অনলাইন ডেস্ক
পাঁচ বছর আগের অক্টোবর মাসে বাগ্দত্তা হাতিজে চেঙ্গিসকে বিয়ে করার কথা ছিল সৌদি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক জামাল খাশোগির, সব ঠিকঠাক চলছিল। একদিন বিয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ওঠাতে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন খাশোগি। পায়ে হেঁটে সেখানে ঢুকলেও আর কখনো নিজ পায়ে বের হতে পারেননি তিনি। সেখানে ১৫ সদস্যের একদল ঘাতক তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর চাপাতি দিয়ে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে সৌদির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত দুটি চার্টার করা ফ্লাইটে হত্যাকারীরা তুরস্ক থেকে বের হয়ে যায়।
হত্যার সঙ্গে সৌদি আরবের যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান জড়িত বলে দাবি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। কিন্তু এর কোনো বিচার তো হয়ইনি বরং এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমানের শাসন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
সেই ঘটনার পর মোহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ বিশ্ব অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সৌদি আরবকে বিশ্ব পর্যটনের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত করেছেন। আরও এগিয়ে গিয়ে, আগামী প্রজন্মের শহর নিওম নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ—৫০০ বিলিয়ন ডলার—বিনিয়োগের পরিকল্পনাও করেছেন। শুধু তাই নয়, ফুটবল, গলফসহ দেশের অন্যান্য ক্রীড়া খাতেও ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগ করেছেন সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। এত কিছুর উদ্দেশ্য একটাই—দেশটির ভয়ংকর মানবাধিকার রেকর্ডকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা।
কেবল অর্থনৈতিক নয়, এই সময়ে রাজনৈতিক পুঁজিও কম অর্জন করেননি সৌদি যুবরাজ। বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে দীর্ঘ দিন ধরেই তৈল মর্দন করে যাচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ড নামে যেমনটা করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো। ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে সৌদি আরব বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে বেশ চড়া মূল্যই আদায় করে নিতে চাইছে। সৌদি চায় একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি যার মাধ্যমে কখনো সৌদি আরব আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। পাশাপাশি বেসামরিক উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায় রিয়াদ। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রশাসনকে ‘একঘরে’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু এর পর বাইডেন প্রশাসন যা করেছে তা প্রতিশ্রুতি থেকে বহু দূরে।
এখন প্রশ্ন হলো—যুবরাজ মোহাম্মদ কীভাবে বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া সেই হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ভাগ্যকে বদলে দিলেন এবং কীভাবে নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধার করলেন? সংক্ষেপে বলতে গেলে—যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের সহায়তায়। তাঁরা উভয়ই একই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করলেও স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার রক্ষণের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন সৌদি আরবের ক্ষেত্রে।
ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা শুরু থেকেই সৌদি আরবকে ছাড় দিয়েছেন। যেমন, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ৯ দিন পর ১১ অক্টোবর ট্রাম্পকে তাঁর শীর্ষ কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সৌদি আরবকে যে কয়েক বিলিয়ন ডলার অস্ত্র দেওয়ার কথা তা তিনি বাতিল করবেন কিনা। জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা বিষয়টি পছন্দ করি বা না করি কিন্তু আমরা দেশটিতে ১১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা বাতিল করব...এটি আমার কাছে মোটেও পছন্দনীয় নয়।’
ট্রাম্পের কাছে খাশোগি হত্যাকাণ্ড ছিল স্রেফ একটি ‘কোলাট্যারাল ড্যামেজ’। সেই সময়ে ট্রাম্পের মন্তব্যই প্রমাণ করে দেয় সে সময় দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে কী প্রাধান্য ছিল। পূর্বসূরিদের মতো ট্রাম্পও মানবাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুবচন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। সে সময় ট্রাম্প কোনো ভণিতা করেননি। তাঁর কাছে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা, মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ নিরাপত্তা স্বার্থ এবং অস্ত্র বেচাকেনার জন্য সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক যেকোনো কিছুর চেয়েই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাম্পের পরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনও তাঁর পূর্বসূরির পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখেন। তাঁর প্রশাসনও শেষ পর্যন্ত সৌদি যুবরাজকে সন্তুষ্ট করেছে ট্রাম্পের মতোই। খাশোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য মোহাম্মদ বিন সালমান ও সৌদি আরবকে মানবাধিকার ইস্যুতে জবাবদিহির আওতায় আনার যে প্রতিশ্রুতি বাইডেন দিয়েছিলেন তা পালনে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হন।
২০২১ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বাইডেন জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে হত্যাকাণ্ডের জন্য মোহাম্মদ বিন সালমানকে সরাসরি দায়ী করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলে এটি একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না যে, সৌদি যুবরাজের অনুমতি ছাড়া কোনো একটি সংস্থা এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৭ জন সৌদি যুবরাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতি নিয়োজিত র্যাপিড ইন্টারভেনশন ফোর্সের সদস্য। এই বাহিনীটি সরাসরি তাঁর নির্দেশেই চলে এবং কেবল তাঁকেই জবাবদিহি করে।
প্রমাণ থাকার পরও বাইডেন প্রশাসন মোহাম্মদ বিন সালমানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বা কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই অবস্থায় সৌদি যুবরাজ নিশ্চিত হয়ে যান যে, বাইডেন প্রশাসন তাঁকে এবং সৌদি আরবকে ‘একঘরে’ করে রাখার যে প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছিলেন তা কাজে পরিণত করবেন না।
প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে সৌদি আরবের হামলার কারণে ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানির প্রমাণ থাকার পরও ২০২২ সালের মাঝামাঝি এসে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারে অস্ত্র চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করে। এমনকি ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ছিল সৌদি আরব। এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এককভাবে এই সময়ে ৭৮ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
কিন্তু সৌদি যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘অল্প’ প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বাইডেনকে বিব্রত করতে এবং বিশ্বের জ্বালানি বাজারে নিজের প্রভাব বাড়াতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের পর বিশ্বের জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পর মোহাম্মদ বিন সালমান সেই সুযোগ পেয়ে যান।
পরে ২০২২ সালের জুলাই মাসে বাইডেন তড়িঘড়ি করে সৌদি আরব সফর করেন এবং যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর এই সফরের মধ্য দিয়ে খাশোগি হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে তাঁর অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে যায়। এই সফরে বাইডেন সৌদি যুবরাজের সঙ্গে উষ্ণ ফিস্ট বাম্প বিনিময় করেন। পরে হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যুবরাজের সঙ্গে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। এই সময় সৌদি যুবরাজ ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না এবং এসব বিষয়ে সৌদি আরব সংস্কার আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
কিন্তু সৌদি যুবরাজ যে মাথানত করেননি তা বোঝাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করায় দেশটির আদালত দুই নারীকে কারাদণ্ড দেয়। পরে সে বছরের অক্টোবরে সৌদি আরব রাশিয়া ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের সঙ্গে মিলে দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। অথচ বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সৌদি যুবরাজ সেই অনুরোধ থোড়াই কেয়ার করেছেন।
সেই ধাক্কার পর যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। সে সময় বাইডেন মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত থাকলেও মন্তব্য করেন যে, তাঁরা যা করেছে তার ফলাফল তাঁরা অবশ্যই ভোগ করবে। কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই মার্কিন প্রশাসন সৌদি আরব ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিষয়ে সব ধরনের ভণিতাও বাদ দেয়। বাইডেন ও তাঁর সহযোগীরা বিশ্বে স্থিতিশীল তেলের বাজার নিশ্চিতে সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনা শুরু করে দেয়।
এর মধ্য দিয়ে সৌদি যুবরাজ কেবল বাইডেনকেই অপমান করেননি, তিনি দেখিয়েছেন যে—পাঁচ বছর আগের তুলনায় তিনি বর্তমানে কতটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। তিনি এটিও দেখিয়েছেন যে, বিনিয়োগকারীরা তার অনুগ্রহ তালাশ করছেন। ট্রাম্প ও বাইডেনকে ধন্যবাদ, তাদের কারণেই সৌদি যুবরাজ আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
পাঁচ বছর আগের অক্টোবর মাসে বাগ্দত্তা হাতিজে চেঙ্গিসকে বিয়ে করার কথা ছিল সৌদি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক জামাল খাশোগির, সব ঠিকঠাক চলছিল। একদিন বিয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ওঠাতে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন খাশোগি। পায়ে হেঁটে সেখানে ঢুকলেও আর কখনো নিজ পায়ে বের হতে পারেননি তিনি। সেখানে ১৫ সদস্যের একদল ঘাতক তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর চাপাতি দিয়ে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে সৌদির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত দুটি চার্টার করা ফ্লাইটে হত্যাকারীরা তুরস্ক থেকে বের হয়ে যায়।
হত্যার সঙ্গে সৌদি আরবের যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান জড়িত বলে দাবি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। কিন্তু এর কোনো বিচার তো হয়ইনি বরং এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমানের শাসন আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
সেই ঘটনার পর মোহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ বিশ্ব অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সৌদি আরবকে বিশ্ব পর্যটনের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত করেছেন। আরও এগিয়ে গিয়ে, আগামী প্রজন্মের শহর নিওম নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ—৫০০ বিলিয়ন ডলার—বিনিয়োগের পরিকল্পনাও করেছেন। শুধু তাই নয়, ফুটবল, গলফসহ দেশের অন্যান্য ক্রীড়া খাতেও ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগ করেছেন সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। এত কিছুর উদ্দেশ্য একটাই—দেশটির ভয়ংকর মানবাধিকার রেকর্ডকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা।
কেবল অর্থনৈতিক নয়, এই সময়ে রাজনৈতিক পুঁজিও কম অর্জন করেননি সৌদি যুবরাজ। বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে দীর্ঘ দিন ধরেই তৈল মর্দন করে যাচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ড নামে যেমনটা করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো। ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে সৌদি আরব বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে বেশ চড়া মূল্যই আদায় করে নিতে চাইছে। সৌদি চায় একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি যার মাধ্যমে কখনো সৌদি আরব আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। পাশাপাশি বেসামরিক উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায় রিয়াদ। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রশাসনকে ‘একঘরে’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু এর পর বাইডেন প্রশাসন যা করেছে তা প্রতিশ্রুতি থেকে বহু দূরে।
এখন প্রশ্ন হলো—যুবরাজ মোহাম্মদ কীভাবে বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া সেই হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ভাগ্যকে বদলে দিলেন এবং কীভাবে নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধার করলেন? সংক্ষেপে বলতে গেলে—যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের সহায়তায়। তাঁরা উভয়ই একই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করলেও স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার রক্ষণের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন সৌদি আরবের ক্ষেত্রে।
ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা শুরু থেকেই সৌদি আরবকে ছাড় দিয়েছেন। যেমন, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ৯ দিন পর ১১ অক্টোবর ট্রাম্পকে তাঁর শীর্ষ কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সৌদি আরবকে যে কয়েক বিলিয়ন ডলার অস্ত্র দেওয়ার কথা তা তিনি বাতিল করবেন কিনা। জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা বিষয়টি পছন্দ করি বা না করি কিন্তু আমরা দেশটিতে ১১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা বাতিল করব...এটি আমার কাছে মোটেও পছন্দনীয় নয়।’
ট্রাম্পের কাছে খাশোগি হত্যাকাণ্ড ছিল স্রেফ একটি ‘কোলাট্যারাল ড্যামেজ’। সেই সময়ে ট্রাম্পের মন্তব্যই প্রমাণ করে দেয় সে সময় দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে কী প্রাধান্য ছিল। পূর্বসূরিদের মতো ট্রাম্পও মানবাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুবচন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। সে সময় ট্রাম্প কোনো ভণিতা করেননি। তাঁর কাছে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা, মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ নিরাপত্তা স্বার্থ এবং অস্ত্র বেচাকেনার জন্য সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক যেকোনো কিছুর চেয়েই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাম্পের পরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনও তাঁর পূর্বসূরির পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখেন। তাঁর প্রশাসনও শেষ পর্যন্ত সৌদি যুবরাজকে সন্তুষ্ট করেছে ট্রাম্পের মতোই। খাশোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য মোহাম্মদ বিন সালমান ও সৌদি আরবকে মানবাধিকার ইস্যুতে জবাবদিহির আওতায় আনার যে প্রতিশ্রুতি বাইডেন দিয়েছিলেন তা পালনে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হন।
২০২১ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বাইডেন জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে হত্যাকাণ্ডের জন্য মোহাম্মদ বিন সালমানকে সরাসরি দায়ী করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলে এটি একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না যে, সৌদি যুবরাজের অনুমতি ছাড়া কোনো একটি সংস্থা এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৭ জন সৌদি যুবরাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতি নিয়োজিত র্যাপিড ইন্টারভেনশন ফোর্সের সদস্য। এই বাহিনীটি সরাসরি তাঁর নির্দেশেই চলে এবং কেবল তাঁকেই জবাবদিহি করে।
প্রমাণ থাকার পরও বাইডেন প্রশাসন মোহাম্মদ বিন সালমানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বা কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই অবস্থায় সৌদি যুবরাজ নিশ্চিত হয়ে যান যে, বাইডেন প্রশাসন তাঁকে এবং সৌদি আরবকে ‘একঘরে’ করে রাখার যে প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছিলেন তা কাজে পরিণত করবেন না।
প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে সৌদি আরবের হামলার কারণে ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানির প্রমাণ থাকার পরও ২০২২ সালের মাঝামাঝি এসে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারে অস্ত্র চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করে। এমনকি ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ছিল সৌদি আরব। এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এককভাবে এই সময়ে ৭৮ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
কিন্তু সৌদি যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘অল্প’ প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বাইডেনকে বিব্রত করতে এবং বিশ্বের জ্বালানি বাজারে নিজের প্রভাব বাড়াতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণের পর বিশ্বের জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পর মোহাম্মদ বিন সালমান সেই সুযোগ পেয়ে যান।
পরে ২০২২ সালের জুলাই মাসে বাইডেন তড়িঘড়ি করে সৌদি আরব সফর করেন এবং যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর এই সফরের মধ্য দিয়ে খাশোগি হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে তাঁর অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে যায়। এই সফরে বাইডেন সৌদি যুবরাজের সঙ্গে উষ্ণ ফিস্ট বাম্প বিনিময় করেন। পরে হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের যুবরাজের সঙ্গে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। এই সময় সৌদি যুবরাজ ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না এবং এসব বিষয়ে সৌদি আরব সংস্কার আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
কিন্তু সৌদি যুবরাজ যে মাথানত করেননি তা বোঝাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করায় দেশটির আদালত দুই নারীকে কারাদণ্ড দেয়। পরে সে বছরের অক্টোবরে সৌদি আরব রাশিয়া ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের সঙ্গে মিলে দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। অথচ বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সৌদি যুবরাজ সেই অনুরোধ থোড়াই কেয়ার করেছেন।
সেই ধাক্কার পর যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে যায়। সে সময় বাইডেন মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত থাকলেও মন্তব্য করেন যে, তাঁরা যা করেছে তার ফলাফল তাঁরা অবশ্যই ভোগ করবে। কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই মার্কিন প্রশাসন সৌদি আরব ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিষয়ে সব ধরনের ভণিতাও বাদ দেয়। বাইডেন ও তাঁর সহযোগীরা বিশ্বে স্থিতিশীল তেলের বাজার নিশ্চিতে সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনা শুরু করে দেয়।
এর মধ্য দিয়ে সৌদি যুবরাজ কেবল বাইডেনকেই অপমান করেননি, তিনি দেখিয়েছেন যে—পাঁচ বছর আগের তুলনায় তিনি বর্তমানে কতটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। তিনি এটিও দেখিয়েছেন যে, বিনিয়োগকারীরা তার অনুগ্রহ তালাশ করছেন। ট্রাম্প ও বাইডেনকে ধন্যবাদ, তাদের কারণেই সৌদি যুবরাজ আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
৯ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
২ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে