মারুফ ইসলাম
২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন বাহিনীকে হঠাৎ করেই আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার পর তালেবানরা ক্ষমতায় এলে পাশের দেশ পাকিস্তান বেশ খুশি হয়েছিল। তবে চীন বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ‘বিরাট প্রোপাগান্ডা’ ছাড়া কিছুই নয়। দৃশ্যত, তারা আফগানিস্তান ছাড়লেও আড়ালে থেকে ঠিকই কলকাঠি নাড়বে।
সেই দুটি দেশের অবস্থা এখন কী, তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন কেমন, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা নানা আলোচনা করছেন।
ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্য যে পাকিস্তানিরা তালেবানের মাধ্যমে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এটি ভারতকে চাপে রাখার পাকিস্তানের অন্যতম এক কৌশলও বটে। কিন্তু পাকিস্তানের এই স্বপ্ন খুব একটা পূরণ হয়নি। অন্যান্য বিদেশি শক্তির চেয়ে আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই।
আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবানের পুনরুত্থান বরং বুমেরাং হয়েছে পাকিস্তানের জন্য। তালেবানের বিজয় পাকিস্তানের কট্টরপন্থীদের উজ্জীবিত করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) অনেক বেশি উজ্জীবিত হয়েছে। ফলে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকেই পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ বেড়েছে।
টিটিপির বেশির ভাগ যোদ্ধা আফগানদের মতোই। তাঁরা জাতিতে পশতুন। এই যোদ্ধাদের বেশির ভাগেরই জমিজমা সীমান্তের দুই পাশেই রয়েছে। ফলে উভয় দেশে তাঁদের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। গত ২ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ চিন্তান্বিত সুরে বলেছেন, ‘টিটিপির যোদ্ধারা আফগান সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। তারা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।’
পাকিস্তান ভেবেছিল, আফগানিস্তানের মাধ্যমে তারা ভারতকে কৌশলগত চাপে রাখবে। কিন্তু উল্টো টিটিপির মাধ্যমে পাকিস্তানকেই চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আফগানিস্তান।
কিছুদিন আগে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানে টিটিপির ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেবেন। এরপর একজন তালেবান কর্মকর্তা যে টুইট করেছেন, তা বেশ ইঙ্গিতবহ। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের একটি ছবি পোস্ট করেছেন।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিরোধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নাম ‘ডুরান্ড লাইন’। এটি আফগান-পাকিস্তানের সীমান্তরেখা। ১৮৯৩ সালে এই সীমান্তরেখা এঁকেছিল ব্রিটিশরা। এই সীমান্তে সংঘর্ষ লেগেই আছে। গত মাসেই এখানে তালেবান বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে পাকিস্তানের ছয়জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। পাকিস্তান সেখানে প্রায়ই কাঁটাতারের বেড়া দেয় আর তালেবানেরা সেই বেড়া কেটে ফেলে।
পাকিস্তান ভেবেছিল, তালেবানদের সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়া ও লেনদেন বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের সরাসরি লেনদের বেড়েছে এবং ভারতের কাছ থেকেও তারা সাহায্য পাচ্ছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে করাচির মধুর সম্পর্কেও তিক্ততা তৈরি হয়েছে বেশ আগেই। সব মিলিয়ে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর খুব বেশি সুবিধা হয়নি পাকিস্তানের।
চীন অবশ্য এ ব্যাপারে একটু কম বিভ্রান্তিতে ছিল। তারা কখনোই মনে করেনি যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার তাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ইউএস জার্মান মার্শাল ফান্ড’-এর গবেষক অ্যান্ড্রু স্মল যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘চীনা নীতিনির্ধারকেরা অন্তত আশা করেছিলেন, তালেবানরা তাদের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি চাইবে এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে।’
তালেবান এখনো সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে জন্য চীন খুব উদ্বিগ্ন, তা মনে হয় না। সি চিন পিং সরকার এ ব্যাপারে স্থির মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। চীন এখনো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে কাবুল থেকে চীনা দূতাবাস প্রত্যাহারও করেনি। চীনের দূতাবাস সেখানে এখনো কাজ করছে।
অ্যান্ড্রু স্মল বলেছেন, ‘সি সরকার আশা করছে, জিনজিয়াং সীমান্তের ওপারে উইঘুর জঙ্গিদের দমন করতে চীনকে সহযোগিতা করবে তালেবান।’
চীনের সে আশা পূরণ হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এ ব্যাপারে তালেবানের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। যা কিছু দৃশ্যমান তা হচ্ছে, চীন আফগানিস্তানে যে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বন্ধ হয়ে গেছে। আফগানিস্তানে এখন তেমন কোনো চীনা বিনিয়োগ নেই।
তবে লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, তালেবানরা ইদানীং উন্নয়নের কথা বলতে শিখেছে। যদিও দেশটিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব নাজুক। গত মাসেই বন্দুকধারীরা কাবুলের এমন একটি হোটেলে হামলা চালিয়েছে যে হোটেলে সাধারণত চীনা ব্যবসায়ীরা থাকতেন। এসব কারণে চীনা বিনিয়োগকারীরা আফগানিস্তানের ব্যাপারে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
আরও একটি বিষয় পরিষ্কার। সেটি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন কখনোই আফগান মাটি দখলের মতো ঝুঁকি নিতে যাবে না। বরং সেখান থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে। অ্যান্ড্রু স্মল যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেখানেও একই ধরনের প্রতিধ্বনি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তান থেকে চীন তার কার্যক্রম কমিয়ে আনবে। বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াবে।’
মার্কিন সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগান অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশটির ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে যে বিনিয়োগ আসার কথা ছিল, তা আসেনি। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট খান জান অ্যালোকোজায়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীন এক পয়সাও বিনিয়োগ করেনি। তাদের অনেক কোম্পানি এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করেছে, গবেষণা করেছে এবং চলে গেছে। খুবই হতাশাজনক ব্যাপার।’
লক্ষ করার মতো আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক রয়েছে বিশ্বাস করে চীন। এর আগে একাধিক অনুষ্ঠানে ইটিআইএমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তালেবানকে অনুরোধ করেছেন চীনা নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু তালেবান এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। এমনকি আফগান মাটিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে কাজ করতে দেবে না, এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। ফলে চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে ৭৬ কিলোমিটারব্যাপী সীমান্ত রয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে উত্তেজনা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইটিআইএমের সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য অস্বীকার করেছে তালেবান। কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের একজন নেতা সুহেল শাহীন বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের মাটিতে বসে ইটিআইএম কাজ করছে, এ অভিযোগ সত্য নয়। আমরা কাউকেই কোনো দেশের বিরুদ্ধে আফগান মাটি ব্যবহার করার অনুমতি দিই না।’
তবে গত বছরের মে মাসে এক প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি দেশকে উদ্ধৃত করে জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানে ইটিআইএমের উপস্থিতি রয়েছে।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জিনজিয়াংয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী যেকোনো গোষ্ঠীকে সমর্থন করা বেইজিং সহ্য করবে না। সুতরাং আফগানিস্তান যতই অস্বীকার করুক, চীন এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবেই।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংকট্যাংক ইসলামিক থিওলজি অব কাউন্টার টেররিজমের ডেপুটি ডিরেক্টর ফারান জেফরি বলেছেন, ‘ইটিআইএম অবশ্যই চীনের জন্য একটি টাইম বোমা। এটি চীনের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।’
মাটির নিচের সম্পদ আহরণের স্বপ্ন আফগানদের বহু শতাব্দী আগের। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর চীন ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, তারা মাটি খনন করে সম্পদ উত্তোলন করতে আফগানিস্তানকে সহায়তা করবে। তবে এখনো সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তালেবানের নতুন সরকার কীভাবে দেশ শাসন করবে তা দেখার জন্য অন্য অনেক দেশের মতো চীনও অপেক্ষা করছে।
আফগান-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বারবার তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত বছরের মার্চ মাসে তিনি আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে আলোচনার জন্য কাবুলে একটি বিরল সফর করেন। তার পরও সম্পর্কের খুব একটা উন্নতি হয়নি।
আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মেটালার্জিক্যাল করপোরেশনের তিন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি রয়েছে। তালেবান সরকার আশা করেছিল এই চুক্তির আওতাধীন প্রকল্পগুলো থেকে তারা প্রতিবছর লাখ লাখ ডলার আয় করবে। কিন্তু প্রকল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে।
চীন বারবার নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রসঙ্গ তুলেছে। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুফতি ইসমাতুল্লাহ বোরহান বলেছেন, ‘নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি নেই। তালেবান সরকার সারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছে এবং চীনসহ অন্যান্য দেশের জন্য উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করেছে।’
আপাতত যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, আফগানিস্তানের মাটিতে নিচে সোনা, তামা, লিথিয়ামসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভান্ডার আরও অনেক দিন মাটির নিচেই থাকবে। গবেষকদের ধারণা, অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির নিচে। এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের লোভ খুব সহজে চীন ছেড়ে দেবে, তা ভাবা বাতুলতা।
সুতরাং চীনের সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়, তা দেখার জন্য চোখ রাখতে হবে ভবিষ্যতেই।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, জাপান টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, আল জাজিরা ও ডন
২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন বাহিনীকে হঠাৎ করেই আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার পর তালেবানরা ক্ষমতায় এলে পাশের দেশ পাকিস্তান বেশ খুশি হয়েছিল। তবে চীন বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ‘বিরাট প্রোপাগান্ডা’ ছাড়া কিছুই নয়। দৃশ্যত, তারা আফগানিস্তান ছাড়লেও আড়ালে থেকে ঠিকই কলকাঠি নাড়বে।
সেই দুটি দেশের অবস্থা এখন কী, তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন কেমন, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা নানা আলোচনা করছেন।
ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্য যে পাকিস্তানিরা তালেবানের মাধ্যমে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এটি ভারতকে চাপে রাখার পাকিস্তানের অন্যতম এক কৌশলও বটে। কিন্তু পাকিস্তানের এই স্বপ্ন খুব একটা পূরণ হয়নি। অন্যান্য বিদেশি শক্তির চেয়ে আফগানিস্তানের ওপর পাকিস্তানের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই।
আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবানের পুনরুত্থান বরং বুমেরাং হয়েছে পাকিস্তানের জন্য। তালেবানের বিজয় পাকিস্তানের কট্টরপন্থীদের উজ্জীবিত করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) অনেক বেশি উজ্জীবিত হয়েছে। ফলে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকেই পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ বেড়েছে।
টিটিপির বেশির ভাগ যোদ্ধা আফগানদের মতোই। তাঁরা জাতিতে পশতুন। এই যোদ্ধাদের বেশির ভাগেরই জমিজমা সীমান্তের দুই পাশেই রয়েছে। ফলে উভয় দেশে তাঁদের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। গত ২ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ চিন্তান্বিত সুরে বলেছেন, ‘টিটিপির যোদ্ধারা আফগান সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। তারা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।’
পাকিস্তান ভেবেছিল, আফগানিস্তানের মাধ্যমে তারা ভারতকে কৌশলগত চাপে রাখবে। কিন্তু উল্টো টিটিপির মাধ্যমে পাকিস্তানকেই চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আফগানিস্তান।
কিছুদিন আগে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানে টিটিপির ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেবেন। এরপর একজন তালেবান কর্মকর্তা যে টুইট করেছেন, তা বেশ ইঙ্গিতবহ। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের একটি ছবি পোস্ট করেছেন।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিরোধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নাম ‘ডুরান্ড লাইন’। এটি আফগান-পাকিস্তানের সীমান্তরেখা। ১৮৯৩ সালে এই সীমান্তরেখা এঁকেছিল ব্রিটিশরা। এই সীমান্তে সংঘর্ষ লেগেই আছে। গত মাসেই এখানে তালেবান বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে পাকিস্তানের ছয়জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। পাকিস্তান সেখানে প্রায়ই কাঁটাতারের বেড়া দেয় আর তালেবানেরা সেই বেড়া কেটে ফেলে।
পাকিস্তান ভেবেছিল, তালেবানদের সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়া ও লেনদেন বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের সরাসরি লেনদের বেড়েছে এবং ভারতের কাছ থেকেও তারা সাহায্য পাচ্ছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে করাচির মধুর সম্পর্কেও তিক্ততা তৈরি হয়েছে বেশ আগেই। সব মিলিয়ে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর খুব বেশি সুবিধা হয়নি পাকিস্তানের।
চীন অবশ্য এ ব্যাপারে একটু কম বিভ্রান্তিতে ছিল। তারা কখনোই মনে করেনি যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার তাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ইউএস জার্মান মার্শাল ফান্ড’-এর গবেষক অ্যান্ড্রু স্মল যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘চীনা নীতিনির্ধারকেরা অন্তত আশা করেছিলেন, তালেবানরা তাদের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি চাইবে এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে।’
তালেবান এখনো সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে জন্য চীন খুব উদ্বিগ্ন, তা মনে হয় না। সি চিন পিং সরকার এ ব্যাপারে স্থির মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। চীন এখনো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে কাবুল থেকে চীনা দূতাবাস প্রত্যাহারও করেনি। চীনের দূতাবাস সেখানে এখনো কাজ করছে।
অ্যান্ড্রু স্মল বলেছেন, ‘সি সরকার আশা করছে, জিনজিয়াং সীমান্তের ওপারে উইঘুর জঙ্গিদের দমন করতে চীনকে সহযোগিতা করবে তালেবান।’
চীনের সে আশা পূরণ হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এ ব্যাপারে তালেবানের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। যা কিছু দৃশ্যমান তা হচ্ছে, চীন আফগানিস্তানে যে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বন্ধ হয়ে গেছে। আফগানিস্তানে এখন তেমন কোনো চীনা বিনিয়োগ নেই।
তবে লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, তালেবানরা ইদানীং উন্নয়নের কথা বলতে শিখেছে। যদিও দেশটিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব নাজুক। গত মাসেই বন্দুকধারীরা কাবুলের এমন একটি হোটেলে হামলা চালিয়েছে যে হোটেলে সাধারণত চীনা ব্যবসায়ীরা থাকতেন। এসব কারণে চীনা বিনিয়োগকারীরা আফগানিস্তানের ব্যাপারে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
আরও একটি বিষয় পরিষ্কার। সেটি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন কখনোই আফগান মাটি দখলের মতো ঝুঁকি নিতে যাবে না। বরং সেখান থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে। অ্যান্ড্রু স্মল যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেখানেও একই ধরনের প্রতিধ্বনি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তান থেকে চীন তার কার্যক্রম কমিয়ে আনবে। বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াবে।’
মার্কিন সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগান অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশটির ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে যে বিনিয়োগ আসার কথা ছিল, তা আসেনি। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট খান জান অ্যালোকোজায়ে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীন এক পয়সাও বিনিয়োগ করেনি। তাদের অনেক কোম্পানি এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করেছে, গবেষণা করেছে এবং চলে গেছে। খুবই হতাশাজনক ব্যাপার।’
লক্ষ করার মতো আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক রয়েছে বিশ্বাস করে চীন। এর আগে একাধিক অনুষ্ঠানে ইটিআইএমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তালেবানকে অনুরোধ করেছেন চীনা নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু তালেবান এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। এমনকি আফগান মাটিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে কাজ করতে দেবে না, এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। ফলে চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে ৭৬ কিলোমিটারব্যাপী সীমান্ত রয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে উত্তেজনা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইটিআইএমের সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য অস্বীকার করেছে তালেবান। কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের একজন নেতা সুহেল শাহীন বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের মাটিতে বসে ইটিআইএম কাজ করছে, এ অভিযোগ সত্য নয়। আমরা কাউকেই কোনো দেশের বিরুদ্ধে আফগান মাটি ব্যবহার করার অনুমতি দিই না।’
তবে গত বছরের মে মাসে এক প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি দেশকে উদ্ধৃত করে জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানে ইটিআইএমের উপস্থিতি রয়েছে।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জিনজিয়াংয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী যেকোনো গোষ্ঠীকে সমর্থন করা বেইজিং সহ্য করবে না। সুতরাং আফগানিস্তান যতই অস্বীকার করুক, চীন এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবেই।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংকট্যাংক ইসলামিক থিওলজি অব কাউন্টার টেররিজমের ডেপুটি ডিরেক্টর ফারান জেফরি বলেছেন, ‘ইটিআইএম অবশ্যই চীনের জন্য একটি টাইম বোমা। এটি চীনের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।’
মাটির নিচের সম্পদ আহরণের স্বপ্ন আফগানদের বহু শতাব্দী আগের। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর চীন ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, তারা মাটি খনন করে সম্পদ উত্তোলন করতে আফগানিস্তানকে সহায়তা করবে। তবে এখনো সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তালেবানের নতুন সরকার কীভাবে দেশ শাসন করবে তা দেখার জন্য অন্য অনেক দেশের মতো চীনও অপেক্ষা করছে।
আফগান-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বারবার তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত বছরের মার্চ মাসে তিনি আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে আলোচনার জন্য কাবুলে একটি বিরল সফর করেন। তার পরও সম্পর্কের খুব একটা উন্নতি হয়নি।
আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মেটালার্জিক্যাল করপোরেশনের তিন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি রয়েছে। তালেবান সরকার আশা করেছিল এই চুক্তির আওতাধীন প্রকল্পগুলো থেকে তারা প্রতিবছর লাখ লাখ ডলার আয় করবে। কিন্তু প্রকল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে।
চীন বারবার নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রসঙ্গ তুলেছে। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুফতি ইসমাতুল্লাহ বোরহান বলেছেন, ‘নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি নেই। তালেবান সরকার সারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছে এবং চীনসহ অন্যান্য দেশের জন্য উপযুক্ত ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করেছে।’
আপাতত যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, আফগানিস্তানের মাটিতে নিচে সোনা, তামা, লিথিয়ামসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভান্ডার আরও অনেক দিন মাটির নিচেই থাকবে। গবেষকদের ধারণা, অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির নিচে। এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের লোভ খুব সহজে চীন ছেড়ে দেবে, তা ভাবা বাতুলতা।
সুতরাং চীনের সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়, তা দেখার জন্য চোখ রাখতে হবে ভবিষ্যতেই।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, জাপান টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, আল জাজিরা ও ডন
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৬ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৮ দিন আগে