দীপংকর গৌতম
আষাঢ়ের গাদলা। তিন দিন ধরে বৃষ্টি শেষ না হওয়ায় মলনের ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে অবিনাশ। পলিথিনেও ধানের সুরক্ষা হচ্ছে না। মাত্র দুই দিন পাল্লায় থাকার পরই ধানের আঁটিতে সিধলা পড়ে যাচ্ছে। কষ্টে তোলা ধান গোলায় ওঠানোর আগেই এ কোন বিপদ এল। ইচ্ছা ছিল ধান ওঠার পর ঘরের টিনগুলো বদল করবে। বাবার কিছু বন্ধক রাখা জমি মুক্ত করবে। কিন্তু এ কোন দুর্যোগে পড়ল সে। ভেবে পায় না। ঘরের দ্বারে বসে লুঙ্গির কাছার ভেতরে পলিথিনে বাঁধা একটা ৫৫০ মার্কা বিড়িতে টান দেয়। বিড়িতেও কড়কড়া স্বাদ নেই। কেমন ড্যাম ড্যাম ভাব গলা পোড়ায়। মাত্রই শুকুর দোকান থেকে আনা বিড়ি কীভাবে ড্যাম হলো, বুঝতে পারে না অবিনাশ। বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে ধান নিয়ে কী করবে ভাবতে থাকে। এই কৃষিকাজ করতে আর তার ইচ্ছা করে না। কত ঝামেলা আজকাল। সারের ডিলার পর্যন্ত অনেক ক্ষমতাধর। কোনো কিছুতেই কিছু বলার উপায় নেই। কথায় কথায় পুলিশের ভয় দেখায়। কীটনাশক থেকে সেচের জল, সবখানে রাজনীতি। এতসব কি অবিনাশ সামলাতে পারে? সবকিছুতে দাম বেশি। দাম নেই তার ফসলের। অবিনাশ শীতকালে এবার মেয়ের বাসাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। নাতি হয়েছে। না গেলে কেমন দেখায়। ঘরের বউ থেকে পাড়াপড়শি সবাই বললে, অবিনাশ নলিনী খুড়ার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গাড়িতে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় যাওয়ার সময় পাশে বসা এক লোক তাকে বুঝিয়েছিল। এই সেতুতে তারও ভাগ আছে। তাতে অবিনাশ বিস্মিত হয়েছিল। তার যদি ভাগ থাকে, সে এই সেতুতে একটু দাঁড়াবে। তার মেয়ের মোবাইল ফোনটা দিয়ে একটা ফটো তুলবে। কিন্তু এসব চিন্তা তার শেষ হয়ে যায় গুলিস্তানে নেমে। বরিশাল থেকে গুলিস্তান নেমে জামাইয়ের দেখা পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত অবিনাশ। অবিনাশ মেয়ের জন্য সবজি কিনতে গেলে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সব সবজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। তার বোনা সবজি এত দামে বিক্রি হয় আর তার জমি চাষের কিস্তি দিতে জীবন যায়। এ কেমন বিচার? ঢাকায় যে কদিন ছিল, সে কদিন খুবই মনমরা ছিল। মেয়ে ময়না বারবার জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমার কী অইছে? খাও না কেন?
অবিনাশ চুপ করে বিড়িতে সুখটান দিয়ে চলে।
এ কেমন দেশ সে বুঝে পায় না। অবিনাশের দাদু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দাঙ্গায় আহত হয়ে দেশে এসে ছেলে মন্মথ বিশ্বাসকে বলেছিলেন, জিন্নাহ-মহাত্মা গান্ধী দেশভাগ করলেও মাটি ভাগ করতে পারবে না। এই মাটি আমাদের মা। আমাদের ভবিষ্যৎ। মাটি ছাড়বি না। বাবার মুখে বারবার সে এ কথা শুনেছে। তার বাবা মাটির সঙ্গে কথা বলত। মাটির ভাষা বুঝত। মাটির ডাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী ক্যাম্পে মন্মথের বাবা-মা ডায়রিয়ায় মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশে এলে অবিনাশের জন্ম। অবিনাশও তার বাবার মতো মাটির ভাষা বোঝে। মাটির সুখ-দুঃখ বোঝে, মাটির সঙ্গে কথা বলে। জমিতে ফসলের বীজ বুনে সে জমিনের ওপর শুয়ে মাটিতে কান দিত। অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে অন্যান্য কৃষকদের বলত, মাটির ডাক শুনেছি। এবার ফসল ভালো হবে। বেশি বৃষ্টি হলে বা ফসলে লু হাওয়া বইলেও সে বলতে পারত। চাষিরা তাই সন্ধ্যা হলে অবিনাশের বাড়িতে এসে তামাক খেত, তাসের আসর জমিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করত—ও অবিনাশ, মাটির কথা শুনেছিস? কী কইল মাটি? ভালো হবে?
অবিনাশের কথা খুব হেরফের হতো না। তাই কৃষক বিশ্বাস করত অবিনাশের কথা। কিন্তু ইদানীং সময় কেমন বদলে যাচ্ছে। সে ঋণ করে ফসল চাষ করে আর লাভ নিয়ে যায় কারা? তার উৎপাদিত ফসল যেন তাকে চেনে না। ৫ টাকার টমেটো এখন ৮০ টাকা। এতসব ভাবতে ভাবতে দেখে, পাশের বাড়ি শুকদেব টিন নিয়ে আসছে বৃষ্টির মধ্যে। মন্মথ জিজ্ঞেস করে—ও বেডা, টিন দিয়া কী হরবা?
শুকদেব বলে, গাদলা শুরু হইছে, দেখছ না। বইসকা থাকলে তো ধান নষ্ট হবে। তাই গাদলার মধ্যেই ধানের মলন দেব। টিনের ছাপড়া বানাইয়া ধানের মলন দেব। গাদলা হয় হউক। এয়ার মধ্যেই কাজ শেষ করব।
প্রতিবছর গাদলা আসে। তিন-চার দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হয়। গাদলায় জনজীবনে দুর্ভোগ অন্তহীন। তারপর সদ্য ধান কাটা কৃষকের অবস্থা হয়ে ওঠে আরও করুণ। বেশি বৃষ্টিতে নেতিয়ে যাচ্ছে ধান। ধানের আঁটিতে ছত্রাক পড়ছে। শুকদেব এতক্ষণে অবিনাশের উঠানে ছাপড়া দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ছাপড়া হলেই শুরু হলো ধানের মলন। গরু দিয়ে ধান মলতে মলতে অবিনাশের মনে পড়ছে, এমনি এক দিনে পাশের বাড়ির ধাত্রী সুরবালা এসে চিৎকার করতে করতে তাকে ডাকছিল, ও অবিনাশ, তাড়াতাড়ি আয়, তোর ছাওয়াল হইছে। বাড়ির বিটিগো ক, ঝাহে ঝাহে জোকার দিতে।
অবিনাশ গিয়ে আঁতুড়ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল চাঁদের মতো ছেলে তার। তার ঘরে কোন ভুলে এসেছে কে জানে? কিন্তু জন্মের তিন দিন পর ছেলেটা মারা গেল। শহরে ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তার বলেছিল, বাঁশের যে চটা দিয়ে নাড়ি কাটা হয়েছিল, সে চটায় ধনুষ্টঙ্কারের জীবাণু ছিল। তার মায়ের কতজন সন্তান, তাদের জন্ম এভাবেই। শুধু তাই কেন, বাড়ির আশপাশে কত বাচ্চাই তো হচ্ছে এভাবে দিনের পর দিন। অথচ কপাল পোড়া গেল শুধু তার? তার সন্তান ধনুষ্টঙ্কারে মারা গেল, এটা অবিনাশ বিশ্বাসই করতে পারে না। ছেলেসন্তান বলে কথা। সন্তান মারা যাওয়ায় অবিনাশ বজ্রপড়া বৃক্ষের মতো শোকে চুপ হয়ে গেল। এরপরে এক এক করে ছেলে, মেয়ে এসে তার ঘর ভরিয়েছে, তবুও প্রথম সন্তানের কথা সে কোনোমতেই ভুলতে পারে না। এর মধ্যেই এল লক্ষ্মীদীঘা ধানের মৌসুম। এ সময় এলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। তার গোঁসাই তাকে বলেছে, এই ছেলে বেঁচে থাকলে তার কোনো দুঃখ থাকত না। তার সংসার ধনে-জনে পূর্ণ হতো। কিন্তু কোন পাপে তার এই রাজসন্তান তার ঘরে থাকল না। তার স্ত্রী সুরবালা তাকে বারবার বুঝিয়েছে, তার জীবনে অপূর্ণ তো কিছু নেই। ধন-জন সবই তো আছে তার। কিন্তু কোনো কথায় তার বুঝ মানে না অবিনাশ। বারবার বিড়িতে সুখটান দিয়ে চলে, একটার পিছে একটা বিড়ি ধরায়। ভাত খাওয়া প্রায় বন্ধ। এবার মেয়ের কাছ থেকে এসে সে তার স্ত্রীকে ডেকে বলেছে, —তুই কস বউ আমার ধনে-জনে পূর্ণ। শহরে যাইয়া দেখ, আমার ৫ টাকার টমেটো আমার কাছে ৮০ টাকা চায়। কত সবজি! সব সবজি আমার দিকে চাইয়া থাহে। আমার খ্যাতের ফসল, আমারে চেনে দূর শহরে যাইয়াও। আমার লগে তারা কথা কয়। আর দোকানদার দাম চাইতেই থাহে। এট্টা লোক নাই এট্টু উচিত কথা কবে। এই কষ্টের কথা আমি কোথায় কই? ধার শোধ করতে পারি না। আর আমার ঘাম ঝরানো, বৃষ্টিভেজা ফসলে অন্য মানুষ সুখ নেয়।
এবারে শুকদেবের জন্য ভালোয় ভালোয় অবিনাশেরও মলন শেষ হয়। ভালো ধান পেয়ে দুজনের দিন ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। এখনো সবার ধান কাটা হয়নি। বৃষ্টির জল বাড়ছে। ভাসছে খেত। গাছপালা, বৃক্ষরাজি সব যেন অপরিচিত লাগে অবিনাশের। বৃষ্টিতে রং ধুয়ে আরও ঘন হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার লগ্ন এলে এই বৃষ্টি সহজে থামবে না। বন্যা এলে বড় সংকট হবে। ভাবতে ভাবতে কয়বার হাই তুলে বৃষ্টির মধ্যে শেষ বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতরে অবিনাশ দেখে, জোছনার ভেতরে তার বাবা বলছে অবিনাশ, মাটির কথা শুনতে পাস না। মাটি তো কান্দে। কৃষকের অধিকার ছাড়া দেশ বাঁচে না। লাঠি নিয়া বাইর হ অবিনাশ। বজ্জাতে দ্যাশ ভইরে গেছে। লাঠি হাতে ল। ঘুম থেকে উঠে পড়ে অবিনাশ। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। হাতে লাঠি নিয়ে বের হয়। কেমন ধবল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে মাঠ। সে মাটিতে কান পাতে। আবার উঠে দাঁড়ায়। অবিনাশ ঘামছে। তার বউ এসে বলে, তোমার কী অইছে? অবিনাশ বলে, বউ দ্যাশ ভালো নাই, বাজারে নষ্ট লোকের রাজত্ব। মাটির ডাক শোন। পাড়ার সবাইরে ডাক দে। আমাগো সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। আমাগো স্বপ্ন লুট করে নিচ্ছে। সুরবালা কাঁদে—তোমার কী অইল? এই রাজনীতি বোঝার দরকার নাই। এসব আমাগো জন্য না। তুমি ঘুমাও। ঘরে আসো। এবার অবিনাশ দেখে জোছনার ভেতরে তার ছায়া যত দূর চোখ যায়, তত দূর দীর্ঘ। বউকে কাছে ডেকে এবার অবিনাশ বলে, আমার বাবা কইত, মানুষের চেয়ে ছায়া বড় হলে সে আর বাঁচে না। আমার ছেলে-মেয়ে-জমি সব তোর রইল। মাটি ডাক দিছে, সবাইরে কইস। আমার বুকে ব্যথা উঠছে, বৃষ্টির মধ্যে তার ঘাম ভেজা আঠালো শরীরের অসুস্থতা কেউ না বুঝলেও অবিনাশ বুঝে ফেলে। সে বুক চেপে ধরে বউকে বলে, আমি চলে গেলাম বউ, মরণব্যথা আমারে ডাক দিছে। গলা কাটা মুরগির মতো অবিনাশ উঠোনের কাদা-জলে গড়াগড়ি খেতে থাকে। টিনের চালে আতাগাছে একটা প্যাঁচা ডাকতে থাকে। দূর থেকে শিয়ালের ডাক আসে। কাউরিয়া বিলের পাশে স্বর্ণগ্রামে কুপির আলো একটার পর একটা জ্বলছে। অবিনাশের চিৎকারে জেগে ওঠে পাড়া। তার সঙ্গে সুরবালার দিশেহারা কান্না অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক।
গ্রামের পর গ্রাম নিম্নবর্গের কৃষকেরা সব ছুটে আসতে থাকে। এই ভর রাত্তিরে কৃষক অবিনাশের কী হলো? মানুষের দীর্ঘ সারি ক্রমশ দীর্ঘ হয় অবিনাশ ও সুরবালার চিৎকারে। কুপির আলোর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কৃষকেরা সে আলোতে গাদলায় অসহায় ফসলের খেত দেখতে থাকে। দিনের পর দিন এই ফসল তারা ফলায় আর তাদের ভাগ্য বদলায় না। ধনী হয়ে যায় অন্য মানুষ-মধ্যস্বত্বভোগীরা। এসব দেখে অবিনাশ আগেই সবাইকে বলেছিল—লাঠি হাতে বজ্জাত তাড়াও, নয় সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভেসে মানুষের পেটের খাবার ফলাতে হবে—এ বড় অন্যায়। অবিনাশের কাতরানো এক সময় কমে আসে। তাগড়া শরীরটা নিস্তেজ হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। সুরবালা তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে—ভগবান, এ কেমন বিচার তোমার। আমার সব শ্যাষ হইয়া গেল। গাদলার বৃষ্টি অঝোরে ঝরতে থাকে। অজস্র মানুষ এসে অবিনাশকে চাপড়ায় শুইয়ে নিয়ে চলে। কেঁদে ওঠে সবাই। বৃষ্টির শব্দে তখন আর কিছু শোনা যায় না। বৃষ্টির গতি বাড়ে। অন্ধকার চারদিক। বিল, বৃক্ষ সব যেন কালো পর্দায় ঢেকে আছে। তার মধ্যে সোনালি রঙের আলোর মিছিল বাড়তেই থাকে। শ্মশানে প্রশান্তির বৃষ্টি বয়ে চলে। অবিনাশকেও দাহ করার প্রস্তুতি চলে। গাদলা তখনো শেষ হয় না।
আষাঢ়ের গাদলা। তিন দিন ধরে বৃষ্টি শেষ না হওয়ায় মলনের ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে অবিনাশ। পলিথিনেও ধানের সুরক্ষা হচ্ছে না। মাত্র দুই দিন পাল্লায় থাকার পরই ধানের আঁটিতে সিধলা পড়ে যাচ্ছে। কষ্টে তোলা ধান গোলায় ওঠানোর আগেই এ কোন বিপদ এল। ইচ্ছা ছিল ধান ওঠার পর ঘরের টিনগুলো বদল করবে। বাবার কিছু বন্ধক রাখা জমি মুক্ত করবে। কিন্তু এ কোন দুর্যোগে পড়ল সে। ভেবে পায় না। ঘরের দ্বারে বসে লুঙ্গির কাছার ভেতরে পলিথিনে বাঁধা একটা ৫৫০ মার্কা বিড়িতে টান দেয়। বিড়িতেও কড়কড়া স্বাদ নেই। কেমন ড্যাম ড্যাম ভাব গলা পোড়ায়। মাত্রই শুকুর দোকান থেকে আনা বিড়ি কীভাবে ড্যাম হলো, বুঝতে পারে না অবিনাশ। বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে ধান নিয়ে কী করবে ভাবতে থাকে। এই কৃষিকাজ করতে আর তার ইচ্ছা করে না। কত ঝামেলা আজকাল। সারের ডিলার পর্যন্ত অনেক ক্ষমতাধর। কোনো কিছুতেই কিছু বলার উপায় নেই। কথায় কথায় পুলিশের ভয় দেখায়। কীটনাশক থেকে সেচের জল, সবখানে রাজনীতি। এতসব কি অবিনাশ সামলাতে পারে? সবকিছুতে দাম বেশি। দাম নেই তার ফসলের। অবিনাশ শীতকালে এবার মেয়ের বাসাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। নাতি হয়েছে। না গেলে কেমন দেখায়। ঘরের বউ থেকে পাড়াপড়শি সবাই বললে, অবিনাশ নলিনী খুড়ার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গাড়িতে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় যাওয়ার সময় পাশে বসা এক লোক তাকে বুঝিয়েছিল। এই সেতুতে তারও ভাগ আছে। তাতে অবিনাশ বিস্মিত হয়েছিল। তার যদি ভাগ থাকে, সে এই সেতুতে একটু দাঁড়াবে। তার মেয়ের মোবাইল ফোনটা দিয়ে একটা ফটো তুলবে। কিন্তু এসব চিন্তা তার শেষ হয়ে যায় গুলিস্তানে নেমে। বরিশাল থেকে গুলিস্তান নেমে জামাইয়ের দেখা পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত অবিনাশ। অবিনাশ মেয়ের জন্য সবজি কিনতে গেলে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সব সবজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। তার বোনা সবজি এত দামে বিক্রি হয় আর তার জমি চাষের কিস্তি দিতে জীবন যায়। এ কেমন বিচার? ঢাকায় যে কদিন ছিল, সে কদিন খুবই মনমরা ছিল। মেয়ে ময়না বারবার জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমার কী অইছে? খাও না কেন?
অবিনাশ চুপ করে বিড়িতে সুখটান দিয়ে চলে।
এ কেমন দেশ সে বুঝে পায় না। অবিনাশের দাদু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দাঙ্গায় আহত হয়ে দেশে এসে ছেলে মন্মথ বিশ্বাসকে বলেছিলেন, জিন্নাহ-মহাত্মা গান্ধী দেশভাগ করলেও মাটি ভাগ করতে পারবে না। এই মাটি আমাদের মা। আমাদের ভবিষ্যৎ। মাটি ছাড়বি না। বাবার মুখে বারবার সে এ কথা শুনেছে। তার বাবা মাটির সঙ্গে কথা বলত। মাটির ভাষা বুঝত। মাটির ডাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী ক্যাম্পে মন্মথের বাবা-মা ডায়রিয়ায় মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশে এলে অবিনাশের জন্ম। অবিনাশও তার বাবার মতো মাটির ভাষা বোঝে। মাটির সুখ-দুঃখ বোঝে, মাটির সঙ্গে কথা বলে। জমিতে ফসলের বীজ বুনে সে জমিনের ওপর শুয়ে মাটিতে কান দিত। অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে অন্যান্য কৃষকদের বলত, মাটির ডাক শুনেছি। এবার ফসল ভালো হবে। বেশি বৃষ্টি হলে বা ফসলে লু হাওয়া বইলেও সে বলতে পারত। চাষিরা তাই সন্ধ্যা হলে অবিনাশের বাড়িতে এসে তামাক খেত, তাসের আসর জমিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করত—ও অবিনাশ, মাটির কথা শুনেছিস? কী কইল মাটি? ভালো হবে?
অবিনাশের কথা খুব হেরফের হতো না। তাই কৃষক বিশ্বাস করত অবিনাশের কথা। কিন্তু ইদানীং সময় কেমন বদলে যাচ্ছে। সে ঋণ করে ফসল চাষ করে আর লাভ নিয়ে যায় কারা? তার উৎপাদিত ফসল যেন তাকে চেনে না। ৫ টাকার টমেটো এখন ৮০ টাকা। এতসব ভাবতে ভাবতে দেখে, পাশের বাড়ি শুকদেব টিন নিয়ে আসছে বৃষ্টির মধ্যে। মন্মথ জিজ্ঞেস করে—ও বেডা, টিন দিয়া কী হরবা?
শুকদেব বলে, গাদলা শুরু হইছে, দেখছ না। বইসকা থাকলে তো ধান নষ্ট হবে। তাই গাদলার মধ্যেই ধানের মলন দেব। টিনের ছাপড়া বানাইয়া ধানের মলন দেব। গাদলা হয় হউক। এয়ার মধ্যেই কাজ শেষ করব।
প্রতিবছর গাদলা আসে। তিন-চার দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হয়। গাদলায় জনজীবনে দুর্ভোগ অন্তহীন। তারপর সদ্য ধান কাটা কৃষকের অবস্থা হয়ে ওঠে আরও করুণ। বেশি বৃষ্টিতে নেতিয়ে যাচ্ছে ধান। ধানের আঁটিতে ছত্রাক পড়ছে। শুকদেব এতক্ষণে অবিনাশের উঠানে ছাপড়া দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ছাপড়া হলেই শুরু হলো ধানের মলন। গরু দিয়ে ধান মলতে মলতে অবিনাশের মনে পড়ছে, এমনি এক দিনে পাশের বাড়ির ধাত্রী সুরবালা এসে চিৎকার করতে করতে তাকে ডাকছিল, ও অবিনাশ, তাড়াতাড়ি আয়, তোর ছাওয়াল হইছে। বাড়ির বিটিগো ক, ঝাহে ঝাহে জোকার দিতে।
অবিনাশ গিয়ে আঁতুড়ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল চাঁদের মতো ছেলে তার। তার ঘরে কোন ভুলে এসেছে কে জানে? কিন্তু জন্মের তিন দিন পর ছেলেটা মারা গেল। শহরে ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তার বলেছিল, বাঁশের যে চটা দিয়ে নাড়ি কাটা হয়েছিল, সে চটায় ধনুষ্টঙ্কারের জীবাণু ছিল। তার মায়ের কতজন সন্তান, তাদের জন্ম এভাবেই। শুধু তাই কেন, বাড়ির আশপাশে কত বাচ্চাই তো হচ্ছে এভাবে দিনের পর দিন। অথচ কপাল পোড়া গেল শুধু তার? তার সন্তান ধনুষ্টঙ্কারে মারা গেল, এটা অবিনাশ বিশ্বাসই করতে পারে না। ছেলেসন্তান বলে কথা। সন্তান মারা যাওয়ায় অবিনাশ বজ্রপড়া বৃক্ষের মতো শোকে চুপ হয়ে গেল। এরপরে এক এক করে ছেলে, মেয়ে এসে তার ঘর ভরিয়েছে, তবুও প্রথম সন্তানের কথা সে কোনোমতেই ভুলতে পারে না। এর মধ্যেই এল লক্ষ্মীদীঘা ধানের মৌসুম। এ সময় এলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। তার গোঁসাই তাকে বলেছে, এই ছেলে বেঁচে থাকলে তার কোনো দুঃখ থাকত না। তার সংসার ধনে-জনে পূর্ণ হতো। কিন্তু কোন পাপে তার এই রাজসন্তান তার ঘরে থাকল না। তার স্ত্রী সুরবালা তাকে বারবার বুঝিয়েছে, তার জীবনে অপূর্ণ তো কিছু নেই। ধন-জন সবই তো আছে তার। কিন্তু কোনো কথায় তার বুঝ মানে না অবিনাশ। বারবার বিড়িতে সুখটান দিয়ে চলে, একটার পিছে একটা বিড়ি ধরায়। ভাত খাওয়া প্রায় বন্ধ। এবার মেয়ের কাছ থেকে এসে সে তার স্ত্রীকে ডেকে বলেছে, —তুই কস বউ আমার ধনে-জনে পূর্ণ। শহরে যাইয়া দেখ, আমার ৫ টাকার টমেটো আমার কাছে ৮০ টাকা চায়। কত সবজি! সব সবজি আমার দিকে চাইয়া থাহে। আমার খ্যাতের ফসল, আমারে চেনে দূর শহরে যাইয়াও। আমার লগে তারা কথা কয়। আর দোকানদার দাম চাইতেই থাহে। এট্টা লোক নাই এট্টু উচিত কথা কবে। এই কষ্টের কথা আমি কোথায় কই? ধার শোধ করতে পারি না। আর আমার ঘাম ঝরানো, বৃষ্টিভেজা ফসলে অন্য মানুষ সুখ নেয়।
এবারে শুকদেবের জন্য ভালোয় ভালোয় অবিনাশেরও মলন শেষ হয়। ভালো ধান পেয়ে দুজনের দিন ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। এখনো সবার ধান কাটা হয়নি। বৃষ্টির জল বাড়ছে। ভাসছে খেত। গাছপালা, বৃক্ষরাজি সব যেন অপরিচিত লাগে অবিনাশের। বৃষ্টিতে রং ধুয়ে আরও ঘন হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার লগ্ন এলে এই বৃষ্টি সহজে থামবে না। বন্যা এলে বড় সংকট হবে। ভাবতে ভাবতে কয়বার হাই তুলে বৃষ্টির মধ্যে শেষ বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতরে অবিনাশ দেখে, জোছনার ভেতরে তার বাবা বলছে অবিনাশ, মাটির কথা শুনতে পাস না। মাটি তো কান্দে। কৃষকের অধিকার ছাড়া দেশ বাঁচে না। লাঠি নিয়া বাইর হ অবিনাশ। বজ্জাতে দ্যাশ ভইরে গেছে। লাঠি হাতে ল। ঘুম থেকে উঠে পড়ে অবিনাশ। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। হাতে লাঠি নিয়ে বের হয়। কেমন ধবল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে মাঠ। সে মাটিতে কান পাতে। আবার উঠে দাঁড়ায়। অবিনাশ ঘামছে। তার বউ এসে বলে, তোমার কী অইছে? অবিনাশ বলে, বউ দ্যাশ ভালো নাই, বাজারে নষ্ট লোকের রাজত্ব। মাটির ডাক শোন। পাড়ার সবাইরে ডাক দে। আমাগো সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। আমাগো স্বপ্ন লুট করে নিচ্ছে। সুরবালা কাঁদে—তোমার কী অইল? এই রাজনীতি বোঝার দরকার নাই। এসব আমাগো জন্য না। তুমি ঘুমাও। ঘরে আসো। এবার অবিনাশ দেখে জোছনার ভেতরে তার ছায়া যত দূর চোখ যায়, তত দূর দীর্ঘ। বউকে কাছে ডেকে এবার অবিনাশ বলে, আমার বাবা কইত, মানুষের চেয়ে ছায়া বড় হলে সে আর বাঁচে না। আমার ছেলে-মেয়ে-জমি সব তোর রইল। মাটি ডাক দিছে, সবাইরে কইস। আমার বুকে ব্যথা উঠছে, বৃষ্টির মধ্যে তার ঘাম ভেজা আঠালো শরীরের অসুস্থতা কেউ না বুঝলেও অবিনাশ বুঝে ফেলে। সে বুক চেপে ধরে বউকে বলে, আমি চলে গেলাম বউ, মরণব্যথা আমারে ডাক দিছে। গলা কাটা মুরগির মতো অবিনাশ উঠোনের কাদা-জলে গড়াগড়ি খেতে থাকে। টিনের চালে আতাগাছে একটা প্যাঁচা ডাকতে থাকে। দূর থেকে শিয়ালের ডাক আসে। কাউরিয়া বিলের পাশে স্বর্ণগ্রামে কুপির আলো একটার পর একটা জ্বলছে। অবিনাশের চিৎকারে জেগে ওঠে পাড়া। তার সঙ্গে সুরবালার দিশেহারা কান্না অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক।
গ্রামের পর গ্রাম নিম্নবর্গের কৃষকেরা সব ছুটে আসতে থাকে। এই ভর রাত্তিরে কৃষক অবিনাশের কী হলো? মানুষের দীর্ঘ সারি ক্রমশ দীর্ঘ হয় অবিনাশ ও সুরবালার চিৎকারে। কুপির আলোর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কৃষকেরা সে আলোতে গাদলায় অসহায় ফসলের খেত দেখতে থাকে। দিনের পর দিন এই ফসল তারা ফলায় আর তাদের ভাগ্য বদলায় না। ধনী হয়ে যায় অন্য মানুষ-মধ্যস্বত্বভোগীরা। এসব দেখে অবিনাশ আগেই সবাইকে বলেছিল—লাঠি হাতে বজ্জাত তাড়াও, নয় সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভেসে মানুষের পেটের খাবার ফলাতে হবে—এ বড় অন্যায়। অবিনাশের কাতরানো এক সময় কমে আসে। তাগড়া শরীরটা নিস্তেজ হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। সুরবালা তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে—ভগবান, এ কেমন বিচার তোমার। আমার সব শ্যাষ হইয়া গেল। গাদলার বৃষ্টি অঝোরে ঝরতে থাকে। অজস্র মানুষ এসে অবিনাশকে চাপড়ায় শুইয়ে নিয়ে চলে। কেঁদে ওঠে সবাই। বৃষ্টির শব্দে তখন আর কিছু শোনা যায় না। বৃষ্টির গতি বাড়ে। অন্ধকার চারদিক। বিল, বৃক্ষ সব যেন কালো পর্দায় ঢেকে আছে। তার মধ্যে সোনালি রঙের আলোর মিছিল বাড়তেই থাকে। শ্মশানে প্রশান্তির বৃষ্টি বয়ে চলে। অবিনাশকেও দাহ করার প্রস্তুতি চলে। গাদলা তখনো শেষ হয় না।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে