দুর্বল হয়ে পড়ছে মিয়ানমার জান্তা, বিদ্রোহ সফল হবে কি

আব্দুর রহমান
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬: ০৩
Thumbnail image

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করেছিল ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে। এরপর পেরিয়ে গেছে তিন বছর। তবে এই দীর্ঘ সময়েও জান্তা বাহিনী ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারেনি। মিয়ানমারের জনগণ, বিশেষ করে নিপীড়ত বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা এই জবরদখল মেনে নেয়নি। সেনানিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বদলে বিদ্রোহীদের কাছে উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তা বাহিনী। বিদ্রোহীদের জোরালো আঘাত জান্তা বাহিনীর পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে দিচ্ছে। 

২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছিলেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এর মাধ্যমে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ উসকে দিয়েছেন তিনি। এ কারণে বিশ্বমহলে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি মিয়ানমারের জনতার ঘৃণাও কুড়িয়েছেন তিনি।

ক্ষমতা দখলের পর সু চিকে করা হয় গৃহবন্দী; সাজানো বিচারে তাঁকে দেওয়া হয় কারাদণ্ড। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতা ও অন্যান্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা মিলে গঠন করেন জাতীয় ঐক্যের সরকার। সেই সরকারের ছত্রছায়ায় মিয়ানমারে জান্তার বিরুদ্ধে শুরু হয় সশস্ত্র লড়াই। 

সেই লড়াইয়ে শামিল হয় সীমান্তসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত নাম দেওয়া হয় এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস বা ইএওএস। এর সদস্যগুলো জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত লড়াই চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি তারা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে।

বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মির (এএ) সমন্বয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স রাখাইন, চিন ও শান রাজ্যে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। 

গত বছরের অক্টোবরে শুরু করা অপারেশন-১০২৭-এর পর রাখাইনের অধিকাংশ শহরই নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেছে আরাকান আর্মি। চিন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে থ্রি ব্রাদার্স। মাঝে চীনের মধ্যস্থতায় এই তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনী অস্ত্রবিরতিতে গেলেও মাত্র দিন কয়েক পরই তা ভেস্তে যায়। বিদ্রোহীদের দাবি, জান্তা বাহিনীই তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে অস্ত্রবিরতির শর্ত ভেঙেছে। 

 বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল আর্মির সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীতজান্তা বাহিনী যে বিপুল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর মুখে রয়েছে তা-ই নয়, তাদের বিপুল পরিমাণ সেনা ও শীর্ষ কর্মকর্তাও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করে দিয়েছেন, অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। বড় সংখ্যার সেনারা পালিয়েছে চীন ও ভারতে। অনেক সেনা কর্মকর্তা টানা যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। লড়াই বন্ধ করে ক্যাম্প-ঘাঁটিতে স্রেফ শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে জান্তার সেনা ওন্না কায়াও বলেন, ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার নির্দেশনার অপেক্ষায় থেকে থেকে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সঙ্গীসহ শিবির থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আত্মসমর্পণ না করলে হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।’ 

কেবল যুদ্ধের ক্লান্তিই নয়, নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বিবেকের দংশনে ভুগছেন অনেকে। তাঁদের মনের কথা যেন প্রতিধ্বনিত হলো ওন্না কায়াওয়ের কথায়। তিনি বলেন, ‘ভুল বোঝার পর এক মুহূর্তও আর লড়াই করতে চাইনি। বাবা-মায়ের বয়সী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর লুট করা হচ্ছে। কারণ ছাড়াই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে সবকিছু। আমি এসব কিছু দেখেছি নিজের চোখে। নৃশংসতার শিকার মানুষদের প্রতি আমার মায় হয়।’

স্রেফ সামরিক নেতৃত্বের ক্ষমতালিপ্সার জন্য লড়াইয়ে দোটানায় ভুগছে সেনাদের বড় অংশ। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে বর্মি ভাষায় ‘তাতমাদাও’ বা জান্তা বাহিনীর লড়াইয়ের ওপর। পরিস্থিতি এতই বিগড়ে গেছে যে একসময়ের শুভাকাঙ্ক্ষীরাই মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন। 

জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং তাঁর একসময়কার ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যেই সমর্থন হারাচ্ছেন। কেবল তাই নয়, তাঁদের অনেকে আবার তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন। সমর্থকদের অভিযোগ, মিন অং হ্লাইং একসময়কার অজেয় জান্তা বাহিনীকে খেলো বাহিনীতে পরিণত করেছে, তিনি অনেক স্বার্থপর আচরণ করছেন এবং তাঁর কোনো ‘মেরুদণ্ড’ নেই। 

জান্তা সরকার ও মিন অং হ্লাইংয়ের অন্যতম সমর্থক ছিলেন ফুটবলার মং মং। সম্প্রতি সুর বদলে তিনি বলেন, ‘মিন অং হ্লাইং যে তিন বছর পেয়েছিলেন, তাঁর জন্য সেইটাই যথেষ্ট।’ নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এই ঘোষণা দেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে আরও অনেকে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। 

মং মং তাঁর ভিডিওতে বলেন, ‘উ মিন অং হ্লাইং গত তিন বছরে কোনো সক্ষমতাই প্রদর্শন করতে পারেননি, যার ফলে দেশটি ঐতিহাসিক লজ্জা ও মন্দার মধ্যে পড়েছে। তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অযোগ্য...জবাবদিহির সঙ্গে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।’ 

কেবল ঘরে নয়, বাইরেও সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে আছে জান্তাপ্রধান ও জান্তা বাহিনী। বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীর কারণে মিয়ানমারের নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশ কখনোই সেভাবে নেপিদোকে সুনজরে দেখেনি। অপর প্রতিবেশী ভারত অভ্যুত্থানের প্রথম দিকে সেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও এখন কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের সেনারা ভারতে পালানোর পর নয়া দিল্লি মিয়ানমার-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ে তুলে দেওয়ার কথা বলেছে। 

তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ও মিত্রদেশ চীনও মিয়ানমারের ওপর নাখোশ। চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিন গ্যাং খোলাখুলি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। খুব সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতি ভেস্তে যাওয়ার বিষয়টি যে বেইজিং ইতিবাচকভাবে নেবে না তা বলাইবাহুল্য। 

বিদ্রোহীদের বাড়বাড়ন্ত তৎপরতার কারণে রাখাইনে চীনের অর্থায়নে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ ঝুলে গেছে। বন্দর এলাকার আশপাশের বিশাল অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এমনকি রাখাইন ও ইয়াঙ্গুন থেকে মিয়ানমারের মাঝ বরাবর যে অর্থনৈতিক করিডরে চীনে পৌঁছেছে সেপথও বিদ্রোহীরা কবজা করেছে। এসব অস্থিতিশীলতার মধ্যে জান্তা বাহিনীর প্রতি নেকনজরের ধৈর্য চীনের কত দিন থাকে তা ভাবার বিষয়।

জান্তাবাহিনী প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ছবি: এএফপিনানা বিষয়ে নেপিদো-বেইজিংয়ের মধ্যে উদ্ভূত সংকট নিরসনের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ছিল রাশিয়া। এমনকি জান্তা বাহিনীর সমরাস্ত্রের অন্যতম বড় উৎসও দেশটি। কিন্তু নেপিদো-বেইজিং দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কো কত দিন নেপিদোকে সমর্থন দিয়ে যাবে, বিশেষ করে মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের প্রাধান্য বাড়তে থাকার সময়ে—তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানও মিয়ানমারকে সেই অর্থে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে না। জোটটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই অনুমান বিশ্লেষকদের। বিশেষ করে, এই জোট চলতি সপ্তাহেই মিয়ানমারকে বলেছে, এই দেশে যে সমস্যা চলছে তা একেবারেই নিজস্ব; এবং তার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। 

ফলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ঘরে এবং বাইরে দুই জায়গাতেই যে চাপের মুখে আছে তা স্পষ্ট। বিপরীতে জাতীয় ঐক্যের সরকার দাবি করেছে, মিয়ানমারের অন্তত ৬০ শতাংশ এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের সরকারের নিজস্ব সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) নিয়ন্ত্রণে হয়তো সব এলাকা নেই তবে পিডিএফসহ অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র জোট এথনিক আর্মড ফোর্সের অধীনে যে বিপুল পরিমাণ এলাকা রয়েছে তা জান্তাবাহিনীর নিশ্চুপ থাকা থেকেই বোঝা যায়। 

মিয়ানমারের স্বাধীন থিংকট্যাংক তাগাং ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ও উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারের এশিয়া প্রোগ্রামের ফেলো ইয়ে মায়ো হেইন বলেছেন, যে কোনো বিবেচনায়ই জান্তাবাহিনী এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। 

ইয়ে মায়ো হেইন আরও বলেন, ‘ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জান্তাবাহিনী মিয়ানমারের ১৪টি রাজ্য ও অঞ্চলের মধ্যে ১২টিতেই প্রচলিত যুদ্ধ থেকে শুরু করে গেরিলা কৌশল এবং প্রকাশ্য থেকে গোপন অভিযান পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে একযোগে আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছে।’ 

জান্তা বাহিনীর এমন নজিরবিহীন ব্যর্থতার মুখে হয়তো মিন অং হ্লাইং পদত্যাগ করবেন কিন্তু তারপর কী হবে?—এটিই এখন বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের পুর্নগঠন হবে কীভাবে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যদি জান্তাবাহিনীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষমও হয়, তাঁরা কি সফল হতে পারবে? বিশেষ করে গোষ্ঠীগুলোর নিজ নিজ দাবি পূরণের বিষয়টি কীভাবে মীমাংসা হবে তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। 

ইয়ে মায়ো হেইন বলছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ৭০ বছর ধরে এক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে জান্তাপ্রধানই সবচেয়ে শক্তিশালী। সেই বিবেচনায় ক্ষমতার পালাবদলে সহিংস পরিণতির আশঙ্কাও রয়েছে। 

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, ইরাবতীর, নিক্কেই এশিয়া ও দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন—

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শপথ নিয়েই বাইডেনের নীতি বাতিল ও ১০০ নির্বাহী আদেশের ঘোষণা ট্রাম্পের

শাহজালাল বিমানবন্দরে চাকরি নেননি মনোজ কুমার, বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে বিভ্রান্তি

বিপিএলে আতশি কাচের নিচে চল্লিশের বেশি ক্রিকেটার

নতুন ভোটার যাচাই: জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পাচ্ছেন শিক্ষকেরা

বিদ্যালয়ে একই পরিবারের ১৬ জনের চাকরি, তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্টের

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত