অনলাইন ডেস্ক
ভারতে লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। ১৯ এপ্রিল দেশটিতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪ শতাধিকে জয় পাবে। যদিও গত নির্বাচনে ৩৫৪ আসন পেয়েছিল এনডিএ। এর মধ্যে শুধু বিজেপিই পেয়েছিল ৩০৩। এবার নির্বাচনে বিজেপির টার্গেট ৩৭০।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, টানা দুই মেয়াদে থাকা এনডিএর মুখ মোদি ম্যাজিকের ধার অনেকটা কমে গেছে। এবারের নির্বাচনে এনডিএর সাফল্য আর শুধুই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তির ওপর নির্ভর করছে না। ফলে নির্বাচনী প্রচারে মোদি ‘এবার ৪০০ পার’ করার ডাক দিলেও ভোটাররা কতটা সাড়া দেবেন সেটি, লক্ষ্য পূরণের ম্যাজিক আর মোদির হাতে নেই! এনডিএর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দক্ষিণের রাজ্যগুলো।
লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে একক দল হিসেবে কংগ্রেস ৪০০ আসনের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সেটি সম্ভব হয়েছিল মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ফলস্বরূপ জনগণের সহানুভূতির কারণে। কিন্তু এবার কংগ্রেসর অবস্থা এতটাই নাজুক যে বিজেপির সামনে ন্যূনতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দিহান অনেক বিশ্লেষক।
তবে কংগ্রেস যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ পুঁজি করা বিজেপি এবারের নির্বাচনে ৪ শতাধিক আসন পাবে কি না সেটিই বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বিষয়টি নির্ধারণ করে দেবে দক্ষিণ ভারত। কারণ, বিজেপির হিন্দুত্ব মন্ত্র দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে মোটেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বাস দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য—তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা ও তেলেঙ্গানায় এবং কেন্দ্রশাসিত পদুচেরি ও লাক্ষাদ্বীপে। এই অঞ্চলটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ভারতের জিডিপিতে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর অবদান ৩০ শতাংশের বেশি।
মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ভারতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিলেও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই অঞ্চলের ১৩১ আসনের মধ্যে মাত্র ৩০টি পেয়েছিল। যার অধিকাংশই ছিল কর্ণাটকে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপি সে অর্থে কোনো জায়গায় পায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের নির্বাচনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী।
সর্বশেষ লোকসভায় বিজেপি ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৩০৩টিতে জিতেছিল, যার অধিকাংশই উত্তর ভারতে। দেশের এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই বিজেপির অনুকূলে। কিন্তু লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা বিজেপি পায়নি কেবল দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কারণেই।
নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিসের চেয়ারম্যান মোহন গুরুস্বামী বলেন, ‘অন্ধ্র প্রদেশ ও দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি খুবই অজনপ্রিয়। আসলে, এই অঞ্চলে যে কেউ বিজেপির সঙ্গে জোট করবে, তারাই এ নির্বাচনে খারাপ করবে।’
একই সুর অর্থনীতিবিদ ও বিজেপি সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের স্বামী পারাকালা প্রভাকরের কথায়ও। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ‘উত্তর-দক্ষিণের’ বিভাজনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে বিজেপির এই খাবি খাওয়া নতুন নয়। উত্তর ভারতের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব সূচকেই দক্ষিণের রাজ্যগুলো এগিয়ে। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব কম। বিজেপির রাজনীতির ঐতিহ্যই ধর্মকেন্দ্রিক।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের আর্থসামাজিক তুলনা টানা যেতে পারে কেরালা ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে। কেরালায় নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মাত্র ৬, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। অথচ একই দেশের উত্তর প্রদেশে নবজাতক মৃত্যুর হার হাজারে ৪৮, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সমান। মূলত এই তুলনামূলক অবস্থার কারণেই দক্ষিণ ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কখনোই হালে পানি পায়নি বলেই মনে করেন পারাকালা প্রভাকর।
ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তেলেগু দেশম পার্টির সাবেক নেতা কিশোর চন্দ্র দেও বলছেন, ‘উত্তর ভারতে মানুষকে ধর্মের ছাতার নিচে আনা সম্ভব হলেও দক্ষিণ ভারতে এটি সম্ভব নয়।’ কিছুদিন আগে, তেলেগু দেশম পার্টি ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কিশোর দল থেকে পদত্যাগ করেন।
তামিলনাড়ুর তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল পরিষেবাবিষয়ক মন্ত্রী পালানিভেল থিয়াগা রাজনও কিশোর চন্দ্র দেওয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণে কয়েক শ বছর আগে থেকে সব ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থানের ঐতিহ্য আছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই দক্ষিণে বুমেরাং হবে।’
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে দক্ষিণ ভারতের সেক্যুলার অবস্থান টিকবে কি না তা আসন্ন নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে নির্বাচনের আগে, বিজেপি এবং মোদি অবশ্যই চেষ্টা করেছেন, দক্ষিণ ভারতে অবস্থান শক্ত করার। আর এ লক্ষ্যে মোদি বেছে নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুকে, যেখানে লোকসভার ৩৯টি আসন রয়েছে।
পুরো তামিলনাড়ুতেই ১৯ এপ্রিল ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে, মোদি এই রাজ্যে অন্তত ছয়বার সফর করেছেন। এমনকি নিজের তামিল ভাষার অজ্ঞতা ঢাকতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্য নিয়ে সমাবেশে হিন্দি ভাষণ তামিল ভাষায় শুনিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন, তামিল ভোটারদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ভোটার টানতে।
ভোটের পাল্লা ভারী করতে মোদি তামিল জনগণকে বিভাজিত করতে ৫০ বছর আগে নির্ধারণ হয়ে যাওয়া কাচ্চাথিভু দ্বীপের বিষয়টি হাজির করেছেন। তাঁর সরকারের দাবি, তৎকালীন ভারত সরকার ইচ্ছা করে ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরের দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে উপহার দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত তামিলদের মধ্যে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
কাচ্চাথিভু ইস্যুতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রতি তোপ দাগার পাশাপাশি মোদি তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন দল দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাগাম বা ডিএমকের বিরুদ্ধে হিন্দুবিরোধী মনোভাবের অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরে সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের ছেলে ডিএমকে নেতা উদয়ানিধি স্ট্যালিন হিন্দু তথা সনাতন ধর্মকে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মূলত হিন্দুধর্মে বর্ণপ্রথার সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন।
এই অবস্থায় দিল্লিভিত্তিক কিছু জরিপ সংস্থা বলছে, বিজেপি হয়তো সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভোট বাগাতে পারবে। তবে আসনসংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপির জন্য বিষয়টি ‘বলা সহজ, করা কঠিন’—প্রবাদের মতোই।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরেই ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী মনোভাব প্রবল। জাতীয়তাবাদী যেকোনো ধারণাই দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দীর্ঘকাল ধরেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এই মনোভাবের কারণে, তামিল রাজনৈতিক নেতা রামাস্বামী নাইকার—যিনি পেরিয়ার নামেই বেশি পরিচিত—নিজের দল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের উচ্চপর্যায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত।
বিজেপি নেতারা প্রায়ই পেরিয়ারের সমালোচনা করেন। তবে ডিএমকে ও প্রতিদ্বন্দ্বী অল ইন্ডিয়া আন্না ডিএমকে (এআইএডিএমকে) উভয়ই পেরিয়ারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকার করেছে। ফলে কংগ্রেসই যেখানে ছাড় পায়নি, সেখানে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসবে—এমনটা ভাবা অমূলকই।
তবে কর্ণাটকে বিজেপির অবস্থান তুলনামূলক রমরমাই বলা চলে। বিগত দুই দশকে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির জন্য অনেক বেশি উর্বর ভূমি ছিল রাজ্যটি। রাজ্যটি ২০০৮ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজেপি শাসিত ছিল। এমনকি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যটির ২৮ আসনের মধ্যে ২৫টিই জিতেছিল বিজেপি।
তবে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছে। ফিরেই লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ‘অন্যায়’ ও ‘বঞ্চনার’ অভিযোগ তুলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কংগ্রেসের এই কৌশল কাজে দেবে। এ বিষয়ে ‘দক্ষিণ বনাম উত্তর: মহাবিভাজন’ বইয়ে লেখক আর এস নীলাকান্তন বলেন, ‘উত্তরের তুলনায় এই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জনগণ গড়ে যে পরিমাণ কর দেয়, সেই তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে খুব সামান্যই পায়।’
দক্ষিণে তুলনামূলক কম বরাদ্দের পক্ষে বিজেপি শিবিরের যুক্তি হলো, কেন্দ্র সরকারকে উত্তরের রাজ্যগুলোর দুর্বল সামাজিক সূচকসহ সামগ্রিক উন্নতিতে সহায়তা করতে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। তবে এর সমালোচকদের যুক্তি, এই বিষয়টি দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জন্য আঘাত। কারণ, উত্তরের রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় সংস্থান ব্যবহার করে স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় দ্রুত অগ্রগতি করছে, এমন প্রমাণ খুব একটা নেই।
এ ছাড়া, ২০২৬ সালের মধ্যে নতুন করে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণের সম্ভাবনা দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত শাসক দল এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকার সীমানা এমনভাবে নির্ধারণ করতে চায় যাতে তাদের ভাগে পর্যাপ্তসংখ্যক ভোটার নিশ্চিত হয়।
আর এস নীলাকান্তন বলছেন, যেহেতু দক্ষিণের রাজ্যগুলো ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় উত্তরের চেয়ে এগিয়ে এবং এসব রাজ্যের জনসংখ্যা অনেক কম—সেই বিবেচনায় সীমানা নির্ধারণ এমনভাবে করা হবে যাতে এসব রাজ্যে লোকসভা আসন কমে যায়। যার ফলে জাতীয় তথা লোকসভা নির্বাচনের রাজনীতিতে এসব রাজ্যের প্রভাব কমে যাবে।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জনসংখ্যা বিবেচনায় লোকসভা আসন নির্ধারণ করা হলে তামিলনাড়ুর আসন ৩৯ থেকে ৩০-এ নেমে যেতে পারে। বিপরীতে উত্তর প্রদেশের আসন ৮০ থেকে ৯০-এ উন্নীত হতে পারে।’ তাঁর মতে, উত্তর আর দক্ষিণ ভারতের পার্থক্যের বিষয়টি এখন আর কেবলই আবেগের বিষয় নয়। এখন এটি কঠিন বাস্তবতার বিষয় এবং পরিসংখ্যানেও সেটি স্পষ্ট।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ভারতে লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। ১৯ এপ্রিল দেশটিতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪ শতাধিকে জয় পাবে। যদিও গত নির্বাচনে ৩৫৪ আসন পেয়েছিল এনডিএ। এর মধ্যে শুধু বিজেপিই পেয়েছিল ৩০৩। এবার নির্বাচনে বিজেপির টার্গেট ৩৭০।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, টানা দুই মেয়াদে থাকা এনডিএর মুখ মোদি ম্যাজিকের ধার অনেকটা কমে গেছে। এবারের নির্বাচনে এনডিএর সাফল্য আর শুধুই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তির ওপর নির্ভর করছে না। ফলে নির্বাচনী প্রচারে মোদি ‘এবার ৪০০ পার’ করার ডাক দিলেও ভোটাররা কতটা সাড়া দেবেন সেটি, লক্ষ্য পূরণের ম্যাজিক আর মোদির হাতে নেই! এনডিএর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দক্ষিণের রাজ্যগুলো।
লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে একক দল হিসেবে কংগ্রেস ৪০০ আসনের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সেটি সম্ভব হয়েছিল মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ফলস্বরূপ জনগণের সহানুভূতির কারণে। কিন্তু এবার কংগ্রেসর অবস্থা এতটাই নাজুক যে বিজেপির সামনে ন্যূনতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দিহান অনেক বিশ্লেষক।
তবে কংগ্রেস যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ পুঁজি করা বিজেপি এবারের নির্বাচনে ৪ শতাধিক আসন পাবে কি না সেটিই বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বিষয়টি নির্ধারণ করে দেবে দক্ষিণ ভারত। কারণ, বিজেপির হিন্দুত্ব মন্ত্র দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে মোটেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বাস দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য—তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা ও তেলেঙ্গানায় এবং কেন্দ্রশাসিত পদুচেরি ও লাক্ষাদ্বীপে। এই অঞ্চলটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ভারতের জিডিপিতে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর অবদান ৩০ শতাংশের বেশি।
মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ভারতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিলেও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই অঞ্চলের ১৩১ আসনের মধ্যে মাত্র ৩০টি পেয়েছিল। যার অধিকাংশই ছিল কর্ণাটকে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপি সে অর্থে কোনো জায়গায় পায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের নির্বাচনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী।
সর্বশেষ লোকসভায় বিজেপি ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৩০৩টিতে জিতেছিল, যার অধিকাংশই উত্তর ভারতে। দেশের এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই বিজেপির অনুকূলে। কিন্তু লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা বিজেপি পায়নি কেবল দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কারণেই।
নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিসের চেয়ারম্যান মোহন গুরুস্বামী বলেন, ‘অন্ধ্র প্রদেশ ও দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি খুবই অজনপ্রিয়। আসলে, এই অঞ্চলে যে কেউ বিজেপির সঙ্গে জোট করবে, তারাই এ নির্বাচনে খারাপ করবে।’
একই সুর অর্থনীতিবিদ ও বিজেপি সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের স্বামী পারাকালা প্রভাকরের কথায়ও। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ‘উত্তর-দক্ষিণের’ বিভাজনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে বিজেপির এই খাবি খাওয়া নতুন নয়। উত্তর ভারতের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব সূচকেই দক্ষিণের রাজ্যগুলো এগিয়ে। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব কম। বিজেপির রাজনীতির ঐতিহ্যই ধর্মকেন্দ্রিক।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের আর্থসামাজিক তুলনা টানা যেতে পারে কেরালা ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে। কেরালায় নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মাত্র ৬, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। অথচ একই দেশের উত্তর প্রদেশে নবজাতক মৃত্যুর হার হাজারে ৪৮, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সমান। মূলত এই তুলনামূলক অবস্থার কারণেই দক্ষিণ ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কখনোই হালে পানি পায়নি বলেই মনে করেন পারাকালা প্রভাকর।
ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তেলেগু দেশম পার্টির সাবেক নেতা কিশোর চন্দ্র দেও বলছেন, ‘উত্তর ভারতে মানুষকে ধর্মের ছাতার নিচে আনা সম্ভব হলেও দক্ষিণ ভারতে এটি সম্ভব নয়।’ কিছুদিন আগে, তেলেগু দেশম পার্টি ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কিশোর দল থেকে পদত্যাগ করেন।
তামিলনাড়ুর তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল পরিষেবাবিষয়ক মন্ত্রী পালানিভেল থিয়াগা রাজনও কিশোর চন্দ্র দেওয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণে কয়েক শ বছর আগে থেকে সব ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থানের ঐতিহ্য আছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই দক্ষিণে বুমেরাং হবে।’
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে দক্ষিণ ভারতের সেক্যুলার অবস্থান টিকবে কি না তা আসন্ন নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে নির্বাচনের আগে, বিজেপি এবং মোদি অবশ্যই চেষ্টা করেছেন, দক্ষিণ ভারতে অবস্থান শক্ত করার। আর এ লক্ষ্যে মোদি বেছে নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুকে, যেখানে লোকসভার ৩৯টি আসন রয়েছে।
পুরো তামিলনাড়ুতেই ১৯ এপ্রিল ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে, মোদি এই রাজ্যে অন্তত ছয়বার সফর করেছেন। এমনকি নিজের তামিল ভাষার অজ্ঞতা ঢাকতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্য নিয়ে সমাবেশে হিন্দি ভাষণ তামিল ভাষায় শুনিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন, তামিল ভোটারদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ভোটার টানতে।
ভোটের পাল্লা ভারী করতে মোদি তামিল জনগণকে বিভাজিত করতে ৫০ বছর আগে নির্ধারণ হয়ে যাওয়া কাচ্চাথিভু দ্বীপের বিষয়টি হাজির করেছেন। তাঁর সরকারের দাবি, তৎকালীন ভারত সরকার ইচ্ছা করে ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরের দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে উপহার দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত তামিলদের মধ্যে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
কাচ্চাথিভু ইস্যুতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রতি তোপ দাগার পাশাপাশি মোদি তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন দল দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাজাগাম বা ডিএমকের বিরুদ্ধে হিন্দুবিরোধী মনোভাবের অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরে সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের ছেলে ডিএমকে নেতা উদয়ানিধি স্ট্যালিন হিন্দু তথা সনাতন ধর্মকে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মূলত হিন্দুধর্মে বর্ণপ্রথার সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন।
এই অবস্থায় দিল্লিভিত্তিক কিছু জরিপ সংস্থা বলছে, বিজেপি হয়তো সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভোট বাগাতে পারবে। তবে আসনসংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপির জন্য বিষয়টি ‘বলা সহজ, করা কঠিন’—প্রবাদের মতোই।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরেই ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী মনোভাব প্রবল। জাতীয়তাবাদী যেকোনো ধারণাই দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দীর্ঘকাল ধরেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এই মনোভাবের কারণে, তামিল রাজনৈতিক নেতা রামাস্বামী নাইকার—যিনি পেরিয়ার নামেই বেশি পরিচিত—নিজের দল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের উচ্চপর্যায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত।
বিজেপি নেতারা প্রায়ই পেরিয়ারের সমালোচনা করেন। তবে ডিএমকে ও প্রতিদ্বন্দ্বী অল ইন্ডিয়া আন্না ডিএমকে (এআইএডিএমকে) উভয়ই পেরিয়ারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকার করেছে। ফলে কংগ্রেসই যেখানে ছাড় পায়নি, সেখানে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসবে—এমনটা ভাবা অমূলকই।
তবে কর্ণাটকে বিজেপির অবস্থান তুলনামূলক রমরমাই বলা চলে। বিগত দুই দশকে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির জন্য অনেক বেশি উর্বর ভূমি ছিল রাজ্যটি। রাজ্যটি ২০০৮ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজেপি শাসিত ছিল। এমনকি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যটির ২৮ আসনের মধ্যে ২৫টিই জিতেছিল বিজেপি।
তবে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছে। ফিরেই লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ‘অন্যায়’ ও ‘বঞ্চনার’ অভিযোগ তুলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কংগ্রেসের এই কৌশল কাজে দেবে। এ বিষয়ে ‘দক্ষিণ বনাম উত্তর: মহাবিভাজন’ বইয়ে লেখক আর এস নীলাকান্তন বলেন, ‘উত্তরের তুলনায় এই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জনগণ গড়ে যে পরিমাণ কর দেয়, সেই তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে খুব সামান্যই পায়।’
দক্ষিণে তুলনামূলক কম বরাদ্দের পক্ষে বিজেপি শিবিরের যুক্তি হলো, কেন্দ্র সরকারকে উত্তরের রাজ্যগুলোর দুর্বল সামাজিক সূচকসহ সামগ্রিক উন্নতিতে সহায়তা করতে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। তবে এর সমালোচকদের যুক্তি, এই বিষয়টি দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জন্য আঘাত। কারণ, উত্তরের রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় সংস্থান ব্যবহার করে স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় দ্রুত অগ্রগতি করছে, এমন প্রমাণ খুব একটা নেই।
এ ছাড়া, ২০২৬ সালের মধ্যে নতুন করে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণের সম্ভাবনা দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত শাসক দল এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকার সীমানা এমনভাবে নির্ধারণ করতে চায় যাতে তাদের ভাগে পর্যাপ্তসংখ্যক ভোটার নিশ্চিত হয়।
আর এস নীলাকান্তন বলছেন, যেহেতু দক্ষিণের রাজ্যগুলো ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় উত্তরের চেয়ে এগিয়ে এবং এসব রাজ্যের জনসংখ্যা অনেক কম—সেই বিবেচনায় সীমানা নির্ধারণ এমনভাবে করা হবে যাতে এসব রাজ্যে লোকসভা আসন কমে যায়। যার ফলে জাতীয় তথা লোকসভা নির্বাচনের রাজনীতিতে এসব রাজ্যের প্রভাব কমে যাবে।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জনসংখ্যা বিবেচনায় লোকসভা আসন নির্ধারণ করা হলে তামিলনাড়ুর আসন ৩৯ থেকে ৩০-এ নেমে যেতে পারে। বিপরীতে উত্তর প্রদেশের আসন ৮০ থেকে ৯০-এ উন্নীত হতে পারে।’ তাঁর মতে, উত্তর আর দক্ষিণ ভারতের পার্থক্যের বিষয়টি এখন আর কেবলই আবেগের বিষয় নয়। এখন এটি কঠিন বাস্তবতার বিষয় এবং পরিসংখ্যানেও সেটি স্পষ্ট।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
গত সেপ্টেম্বরে ভ্লাদিভস্টকের একটি অর্থনৈতিক ফোরামে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এ বিষয়ে পরে তিনি একটি উপহাসমূলক হাসি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
১ ঘণ্টা আগেআব্রাহাম অ্যাকর্ডস মূলত একটি চটকদার বিষয়। এতে বাস্তব, স্থায়ী আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই এতে ছিল না। যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে তারা তা করেছে—কারণ, তারা ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তারের পথ হিসেবে দেখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরায়েলের ওপর মার
৮ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেখেয়ালি, সেটা আগা থেকেই সবার জানা। তবে দেশটির নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে এসেও তিনি অসংলগ্ন, অশ্লীল, স্বৈরতান্ত্রিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ থেকে অন্তত একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে একটি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।
৯ দিন আগেএবারের আইএমইএক্স মহড়ায়ও কিছু দেশ আছে যারা আগেরবারও অংশগ্রহণ করেছিল। এসব দেশের নাম আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই মহড়ার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—ইরান ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে এমন দেশগুলোর কক্ষপথে নিয়ে যাচ্ছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত
৯ দিন আগে