ইউক্রেনকে দুই ভাগ করাই এখন যুদ্ধ বন্ধে একমাত্র পথ

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ২১
Thumbnail image
ট্রাম্পের চাপে পুতিনের অবস্থানের কাছে নতি স্বীকার করতে হতে পারে জেলেনস্কির। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর থেকেই আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ইউক্রেন ইস্যু। তিনি আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর যেসব বিষয় অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা করবেন, তার একটি হলো ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের যেসব ভূখণ্ড দখল করেছে, সেগুলো ফেরত পাওয়া আশা হয়তো ইউক্রেনকে ছেড়ে দিতে হবে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প মনোনীত দূত সাবেক মার্কিন জেনারেল কিথ কেলোগের পরিকল্পনা থেকেও এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইদানীং যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেখানেও রাশিয়া অধিকৃত ভূখণ্ড নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। অথচ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো শান্তি আলোচনার প্রধান শর্ত হিসেবে দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করছিলেন।

চলতি বছরের এপ্রিলে কেলোগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এনএসএ–এর সাবেক চিফ অব স্টাফ ফ্রেড ফ্লেইটজ একটি কৌশলপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা যুক্তি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা করা। এই কৌশলপত্রটি প্রকাশ করেছে আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউট (এএফপিআই)। ২০২১ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

এই কৌশলপত্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার জন্য দায়ী করা হয়েছে। বিশেষত, ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত এবং রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যর্থ হওয়ার কথা তারা উল্লেখ করেছে। এতে আরও অভিযোগ আনা হয়েছে যে, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে একটি ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

কেলোগের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিপরীতে একজন শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট থাকলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা ঠেকানো যেত। মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিধ্বনিই করেছেন কেলোগে।

অবশ্য বাইডেনকে দুর্বল মনে করার কারণেই পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—কেলোগ ও ফ্লেইটজের এমন দাবি সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

কেলোগের পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ শেষ করার একটি আনুষ্ঠানিক নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার মূল বিষয়গুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখবে। তবে ভবিষ্যতে এই সামরিক সহায়তা নির্ভর করবে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেবে কিনা তার ওপর। পুতিনকে আলোচনায় রাজি করানোর জন্য ন্যাটো নেতারা ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিতে পারেন।

কেলোগ–ফ্লেইটজের কৌশলপত্রে আরও যেসব মূল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো হলো—রাশিয়া যদি একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, তবে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া, রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রিতে শুল্ক আরোপ করে সেই অর্থ ইউক্রেন পুনর্গঠনের কাজে ব্যবহারেরও প্রস্তাব রাখা হয়েছে এই কৌশলপত্রে।

রাশিয়া ২০১৪ সালেই ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিজেদের ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ছাড়া, ইউক্রেনের দনবাসের প্রায় ৮০ শতাংশ—যা দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে গঠিত এবং জাপোরিঝিয়া ও খেরসনের ৭০ শতাংশেরও বেশি, এর পাশাপাশি মাইকোলাইভ ও খারকিভের কিছু অংশ এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।

মোট কথা, এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দল যে ধারণা হাজির করেছে, সেখানে ইউক্রেনকে তার হারানো ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ারই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত, জেলেনস্কিও বিষয়টি অনেকটা মেনে নিয়েছেন। কিছুদিন আগে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি আলোচনার জন্য প্রস্তুত। যদিও তিনি এখনো ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে আগ্রহী। তবে চলতি সপ্তাহে তিনি বলেছেন, দখলকৃত কিছু অঞ্চল ফিরে পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে।

অধিকৃত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফেরত পাওয়ার প্রসঙ্গে জেলেনস্কির বক্তব্যে আর তেমন জোর নেই। যেখানে তাঁকে প্রতিনিয়ত জনবল সংকট এবং নতুন নতুন ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি, অনেক অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষতে হচ্ছে।

সর্বশেষ গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন এলিসি প্রাসাদে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমরা সবাই শান্তি চাই। তবে আমাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ...যে, এই শান্তি যেন সবার জন্য ন্যায়সংগত হয় এবং রাশিয়া, পুতিন বা অন্য কোনো আগ্রাসী কখনোই ফিরে আসার সুযোগ না পায়।’ জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘এবং এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—একটি ন্যায়সংগত শান্তি এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, ইউক্রেনের জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।’

ট্রাম্প বরাবরই ইউক্রেনের পেছনে সামরিক সহায়তার নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচের বিরোধী। এ নিয়ে তিনি সব সময়ই বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করে এসেছেন। তিনি বরং দ্রুত সমঝোতার মাধ্যম যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলে আসছেন।

এলিসি প্রাসাদে বৈঠক শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘জেলেনস্কি এবং ইউক্রেন একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে এবং এই পাগলামি থামাতে চাচ্ছেন। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হওয়া উচিত এবং আলোচনার শুরু করা উচিত।’

পোস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইঙ্গিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমি ভ্লাদিমিরকে ভালোভাবে চিনি। এটাই তাঁর জন্য কাজ করার সময়। চীন সহায়তা করতে পারে। বিশ্ব অপেক্ষায় আছে!’

এই দুই নেতার বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এলিসি প্রাসাদের আলোচনায় সেই অর্থে ইউক্রেনের হারানো ভূখণ্ডের বিষয়টি অতটা গুরুত্ব পায়নি। অথবা হতে পারে, রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে বসাতে এখনই বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে না।

কিন্তু ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের জন্য মনোনীত পরিকল্পনা এবং জেলেনস্কির সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো থেকে একটি বিষয় অনুমান করা যায় যে, ইউক্রেন হয়তো হারানো ভূখণ্ডের বিষয়টি আলোচনার শর্ত হিসেবে জোরালো ভাবে হাজির করতে পারবে না।

এর একটি কারণ হতে পারে, রণক্ষেত্রে কিয়েভের দুর্বল অবস্থান। পাশাপাশি আলোচনায় নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে বা আপার হ্যান্ডে রাখার জন্য ইউক্রেন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল দখলে যে অভিযান পরিচালনা করেছিল তা এক প্রকার ব্যর্থ হয়েছে। রুশ বাহিনী কুরস্ক অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয়দের প্রায় তাড়িয়েই দিয়েছে এবং গত নভেম্বরে তারা ইউক্রেনে অন্তত ৬০০ বর্গকিলোমিটার নতুন করে দখল করেছে।

এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—রণক্ষেত্রে জীবনবাজি রাখা ইউক্রেনীয়দের ভবিষ্যৎ আসলে কী? এই অসম যুদ্ধের বাস্তবতা তাঁরা এতদিনে টের পেয়ে গেছেন। সম্মুখযোদ্ধারা মূলত পশ্চিমা পরাশক্তিদের পক্ষে লড়ছেন। যে যুদ্ধে তাঁদের বিজয় প্রায় অসম্ভব। তাঁদের হাতে এখন দুটি অপশন—হয় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, নয়তো মৃত্যু। স্বাধীনতা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এই বাস্তবতায় ইউক্রেনের প্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। ইউক্রেনীয়রা এরই মধ্যে ক্লান্ত, হতাশ।

এই অবস্থায় রাশিয়া যে, আলোচনার শর্ত নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে সেটি চোখ বন্ধ করে বলা যায়। এ বিষয়ে বিশ্লেষক এবং সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্পের জন্য পুতিনকে আলোচনায় রাজি করানো কঠিন হতে পারে। কারণ, পুতিন এরই মধ্যে ইউক্রেনকে চাপের মুখে ফেলেছেন এবং আরও ভূমি দখলের মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন—এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার রাশিয়া–বিষয়ক সাবেক শীর্ষ বিশ্লেষক এবং বর্তমানে কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থিংক ট্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ইউজিন রুমার বলেন, ‘পুতিনের কোনো তাড়া নেই। যতক্ষণ না ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করে এবং চারটি অঞ্চল রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে না নেয়—ততক্ষণ পর্যন্ত পুতিন যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত নন।’

রুমার আরও বলেন, ‘পুতিন সম্ভবত সময় নিয়ে আরও ভূখণ্ড দখল করবেন এবং ট্রাম্প কী ধরনের ছাড় দেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করবেন।’

বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত মে মাসে জানিয়েছিল, পুতিন একটি সমঝোতার যুদ্ধবিরতিতে যেতে প্রস্তুত, তবে ইউক্রেনকে হারানো ভূখণ্ড ফেরত দেওয়া হবে না। কিয়েভ এবং পশ্চিমা বিশ্ব সাড়া না দিলে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন পুতিন।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এমন কোনো অবস্থানে নেই যেখান থেকে তিনি অধিকৃত অঞ্চল ফেরত পাওয়ার জন্য শক্তভাবে দাবি তুলতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে ট্রাম্পের দলের পরিকল্পনাও বলে যে, ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন ইউক্রেনকে ভূখণ্ড হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে চাপ দিতে পারে যাতে, প্রায় ৩ বছর ধরে চলমান যুদ্ধটি বন্ধ করা যায়।

তথ্যসূত্র: পলিটিকো, রয়টার্স, এএফপি ও আরটি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত