বুলডোজার যেভাবে মোদির ভারতের প্রতীক হয়ে উঠল

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
ভারতের বিজেপি সরকারের বুলডোজার জাস্টিসের মূল টার্গেট মুসলিমরা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর একটি হলো বুলডোজার। তবে ভারতে এটির ব্যবহার নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই রয়েছে! নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে বিভাজন ও সহিংস প্রতিশোধমূলক আবহ তৈরি করেছে, সেটির একটি প্রতীক হলো বুলডোজার। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর সমালোচনা ও আদালতের তিরস্কারের পরও বিজেপির বুলডোজার থামেনি। আইনি ব্যবস্থা ও উন্নয়নের নামে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করতেই বুলডোজার ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ভারতীয় সমাজের বর্তমান ‘অস্বাভাবিক ধর্মীয়’ পরিস্থিতিকেই তুলে ধরে।

উত্তর প্রদেশ রাজ্যে প্রথম শুরু হয় এই তথাকথিত ‘বুলডোজার জাস্টিস’ বা ‘বুলডোজার বিচার’। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য এটি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়া পরিহিত হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ। ২০২০ সাল থেকে তাঁর অধীনে রাজ্য কর্মকর্তারা নিয়মিত বুলডোজার ব্যবহারের আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন।

বিজেপি সরকারের চোখে বিবেচিত অপরাধমূলক কার্যকলাপ বা সরকারবিরোধী প্রতিবাদে জড়িত এমন ব্যক্তি, বিশেষ করে মুসলমানদের সম্পত্তি ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয় বুলডোজার। আদিত্যনাথ দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মন্তব্যের জন্য পরিচিত। তিনিই মূলত বুলডোজারকে তথাকথিত ‘ন্যায়বিচারের’ হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর ফলে এই সন্ন্যাসী ‘বুলডোজার বাবা’ উপাধিও অর্জন করেছেন!

ন্যায়বিচারের নামে বুলডোজারের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূতভাবে মুসলিমদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদে আক্রমণ প্রথমে উত্তর প্রদেশে শুরু হলেও পরে এই কৌশল বিজেপি–শাসিত আসাম, গুজরাট, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানেও সরকারগুলোর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের মে মাসে উত্তর প্রদেশে এক বক্তৃতায় মোদি নিজে আদিত্যনাথের বুলডোজার রাজনীতিকে সমর্থন করেন।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘বুলডোজার অবিচার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত শাস্তিমূলক ভাঙচুরের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সরাসরি উসকানিতে এসব কাজ ঘটেছে এবং এর ফলে অন্তত ৬১৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বেশির ভাগই মুসলিম।

গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি তুলনামূলক কম আসন পাওয়ার পরও মুসলিমদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘বুলডোজার জাস্টিস’ এখনো চালু আছে। গত বছরের জুনে মধ্যপ্রদেশের মণ্ডলা জেলায় মুসলিমদের ১১টি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। প্রশাসনের দাবি, এসব বাড়িতে থাকা ফ্রিজে গরুর মাংস পাওয়া গিয়েছিল। অক্টোবরে রাজস্থানে একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, বাড়িটি মন্দিরের জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত।

বলতে গেলে, বুলডোজার এখন ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতীক হিসেবে। ২০২৪ সালের নির্বাচন চলাকালে ভারতজুড়ে রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে মোদি ও আদিত্যনাথের পোস্টার দিয়ে সাজানো বুলডোজারের বহর প্রদর্শন করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। বুলডোজার কেবল রাজনৈতিক প্রতীকই নয়; এটি জাতীয় সংস্কৃতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বুলডোজার এখন জনপ্রিয় খেলনা ও স্ন্যাকসের প্যাকেটের ছবিতেও ঠাঁই নিয়েছে। ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভের পর তরুণ সমর্থকেরা বুলডোজারের ট্যাটু করার জন্য লাইন দিয়েছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, হিন্দুত্ববাদী জনপ্রিয় সংগীতের মধ্যে নিয়মিতভাবে বুলডোজারের উল্লেখ করা হচ্ছে।

এ ধরনের গান ‘বুলডোজার জাস্টিস’ বাস্তবায়নকারীদের স্তুতি করে, তাদের বীর হিসেবে তুলে ধরে এবং তাদের নায়ক ও হিন্দু পরিচয়ের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে। বুলডোজার যারা পরিচালনা করেন তাঁরা নিজেরাও এই প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের গৌরবগাথা তুলে ধরতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী।

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির হতাশাজনক ফলাফলের পর আলোচনা শুরু হয়েছে যে, ‘বুলডোজার জাস্টিস’–এর ওপর ভর করা দলটির বিভাজনমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতটা টেকসই! তবে বুলডোজার এখনো আদিত্যনাথের রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রে রয়ে গেছে।

গত জুলাইয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনে উত্তর প্রদেশের মন্ত্রী সঞ্জয় নিশাদ দলটির পরাজয়ের কারণ হিসেবে ‘বুলডোজারের অপব্যবহারকে’ চিহ্নিত করেন।

এর প্রতিক্রিয়ায়, আদিত্যনাথ ‘বুলডোজার নীতি’–এর পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদে কেবল চাকরি করার জন্য বসেননি, যারা দোষী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যও বসেছেন এবং সেই কাজ করছেন।

অনেক বিজেপি সমর্থক স্পষ্টতই যোগীর এই মতের পক্ষে। গত বছরের ৯ নভেম্বর আদিত্যনাথের এক সমর্থক মায়াপুর শহরে এক জনসমাবেশে বুলডোজারে চড়ে উপস্থিত হন। এটি মূলত একটি স্পষ্ট হুমকি ছিল যে, জনগণকে সম্প্রদায়ভিত্তিক সীমানা মানতে হবে, না হলে কঠোর পরিণতির মুখে পড়তে হবে।

বুলডোজারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার এরই মধ্যেই ভারতে হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে দেশটিতে রাজনৈতিক প্রতীকের মাধ্যমে বিভাজন উসকে দেওয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় চিত্রকল্প ও শব্দের মাধ্যমে ‘আমরা’ ও ‘ওরা’—এর রাজনীতি বাস্তবায়ন করে আসছে।

ভারত ভাগের সময় হিন্দু–মুসলমান দুই জাতির যে ধারণা ছিল, বিজেপি নেতারা এখনো সেই ধারণাই প্রচার করছেন। তাঁদের অবস্থান হলো—এই দুই সম্প্রদায় একক জাতি হিসেবে থাকলেও এরা আলাদা এবং পরস্পরের স্বার্থ বিপরীত। আদিত্যনাথ অতীতে অনেক সময় ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ অর্থাৎ, হিন্দুরা বিভক্ত হলে তাদের (ওরা) কেটে ফেলবে— এমন মুসলিম বিদ্বেষী ও ভীতি উদ্রেককারী স্লোগান ব্যবহার করেছেন।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের সময় আবারও এই স্লোগান ব্যবহার করেন যোগী। কেবল তা–ই নয়, মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মোদি নিজেও আদিত্যনাথের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেই কেবল নিরাপদ।’ এ ক্ষেত্রে বিজেপির নীরব বার্তাটি হলো, বিরোধী দল কংগ্রেসই ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে, তারাই হিন্দুদের মধ্যে বর্ণ বিভেদের রাজনীতি করে।

ভারতের সামাজিক বৈচিত্র্য এখন ধর্মীয় দ্বিমুখী স্রোতে পরিণত হয়েছে। যেখানে মুসলিমদের এমন একটি গোষ্ঠী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যারা হুমকি সৃষ্টি করছে এবং তাই তাদের শাসন (সভ্য) করতে হবে। আর এই শাসন কার্যকরের মোক্ষম হাতিয়ার বুলডোজার।

ধর্মীয় বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত ভারতে সামাজিক বিভাজন তৈরি করেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত সরকার হিন্দুদের মাঝে মুসলিমদের নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। যা পরিশেষে পক্ষপাত তৈরি করে এবং নির্বাচনী রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব ফেলে। এটি অবশ্যই নির্বাচনী সফলতা নিশ্চিত করে না। তার প্রমাণ বিজেপি গত বছরের নির্বাচনে পেয়েছে। তবে এটি সামাজিক বিভাজনকে আরও গভীর করে এবং মুসলিমসহ অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য আগামী প্রজন্মে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে।

বুলডোজার এই ধ্বংসাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির নতুন রূপ। তবে এখন একটি ক্ষীণ আশা দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় মুসলিমরা হয়তো এর সরাসরি ‘বুলডোজার জাস্টিস’–এর হাত থেকে বাঁচতে পারবে, কিন্তু প্রতীকীভাবে এটি চলতেই থাকবে হয়তো। গত বছরের নভেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দেয়। সেই রায়ে বুলডোজারের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত ধ্বংসযজ্ঞকে নিন্দা করে। আদালত বলেছে, কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য আদিত্যনাথ বা মোদি এখনো এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।

আদালতের নির্দেশের পর যদিও সরকার অনুমোদিত ‘বুলডোজার জাস্টিস’ হয়তো আর হবে না। তবে এর ফলে যে গভীর সামাজিক ক্ষত হয়েছে, তা হয়তো কখনই সেরে উঠবে না। বুলডোজার হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিতেই চিরকাল থাকবে।

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

টিউলিপ সিদ্দিকের পতন ঘটাতে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ রাজনীতির আঁতাত

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

কিশোরগঞ্জে বিএনপি নেতা হত্যা: সাবেক চেয়ারম্যানসহ গ্রেপ্তার ৪

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত