সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
সকালে ঘুম থেকে উঠে খানিকটা ভালো লাগছিল। পুরোপুরি না। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথাও গিয়ে নাশতা করতে ইচ্ছা করছিল না। এদিন থেকে আমার চেয়ে ভুবনের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমরা নাশতা করিনি। ভাবলাম যাত্রাপথে খেয়ে নেব। গলা দিয়ে কিছু নামার অবস্থায় নেই। আমরা প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে গিয়েছিলাম। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলো অনেকক্ষণ। তখনো গাড়ির ব্যবস্থা হয়নি। অমরদা বলেছিলেন সকাল ৭টার মধ্যে রওনা দিতে পারব। কিন্তু সেখানে ৮টার ওপরে বেজে গিয়েছিল। বড় দলটাও চলে যাবে শিলিগুড়ি। এদিকে দেরি দেখে আকাশ ভাইয়ারা ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। কেননা, তাঁদের সময়মতো পৌঁছে বাস ধরতে হবে। অমরদা এদিক-সেদিক ফোন ঘুরিয়ে অবশেষে একটা গাড়ি নিশ্চিত করলেন।
আসলে হয়েছিল কী, যে চালক আসার কথা ছিল, তিনি শেষ মুহূর্তে আর আসেননি। আমাদের অবস্থা তখন কিছুটা উন্নতির দিকে। হোটেলের লবিতে বসে থাকার চেয়ে বাইরে মল রোডের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করাটা ভালো লাগছিল। অবশেষে একটা জিপ গাড়ি এসে উপস্থিত হলো আমাদের জন্য। হুড়োহুড়ি করে উঠে গেলাম গাড়িতে। জিপ চালু করার আগে অমরদা বিদায় নিতে এলেন। তিনি আরেকটা দলকে গাইড করার জন্য থেকে যাচ্ছিলেন। খুব করে বলে দিলেন গাড়ির চালককে পরিচয় করিয়ে, ‘ও কিন্তু আমার নিজের লোক। আমার বন্ধু। আপনারা নিশ্চিন্তে যান। কোনো অসুবিধা হবে না।’ কিন্তু চালককে দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিল না। তিনি প্রথমেই বাদ সাধলেন আমাদের দুজনের সামনে বসা নিয়ে। তবু আমরা বসেছিলাম। কারণ পেছনে গাদাগাদি করে বসা সম্ভব নয়। তিনি যতই মুড দেখিয়ে রেগে যাচ্ছিলেন, ততই আমরা বিনয়ী হয়ে তাকে বোঝাচ্ছিলাম।
যাত্রাপথে র্যাংপোতে আবার থামতে হয়েছিল। আমাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। কিছু নাশতাপানি খাওয়া দরকার ছিল। ভুবন নেমে দোকান থেকে ব্রিটানিয়ার কেক, পানি আর সেখানকার কোনো একটা প্যারাসিটামল কিনে আনল। বাকিরা কোথা থেকে যেন নাশতা খেয়ে এলেন। আমি একবিন্দুও নামলাম না গাড়ি থেকে। ভীষণ খারাপ লাগছিল। যখন কেউ ছিল না, তখন চালকের সে কী হম্বিতম্বি! একে তো আমাদের দুজনের একসঙ্গে সামনে বসা নিয়ে তার সমস্যা, তার ওপর কেউ কেন জলদি ফিরে আসছে না, সেটা নিয়েও সমস্যা। অথচ সবার নাশতা সারতে যতক্ষণ সময় লাগার কথা, ততক্ষণেই সবাই ফিরে এসেছিলেন। আবার চালকের অনুপস্থিতেও সবাই যার যার রাগ ঝেড়ে নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই চালকের সঙ্গে আমাদের মতের বনিবনা হচ্ছিল না বলে এই অবস্থা। আমি আর ভুবন একটু কেক খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিলাম। ভুবন পেয়ারা ফ্লেভারের একটা পানির বোতল এনেছিল। বোতলটা সুন্দর। এখনো বাসায় রেখে দিয়েছি। পানিও খেতে ভালো। সবাই গাড়িতে উঠে পড়লে আবার যাত্রা শুরু হলো।
এবার মনে হয় আগের চেয়ে বেশি বিনয় দেখাচ্ছিলেন সবাই। শুধু চালককে ‘গরম’ থেকে ‘নরম’ করার জন্য। ভাবের চোটে তো চালক কথা তেমন বলছিলেন না, কিন্তু যখন শুরু করলেন, তখন মনে হলো লোকটা বেশ মিশুক। সেদিনের যাত্রাটা গানের বদলে রানাদার জীবনের গল্প শুনে কেটে গিয়েছিল। চালকের নাম রানা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। এর চেয়ে কমও হতে পারে। জানা হয়নি। জিপটা তাঁর নিজের। এ রকম আরও ৮-৯টা জিপের মালিক তিনি। বাকিগুলোর জন্য চালক রেখেছেন। ভগবানের কৃপায় নাকি এখন তার যথেষ্ট উপার্জন হয়। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাসে ৪০ হাজার রুপি বেতন। বেশ চলে যায় সংসার খরচ। মেয়ে আছে, পড়ে ক্লাস এইটে। এই বয়সেই ধনী বন্ধুদের দেখে নাকি অনেক দামি জিনিস বায়না ধরে। কিন্তু মেয়েকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চান রানা দম্পতি। মেয়ের সব আবদার পূরণ করেন না। বুঝেশুনে করেন। মেয়ে থাকে হোস্টেলে। ছুটিতে বাড়িতে আসে। মেয়ের কথা থেকে চলে গেলেন তাঁর প্রেমের গল্পে। খুব মজা নিয়ে শুনছিলাম আমরা।
ফোনে পরিচয় হয় নেপালি, মানে সিকিমের মেয়ের সঙ্গে। ভুল নম্বরে কথা বলে মেয়ের কণ্ঠটা খুব ভালো লেগেছিল রানাদার। বলছিলেন, ‘পাহাড়ি মেয়ে পটানো খুব সোজা। কণ্ঠটা ভালো লেগে গেল, তাই পটিয়ে ফেললাম।’ হো হো করে হেসে উঠলাম সবাই। এরপর বললেন লোভনীয় কথা, ‘নেপালিরা মেয়ে বিয়ে দিলে বরকে সম্পত্তি উপহার দেয়। সেই লোভেও তো এই মেয়েকে বিয়ে করা চাই!’ আরও একটু হেসে নিলাম আমরা। রানাদার প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতে অনেকটুকু পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। মাঝপথে কারও কারও প্রকৃতির ডাক এসেছিল। রানাদা বললেন, ‘এই একটু সামনে ভালো জায়গা আছে। যেখানে-সেখানে তো নামা যাবে না। আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে নামতে পারবেন। মেয়েছেলেরাও নামে ওখানে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিও নামতে পারবে।’ আমার নামার কোনো দরকার পড়েনি। অযথা নেমে আর কী করব। যাই হোক, রানাদার ‘আরেকটু সামনে’ এল অনেকক্ষণ সময় পর। আধা ঘণ্টার ওপরে হবে সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে যথাস্থানে গাড়ি থামালে ‘ভালো জায়গা’ পেলাম না। বরং উদ্যানের মতো খোলা জায়গা! সেখানে বানরের ছড়াছড়ি। মনের আনন্দে খেলছে, লাফাচ্ছে, খাচ্ছে, উকুন বেছে দিচ্ছে। সবাই নামলেন। আমি আর ভুবন বসেই রইলাম। রানাদা দেখিয়ে দিলেন, কাজ সারতে এক পাশে পাহাড়ের চিপায় জংলার মধ্যে যেতে। আমাকে বললে আমি মানা করে দিলাম। কারণ আমার দরকার নাই। কিন্তু তিনি অভয় দিচ্ছিলেন, ‘দেখো, কত মহিলা মানুষ যাচ্ছে।’ আমি বোঝালাম, ‘আমার তো প্রয়োজন নেই দাদা।’ আমি বসে বানরের কীর্তি দেখছিলাম। আমাদের খাওয়ার পর বাকি থাকা কেক সৌরভ ভাই বানরদের খেতে দিলেন। তখন আমার কিছুটা সুস্থ লাগছিল।
সবাই কাজ সেরে গাড়িতে উঠে এলে রানাদা এবার শুরু করলেন তার প্রেমিকার কাহিনি। না না, যাঁকে বিয়ে করেছেন তাঁর কথা বলছি না। বিয়ের পর পরকীয়া করছেন, সেই গল্প করলেন। ভয়ানক কাহিনি শুনে আমাদের মুখের চোয়াল নিচে ঝুলে গেল! এতক্ষণ কী আসলেই এই লোকটার কাহিনি শুনছিলাম? যিনি স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের প্রতি এত দায়িত্বশীল আর শ্রদ্ধেয়? কান খাড়া করে রইলাম আবার জিজ্ঞেস করে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না প্রথমে। আকাশ ভাই মশকরা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউদি জানে আপনার প্রেমিকার কথা?’ অবলীলায় রানাদা বলে গেলেন, ‘অবশ্যই। আমি আমার স্ত্রীকে না জানিয়ে কিছু করি না।’ আমাদের চোয়াল ঝুলতে ঝুলতে ব্যথা হয়ে যাওয়ার অবস্থা! রানাদা বলতে লাগলেন, ‘আমার স্ত্রী কিছুই মনে করে না। ও জানে আমি যখন শিলিগুড়ি যাই, এক রাত হোটেলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কাটাই। গল্পগুজব করে আমার মন ভালো হয়ে গেলে আমি গ্যাংটকে ফিরে যাই। এমনকি আমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায়ও জানে। ওর বর জানে যে আমার সঙ্গে সময় কাটায়। কিচ্ছু বলে না।’ আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ। আকাশ ভাই শুধু বললেন, ‘বেশ বেশ। খুব ভালো!’ মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। কিছুক্ষণ পর রানাদাকে দেখলাম হাতের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে পিষে পিষে মুখে ভরছে। এটা কী জানতে চাইলাম। বললেন, ‘গুল। আমার আবার বাজে কোনো নেশা নাই। চা-বিড়ি কিছুই না। একটু গুল খাই। এটা ভালো।’ মনে মনে ভাবলাম, ভাইরে, নেশা তো নেশাই! ভালো আর মন্দ কী!
কথায় কথায় সময়ের আগে পৌঁছাতে পারলাম শিলিগুড়িতে। রানাদা তার একটা কার্ড দিলেন, নম্বরসহ। বললেন, ‘ইন্ডিয়ায় আবার এলে আমাকে ফোন করবেন। বললেই হবে, রানাদা, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। যেকোনো দরকারে ফোন করতে পারেন। আমার নেটওয়ার্ক ভালো। আমার নাম রানা। এখানে রানাদাকে সবাই চেনে।’ কার্ডটা সম্ভবত আকাশ ভাই রেখেছিলেন। আমরা নেমে বিদায় দিয়ে দিলাম রানাদাকে। তাঁকে ফিরতে হবে গ্যাংটকে। জরুরি কাজ আছে। ভুবনের ধারণা, রানাদার এসব গল্প পুরোটাই চাপা! হোক, তা-ও তো নতুন গল্প শুনলাম।
আকাশ ভাইয়ারা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেননি। বাস কাউন্টারে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ছিল না। বাস চলে এসেছিল। এই বাস দিয়ে ফিরবেন চেংড়াবান্ধা সীমানায়। তারা বিদায় নিয়ে বাসে উঠে গেলেন। রইলাম বাকি আমি, ভুবন, সৌরভ ভাই আর ইমরান ভাই। বাবা বলেছিলেন, বাস কাউন্টারের পেছনে কম দামের হোটেল আছে, ভালো। আমাকে কাউন্টারে অপেক্ষা করতে বলে ভুবন ঘুরে এসে জানাল, ওই হোটেলগুলোর পরিবেশ পছন্দ হয়নি। কাউন্টারের ঠিক পাশের হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজায় দরদাম করে একটা কক্ষে উঠে গেলাম। সৌরভ ভাইদের কাছাকাছি রুম পেলাম। তাঁদেরটা আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল শ্যামলী পরিবহনের মাধ্যমে। অমরদা ডিসকাউন্টে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমদের জন্যও অমরদা ডিসকাউন্টের কথা বলে দিলেন। আমাদের রুম গুছিয়ে দিতে সময় নিচ্ছিল। কিছুক্ষণ সৌরভ ভাইদের রুমে বিশ্রাম নিলাম। আমাদের রুমটা পেলে সবাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বের হলাম। কোথায় খাওয়া যায়? খুব গরুর মাংসের বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছিল। আমার একার না, সবার। তখন সুস্থ লাগছিল।
ভেবেছিলাম দুপুরের খাবারের পর মার্কেটে যাব। ব্যাটারির একটা রিকশা ভাড়া করে চালককে বললাম মুসলিম কোনো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে, যেখানে গরুর মাংস পাওয়া যায়। চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন মুসলিম একটা রেস্তোরাঁয়। কিন্তু হায়, সেখানে গরুর মাংসের কিছুই নেই। আশপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওইটাই একমাত্র মুসলিম হোটেল এদিকের। তেমন কিছু চিনি-জানি না বলে সেখানেই খেতে ঢুকলাম। নিলাম খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, বাসমতি চালের। সৌরভ ভাই মাংস খাবেন না। তাই নিলেন ডিম বিরিয়ানি। আমি এক লোকমা মুখে দিয়েই বিস্বাদ অনুভূতি পেলাম। লবণের ছড়াছড়ি। অন্যরা কষ্ট করে খেতে পারলেও আমি আর ভুবন পারছিলাম না একদম। ভুবন তা-ও আমার চেয়ে বেশি খেতে পেরেছিল। আমি অর্ধেকের বেশি নষ্ট করলাম আর মনে মনে নিজেকে গাল দিলাম! খাবার নষ্ট করা আমার একেবারেই পছন্দ না। অবাক করে দিয়ে চেটেপুটে খেলেন সৌরভ ভাই। তারও এক কথা, ‘খাবার নষ্ট করা ঠিক না।’ ওয়েটারকে বিল দিতে বলা হলো। বিল নিয়ে এলে আমি ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, আপনাদের এখানে কি লবণের দাম কম? না মানে আমি নিয়ে যেতে চাই তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।’
লোকটা খুব খুশি হয়ে জবাব দিলেন, ‘দিদি, শুধু লবণ কেন! আমাদের যেকোনো মুদি দোকানে যান। কম দামে আরও ভালো ভালো জিনিস পাবেন।’ আমি ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বললাম, আহা বেচারা, আমার ঠাট্টাটাই বুঝল না! বিল চুকিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে। শরীর আবার অসুস্থ লাগা শুরু হয়ে গেল। রাস্তার ধারে জুসের দোকান দেখে ভাবলাম খেয়ে নিই, হয়তো জ্বরের মুখে ভালো লাগবে। সবাই মিলেই খেলাম। কেউ আনারস, কেউ মাল্টা, কেউ লেবু। তাজা ফল কেটে সামনেই বানিয়ে দেয়। ভালোই লাগল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আর শরীর চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফিরে গেলাম। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে হয়তো। সন্ধ্যায় বিধান মার্কেটে যাব, এরপর বাইরে কোথাও খেয়ে ফিরব। তাই দুজনেই ওষুধ খেয়ে নিলাম। কিন্তু অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হলো না। আমার এক সহকর্মী থাকেন মুম্বাইতে, দেবারতি নাম। বাঙালি। কলকাতার মেয়ে। তাঁকে জানিয়েই আমি ভারতে গিয়েছিলাম। তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যেকোনো সমস্যায় দাদাকে ফোন দিও।
দাদা শিলিগুড়িতেই থাকেন।’ জ্বরের ঘোরেও দাদাকে জানাতে ভুললাম না আমাদের অসুস্থতার কথা। এর আগেও ভারতে পৌঁছে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। যাই হোক, দাদা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। জানালেন, তিনি কাজের জন্য কলকাতা গিয়েছেন। পরদিন ফিরবেন। ফিরে দেখা করবেন। এদিকে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে। ভুবন তো একদম বাসি লিকলিকে বরবটির মতো নেতিয়ে পড়ছিল। আমার শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলেও দুর্বলতা বাড়ছিল। আর ভুবনের জ্বর ১০৩ ডিগ্রিতে উঠে বসে ছিল। নামার কোনো খবরই নেই! হোটেল থেকেই থার্মোমিটার দিয়েছিল মাপতে। বিকেলে সৌরভ ভাইয়ারা মার্কেটে যাওয়ার আগে আমাদের জানিয়ে গেলেন।
আমরা পড়ে রইলাম হোটেল রুমেই, জ্বরে কাতর। টিভিতে খুব অল্প চ্যানেল দেখা যায়। তা-ও বেশির ভাগ চ্যানেলে অপরিচিত ভাষায় সব অনুষ্ঠান। ঘুরেফিরে দু-একটা হিন্দি চ্যানেল পেয়ে সেগুলোই দেখছিলাম এই ভেবে, যেন শরীর খারাপ লাগাটা ভুলে থাকতে পারি। কিন্তু ভুবনের অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। সন্ধ্যার দিকে হোটেলের এক কর্মচারীকে ডেকে জানতে চাইলাম আশপাশে কোনো হাসপাতালে নেওয়া যাবে কি না। বললেন, ‘দিদি, এখন যদি কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যান, তবে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করিয়ে দেবে। খামোখা খরচা হবে। আর এমন সময় ডাক্তারও পাবেন না সেখানে। আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি। সেটা খাইয়ে দিন। ঠিক হয়ে যাবে।’ ভরসা করে তাঁর দেওয়া ওষুধ খাওয়লাম ভুবনকে। কিন্তু নাহ, অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। সৌরভ ভাইয়ারা ফিরে এসে দেখালেন তাঁদের কেনাকাটা। ভুবন শুধু আফসোস করছিল, ‘ইশ্ ভাই। রিজনেবল দামে এত জুতা এনেছেন। আমরা সুস্থ থাকলে যেতাম। শ্রীলেদার থেকে কয়েক জোড়া জুতা কেনার ইচ্ছা ছিল।’ সৌরভ ভাই তো পরিবারের সবার জন্য ৮-১০ জোড়া জুতা কিনে নিয়েছিলেন।
রাতে স্যুপ ফরমাশ করলাম। কোথাও যাওয়ার তো অবস্থা ছিল না। এত জঘন্য লাগছিল খাবার, পারছিলাম না খেতে। তবু জোর করে কিছুটা খেয়ে নিলাম। কারণ, শক্তি দরকার। ওষুধও খাওয়া দরকার। ভুবন যে নিজে উঠে খাবে, সেই অবস্থায় ছিল না। আমি জোর করে অল্প একটু খাইয়ে দিলাম ওকে। জোর করে খাইয়ে যা হয় আরকি, বমি করে ফেলে দিল সব! দুজনে ওষুধপত্র খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
আরও পড়ুন:
সকালে ঘুম থেকে উঠে খানিকটা ভালো লাগছিল। পুরোপুরি না। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথাও গিয়ে নাশতা করতে ইচ্ছা করছিল না। এদিন থেকে আমার চেয়ে ভুবনের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমরা নাশতা করিনি। ভাবলাম যাত্রাপথে খেয়ে নেব। গলা দিয়ে কিছু নামার অবস্থায় নেই। আমরা প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে গিয়েছিলাম। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলো অনেকক্ষণ। তখনো গাড়ির ব্যবস্থা হয়নি। অমরদা বলেছিলেন সকাল ৭টার মধ্যে রওনা দিতে পারব। কিন্তু সেখানে ৮টার ওপরে বেজে গিয়েছিল। বড় দলটাও চলে যাবে শিলিগুড়ি। এদিকে দেরি দেখে আকাশ ভাইয়ারা ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। কেননা, তাঁদের সময়মতো পৌঁছে বাস ধরতে হবে। অমরদা এদিক-সেদিক ফোন ঘুরিয়ে অবশেষে একটা গাড়ি নিশ্চিত করলেন।
আসলে হয়েছিল কী, যে চালক আসার কথা ছিল, তিনি শেষ মুহূর্তে আর আসেননি। আমাদের অবস্থা তখন কিছুটা উন্নতির দিকে। হোটেলের লবিতে বসে থাকার চেয়ে বাইরে মল রোডের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করাটা ভালো লাগছিল। অবশেষে একটা জিপ গাড়ি এসে উপস্থিত হলো আমাদের জন্য। হুড়োহুড়ি করে উঠে গেলাম গাড়িতে। জিপ চালু করার আগে অমরদা বিদায় নিতে এলেন। তিনি আরেকটা দলকে গাইড করার জন্য থেকে যাচ্ছিলেন। খুব করে বলে দিলেন গাড়ির চালককে পরিচয় করিয়ে, ‘ও কিন্তু আমার নিজের লোক। আমার বন্ধু। আপনারা নিশ্চিন্তে যান। কোনো অসুবিধা হবে না।’ কিন্তু চালককে দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিল না। তিনি প্রথমেই বাদ সাধলেন আমাদের দুজনের সামনে বসা নিয়ে। তবু আমরা বসেছিলাম। কারণ পেছনে গাদাগাদি করে বসা সম্ভব নয়। তিনি যতই মুড দেখিয়ে রেগে যাচ্ছিলেন, ততই আমরা বিনয়ী হয়ে তাকে বোঝাচ্ছিলাম।
যাত্রাপথে র্যাংপোতে আবার থামতে হয়েছিল। আমাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। কিছু নাশতাপানি খাওয়া দরকার ছিল। ভুবন নেমে দোকান থেকে ব্রিটানিয়ার কেক, পানি আর সেখানকার কোনো একটা প্যারাসিটামল কিনে আনল। বাকিরা কোথা থেকে যেন নাশতা খেয়ে এলেন। আমি একবিন্দুও নামলাম না গাড়ি থেকে। ভীষণ খারাপ লাগছিল। যখন কেউ ছিল না, তখন চালকের সে কী হম্বিতম্বি! একে তো আমাদের দুজনের একসঙ্গে সামনে বসা নিয়ে তার সমস্যা, তার ওপর কেউ কেন জলদি ফিরে আসছে না, সেটা নিয়েও সমস্যা। অথচ সবার নাশতা সারতে যতক্ষণ সময় লাগার কথা, ততক্ষণেই সবাই ফিরে এসেছিলেন। আবার চালকের অনুপস্থিতেও সবাই যার যার রাগ ঝেড়ে নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই চালকের সঙ্গে আমাদের মতের বনিবনা হচ্ছিল না বলে এই অবস্থা। আমি আর ভুবন একটু কেক খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিলাম। ভুবন পেয়ারা ফ্লেভারের একটা পানির বোতল এনেছিল। বোতলটা সুন্দর। এখনো বাসায় রেখে দিয়েছি। পানিও খেতে ভালো। সবাই গাড়িতে উঠে পড়লে আবার যাত্রা শুরু হলো।
এবার মনে হয় আগের চেয়ে বেশি বিনয় দেখাচ্ছিলেন সবাই। শুধু চালককে ‘গরম’ থেকে ‘নরম’ করার জন্য। ভাবের চোটে তো চালক কথা তেমন বলছিলেন না, কিন্তু যখন শুরু করলেন, তখন মনে হলো লোকটা বেশ মিশুক। সেদিনের যাত্রাটা গানের বদলে রানাদার জীবনের গল্প শুনে কেটে গিয়েছিল। চালকের নাম রানা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। এর চেয়ে কমও হতে পারে। জানা হয়নি। জিপটা তাঁর নিজের। এ রকম আরও ৮-৯টা জিপের মালিক তিনি। বাকিগুলোর জন্য চালক রেখেছেন। ভগবানের কৃপায় নাকি এখন তার যথেষ্ট উপার্জন হয়। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাসে ৪০ হাজার রুপি বেতন। বেশ চলে যায় সংসার খরচ। মেয়ে আছে, পড়ে ক্লাস এইটে। এই বয়সেই ধনী বন্ধুদের দেখে নাকি অনেক দামি জিনিস বায়না ধরে। কিন্তু মেয়েকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চান রানা দম্পতি। মেয়ের সব আবদার পূরণ করেন না। বুঝেশুনে করেন। মেয়ে থাকে হোস্টেলে। ছুটিতে বাড়িতে আসে। মেয়ের কথা থেকে চলে গেলেন তাঁর প্রেমের গল্পে। খুব মজা নিয়ে শুনছিলাম আমরা।
ফোনে পরিচয় হয় নেপালি, মানে সিকিমের মেয়ের সঙ্গে। ভুল নম্বরে কথা বলে মেয়ের কণ্ঠটা খুব ভালো লেগেছিল রানাদার। বলছিলেন, ‘পাহাড়ি মেয়ে পটানো খুব সোজা। কণ্ঠটা ভালো লেগে গেল, তাই পটিয়ে ফেললাম।’ হো হো করে হেসে উঠলাম সবাই। এরপর বললেন লোভনীয় কথা, ‘নেপালিরা মেয়ে বিয়ে দিলে বরকে সম্পত্তি উপহার দেয়। সেই লোভেও তো এই মেয়েকে বিয়ে করা চাই!’ আরও একটু হেসে নিলাম আমরা। রানাদার প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতে অনেকটুকু পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। মাঝপথে কারও কারও প্রকৃতির ডাক এসেছিল। রানাদা বললেন, ‘এই একটু সামনে ভালো জায়গা আছে। যেখানে-সেখানে তো নামা যাবে না। আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে নামতে পারবেন। মেয়েছেলেরাও নামে ওখানে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিও নামতে পারবে।’ আমার নামার কোনো দরকার পড়েনি। অযথা নেমে আর কী করব। যাই হোক, রানাদার ‘আরেকটু সামনে’ এল অনেকক্ষণ সময় পর। আধা ঘণ্টার ওপরে হবে সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে যথাস্থানে গাড়ি থামালে ‘ভালো জায়গা’ পেলাম না। বরং উদ্যানের মতো খোলা জায়গা! সেখানে বানরের ছড়াছড়ি। মনের আনন্দে খেলছে, লাফাচ্ছে, খাচ্ছে, উকুন বেছে দিচ্ছে। সবাই নামলেন। আমি আর ভুবন বসেই রইলাম। রানাদা দেখিয়ে দিলেন, কাজ সারতে এক পাশে পাহাড়ের চিপায় জংলার মধ্যে যেতে। আমাকে বললে আমি মানা করে দিলাম। কারণ আমার দরকার নাই। কিন্তু তিনি অভয় দিচ্ছিলেন, ‘দেখো, কত মহিলা মানুষ যাচ্ছে।’ আমি বোঝালাম, ‘আমার তো প্রয়োজন নেই দাদা।’ আমি বসে বানরের কীর্তি দেখছিলাম। আমাদের খাওয়ার পর বাকি থাকা কেক সৌরভ ভাই বানরদের খেতে দিলেন। তখন আমার কিছুটা সুস্থ লাগছিল।
সবাই কাজ সেরে গাড়িতে উঠে এলে রানাদা এবার শুরু করলেন তার প্রেমিকার কাহিনি। না না, যাঁকে বিয়ে করেছেন তাঁর কথা বলছি না। বিয়ের পর পরকীয়া করছেন, সেই গল্প করলেন। ভয়ানক কাহিনি শুনে আমাদের মুখের চোয়াল নিচে ঝুলে গেল! এতক্ষণ কী আসলেই এই লোকটার কাহিনি শুনছিলাম? যিনি স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের প্রতি এত দায়িত্বশীল আর শ্রদ্ধেয়? কান খাড়া করে রইলাম আবার জিজ্ঞেস করে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না প্রথমে। আকাশ ভাই মশকরা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউদি জানে আপনার প্রেমিকার কথা?’ অবলীলায় রানাদা বলে গেলেন, ‘অবশ্যই। আমি আমার স্ত্রীকে না জানিয়ে কিছু করি না।’ আমাদের চোয়াল ঝুলতে ঝুলতে ব্যথা হয়ে যাওয়ার অবস্থা! রানাদা বলতে লাগলেন, ‘আমার স্ত্রী কিছুই মনে করে না। ও জানে আমি যখন শিলিগুড়ি যাই, এক রাত হোটেলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কাটাই। গল্পগুজব করে আমার মন ভালো হয়ে গেলে আমি গ্যাংটকে ফিরে যাই। এমনকি আমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায়ও জানে। ওর বর জানে যে আমার সঙ্গে সময় কাটায়। কিচ্ছু বলে না।’ আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ। আকাশ ভাই শুধু বললেন, ‘বেশ বেশ। খুব ভালো!’ মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। কিছুক্ষণ পর রানাদাকে দেখলাম হাতের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে পিষে পিষে মুখে ভরছে। এটা কী জানতে চাইলাম। বললেন, ‘গুল। আমার আবার বাজে কোনো নেশা নাই। চা-বিড়ি কিছুই না। একটু গুল খাই। এটা ভালো।’ মনে মনে ভাবলাম, ভাইরে, নেশা তো নেশাই! ভালো আর মন্দ কী!
কথায় কথায় সময়ের আগে পৌঁছাতে পারলাম শিলিগুড়িতে। রানাদা তার একটা কার্ড দিলেন, নম্বরসহ। বললেন, ‘ইন্ডিয়ায় আবার এলে আমাকে ফোন করবেন। বললেই হবে, রানাদা, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। যেকোনো দরকারে ফোন করতে পারেন। আমার নেটওয়ার্ক ভালো। আমার নাম রানা। এখানে রানাদাকে সবাই চেনে।’ কার্ডটা সম্ভবত আকাশ ভাই রেখেছিলেন। আমরা নেমে বিদায় দিয়ে দিলাম রানাদাকে। তাঁকে ফিরতে হবে গ্যাংটকে। জরুরি কাজ আছে। ভুবনের ধারণা, রানাদার এসব গল্প পুরোটাই চাপা! হোক, তা-ও তো নতুন গল্প শুনলাম।
আকাশ ভাইয়ারা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেননি। বাস কাউন্টারে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ছিল না। বাস চলে এসেছিল। এই বাস দিয়ে ফিরবেন চেংড়াবান্ধা সীমানায়। তারা বিদায় নিয়ে বাসে উঠে গেলেন। রইলাম বাকি আমি, ভুবন, সৌরভ ভাই আর ইমরান ভাই। বাবা বলেছিলেন, বাস কাউন্টারের পেছনে কম দামের হোটেল আছে, ভালো। আমাকে কাউন্টারে অপেক্ষা করতে বলে ভুবন ঘুরে এসে জানাল, ওই হোটেলগুলোর পরিবেশ পছন্দ হয়নি। কাউন্টারের ঠিক পাশের হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজায় দরদাম করে একটা কক্ষে উঠে গেলাম। সৌরভ ভাইদের কাছাকাছি রুম পেলাম। তাঁদেরটা আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল শ্যামলী পরিবহনের মাধ্যমে। অমরদা ডিসকাউন্টে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমদের জন্যও অমরদা ডিসকাউন্টের কথা বলে দিলেন। আমাদের রুম গুছিয়ে দিতে সময় নিচ্ছিল। কিছুক্ষণ সৌরভ ভাইদের রুমে বিশ্রাম নিলাম। আমাদের রুমটা পেলে সবাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বের হলাম। কোথায় খাওয়া যায়? খুব গরুর মাংসের বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছিল। আমার একার না, সবার। তখন সুস্থ লাগছিল।
ভেবেছিলাম দুপুরের খাবারের পর মার্কেটে যাব। ব্যাটারির একটা রিকশা ভাড়া করে চালককে বললাম মুসলিম কোনো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে, যেখানে গরুর মাংস পাওয়া যায়। চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন মুসলিম একটা রেস্তোরাঁয়। কিন্তু হায়, সেখানে গরুর মাংসের কিছুই নেই। আশপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওইটাই একমাত্র মুসলিম হোটেল এদিকের। তেমন কিছু চিনি-জানি না বলে সেখানেই খেতে ঢুকলাম। নিলাম খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, বাসমতি চালের। সৌরভ ভাই মাংস খাবেন না। তাই নিলেন ডিম বিরিয়ানি। আমি এক লোকমা মুখে দিয়েই বিস্বাদ অনুভূতি পেলাম। লবণের ছড়াছড়ি। অন্যরা কষ্ট করে খেতে পারলেও আমি আর ভুবন পারছিলাম না একদম। ভুবন তা-ও আমার চেয়ে বেশি খেতে পেরেছিল। আমি অর্ধেকের বেশি নষ্ট করলাম আর মনে মনে নিজেকে গাল দিলাম! খাবার নষ্ট করা আমার একেবারেই পছন্দ না। অবাক করে দিয়ে চেটেপুটে খেলেন সৌরভ ভাই। তারও এক কথা, ‘খাবার নষ্ট করা ঠিক না।’ ওয়েটারকে বিল দিতে বলা হলো। বিল নিয়ে এলে আমি ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, আপনাদের এখানে কি লবণের দাম কম? না মানে আমি নিয়ে যেতে চাই তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।’
লোকটা খুব খুশি হয়ে জবাব দিলেন, ‘দিদি, শুধু লবণ কেন! আমাদের যেকোনো মুদি দোকানে যান। কম দামে আরও ভালো ভালো জিনিস পাবেন।’ আমি ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বললাম, আহা বেচারা, আমার ঠাট্টাটাই বুঝল না! বিল চুকিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে। শরীর আবার অসুস্থ লাগা শুরু হয়ে গেল। রাস্তার ধারে জুসের দোকান দেখে ভাবলাম খেয়ে নিই, হয়তো জ্বরের মুখে ভালো লাগবে। সবাই মিলেই খেলাম। কেউ আনারস, কেউ মাল্টা, কেউ লেবু। তাজা ফল কেটে সামনেই বানিয়ে দেয়। ভালোই লাগল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আর শরীর চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফিরে গেলাম। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে হয়তো। সন্ধ্যায় বিধান মার্কেটে যাব, এরপর বাইরে কোথাও খেয়ে ফিরব। তাই দুজনেই ওষুধ খেয়ে নিলাম। কিন্তু অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হলো না। আমার এক সহকর্মী থাকেন মুম্বাইতে, দেবারতি নাম। বাঙালি। কলকাতার মেয়ে। তাঁকে জানিয়েই আমি ভারতে গিয়েছিলাম। তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যেকোনো সমস্যায় দাদাকে ফোন দিও।
দাদা শিলিগুড়িতেই থাকেন।’ জ্বরের ঘোরেও দাদাকে জানাতে ভুললাম না আমাদের অসুস্থতার কথা। এর আগেও ভারতে পৌঁছে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। যাই হোক, দাদা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। জানালেন, তিনি কাজের জন্য কলকাতা গিয়েছেন। পরদিন ফিরবেন। ফিরে দেখা করবেন। এদিকে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে। ভুবন তো একদম বাসি লিকলিকে বরবটির মতো নেতিয়ে পড়ছিল। আমার শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলেও দুর্বলতা বাড়ছিল। আর ভুবনের জ্বর ১০৩ ডিগ্রিতে উঠে বসে ছিল। নামার কোনো খবরই নেই! হোটেল থেকেই থার্মোমিটার দিয়েছিল মাপতে। বিকেলে সৌরভ ভাইয়ারা মার্কেটে যাওয়ার আগে আমাদের জানিয়ে গেলেন।
আমরা পড়ে রইলাম হোটেল রুমেই, জ্বরে কাতর। টিভিতে খুব অল্প চ্যানেল দেখা যায়। তা-ও বেশির ভাগ চ্যানেলে অপরিচিত ভাষায় সব অনুষ্ঠান। ঘুরেফিরে দু-একটা হিন্দি চ্যানেল পেয়ে সেগুলোই দেখছিলাম এই ভেবে, যেন শরীর খারাপ লাগাটা ভুলে থাকতে পারি। কিন্তু ভুবনের অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। সন্ধ্যার দিকে হোটেলের এক কর্মচারীকে ডেকে জানতে চাইলাম আশপাশে কোনো হাসপাতালে নেওয়া যাবে কি না। বললেন, ‘দিদি, এখন যদি কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যান, তবে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করিয়ে দেবে। খামোখা খরচা হবে। আর এমন সময় ডাক্তারও পাবেন না সেখানে। আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি। সেটা খাইয়ে দিন। ঠিক হয়ে যাবে।’ ভরসা করে তাঁর দেওয়া ওষুধ খাওয়লাম ভুবনকে। কিন্তু নাহ, অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। সৌরভ ভাইয়ারা ফিরে এসে দেখালেন তাঁদের কেনাকাটা। ভুবন শুধু আফসোস করছিল, ‘ইশ্ ভাই। রিজনেবল দামে এত জুতা এনেছেন। আমরা সুস্থ থাকলে যেতাম। শ্রীলেদার থেকে কয়েক জোড়া জুতা কেনার ইচ্ছা ছিল।’ সৌরভ ভাই তো পরিবারের সবার জন্য ৮-১০ জোড়া জুতা কিনে নিয়েছিলেন।
রাতে স্যুপ ফরমাশ করলাম। কোথাও যাওয়ার তো অবস্থা ছিল না। এত জঘন্য লাগছিল খাবার, পারছিলাম না খেতে। তবু জোর করে কিছুটা খেয়ে নিলাম। কারণ, শক্তি দরকার। ওষুধও খাওয়া দরকার। ভুবন যে নিজে উঠে খাবে, সেই অবস্থায় ছিল না। আমি জোর করে অল্প একটু খাইয়ে দিলাম ওকে। জোর করে খাইয়ে যা হয় আরকি, বমি করে ফেলে দিল সব! দুজনে ওষুধপত্র খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
আরও পড়ুন:
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে