সময় যত গড়িয়েছে, মার্কিন গণতন্ত্র তার মূল প্রতিশ্রুতি পূরণে ক্রমশ ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সংকীর্ণ ও সুবিধাভোগী অভিজাত গোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে মনোযোগী হয়ে সমস্যাকে আরও গভীর করেছে। মার্কিন ধাঁচের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে শ্রমজীবী মানুষের কাছে ফেরার বিকল্প নেই।
অনলাইন ডেস্ক
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘মার্কিন প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুতর হুমকি’ হিসেবে তুলে ধরে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারণা যে ভোটারদের কাছে একেবারেই পাত্তা পায়নি, তাতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ঠিক ১১ মাস আগে নির্ভরযোগ্য গ্যালাপ জরিপ দেখিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২৮ শতাংশ ভোটার ‘বিদ্যমান মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ নিয়ে সন্তুষ্ট। এই হার জরিপের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমন অনাস্থা আর কখনো দেখা যায়নি।
সবার জন্য সমান সমৃদ্ধি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষজ্ঞনির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনা এবং কার্যকর জনসেবা—এই চারটি বিষয় মার্কিন গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন গণতন্ত্র এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক যেমন ব্যর্থ অপরাপর ধনী (এমনকি মধ্যম আয়ের) দেশগুলো।
তবে, পরিস্থিতি সব সময় এমন ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিন দশকে নাগরিকদের সাধারণ সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে মার্কিন গণতন্ত্র। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখেই সব শ্রেণির মানুষের প্রকৃত মজুরি দ্রুত বেড়েছিল; ফলত সমাজে বৈষম্যও কমেছিল। কিন্তু সত্তর ও আশির দশকের শেষ দিকে সমৃদ্ধির এই ধারা থেমে যায়; দ্রুত বাড়তে থাকে বৈষম্য। উচ্চতর ডিগ্রিধারী নয়, এমন শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে একেবারে নগণ্য। প্রায় অর্ধেক মার্কিন শ্রমিকের চোখের সামনে বাকিদের আয় তাঁদের চেয়ে তরতর করে বেড়েছে।
প্রায় দশক ধরে বিদ্যমান বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি ২০১৫ সালের দিকে বেশ থেমে যায়। এর মধ্যে গত দশক কিছুটা ভালো কাটলেও মহামারির কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি শহরের শ্রমজীবী মানুষ বড় ঘা দিয়েছে। ফলে স্বভাবতই পেটের দায়ের কাছে ডেমোক্র্যাটীয় গণতন্ত্রের বুলি হেরে গেছে। এবারের নির্বাচনে তাই বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
প্রায় দশক ধরে বিদ্যমান বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি ২০১৫ সালের দিকে বেশ থেমে যায়। এর মধ্যে গত দশক কিছুটা ভালো কাটলেও মহামারির কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি শহরের শ্রমজীবী মানুষ বড় ঘা দিয়েছে। ফলে স্বভাবতই পেটের দায়ের কাছে ডেমোক্র্যাটীয় গণতন্ত্রের বুলি হেরে গেছে। এবারের নির্বাচনে বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
মার্কিন গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি মতপ্রকাশের অধিকার। যেকোনো সমস্যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামনে উত্থাপনের অধিকার স্বীকৃত। তবে এই অধিকার কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমেরিকার ইতিহাসের বড় সময়জুড়ে অনেক সংখ্যালঘু ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভোটারদের ক্ষমতাহীনতা গত চার দশকে আরও সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়ে উঠেছে। সমাজতাত্ত্বিক আরলি রাসেল হকশিল্ড যেমনটা বলেছেন, যাদের কলেজ ডিগ্রি নেই এবং যারা মধ্য-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে বাস করেন—এমন অনেক আমেরিকান ‘নিজভূমে পরবাসী’ মনে করেন নিজেকে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতিবাচক দিক হলো—সমাজের বড় অংশের মানুষ যখন এমনটা অনুভব করছে, তখন তাঁরা শ্রমজীবীদের থেকে দূরে সরে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, ব্যাংকার, পেশাজীবী ও শিক্ষিত এলিট জোটে পরিণত হয়েছে। এদের নিজেদেরই অনেক চাওয়া-পাওয়া আছে। সেগুলোর সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির অগ্রাধিকারের মিল নেই বললেই চলে।
তা ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের অসন্তোষকে উসকে দিয়েছে ডানপন্থী বহু গণমাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যম ও অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের ‘অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্বেগ’ উপেক্ষা করার কারণে এমনটা সম্ভব হয়েছে। গত চার বছরে এই প্রবণতা তীব্রতর হয়েছে। কারণ পরিচয় সম্পর্কিত ক্রমাগত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের পরিবেশ। এমন পরিস্থিতি অনেক ভোটারকেও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে।
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় কেবল বিশেষজ্ঞ ও অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে অ্যাজেন্ডা নির্ধারিত হলে অন্তত নাগরিকেরা নিজেদের বলতে পারত যে, কাজ করছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা অন্তত ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকেই ফাঁকা মনে হচ্ছে। তাঁরা এমন একটি আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, যা কথিতভাবে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
কারণ, এই বিশেষজ্ঞরাই ওয়াল স্ট্রিটে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন। তারা জানতেন ঝুঁকি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়। ফলে, এই আর্থিক ব্যবস্থা কেবল তাদেরই ফায়দা দিয়েছে। তাই, মার্কিন প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—এই বিষয়টি কেবল মিথ্যাই প্রমাণিত হয়নি, এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন রাজনীতিবিদ ও নিয়ন্ত্রকেরা দোষীদের উদ্ধার করতে ছুটে গেছেন, কিন্তু লাখো আমেরিকান যারা তাদের বাড়ি ও জীবিকা হারিয়েছিলেন, তাদের জন্য প্রায় কিছুই করেননি—তখন।
বিশেষজ্ঞদের প্রতি জনসাধারণের অবিশ্বাস আরও বেড়েছে কোভিড-১৯ মহামারির সময়। যখন লকডাউন ও ভ্যাকসিনের মতো বিষয়গুলো বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাসের পরীক্ষা হিসেবে দাঁড়িয়েছে এই সময়ে। যারা এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তাদের মূলধারার গণমাধ্যমে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা বিকল্প মাধ্যমগুলোর দিকে ছুটে গেছেন, যেখানে অডিয়েন্স দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখানেই আসে জনসেবার প্রতিশ্রুতির প্রশ্ন। ব্রিটিশ কবি জন বেটজেমন একবার লিখেছিলেন, ‘আমাদের জাতি গণতন্ত্র এবং সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার পক্ষে’। কিন্তু গণতন্ত্র যে নির্ভরযোগ্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রদান করবে, তা নিয়ে সন্দেহ ক্রমশ বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে, এই ব্যবস্থা নিজেরই সাফল্যের শিকার। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক ইউরোপীয় দেশ মেধার ভিত্তিতে নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং জনসেবায় দুর্নীতি কমাতে আইন প্রণয়ন করেছে, নতুন পণ্য থেকে জনগণকে সুরক্ষিত করতে নিয়মাবলি তৈরি করে।
কিন্তু যত বেশি নিয়মকানুন এবং নিরাপত্তা প্রক্রিয়া যোগ হয়েছে, জনসেবা ততটাই অদক্ষ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতি মাইল মহাসড়কে সরকারি ব্যয় তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে, যা নতুন নিরাপত্তা নিয়ম ও প্রক্রিয়ার কারণে হয়েছে। একইভাবে নির্মাণ খাতের উৎপাদনশীলতার পতনও কঠোর ভূমি ব্যবহারবিধির জন্য দায়ী। শুধু ব্যয়ই বাড়েনি; নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং নাগরিকমুখী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে গড়ে ওঠা নিয়মগুলো বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা এবং অন্যান্য সেবার, যেমন শিক্ষা খাতে, মানের অবনতি ঘটিয়েছে।
সংক্ষেপে, গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতির চারটি স্তম্ভই ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন অনেক আমেরিকান। তবে এর মানে এই নয় যে, তারা এখন কোনো ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করেন। আমেরিকানরা এখনো তাদের দেশ নিয়ে গর্বিত এবং এর গণতান্ত্রিক চরিত্রকে তাদের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মনে করেন।
ভালো খবর হলো, গণতন্ত্রকে পুনর্গঠন করা এবং আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে সবার জন্য সমান সমৃদ্ধি এবং নাগরিকদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিয়ে। যার অর্থ হলো, রাজনীতিতে বড় অর্থের (বড় বড় পুঁজির) প্রভাব কমানো। একইভাবে, গণতন্ত্রকে বিশেষজ্ঞদের হাত থেকে পুরোপুরি আলাদা করা সম্ভব নয়, তবে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা কম রাজনীতিককরণ করা যেতে পারে। সরকারি বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সামাজিক পটভূমি থেকে নির্বাচন করা উচিত এবং স্থানীয় সরকারের স্তরে তাদের আরও বেশি নিয়োগ দেওয়া হলে তা উপকারে আসবে।
অবশ্য, ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে এসব কিছু হবে—এমন সম্ভাবনা নেই। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য একটি স্পষ্ট হুমকি এবং তিনি আগামী চার বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রীতি ভেঙে ফেলবেন। তাই গণতন্ত্রকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব পড়ে মধ্য-বামপন্থী শক্তিগুলোর ওপর। তাদেরই বড় ব্যবসা এবং বড় প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক কমাতে হবে এবং তাদের শ্রমজীবী জনগণের শিকড়ে ফিরে যেতে হবে। যদি ট্রাম্পের জয় ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো তিনি অজান্তেই আমেরিকান গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘মার্কিন প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুতর হুমকি’ হিসেবে তুলে ধরে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারণা যে ভোটারদের কাছে একেবারেই পাত্তা পায়নি, তাতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ঠিক ১১ মাস আগে নির্ভরযোগ্য গ্যালাপ জরিপ দেখিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২৮ শতাংশ ভোটার ‘বিদ্যমান মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ নিয়ে সন্তুষ্ট। এই হার জরিপের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমন অনাস্থা আর কখনো দেখা যায়নি।
সবার জন্য সমান সমৃদ্ধি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষজ্ঞনির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনা এবং কার্যকর জনসেবা—এই চারটি বিষয় মার্কিন গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন গণতন্ত্র এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক যেমন ব্যর্থ অপরাপর ধনী (এমনকি মধ্যম আয়ের) দেশগুলো।
তবে, পরিস্থিতি সব সময় এমন ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিন দশকে নাগরিকদের সাধারণ সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে মার্কিন গণতন্ত্র। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখেই সব শ্রেণির মানুষের প্রকৃত মজুরি দ্রুত বেড়েছিল; ফলত সমাজে বৈষম্যও কমেছিল। কিন্তু সত্তর ও আশির দশকের শেষ দিকে সমৃদ্ধির এই ধারা থেমে যায়; দ্রুত বাড়তে থাকে বৈষম্য। উচ্চতর ডিগ্রিধারী নয়, এমন শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে একেবারে নগণ্য। প্রায় অর্ধেক মার্কিন শ্রমিকের চোখের সামনে বাকিদের আয় তাঁদের চেয়ে তরতর করে বেড়েছে।
প্রায় দশক ধরে বিদ্যমান বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি ২০১৫ সালের দিকে বেশ থেমে যায়। এর মধ্যে গত দশক কিছুটা ভালো কাটলেও মহামারির কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি শহরের শ্রমজীবী মানুষ বড় ঘা দিয়েছে। ফলে স্বভাবতই পেটের দায়ের কাছে ডেমোক্র্যাটীয় গণতন্ত্রের বুলি হেরে গেছে। এবারের নির্বাচনে তাই বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
প্রায় দশক ধরে বিদ্যমান বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি ২০১৫ সালের দিকে বেশ থেমে যায়। এর মধ্যে গত দশক কিছুটা ভালো কাটলেও মহামারির কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি শহরের শ্রমজীবী মানুষ বড় ঘা দিয়েছে। ফলে স্বভাবতই পেটের দায়ের কাছে ডেমোক্র্যাটীয় গণতন্ত্রের বুলি হেরে গেছে। এবারের নির্বাচনে বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
মার্কিন গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি মতপ্রকাশের অধিকার। যেকোনো সমস্যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামনে উত্থাপনের অধিকার স্বীকৃত। তবে এই অধিকার কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমেরিকার ইতিহাসের বড় সময়জুড়ে অনেক সংখ্যালঘু ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভোটারদের ক্ষমতাহীনতা গত চার দশকে আরও সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়ে উঠেছে। সমাজতাত্ত্বিক আরলি রাসেল হকশিল্ড যেমনটা বলেছেন, যাদের কলেজ ডিগ্রি নেই এবং যারা মধ্য-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে বাস করেন—এমন অনেক আমেরিকান ‘নিজভূমে পরবাসী’ মনে করেন নিজেকে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতিবাচক দিক হলো—সমাজের বড় অংশের মানুষ যখন এমনটা অনুভব করছে, তখন তাঁরা শ্রমজীবীদের থেকে দূরে সরে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, ব্যাংকার, পেশাজীবী ও শিক্ষিত এলিট জোটে পরিণত হয়েছে। এদের নিজেদেরই অনেক চাওয়া-পাওয়া আছে। সেগুলোর সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির অগ্রাধিকারের মিল নেই বললেই চলে।
তা ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের অসন্তোষকে উসকে দিয়েছে ডানপন্থী বহু গণমাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যম ও অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের ‘অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্বেগ’ উপেক্ষা করার কারণে এমনটা সম্ভব হয়েছে। গত চার বছরে এই প্রবণতা তীব্রতর হয়েছে। কারণ পরিচয় সম্পর্কিত ক্রমাগত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের পরিবেশ। এমন পরিস্থিতি অনেক ভোটারকেও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে।
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় কেবল বিশেষজ্ঞ ও অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে অ্যাজেন্ডা নির্ধারিত হলে অন্তত নাগরিকেরা নিজেদের বলতে পারত যে, কাজ করছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা অন্তত ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকেই ফাঁকা মনে হচ্ছে। তাঁরা এমন একটি আর্থিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, যা কথিতভাবে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
কারণ, এই বিশেষজ্ঞরাই ওয়াল স্ট্রিটে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন। তারা জানতেন ঝুঁকি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়। ফলে, এই আর্থিক ব্যবস্থা কেবল তাদেরই ফায়দা দিয়েছে। তাই, মার্কিন প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—এই বিষয়টি কেবল মিথ্যাই প্রমাণিত হয়নি, এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন রাজনীতিবিদ ও নিয়ন্ত্রকেরা দোষীদের উদ্ধার করতে ছুটে গেছেন, কিন্তু লাখো আমেরিকান যারা তাদের বাড়ি ও জীবিকা হারিয়েছিলেন, তাদের জন্য প্রায় কিছুই করেননি—তখন।
বিশেষজ্ঞদের প্রতি জনসাধারণের অবিশ্বাস আরও বেড়েছে কোভিড-১৯ মহামারির সময়। যখন লকডাউন ও ভ্যাকসিনের মতো বিষয়গুলো বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাসের পরীক্ষা হিসেবে দাঁড়িয়েছে এই সময়ে। যারা এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তাদের মূলধারার গণমাধ্যমে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা বিকল্প মাধ্যমগুলোর দিকে ছুটে গেছেন, যেখানে অডিয়েন্স দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখানেই আসে জনসেবার প্রতিশ্রুতির প্রশ্ন। ব্রিটিশ কবি জন বেটজেমন একবার লিখেছিলেন, ‘আমাদের জাতি গণতন্ত্র এবং সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার পক্ষে’। কিন্তু গণতন্ত্র যে নির্ভরযোগ্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রদান করবে, তা নিয়ে সন্দেহ ক্রমশ বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে, এই ব্যবস্থা নিজেরই সাফল্যের শিকার। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক ইউরোপীয় দেশ মেধার ভিত্তিতে নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং জনসেবায় দুর্নীতি কমাতে আইন প্রণয়ন করেছে, নতুন পণ্য থেকে জনগণকে সুরক্ষিত করতে নিয়মাবলি তৈরি করে।
কিন্তু যত বেশি নিয়মকানুন এবং নিরাপত্তা প্রক্রিয়া যোগ হয়েছে, জনসেবা ততটাই অদক্ষ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতি মাইল মহাসড়কে সরকারি ব্যয় তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে, যা নতুন নিরাপত্তা নিয়ম ও প্রক্রিয়ার কারণে হয়েছে। একইভাবে নির্মাণ খাতের উৎপাদনশীলতার পতনও কঠোর ভূমি ব্যবহারবিধির জন্য দায়ী। শুধু ব্যয়ই বাড়েনি; নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং নাগরিকমুখী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে গড়ে ওঠা নিয়মগুলো বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা এবং অন্যান্য সেবার, যেমন শিক্ষা খাতে, মানের অবনতি ঘটিয়েছে।
সংক্ষেপে, গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতির চারটি স্তম্ভই ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন অনেক আমেরিকান। তবে এর মানে এই নয় যে, তারা এখন কোনো ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করেন। আমেরিকানরা এখনো তাদের দেশ নিয়ে গর্বিত এবং এর গণতান্ত্রিক চরিত্রকে তাদের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মনে করেন।
ভালো খবর হলো, গণতন্ত্রকে পুনর্গঠন করা এবং আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে সবার জন্য সমান সমৃদ্ধি এবং নাগরিকদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিয়ে। যার অর্থ হলো, রাজনীতিতে বড় অর্থের (বড় বড় পুঁজির) প্রভাব কমানো। একইভাবে, গণতন্ত্রকে বিশেষজ্ঞদের হাত থেকে পুরোপুরি আলাদা করা সম্ভব নয়, তবে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা কম রাজনীতিককরণ করা যেতে পারে। সরকারি বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সামাজিক পটভূমি থেকে নির্বাচন করা উচিত এবং স্থানীয় সরকারের স্তরে তাদের আরও বেশি নিয়োগ দেওয়া হলে তা উপকারে আসবে।
অবশ্য, ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে এসব কিছু হবে—এমন সম্ভাবনা নেই। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য একটি স্পষ্ট হুমকি এবং তিনি আগামী চার বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রীতি ভেঙে ফেলবেন। তাই গণতন্ত্রকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব পড়ে মধ্য-বামপন্থী শক্তিগুলোর ওপর। তাদেরই বড় ব্যবসা এবং বড় প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক কমাতে হবে এবং তাদের শ্রমজীবী জনগণের শিকড়ে ফিরে যেতে হবে। যদি ট্রাম্পের জয় ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো তিনি অজান্তেই আমেরিকান গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বছরের নভেম্বরে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
২ ঘণ্টা আগেতৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফেসবুকের তথ্য যাচাই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ ছিল। জাকারবার্গের ঘোষণার পর ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, সম্ভবত তাঁর সমালোচনার কারণেই জাকারবার্গ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্মে ফ্যাক্ট-চেকিং বন্ধের ঘোষণাকে ট্রাম্পের বশ্যতা স্বীকার...
৭ ঘণ্টা আগেপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জাস্টিন ট্রুডোর সরে দাঁড়ানো কানাডার রাজনীতিতে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে। প্রায় এক দশকের শাসনামলে উচ্চাভিলাষী অভিবাসন নীতি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সমালোচনায় বরাবরই আলোচনায় ছিলেন ট্রুডো।
১ দিন আগেআইএস এখনো সক্রিয়। যদিও ২০১৯ সালে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কথিত ‘খিলাফত’–এর পতন হয়েছে বলে জানিয়েছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। কিন্তু সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এবং আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে আইএস পুনর্গঠিত হয়েছে।
১ দিন আগে