টানেল থেকে গেরিলা কায়দায় দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য হিজবুল্লাহর প্রস্তুতি

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১৮: ৩৭
Thumbnail image

ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি বাহিনী শীর্ষ কয়েকজন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্বের শূন্যতা কাটিয়ে উঠছে গোষ্ঠীটি; নতুন সামরিক কমান্ড গঠন করে যুদ্ধের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। হিজবুল্লাহ ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র রয়টার্সকে বিষয়টি জানিয়েছে। 

লেবাননে ইসরায়েলের ব্যাপক হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর সবার একটাই প্রশ্ন, সফলভাবে লেবাননে ঢুকে পড়া ইসরায়েলি বাহিনীকে ঠেকাতে পারবে হিজবুল্লাহ? ব্যাপক রকেট হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের পরও হিজবুল্লাহর কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অস্ত্র রয়ে গেছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক চারটি সূত্র জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর সবচেয়ে বেশি নির্ভুল লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেপণাস্ত্র এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিজবুল্লাহর একজন ফিল্ড কমান্ডারসহ দুটি সূত্র রয়টার্সকে জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর কয়েক দিনের মধ্যেই হিজবুল্লাহর হাইকমান্ড অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর নতুন অপারেশন সেন্টার স্থাপন করতেই মূল্যবান তিন দিন লেগে যায় গোষ্ঠীটির। 

ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহর নতুন এই কমান্ড সেন্টার সক্রিয় রয়েছে। এর অর্থ হলো হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা এখন চাইলেই দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করতে পারবে। তৃতীয় আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, হিজবুল্লাহ দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ‘ওয়ার অব অ্যাট্রিশন’ নামে বহুল প্রচলিত যুদ্ধকৌশলে এগোতে চায় হিজবুল্লাহ। এর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে বস্তুগত ক্ষতিসাধন করে শত্রুকে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য চায় হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি থিঙ্কট্যাংক আলমার বিশ্লেষক আব্রাহাম লেভিন বলেছেন, ‘ধরে নিতে হবে, ইসরায়েলি সেনাদের মোকাবিলায় হিজবুল্লাহ ভালোভাবেই প্রস্তুত। তারা অপেক্ষা করছে। এটি মোটেও কোনো সহজ লক্ষ্য নয়।’ ’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, এই শক্তিশালী “সশ্রস্ত্র” বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে গুলি করার বা আঘাত হানার সক্ষমতা কেড়ে নেয়নি।’ 

প্রকাশ না করার শর্তে হিজবুল্লাহর এক ফিল্ড কমান্ডার নাম বলেন, ‘আমাদের যোদ্ধাদের কেন্দ্রের আদেশ পালন করার ক্ষেত্রে নমনীয়তা আছেন। তাঁরা রণক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সামর্থ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’হিজবুল্লাহর একটি রকেট লঞ্চার। ছবি: এএফপি নতুন কমান্ডকে একটি ‘ছোট সার্কেল’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, নতুন কমান্ড সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ করছে।

ইসরায়েলি হামলা নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর হিজবুল্লাহ নতুন কোনো নেতার নাম ঘোষণা করেনি। তবে গোষ্ঠীটির উপপ্রধান শেখ নাইম কাসেম বলেছেন, হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। তবে তাঁদের সক্ষমতা অক্ষত আছে এবং তাঁরা প্রয়োজনে লড়তে প্রস্তুত। 

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর নিজস্ব ফিক্সড লাইন টেলিফোন নেটওয়ার্ক এখনো অক্ষত এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত সপ্তাহে হিজবুল্লাহর অপারেশন রুম এক বিবৃতিতে বলেছিল, তাদের যোদ্ধারা ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছে এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের ‘দেখছে ও তাদের শুনতে পাচ্ছে’। তবে এই বিবৃতিতে হিজবুল্লাহর নতুন কমান্ডের বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। 
 
১ অক্টোবর ইসরায়েলের সেনারা স্থল অভিযানের জন্য লেবাননে প্রবেশ করে। গোলন্দাজ বাহিনী, আর্মার্ড ইউনিট এবং পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় দক্ষিণ লেবাননে অভিযান চলছে। অভিযানে এখন পর্যন্ত এই ১২ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। জানা গেছে, ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে চারটি ডিভিশন মোতায়েন করেছে। এসব ডিভিশনে ঠিক কতজন সেনা আছে, তা জানায়নি ইসরায়েল। তবে সাধারণত একেকটি ইসরায়েলি ডিভিশনে ন্যূনতম এক হাজার সেনা থাকে। 

দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে যে বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক আছে, তা স্বীকার করে ইসরায়েল। থিঙ্কট্যাংক আলমার ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৬ সালে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের পর গোষ্ঠীটি বিশাল টানেল নেটওয়ার্ক আরও বাড়াতে থাকে। ইসরায়েলের অনুমান, হিজবুল্লাহ টানেল নেটওয়ার্ক কয়েক শ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। 

হিজবুল্লাহর ফিল্ড কমান্ডার বলেন, এই টানেলগুলো যুদ্ধের ভিত্তি। হিজবুল্লাহ এই টানেল তৈরি করতে বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছে। এখন সময় এসেছে এগুলোকে কাজে লাগানোর। একটি সূত্র বলেছে, ইসরায়েল সুড়ঙ্গের পূর্ণাঙ্গ মাত্রা জানে না। 
 
কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, হিজবুল্লাহর সক্ষমতা কিছুটা কমেছে। তবে গোষ্ঠীটি এখনো তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে শেষ অবলম্বন হিসেবে রেখে দিয়েছে। তারপরও গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের দিকে তীব্রতার সঙ্গে রকেট ছুড়তে সক্ষম হয়েছে। হিজবুল্লাহও দাবি করেছে, তারা ইদানীং ইসরায়েলে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে। 

চলমান যুদ্ধ শুরুর আগে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএয়ের ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হিজবুল্লাহর কাছে দেড় লাখ ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট আছে। দুটি সূত্র বলেছে, হিজবুল্লাহ তার সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটগুলো ব্যবহার না করার পথ বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে তারা নির্ভুল লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেপণাস্ত্র তারা এখনো ব্যবহার করেনি। গোষ্ঠীটি এসব ক্ষেপণাস্ত্রকে এক দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য সংরক্ষিত রাখতে এবং ইসরায়েলকে লেবাননের অবকাঠামো যেমন—বৈরুত বিমানবন্দর, সেতু রাস্তাগুলোতে হামলার অজুহাত দেওয়া এড়াতেই এখনো এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেনি।ইসরায়েলি হামলার পর ধোঁয়া উড়ছে লেবাননের একটি শহর থেকে। ছবি: এএফপি সন্দেহ নেই, ইসরায়েল হিজবুল্লাহর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার বুবি-ট্র্যাপড পেজার যোগাযোগ ডিভাইস বিস্ফোরিত হয়েছিল। যাতে বেশ কয়েকজন মারাও যায়। যদিও ইসরায়েল এর দায় স্বীকার করেনি। তবে হিজবুল্লাহ রকেট ছোড়া বন্ধ করেনি। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, হিজবুল্লাহ প্রতিদিন গড়ে ১০০-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট নিক্ষেপ করছে। এটি গোষ্ঠীটির উল্লেখযোগ্য দুর্বলতাই তুলে ধরে। 

হিজবুল্লাহর ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে অনুমানগুলো ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর আগে, এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছিলেন, গোষ্ঠীটির ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। এদিকে, হিজবুল্লাহর পুরোনো মিত্র ইরান এই শূন্যতা পূরণের প্রস্তাব দিলেও সেগুলো কীভাবে সরবরাহ হবে তা নিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা হিজবুল্লাহর রাদওয়ান স্পেশাল ফোর্সের বেশির ভাগ সিনিয়র কমান্ডারসহ কয়েক শ হিজবুল্লাহ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। 

এরই মধ্যে, হিজবুল্লাহ গেরিলা কৌশল অবলম্বন শুরু করেছে। হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ইসরায়েলি সেনাদের ওপর গোপনে আক্রমণ করে। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা তাঁদের অতর্কিত হামলায় মাইন এবং রাশিয়ান তৈরি কর্নেট অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া, ২ অক্টোবর এক বন্দুকযুদ্ধে ইসরায়েলি এক কমান্ডো ইউনিটের পাঁচ সৈন্য নিহত এবং পাঁচজন গুরুতর আহত হয়। তবে ইসরায়েলি বাহিনী এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। 

বৈরুতভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের মোহানাদ হাজি আলি বলেন, তাঁর আশা ছিল, ইসরায়েলি বাহিনী আরও ভেতরে ঢুকবে। প্রশ্ন হলো হিজবুল্লাহ তাদের জন্য কতটা শক্তিশালী বাধা হবে।

লেবাননে হিজবুল্লাহকে পরাজিত করা কঠিন— এমন ইঙ্গিত দিয়ে ক্রিগ বলেন, ‘নিজ মাটিতে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করা হিজবুল্লাহর জন্য ডাল-ভাত। এভাবেই তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং বেশির ভাগ প্রতিরক্ষা কৌশল নিজেরাই তৈরি করেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলকে স্পষ্ট বার্তা দিতে চায় হিজবুল্লাহ। দেশীয় সমর্থক এবং ইরান–সমর্থিত প্রতিরোধ অক্ষের মিত্রদের কাছে আরও স্পষ্ট বার্তা পাঠাতে চায়—তাঁরা এখনো অক্ষত এবং ইসরায়েলের যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম।’ 

অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত