সত্যিই কি তিনি ঘুমাবেন

মইনুল হাসান 
Thumbnail image

‘আমি একটু ঘুমাব, অনেক দিন ভালো ঘুমাইনি।’ 

আপনি অবসরে যাওয়ার পর কী করবেন বলে ঠিক করেছেন—এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল এমন করেই জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ইউরোপের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এক নাগাড়ে চার মেয়াদে মোট ১৬ বছর এই পদে থেকেছেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তিনি নেতৃত্বের পদে থেকেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে এ সময়ের মধ্যে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল যুক্তরাষ্ট্রের চারজন এবং ফ্রান্সের চারজন প্রেসিডেন্টকে দেখেছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে অ্যাঙ্গেলা মের্কেল পরিণত হয়েছেন এক বিস্ময়কর কিংবদন্তিতে। 

এ বছর ২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। দেশটির ২০ তম এ সাধারণ নির্বাচনে শলৎজের দল এসপিডি ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অন্যদিকে মের্কেলের মধ্যডানপন্থী সিডিইউ পেয়েছে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত ‘অন্তর্বর্তীকালীন চ্যান্সেলর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। তারপর তিনি অবসর নেবেন। 

চার মেয়াদে একটি শক্তিশালী দেশের সরকার প্রধান হিসেবে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেন তিনি। ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের ফুকোশিমায় প্রাণঘাতী পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি জার্মানিকে পারমাণবিক শক্তি নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনার উদ্যোগ নেন। জার্মানির অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই তাঁকে বলা হয় ‘লৌহমানবী’। অথচ তাঁর আছে এক কোমল হৃদয়। 

 ২০১৫ সালে যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে লাখ লাখ মানুষ ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছিল, তখন অন্য দেশগুলো দরজা বন্ধ রাখলেও মের্কেল তাদের জন্য জার্মানির দরজা খুলে দিয়েছিলেন। উগ্রপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ১০ লাখ শরণার্থীকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়েছেন, যা মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ কাজ তাঁর জন্য মোটেই সহজ ছিল না। তাঁকে নাস্তানাবুদ করতে উগ্রপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম শরণার্থীদের দিয়ে দেশ দখলের অভিযোগ তোলে। এমনকি তাঁর নিজের দলের মধ্যেই তিনি কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সক্রিয় এবং কার্যকর রাখতে তাঁর অবদান কম নয়। গ্রিসকে ইউরো জোনের ভেতরে রেখে ইউরো মুদ্রাকে বাঁচিয়ে দেন তিনি। এ ছাড়া প্যারিস এবং তাঁর নিজ দেশে সন্ত্রাসী হামলা, কোভিড-১৯ মহামারি ও ব্রেক্সিটের সমস্যা মোকাবিলা ও এর সমাধানে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইউয়ের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সব সময় একমত না হলেও সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টির কারণ হননি। অ্যাঙ্গেলা মের্কেল কখনোই জার্মানির স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেননি। 

টাইম ম্যাগাজিন ২০১৫ সালে অ্যাঙ্গেলা মের্কেলকে বছরের ‘সেরা ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে মনোনীত করেছিল। বলা হয়েছে, ‘অ্যাঙ্গেলা মের্কেল নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আজকের দুনিয়ায় তা বিরল।’ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান ও নৈতিকতাকে ভিত্তি করে নেতৃত্ব দেওয়া তাঁর একটি অসাধারণ গুণ। এ জন্যই তিনি সেরা ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়া নামকরা ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত, শুধু ২০১০ সাল ছাড়া তাঁকে চৌদ্দবার বিশ্বের ক্ষমতাধর নারী হিসেবে মনোনীত করেছে। তাঁকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জাতিসংঘেও তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। 

অ্যাঙ্গেলা ডরোথেয়া মের্কেল ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিম জার্মানির হামবুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হোর্স্ট কাসনার একজন ধর্মযাজক, আর মা হারলিন ছিলেন ল্যাটিন ভাষা ও ইংরেজির শিক্ষক। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার বয়স যখন দুই মাস, তিনি পরিবারের সঙ্গে কমিউনিস্ট-পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রামে চলে যান এবং সেখানেই কাটে তাঁর শৈশব। শিক্ষাজীবনে পদার্থ বিজ্ঞানে অর্জন করেছেন উচ্চতর ডিগ্রি। ডক্টরেট করেছেন কোয়ান্টাম রসায়নে। তিনি একজন বিজ্ঞানী। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে গবেষণা ও বিজ্ঞান ছিল তাঁর জগৎ। 

সেই ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ রাত থেকে খুব একটা ঘুমানোর সুযোগ তাঁর হয়নি। সেদিন জার্মানিকে পূর্ব ও পশ্চিম নাম দিয়ে বিভক্ত করা বিশাল বার্লিন বিভেদের প্রাচীরটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে পূর্ব জার্মানিতে ৪০ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের। সে সময় অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের বয়স ছিল ৩৫। তিনি বলেছিলেন, ‘পঁয়ত্রিশটি বছরের বন্দীদশার অসহ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছেন’, পেয়েছেন নতুন জীবনের স্বাদ। মুক্ত জীবনের শুরুতেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। দীর্ঘ ৪১ বছর বিভক্ত থাকার পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর জার্মান জাতি আবার একত্রিত হয়েছিল। দুই মাস পর ১৯৯০ সালে মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলেন। পরের বছর চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন। হেলমুট কোহল তাঁকে তাঁর নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন। 

সত্যিকার অর্থেই মানবিক ও নৈতিক বলে বলীয়ান অত্যন্ত মার্জিত, সৎ, নির্লোভ এবং সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন রাষ্ট্রনায়ক তিনি। প্রায় নিখুঁত এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য নিজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মের্কেল। হিটলারের ‘রেসিস্ট-ফ্যাসিস্ট’ দুর্নাম কাটিয়ে জার্মানিকে একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করার অনেকখানি কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য। জনগণের একরাশ ভালোবাসা সম্বল করে নিজে থেকেই বিদায় নিতে যাচ্ছেন তিনি। 

জার্মানিতে অনেকেই ‘মোতথি’ অর্থাৎ ‘মা’ সম্বোধনে তাঁর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রকাশ করে থাকেন। অথচ শিশুদের খুব প্রিয় ৬৭ বছর বয়সী অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ব্যক্তিগত জীবনে নিঃসন্তান। তারপরও তাঁর আছে অগণিত সন্তান। বিশ্ব রাজনীতির অস্থির মঞ্চ থেকে বিদেয় নিলেও যারা তাঁকে ভালোবেসে ‘মা’ বলে ডাকেন, তাঁদের তিনি ভুলে থাকতে পারবেন কি? অবসর গ্রহণের পরে সত্যিই কি তিনি ঘুমাবেন? 

মইনুল হাসান: ফ্রান্স প্রবাসী লেখক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত