প্রমথ চৌধুরী: গদ্যশিল্পী ও নির্মাতা

স্বপন নাথ
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩: ৪১

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।

প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) গদ্যশিল্পী। এর চেয়ে বড় সত্য, তিনি বাংলা গদ্যের নির্মাতা। একটি অভিধা তাঁর নামের সঙ্গে জুড়েই আছে—তিনি বাংলা চলতি গদ্যরীতির প্রবর্তক। এই অভিধার পেছনে যুক্তি ও ভিত্তি রয়েছে। এ ছাড়া সাহিত্যচর্চায় তাঁর ছদ্মনাম বীরবল অতি জনপ্রিয়। কারণ তিনি বীরবল নামে একসময় লেখালেখি করেছেন। সাহিত্যচর্চার বাইরে তাঁর মহৎ পরিচয় তিনি অসামান্য সম্পাদক ছিলেন। সবুজপত্র, বিশ্বভারতী, রূপ ও রীতি এবং অলকা সম্পাদনায় যাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সাময়িকপত্র সম্পর্কে বা সাহিত্যে বাঁক বদলের আলোচনা তাঁকে বাদ দিয়ে পূর্ণ হয় না। বিশেষত সবুজপত্র ও বিশ্বভারতী বাংলা সাহিত্যের স্বতন্ত্র পরিচিতি নির্মাণে অবদান রেখেছে।

প্রমথ চৌধুরী জীবনের শুরুতে আইন পেশায় যুক্ত হলেও একপর্যায়ে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত হন। তাঁর অন্যতম রচনা হলো: তেল-নুন-লকড়ি (১৯০৬), সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩), চার-ইয়ারি কথা (১৯১৬), বীরবলের হালখাতা (১৯১৬), The Story of Bengal Literature (১৯১৭), পদচারণ (১৯১৯), রায়তের কথা (১৯২৬), নীললোহিত (১৯৩২), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), আহুতি (১৯১৯), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০), প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৫২-১৯৫৩), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯), সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), দুই বা এক (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪) ও আত্মকথা (১৯৪৬)। সাধারণত প্রবন্ধ, গল্প ও ব্যঙ্গ রচনা পাঠ করে প্রমথ চৌধুরীকে আমাদের জানা এবং এত দিন আপ্লুত থাকা।

স্মরণীয়, বীরবলী ব্যঙ্গ রচনা একসময় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সম্রাট আকবরের রাজসভার নবরত্নের একজন ছিলেন বীরবল। সেই ঐতিহ্যসূত্রে তিনিও তাঁর নাম রাখেন বীরবল। স্মরণীয় প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। এ ছাড়া জনশ্রুতি অর্জন করেছে এমন গল্প ও কবিতা রচনা করেছেন। একজন বাংলাভাষী হিসেবে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর ছিল বিশেষ ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্য। ফলে পঠন-পাঠনের আলোকেই তিনি মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর রচনার অকাট্য যুক্তি থেকেই বোঝা যায় কী অসামান্য পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। মূলত তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন সৃজনশীল প্রবন্ধ লেখক হিসেবে। বাংলা সাহিত্যে পণ্ডিত, জ্ঞানী লেখকদের হিসাব নিলে তালিকা খুব দীর্ঘ হবে না। এর মধ্যে প্রমথ চৌধুরী অবশ্যই উল্লেখযোগ্য একজন।

কিছু সতর্কতার সঙ্গে বলা যায়, একাডেমিক পরিসরে যদি প্রমথ চৌধুরী ভুক্ত না হতেন, তাহলে সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁর রচনা তেমন পঠিত হতো কি না, সন্দেহ। এর মানে এই নয় যে, প্রমথ চৌধুরীর রচনার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাঁর রচনা গ্রহণযোগ্যতার অধিক বলেই কথাটা বলা। পাঠযোগ্যতার বাইরে রাখা বা রাখার কৌশল চলমান আছে, এ জন্যও কথাটি বলতে হয়। আমাদের রুচি ও অভ্যাসের যোগফল এমন সন্দেহের প্রসঙ্গ উসকে দেয়। কারণ প্রমথ চৌধুরী রচনার মধ্যে ভিন্ন রুচি ও শিল্প নির্মাণ করেছেন, যা আমরা অনেকেই গ্রহণ করতাম না। এ কথায় মনে হয় অনেকে আহত বোধ করবেন। কিন্তু এ বিষয়কে মেনে নিয়ে আমরা প্রমথ চৌধুরীর গদ্য পাঠ করি। অতুল চন্দ্র গুপ্ত বলেছেন, ‘তাঁর রচনারীতি বাংলা গদ্যরচনা, প্রবন্ধ ও সমধর্মী রচনাকে বহুল প্রভাবিত করেছে। সাধু বনাম চলিত ভাষার তর্কে প্রমথ চৌধুরীর জয়ের চিহ্ন যেমন আজ বাংলা গদ্যরচনার সারা শরীরে, তেমনি তাঁর রচনারীতির প্রভাব বাংলা গদ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাক্‌-প্রমথ যুগের তুলনায় আজকের বাংলা গদ্য অনেক সংহত, তার গতি অনাড়ষ্ট, জটিলকে স্বচ্ছন্দ প্রকাশের প্রসাদগুণ তার অনেক বেশি।...বাংলা গদ্যের ভাষা ও রচনারীতিতে তিনি যে পরিবর্তন এনেছেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর বড়ো দান বলে তা স্বীকৃত হবে। কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গিতে তাঁর বলার বিষয় যদি চাপা পড়ে, তাহলে তা হবে দেশের দুর্ভাগ্য। এই ঋজু কঠিন তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে তিনি যা বলেছেন, তার প্রধান কথা হচ্ছে মন ও সাহিত্যেও মুক্তির কথা। সে কথা বলার প্রয়োজন চিরকাল থাকবে।’ [প্রবন্ধসংগ্রহ ১৯৮৬: ১৩]
উল্লেখ্য যে, প্রমথ চৌধুরীর অবদান একালে বসে ততটা অনুভব করা যাবে কি না, সন্দেহ। বস্তুত সেকালে উপনিবেশ ও বহুস্তরীভূত সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা শুধু কথার কথা নয়। ওই বাস্তবতা বিবেচনায় না রেখে ওই সময়ের পরিস্থিতি অনুভবে আনা যাবে না, যেখানে সাহিত্যের অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি তাঁর সম্মুখে উজ্জ্বল উদাহরণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারিচাঁদ মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তাঁদের উপস্থিতি ও প্রভাবকে স্বীকার করে নিয়ে প্রমথ চৌধুরী বিপ্লবের সূচনা করেছেন। তা ছাড়া সাহিত্যের প্রথাগত চিন্তা, ভাষা, প্রকরণশৈলী, উপস্থাপনভঙ্গি—সবই পালটে দিয়েছেন। 
সাহিত্য: রস, আর্ট নাকি মনোরঞ্জন বলা নিষ্প্রয়োজন, প্রমথ চৌধুরী নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র সাহিত্য-প্রত্যয়, যা পাঠক-সমালোচকের চিন্তা ও প্রাণে ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। এই অর্থে বিশ শতকে তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ এক সমালোচক। শুধু কি সমালোচনা? এর সঙ্গে লিখেছেন কবিতা, গল্প, রসাত্মক চুটকিজাতীয় রচনা। গল্প নির্মাণে সাধারণ পাঠকের মনোভাব ভাবনায় রেখে লিখেছেন অনন্য কয়েকটি গল্প। এমনকি এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি প্রবন্ধেও। ওই বিষয় বিবেচনায় রেখে তিনি প্রবন্ধের ভাষাও সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মৌখিক ভাষার দিকে নিবদ্ধ রেখেছেন তাঁর দৃষ্টি। এই নিরিখেই তিনি কথা বলেছেন সাহিত্য প্রসঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের পরিধি, বিষয় ও শৈলী কেমন, কী হবে—এসব বিষয়ে তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত। এ জন্য সবুজপত্র প্রকাশনার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর বক্তব্য আজও পাঠক-লেখক উভয়ের কাছে সমাদৃত, যে ক্ষেত্রে তাঁর মৌল কথাই হলো স্বীয় বৈভবে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। তিনি লক্ষ করেছেন, আমরা যা কিছু চিন্তা করছি, তা বাইরের চিন্তা দ্বারা প্রভাবান্বিত। নিজের শেকড় সম্পর্কে কেবলই উদাসীন। তিনি চেয়েছেন স্বশাসিত, সার্বভৌম সাহিত্য। সবকিছুর আগে তিনি দেশ ও মাটির দিকে তাকাতে বলেছেন। যে ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা তৈরি হবে নিজের সত্তা ও শক্তির নিরিখে, অপরের ভিত্তিতে নয়। কারণ দীর্ঘকাল থেকে ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করা হয়েছে। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ গড়তে হলে স্বীয় দেশ ও সম্পদের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বাঙালিমাত্রেই ঐ একই বিলেতি ক্ষুরে মাথা মুড়িয়েছি। শুধু কারো মাথায় কাকপক্ষ অবশিষ্ট, কারো মাথায়-বা শুধু টিকি;...বিদেশী বস্তুর বড়ো বস্তা আমরা মাথায় বহন করছি, অপরে পুঁটলি-পাঁটলা নিয়ে চলেছে। আমরা যদি আমাদের মাথার সে ভার নামাতে না পারি, তা হলে অপরের পক্ষে তাদের সে ভার ঝেড়ে ফেলা কঠিন হবে না। এই স্বদেশীয়তার কথা শুধু দেশের কথা নয়, এ ঘরেরও কথা।’ [তেল নুন লকড়ি ১৯৮৬: ৩৩২]
এর ভিত্তিতে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন বাঙালির দেশপ্রেমের রূপরেখা। আমরা বুঝে নিতে পারি, কী কী বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাঙালির স্বাদেশিকতা শনাক্ত করা যায়, যা এখন অংশত অপসৃত হয়েছে। ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজম’ প্রবন্ধে তিনি সেলফ-সেক্রিফাইস ও হিংসাকেন্দ্রিক ন্যাশনালিজম ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর বিপরীতে তিনি সেলফ-রিয়েলাইজেশনকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কেননা, বাঙালির ঐতিহ্য সৃষ্টি একান্তই বাঙালির। ফলত বাঙালির প্রতিনিধিত্বশীল কবি হিসেবে ভারতচন্দ্রকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মনে করেছেন ভারতচন্দ্রই বাংলা ও প্রাচ্যবোধের মৌলিক কবি। কবি ভারতচন্দ্র প্রাচ্যের মানস ও সারার্থকে রূপায়ণ করেছেন কবিতায়। যে কারণে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করি, সে ভারতচন্দ্রের ভাষা নয়; ইতিমধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণে আমরা সে ভাষার গৌরব বৃদ্ধি করেছি, অর্থাৎ তার গায়ে একরাশ মুখস্থ-করা শব্দ চাপিয়ে দিয়ে তার ভার বৃদ্ধি করেছি, তার গতি মন্দ করেছি। ফরাসি সাহিত্যের শিক্ষা আমাদের মনে বসে গেলে আমরা আবার বহুসংখ্যক পণ্ডিতি শব্দকে সসম্মানে বিদায় করব এবং তার পরিবর্তে বহুসংখ্যক তথাকথিত ইতর শব্দকে সাহিত্যে বরণ করে নেব। কেননা, এই কৃত্রিম ভাষার চাপে আমাদের জাতীয় প্রতিভা মাথা তুলতে পারছে না।’ [ফরাসি সাহিত্যের বর্ণপরিচয় ১৯৮৬: ১২৪] 
এ ক্ষেত্রে আমরা তাঁর কাছে উপনিবেশমুক্তির বার্তা শুনতে পেয়েছি। কারণ এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিবিধ ভূগোলে উপনিবেশের প্রভাবে কী হতে পারে, তা আমরা সবাই লক্ষ করেছি। সেই সব স্থানে উপনিবেশায়ন ও শাসনে শুধু মুখের ভাষা নয়, চিন্তার পাটাতন বদলে গেছে। মানুষ ভুলে গেছে কীভাবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। পৃথিবীকে দেখার স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গির অবশেষ কিছু ছিল না। এ ক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিপ্লবাত্মক বাণী তিনি উচ্চারণ করেছেন, যে ক্ষেত্রে নিজস্ব ভূমি নির্মাণেই যে সবুজপত্রের সূচনা। কারণ সবুজের মধ্যে রয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ‘প্রাণ পশ্চাৎপদ হতে জানে না। তার ধর্ম হচ্ছে এগোনো, তার লক্ষ্য হচ্ছে অমৃতত্ব নয় মৃত্যু।’ [সবুজপত্র ১৯৮৬: ৪৯] 
সমূহ সীমাবদ্ধতার কারণে সাহিত্যচিন্তাকে মুক্ত করা যায়নি। আমরা সাহিত্যচর্চাকে পেশা হিসেবে নিতে পারিনি। এর ফলে রুচি বা উদাহরণযোগ্য সাহিত্য রচিত হচ্ছে না। তিনি স্পষ্টত বলেছেন, সাহিত্যে মানুষের অন্ন, বস্ত্র বা মৌলিক চাহিদার কিছুই পূরণ হয় না। তবে এর চেয়ে বেশি যা অর্জন করা যায়, তা হলো সাহিত্যরস মানসিক শক্তির আধারে পুষ্টি দান করে। জড় থেকে জাগাতে প্রাণকে সজীব করে তোলে। এ জন্য মানবজীবনের রূপান্তরের সহায় হলো সাহিত্য। এভাবে বিবেচনা হয় না বলেই সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও মননশীলতা আসেনি। আপাতভাবে লেখালেখি শখ হলেও তা তো শখের বিষয় নয়। আমরা ওই শখের বৃত্ত থেকে এখনো মুক্ত হতে পারিনি। ফলত ‘সাহিত্য এ দেশে অদ্যাবধি ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। তার জন্য দোষী লেখক কি পাঠক, বলা কঠিন।’ আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, সাহিত্য প্রসঙ্গে তাঁর স্বতন্ত্র ভাবনা ছিল। তিনি ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক। যে কারণে এ দেশের সাহিত্যচর্চার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি জানতেন। এর পিরপ্রেক্ষিতে তাঁর অভিমত হলো, ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ দেওয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়।’ [সাহিত্যে খেলা ১৯৮৬: ৯৭]
আমরা জানি যে, যৌনতা বা অশ্লীলতার অভিযোগে কখনো কখনো লেখক ও সাহিত্য অভিযুক্ত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে এর উদাহরণ কম নয়। এজাতীয় পুরোনো বিতর্কের বিষয়ে প্রমথ চৌধুরী শিল্প ও অশ্লীলতার ভেদরেখা ভিন্নভাবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, রস, সৌন্দর্য ও শিল্পের প্রকাশ যেখানে, তা তো অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হতে পারে না। সংস্কৃত আলংকারিকেরা গ্রাম্যতা, যৌনতার উপস্থাপন বিবেচনায় অশ্লীলতার মানদণ্ড নির্ধারণে প্রয়াসী ছিলেন। কিন্তু সাহিত্যে প্রশ্ন থাকে শিল্পের, নীতির নয়। সাহিত্যের ইতিহাসে এই নীতিবোধের কোনো সমর্থনও নেই। বিশ্বসাহিত্যের ভূগোল থেকেও তা অপসৃত হয়েছে। সংস্কৃত আলংকারিকদের যেসব উদাহরণ দেওয়া হয়ে থাকে, তা অংশত পার্শ্বিক। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও মানদণ্ড বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। স্পষ্টত মরালিটির নিক্তিতে যেখানে সাহিত্য বিবেচনা করা হয়, সেখানে কুসংস্কার পল্লবিত হওয়াই স্বাভাবিক। যারা এই শ্লীল-অশ্লীলের কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তারা beauty এবং শিল্পচৈতন্যের প্রমথ চৌধুরী ছিলেন utility-র অনুরক্ত।

কথা ও ভাষা
প্রমথ চৌধুরী গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলা ভাষার স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের ওপর। মূলত এ ভাষার উপাদান গঠিত হয়েছে ঐতিহ্যের স্রোতধারায়। মূলত বাংলা ভাষার শক্তি নির্ভর করছে আপন সামর্থ্য ও নিজের ভিতের ওপর। এই আলোকে তিনি মুখের কথা দিয়ে সাহিত্যের ভাষা নির্মাণে প্রয়াসী ছিলেন। যে ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব চিহ্নিত হয়ে আছে। তিনি বলেছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ [কথার কথা ১৯৮৬: ২৫৮] 
বাংলা ভাষার দুই রীতি। এখন কিছু প্রয়োজন ছাড়া সাধুরীতির ব্যবহার নেই বললেই চলে। আজ যে চলতি (চলিত) ভাষার কথা বলছি, তা ওই সাধুরীতির উৎস থেকেই আসা। ভাষারীতির আলোচনায় অনেকেই সাধুরীতির পক্ষে কথা বলেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন সাহিত্য রচনা ও আর্টের কথা। সাধুরীতির সমর্থনে এত কথা কেন প্রচার করা হয়? আমরা প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যমে বুঝতে পারি, তিনি যে রীতির কথা বলেছেন, তা শিল্প ও সাহিত্যচর্চার অনুকূল। যাতে চিন্তা ও ভাব প্রকাশে কোনো বিরোধ তৈরি হয় না। এই চলতি রীতি যেমন গতিশীল এবং সাহিত্যের বিষয় ও ভাব প্রকাশে গতিকে শ্লথ করে না, তেমনি এতে অন্য ভাষার উপাদানকেও সহজে যোজন করা যায়। মোদ্দাকথা, প্রচল ভাষাগুলোর মতো রক্ষণশীল নয়। বিতর্ক তৈরি হয়েছে মূলত প্রমিতকরণ যুক্তির কথা বলে। বস্তুত, সাধু ও চলতি রীতি নিয়ে নিরর্থক অধিক সময় ও শ্রম ব্যয় করা হয়েছে। এর কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে হয় না। কাল ব্যবধানে মানুষের মুখের ভাষাই এখন প্রমিত রীতির শক্তি হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। এই মুখের ভাষার সমর্থক প্রমথ চৌধুরী কালান্তরে বিজয়ী হয়েছেন। ফলে ভাষার রূপ-রীতি নির্ধারণে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য চিন্তা পরাজিত হয়েছে। এখনো এর শক্তি ও চিন্তন প্রক্রিয়া যে সক্রিয়, তা বিভিন্ন স্তরের প্রতিক্রিয়ায় এর প্রমাণ মেলে। 
তাঁর মতে, উপভাষা শিষ্টভাষার মূল শক্তি। উপভাষা ও প্রমিত ভাষার প্রশ্ন সাপেক্ষে বাংলা ভাষার উৎস, গঠন, ব্যবহারবিধি নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আবার শুদ্ধাশুদ্ধির আলোচনা, তর্কও বেশ শক্তিশালী। কিন্তু ভাষা পরিবর্তনশীল। ভাষার এই রূপ-রূপান্তর বলে দেয় এর শক্তি ও গতি। ভাষাবৈচিত্র্যের আলোকেই বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ বা ভাষার গঠনকাঠামো বিবেচনাযোগ্য। ভাষাবৈচিত্র্যের স্বীকৃতির অর্থই হলো মানবসভ্যতার বিবিধ স্বরের স্বীকৃতি, যা কিনা কোনো রক্ষণশীল কাঠামোতে ভাবা যায় না। ফলে বাংলা ভাষার গতিবিধি আরোপিত কাঠামো বা নিয়মের মাধ্যমে যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি প্রমিতকরণের কথা বলেছেন, তবে উপভাষা ও কথ্যভাষা অবনমনের মাধ্যমে নয়। প্রবহমান জীবনের বৈশিষ্ট্যে ভাষাও বহমান। অতএব, সেভাবেই গড়ে উঠবে ভাষার শিষ্ট রূপ, যাতে কোনো কৃত্রিমতা গ্রাহ্য নয়। তাঁর ভাষ্য হলো, ‘আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে কলকাতার মৌখিক ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠবে। তার কারণ, কলকাতা রাজধানীতে বাংলাদেশের সকল প্রদেশের অসংখ্য শিক্ষিত ভদ্রলোক বাস করেন। ঐ একটি মাত্র শহরে সমগ্র বাংলাদেশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এবং সকল প্রদেশের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে পরস্পরের কথার আদান-প্রদানে যে নব্য ভাষা গড়ে তুলেছেন, সে ভাষা সর্বাঙ্গীণ বঙ্গ ভাষা।’ [বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা ১৯৮৬: ২৭০] 
প্রচল ভাষাচিন্তকেরা কীভাবে ভাষাকে বিবেচনা করেছেন? তারা বলেছেন, ভাষার সংকট সংকর বৈশিষ্ট্যে। তবে এই সংকরায়ণ প্রক্রিয়া জটিলতা নয় বরং প্রাণবন্ত করেছে বাংলা ভাষাকে। সংকর বৈশিষ্ট্যের অভিযোগ রেখে অনেকেই বাংলা ভাষার শুদ্ধ্যশুদ্ধির যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু বাঙালির জাতিগত পরিণামেই এর ভাষা ও রাজনীতি নির্ধারিত হয়েছে। সুতরাং তিনি ভাষার এই সংকর বৈশিষ্ট্যকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছেন। ‘বাঙালি যে দেহে সংকর, মনে সংকর, ভাষায় সংকর এর জন্য দোষী আমরা নই, কেননা বাঙালি জাতি আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমরা বাঙালি জাতিকে সৃষ্টি করিনি।...এ অবস্থায় বাইরের জিনিসকে আত্মসাৎ করা যে প্রাণের লক্ষণ, নব-আয়ুর্বেদের এই মতকে মেনে নিয়ে নিশ্চিত থাকাই ভালো।’ [আমাদের ভাষা সংকট ১৯৮৬: ২৮২] 
মূলত সাহিত্য, ভাষা ও প্রাচ্যের ঐক্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রমথ চৌধুরীর যুক্তি আমাদের কী বার্তা পৌঁছে দেয়? এর মধ্যে পাঠককে আকৃষ্ট করে চিন্তার মুক্তি, ভাষা ও সাহিত্যবোধের প্রগতিশীলতা বিষয়ে তাঁর অভিমত। যা সবাই গ্রহণ করেছেন নিজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিশ্বাসে। বস্তুত বিশ শতক ও পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের ভাষারীতি চলমান থাকে প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত তত্ত্বরেখায়। 
[আকরগ্রন্থ: প্রমথ চৌধুরী। ১৯৮৬/১৯৬৮। প্রবন্ধসংগ্রহ। কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ]

স্বপন নাথ: উপপরিচালক, নায়েম, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত