন্তু সেখানে কোনো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কৌতুক করা যায় না। কথা হলো ‘সংবেদনশীল’-এর সংজ্ঞাটি কে নির্ধারণ করে? উত্তর—অবশ্যই শাসক।
এতে কি থামানো যাচ্ছে? না, যাচ্ছে না। সারা বিশ্বেই স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চীনেই যেমন সাংহাই বা বেইজিংয়ে মানুষ টিকিট কেটে কৌতুক শুনতে যাচ্ছে। অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম টেনসেন্টে ‘রক অ্যান্ড রোস্ট’ নামের শোয়ের দর্শকসংখ্যার দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। সেখানে রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু নানা সামাজিক সংকট সামনে এনে এমন এমন কৌতুক পরিবেশন করা হয়, যেখানে লক্ষ্যবস্তুটি প্রচ্ছন্ন থাকে। ভারতে ‘কপিল শর্মা শো’ তো রীতিমতো রাজত্ব করছে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের টিভি চ্যানেলগুলোতেও আছে এ ধরনের আলাদা আলাদা শো। কলকাতার ‘মীরাক্কেল’-এর কথাই-বা বাদ যাবে কেন? ইউটিউবে এসব অনুষ্ঠানের একেকটি পর্বের ভিডিওর দর্শকসংখ্যার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে—কতটা হাঁসফাঁস করছে মানুষ।
কৌতুকে মানুষ কখন এতটা ডুবে যায়? উত্তর—যখন মানুষ বিদ্যমান বাস্তবতায় আর টিকতে পারে না, আবার এই না পারার কথাটিও বলতে পারে না মুখ ফুটে, যখন যাবতীয় অভাব-অভিযোগ, দাবি ইত্যাদি কর্তৃপক্ষীয় মারের মুখে স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন তারা কৌতুকের পথে হাঁটে। নিজের অপারগতা নিয়ে নিজেকেই উপহাস করে। প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রান্তকেই হেয় করে। শাসকের নামটি মুখে নিয়ে বা না নিয়েই চলে এই কৌতুক। শাসকের নামটি ঊহ্য থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রটি কতটা কর্তৃত্বপরায়ণ হলো, তার ওপর।
ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, কাজাখস্তান থেকে ভিয়েতনাম, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এশিয়ার দেশগুলোতে কার্টুন এ ক্ষেত্রে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে। এ জন্য কার্টুনিস্টদেরও কম হেনস্তা হতে হচ্ছে না—কখনো সরকার সরাসরি, কখনো তাদের দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে এ হেনস্তার শিকার হতে হয়। মিয়ানমারে যেমন জনপ্রিয় কমেডিয়ান জারগানারকে ২০০৮ সালে ৫৯ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিন বছর কারাভোগ করে তিনি মুক্তি পান। তবে ২০২১ সালে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এখন আবার তিনি মুক্ত। দেশটির বহু কমেডিয়ান, কার্টুনিস্ট এখন গোপনে তাঁদের কাজ চালাচ্ছেন।
বাদ নেই ভারতও। দেশটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জন্য মুনাওয়ার ফারুকী কমেডি শো করা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে এক মাসের মতো কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক তাঁর শো বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কারণ হিসেবে বলা হয়—তিনি ‘বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব’। গত বছরের জানুয়ারিতে কট্টর ডানপন্থী নেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এত সব হেনস্তার পর তিনি তাঁর শো চালিয়ে যেতে চাননি।
হাস্যরস বা রম্য কিংবা কৌতুক ইত্যাদি নিয়ে জলঘোলাও কম হয় না। দার্শনিকেরা এই ধারাটি নিয়ে কখনোই তেমন আগ্রহ দেখাননি। লিখেছেনও খুব কম। খুব কম দার্শনিকই বিষয়টিকে জরুরি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্লেটো তো হাসি-তামাশাকে রাষ্ট্রনেতাদের জন্য নিষিদ্ধই করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, এটি যুক্তিবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আরেকটি কারণে তিনি এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন—এটি অন্যকে হেনস্তার একটি কৌশল।
এই দ্বিতীয় কারণটিই এখানে মুখ্য। কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ কোনো কিছুতে পেরে না উঠে মুখের বচনে, অঙ্গভঙ্গিতে, এঁকে বা লিখে শাসককে হেনস্তার কৌশলটিই নেয়। এতে শাসকের হয়তো কিছু আসে-যায় না; কিন্তু তারা বিচলিত হয়। কারণ কে না জানে—কাউকে ধসিয়ে দিতে শক্তিতে না কুলালে ‘হাস্যকর’ বানিয়ে দেওয়াই দস্তুর। এতে ভেতর থেকে তার শক্তিতে চিড় ধরে। তার প্রশ্নহীন শৌর্যবীর্যই তখন কৌতুকের বিষয় হয়ে ওঠে। এটি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শেষ অস্ত্র, যা বিস্ফোরণের আগে প্রয়োগ করা হয়। ফলে কোনো দেশে বা অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুখোড়, নিরীহ বা অতিনিরীহ—যেকোনো ধরনের কৌতুকপ্রবণতার বাড়বাড়ন্ত দেখলে তার রাষ্ট্রকাঠামোটির দিকেই তাকানো জরুরি। বলা তো যায় না, কৌতুকপ্রবণতা দিয়েই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রটি হয়তো বোঝা সম্ভব হবে।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৩ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগে