হুসাইন আহমদ
জ্বালানি সংকটে গত জুলাই থেকে শিডিউল লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এরপর অক্টোবর থেকে লোডশেডিংয়ের সমস্যা থাকবে না—এমন আশার বাণী সরকারের পক্ষ থেকে শোনানো হচ্ছিল কয়েক মাস ধরেই। কিন্তু অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ চলে গেল, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দূরের কথা, লোডশেডিং আরও এত বেড়েছে যে, দিনে ছয়বারও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে খোদ রাজধানীতে।
সরকার বলছে, শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। সরকারি হিসাবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। এরপর ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড গড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তবে এই সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি অলস পড়ে থাকছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও, দৈনিক প্রকৃত উৎপাদন অর্ধেকেরও কম। যেখানে গতকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট। আর এই ১৩ বছরের মধ্যে গত ১৬ এপ্রিল রেকর্ড ১৮ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছিল। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশিই।
তাহলে কেন এত লোডশেডিং? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়লেও সুষ্ঠুভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কার্যকর ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। এই এক দশকের বেশি সময়ে যে হারে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, সে তুলনায় সঞ্চালন ও বিতরণসহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে নগণ্য। বাংলাদেশ এখন অতি সক্ষমতায় ভুগছে।
তবে সরকারের হিসাব বলছে, এ সময়ে সিস্টেম লস প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে এবং বিতরণ ব্যবস্থায় নির্ভরতাও বেড়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে দুই বছরে দেশে কোনো লোডশেডিং হয়নি বলেও সরকারি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, লোডশেডিং কম বেশি ছিল। গত জুলাই থেকে ঘোষণা দিয়ে শিডিউল লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এখন দিনে সর্বোচ্চ ছয়বার পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে, প্রতিবার এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। সংগত কারণেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ে নাভিশ্বাস ওঠা জনমানসে প্রশ্ন—জনগণের কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এত বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলো, তার সুফল মিলছে না কেন? এর কিন্তু স্পষ্ট কোনো জবাব দিচ্ছে না সরকার।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই বছর ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে বড় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সরবরাহ সংকটের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় তেল আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
এ রকম সময়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে কেমন ভোগান্তি হয়, তা কয়েক দিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় জনগোষ্ঠী। স্বভাবতই সরকার এখনো এই বিপর্যয়ের কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। ভেড়ামারায় গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার পর আট বছর পার হয়েছে। তখন বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক সুপারিশ এসেছিল। এরই মধ্যে আরও অন্তত তিনবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু সবকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় আনাসহ ব্যবস্থার দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি।
সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। এ জন্য চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু সেটা এই ১৩ বছরের শাসনকালে হয়নি।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অলস উৎপাদন সক্ষমতার বোঝা ঘাড়ে নিয়েও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পগুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছে সরকার। দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কোম্পানির মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তথা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে দুই দশক ধরে।
এই শতকের শুরুতে বিশেষ আইনের আওতায় তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেসরকারি খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে উৎসব শুরু হয়েছিল, তার জের এখনো চলছে। নির্বিচারে তৈরি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যতটা বিদ্যুৎ মিলেছে, ব্যয় হয়েছে তার বহু গুণ বেশি।
আর অধুনা কয়লা ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মেগা প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। এর বাইরে পিডিবি, সিপিজিসিবিএল ও এনডব্লিউপিজিসিএলসহ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তো আছেই। সবাই ‘উৎপাদন বাড়াতে’ আগ্রহী। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থার উন্নয়নে কারও আগ্রহ নেই। বিদ্যুৎ সঞ্চালনে আছে ‘সবেধন নীলমণি’ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
গত এক যুগে বিদ্যুৎ উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ—সবই বেড়েছে। কিন্তু সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়নি। অতি পুরোনো ব্যবস্থায় সক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করায় বারবার বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। সে কারণেই উৎপাদন আর না বাড়িয়ে সঞ্চালন ও বিতরণে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এই খাতে দেশি-বিদেশি কেউ আগ্রহ দেখায় না। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে ৮ শতাংশ, কিন্তু সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা বেড়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
জনগণের মনে প্রশ্ন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কী এত মধু, যা বিতরণে নেই! সরকার সেই প্রশ্নের জবাব দেবে সেই ভরসা বোধহয় এখন মানুষ আর করে না। অবশ্য সেই প্রশ্নের আংশিক জবাব দিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ।
সম্প্রতি তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, `উৎপাদনের সংকটকে সামনে এনে সরকার ‘‘উচ্চ কমিশনে’’ চুক্তি করেছে। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখানে পয়সা বেশি, সুবিধা বেশি থাকার কারণে। প্রভাবশালীরাই এই কাজের কন্ট্রাক্ট পায়। কিন্তু ট্রান্সমিশন আর ডিস্ট্রিবিউশনে সেই আগ্রহটা নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ২০২০ সালের মে মাসে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সর্বশেষ পর্যালোচনা তুলে ধরেছিল। তাতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্ধেকের বেশি (৫৭ শতাংশ) উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি সরকার। এই ধারা ২০৩০ সাল নাগাদ চলতে থাকবে বলে ধারণা করে সংস্থাটি।
প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার মাশুল গুনতে হয়েছে ইন্দোনেশিয়াকে। পটুয়াখালীর পায়রায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে আইইইএফএ বলেছে, বাংলাদেশে সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে।
২০২০ সালের ১৪ মে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলেও অর্ধেকের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে। এর জন্যও প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা (১৯ মিলিয়ন ডলার) গচ্চা দিতে হচ্ছে।
গত মে মাসে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, চাহিদা না থাকলেও বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবিকে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এতে ২০২০ সাল পর্যন্ত পিডিবির মাধ্যমে জনগণের মোট ৬২ হাজার ৭০২ কোটি টাকার পুঞ্জীভূত ক্ষতি হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বলছে, দুটি কয়লাভিত্তিক ও একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি ক্রয়-অধিগ্রহণ-ক্ষতিপূরণে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই টাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারী, এনজিওকর্মী ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের পকেটে গেছে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেট বা বিডব্লিউজিইডির হিসাবে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পিডিবি ৩৭টি কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি দিয়েছে। এর ফলে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বা ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে শীর্ষ ১২টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির পকেটে। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। বাকিরা হলো—এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনে কিছুটা উপকার মিললেও কেউ সঞ্চালন বা বিতরণে আগ্রহী নয়; আর সার্বিকভাবে এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো—এখন বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন গ্রিড ও ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার একই কোম্পানির (পিজিসিবি) হাতে এবং এটি ম্যানুয়ালি পরিচালিত। অথচ আদর্শ ব্যবস্থাপনায় গ্রিড ব্যবস্থাপনা ও লোড ব্যবস্থাপনার কাজ ভিন্ন দুই সত্তার হাতে থাকে এবং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। সেই কাজটি গত আট বছরেও হয়নি।
জ্বালানি সংকটে গত জুলাই থেকে শিডিউল লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এরপর অক্টোবর থেকে লোডশেডিংয়ের সমস্যা থাকবে না—এমন আশার বাণী সরকারের পক্ষ থেকে শোনানো হচ্ছিল কয়েক মাস ধরেই। কিন্তু অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ চলে গেল, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দূরের কথা, লোডশেডিং আরও এত বেড়েছে যে, দিনে ছয়বারও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে খোদ রাজধানীতে।
সরকার বলছে, শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। সরকারি হিসাবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। এরপর ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড গড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তবে এই সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি অলস পড়ে থাকছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও, দৈনিক প্রকৃত উৎপাদন অর্ধেকেরও কম। যেখানে গতকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট। আর এই ১৩ বছরের মধ্যে গত ১৬ এপ্রিল রেকর্ড ১৮ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছিল। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশিই।
তাহলে কেন এত লোডশেডিং? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়লেও সুষ্ঠুভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কার্যকর ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। এই এক দশকের বেশি সময়ে যে হারে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, সে তুলনায় সঞ্চালন ও বিতরণসহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে নগণ্য। বাংলাদেশ এখন অতি সক্ষমতায় ভুগছে।
তবে সরকারের হিসাব বলছে, এ সময়ে সিস্টেম লস প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে এবং বিতরণ ব্যবস্থায় নির্ভরতাও বেড়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে দুই বছরে দেশে কোনো লোডশেডিং হয়নি বলেও সরকারি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, লোডশেডিং কম বেশি ছিল। গত জুলাই থেকে ঘোষণা দিয়ে শিডিউল লোডশেডিং শুরু করে সরকার। এখন দিনে সর্বোচ্চ ছয়বার পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে, প্রতিবার এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। সংগত কারণেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ে নাভিশ্বাস ওঠা জনমানসে প্রশ্ন—জনগণের কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এত বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলো, তার সুফল মিলছে না কেন? এর কিন্তু স্পষ্ট কোনো জবাব দিচ্ছে না সরকার।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই বছর ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে বড় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সরবরাহ সংকটের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় তেল আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
এ রকম সময়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে কেমন ভোগান্তি হয়, তা কয়েক দিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় জনগোষ্ঠী। স্বভাবতই সরকার এখনো এই বিপর্যয়ের কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। ভেড়ামারায় গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনার পর আট বছর পার হয়েছে। তখন বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক সুপারিশ এসেছিল। এরই মধ্যে আরও অন্তত তিনবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু সবকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় আনাসহ ব্যবস্থার দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি।
সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলেও গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। এ জন্য চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু সেটা এই ১৩ বছরের শাসনকালে হয়নি।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অলস উৎপাদন সক্ষমতার বোঝা ঘাড়ে নিয়েও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পগুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছে সরকার। দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কোম্পানির মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তথা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে দুই দশক ধরে।
এই শতকের শুরুতে বিশেষ আইনের আওতায় তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেসরকারি খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে উৎসব শুরু হয়েছিল, তার জের এখনো চলছে। নির্বিচারে তৈরি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যতটা বিদ্যুৎ মিলেছে, ব্যয় হয়েছে তার বহু গুণ বেশি।
আর অধুনা কয়লা ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মেগা প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। এর বাইরে পিডিবি, সিপিজিসিবিএল ও এনডব্লিউপিজিসিএলসহ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তো আছেই। সবাই ‘উৎপাদন বাড়াতে’ আগ্রহী। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থার উন্নয়নে কারও আগ্রহ নেই। বিদ্যুৎ সঞ্চালনে আছে ‘সবেধন নীলমণি’ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
গত এক যুগে বিদ্যুৎ উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ—সবই বেড়েছে। কিন্তু সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়নি। অতি পুরোনো ব্যবস্থায় সক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করায় বারবার বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। সে কারণেই উৎপাদন আর না বাড়িয়ে সঞ্চালন ও বিতরণে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এই খাতে দেশি-বিদেশি কেউ আগ্রহ দেখায় না। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে ৮ শতাংশ, কিন্তু সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা বেড়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
জনগণের মনে প্রশ্ন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কী এত মধু, যা বিতরণে নেই! সরকার সেই প্রশ্নের জবাব দেবে সেই ভরসা বোধহয় এখন মানুষ আর করে না। অবশ্য সেই প্রশ্নের আংশিক জবাব দিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ।
সম্প্রতি তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, `উৎপাদনের সংকটকে সামনে এনে সরকার ‘‘উচ্চ কমিশনে’’ চুক্তি করেছে। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখানে পয়সা বেশি, সুবিধা বেশি থাকার কারণে। প্রভাবশালীরাই এই কাজের কন্ট্রাক্ট পায়। কিন্তু ট্রান্সমিশন আর ডিস্ট্রিবিউশনে সেই আগ্রহটা নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ২০২০ সালের মে মাসে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সর্বশেষ পর্যালোচনা তুলে ধরেছিল। তাতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্ধেকের বেশি (৫৭ শতাংশ) উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি সরকার। এই ধারা ২০৩০ সাল নাগাদ চলতে থাকবে বলে ধারণা করে সংস্থাটি।
প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার মাশুল গুনতে হয়েছে ইন্দোনেশিয়াকে। পটুয়াখালীর পায়রায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে আইইইএফএ বলেছে, বাংলাদেশে সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে।
২০২০ সালের ১৪ মে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলেও অর্ধেকের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে। এর জন্যও প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা (১৯ মিলিয়ন ডলার) গচ্চা দিতে হচ্ছে।
গত মে মাসে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, চাহিদা না থাকলেও বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবিকে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এতে ২০২০ সাল পর্যন্ত পিডিবির মাধ্যমে জনগণের মোট ৬২ হাজার ৭০২ কোটি টাকার পুঞ্জীভূত ক্ষতি হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বলছে, দুটি কয়লাভিত্তিক ও একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি ক্রয়-অধিগ্রহণ-ক্ষতিপূরণে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই টাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারী, এনজিওকর্মী ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের পকেটে গেছে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেট বা বিডব্লিউজিইডির হিসাবে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পিডিবি ৩৭টি কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি দিয়েছে। এর ফলে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বা ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে শীর্ষ ১২টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির পকেটে। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। বাকিরা হলো—এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনে কিছুটা উপকার মিললেও কেউ সঞ্চালন বা বিতরণে আগ্রহী নয়; আর সার্বিকভাবে এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো—এখন বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন গ্রিড ও ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার একই কোম্পানির (পিজিসিবি) হাতে এবং এটি ম্যানুয়ালি পরিচালিত। অথচ আদর্শ ব্যবস্থাপনায় গ্রিড ব্যবস্থাপনা ও লোড ব্যবস্থাপনার কাজ ভিন্ন দুই সত্তার হাতে থাকে এবং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। সেই কাজটি গত আট বছরেও হয়নি।
সম্প্রতি ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলার-নির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৯ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে