রাশেদ নিজাম, কুমিল্লা থেকে ফিরে
কুমিল্লা থেকে শুরু হওয়া ঘটনা ছড়িয়েছে পুরো দেশে। ভাঙচুর, সংঘর্ষ, হত্যা, মৃত্যু–কিছুই বাদ যায়নি। আগুন জ্বলেছে। সে আগুনে পুড়েছে বিশ্বাস। শত শত বছর ধরে নিশ্চিন্তে পাশের বাড়ির রহিম-করিমের সঙ্গে পাল-সাহা-ঘোষদের সম্পর্ক। তাহলে এই অবস্থাটা তৈরি করল কে?
প্রশ্ন হলো, ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন কুমিল্লায় যা ঘটেছে, তা কি নিয়ন্ত্রণ করা যেত না? কে বা কারা সেই কাণ্ডের সূত্রপাত করল? ঘটনার পর গ্রেপ্তার ও মামলা হলেও অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা তদন্তের অগ্রগতি মন্ত্রণালয়ে জানাচ্ছি।’ পুলিশ সুপার তাঁর দায়িত্বের জায়গা থেকে হয়তো ঠিকই বলছেন। কিন্তু দেশের মানুষ তো প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়?
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য, কুমিল্লা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকিয়া আফরিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুনানি চলছে। সাক্ষী অনেকেই কারাগারে থাকায় শুনানিতে সময় লাগছে। প্রতিবেদন জমা দিতে আমরা আরও ১৫ দিন সময় চেয়েছি।’ যদিও গত শুক্রবার জেলা প্রশাসন জানিয়েছিল, তিন কার্যদিবসে প্রতিবেদন দেবে কমিটি।
যা ঘটেছিল সেদিন
প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের যে বর্ণনা দিলেন, তাতে নানুয়া দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে কে পবিত্র কোরআন রেখেছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। দিঘির পশ্চিম পাড়ে তিন দশক ধরে বাস করেন ষাটোর্ধ্ব চৌধুরী হাসানুজ্জামান। ঘটনার পরদিন দুপুরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মণ্ডপের সামনেই আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, ‘পূজা এলেই এখানে মণ্ডপ হয়, স্থানীয় সবাই উৎসবমুখরভাবেই তাতে অংশ নেন।
গত দুই দশকে অন্তত এ বিষয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। আমরা বয়স্করা প্রতি সকালেই দিঘির পাড়ে হাঁটতে বের হই। ওই দিন বের হয়ে দেখি অনেক মানুষের জটলা। পবিত্র কোরআন পাওয়া নিয়ে সবাই কথা বলেছেন। কিন্তু কে রেখেছে, এ বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি। পরে তো অনেক লোক এসে এখানে হামলার জন্য জড়ো হয়েছে, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে অনেক।’
মণ্ডপের লাগোয়া নবনির্মিত বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ওই দিন সকালে প্রথম হনুমানের মূর্তির কোলে কোরআন শরিফ দেখেছিলেন দুজন হিন্দু নারী। তাঁদের কাছ থেকে জেনে জাতীয় হেল্প লাইন ৯৯৯-এ ফোন করেন রেজাউল করিম। যিনি নানুয়া দিঘির আশপাশেই থাকেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনওয়ারুল আজিম পৌঁছে যান সেখানে। উদ্ধার করেন কোরআন শরিফ। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। এরপরই মণ্ডপ ঘিরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরে এই মণ্ডপসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়।
নানুয়া দিঘির পাশেই বজ্রপুর এলাকায় থাকেন আকরাম উজ জামান চৌধুরী। এলাকায় সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ঘটনাস্থলেই সমাধান করে ফেলা যেত, যদি ফেসবুক লাইভটা না হতো। সেখানে পুরো বিষয়টি উসকানিমূলকভাবে প্রচার করা হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে এক ব্যক্তি এভাবে ফেসবুক লাইভে ধর্মীয় বিষয় প্রচার করলেও তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
ঘটনার দিন নানুয়া দিঘির পাড়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তামূলকব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ কিংবা প্রশাসন। ওই মণ্ডপ থেকে মিনিট তিনেকের দূরত্বে কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বাসা। তিনিও এসেছিলেন অনেক পরে। ঘটনার পর তাঁর বাসায় গিয়ে ডাকাডাকিও করেন স্থানীয় লোকজন।
মেয়র সাক্কু বলেন, ‘আমি ঘটনা জানার পরেই চলে গেছি। ওসিসাব টেলিফোন করেছেন। বলেছি, আমাকে আধা ঘণ্টা সময় দেন। নয়টার মধ্যে ওখানে পৌঁছে গেছি আমি।’ মেয়র বলেন, ‘আমি যখন গেছি তখন ওখানে কেউ ছিল না। দেখি অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সবাই উত্তেজিত। ডিসি, ওসি কেউ ছিল না। সবার হাত ধরে বললাম, ‘আমি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছি, আপনারা চলে যান, সবকিছু ঠিক থাকবে। তিনটা পর্যন্ত ছিলাম। পরে প্রশাসনের লোকজন আসেন।’
স্থানীয় কোনো মানুষ ওখানে ভাঙচুর করেনি জানিয়ে মেয়র সাক্কু বলেন, ‘টোকাই গোছের একদল উচ্ছৃঙ্খল ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। কেউ কারও কথা শুনছিল না। পুলিশ ফাঁকা গুলি করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় ৭০ জনের মতো লোক স্পটে নিয়ে আসি।’ কাউকে চিনতে পেরেছিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নওয়াববাড়ি, তেইল্লা পুকুর পাড়, মুরাদপুর—এসব এলাকা থেকে লোকজন এসেছিল। শহরের কেউ না, ইউনিয়ন থেকে জমায়েত হয়ে তারা শহরে ঢুকেছে।
মহানগর পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস টিটু বলেন, ‘নানুয়া দিঘির ঘটনার পরেই আমাদের পক্ষ থেকে বারবার পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলাম। সময়মতো যদি উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে মন্দিরগুলো রক্ষা পেত। মানুষের জানমালের ক্ষতি হতো না।’
যেভাবে হামলার শুরু
১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটার কিছু পরে নানুয়া দিঘির পাড় থেকে ওসি চলে যান। তিনি কোনো আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেননি। কিন্তু ফেসবুক লাইভের কারণে বিষয়টি তখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। সকাল ১০টার দিকে কিছু লোক জড়ো হয়ে নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে হামলা করে। সেটিতে সফল হয়ে তারা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে।
শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় চকবাজার। সেখানে অন্যতম বড় মন্দির চানমনি কালীবাড়ি। বেলা ১১টার দিকে এক দফা হামলার চেষ্টা হয় সেখানে। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধের মুখে সফল হতে পারেনি হামলাকারীরা। তবে বেলা ৩টার দিকে তারা আবার ফিরে আসে এবং মই দিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পূজামণ্ডপ জ্বালিয়ে দেয়। ওই মণ্ডপের সামনে কথা হয় কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে। নিরাপত্তার কারণে তাঁরা নাম বলতে চাননি। বলেন, ‘পুলিশকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হয়েছে। বারবারই তাঁরা বলেছেন, ব্যবস্থা নিচ্ছি, ফোর্স পাঠাচ্ছি। কিন্তু সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও তাঁরা আসেননি।’
ওই দিন সন্ধ্যার আগপর্যন্ত রাজগঞ্জ, বজ্রপুর সালাহউদ্দিনের মোড়সহ বেশ কিছু এলাকায় মন্দিরে হামলা হয়। সব জায়গায় সনাতন ধর্মের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় মুসলমানরাও মন্দির ও মণ্ডপ রক্ষায় সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদেরই একজন আরেফিন হক। কীভাবে ছোটবেলার বন্ধুদের ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তাঁর। আরিফ নিজেও আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো দিন এমন অসহায় চেহারা দেখিনি আমাদের পাড়ার হিন্দুদের। কোত্থেকে এরা আসল, মনে হচ্ছিল সব ভেঙেচুরে দেবে।’
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, ‘যদি দলীয় সিদ্ধান্তে আমরা সকাল থেকে মাঠে নামতে পারতাম, তাহলে হয়তো হামলা রোধ করা যেত। পরের দিন আমি রামঘাট থেকে নিজ উদ্যোগে সবাইকে নিয়ে শান্তির পদযাত্রা আয়োজন করি। সেখান থেকেই মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।’
কারা হামলা করল
১৩ অক্টোবর রাত থেকেই পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সতর্ক নজরদারি ছিল কুমিল্লায়। কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। চানমনি কালীবাড়ি, কাত্যায়নী কালীবাড়ি, আনন্দময়ী কালীবাড়ি, কালীগাছতলা মন্দিরসহ হামলার শিকার হওয়া মন্দিরগুলোতে গিয়ে সে কথাই জানা যায়। ওই এলাকার স্থানীয় কোনো মুসলমান হামলা করেনি। শহরের লাগোয়া এলাকা থেকে এসেছিল হামলাকারীরা। মিছিলের সামনের দিকে দু-একজন বয়স্ক লোক থাকলেও পেছনে ১২ থেকে শুরু করে ১৮-২০ বছরের কিশোর ও তরুণেরা।
গত বুধবারের হামলায় আহত হওয়া ব্যবসায়ী মিঠুন পাল জানান, কুমিল্লা শহরের পাশে মুরাদপুর নামের একটা এলাকা রয়েছে, সেখান থেকেই এসেছিল বেশির ভাগ ছেলেপিলে। তাদের হাত ছিল লাঠি আর বাঁশি। সামনে থাকা লোকজন নারায়ে তকবির বলে স্লোগান দিচ্ছিল।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিকভাবে ঘটনাটা মোকাবিলা করার আগে যদি প্রশাসন সংযুক্ত হয়ে যেত, তাহলে ঘটনা এত দূর গড়াত না। হামলার আগে জমায়েত হয়েছে। সেখানে নানা রাজনৈতিক মতের লোকজন ঢুকেছে। আগেই প্রশাসনের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা। সাধারণত মণ্ডপে দু-তিনজন করে আনসার থাকে। পুলিশ থাকে, এবার তাও চোখে পড়েনি। কেউ কোনো গুরুত্বই দেয়নি।
সময়মতো সাড়া না দেওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ কুমিল্লা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, যতটুকু সামর্থ্য ছিল সব দিয়েই চেষ্টা করেছেন তাঁরা। বলেন, ‘আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পটে চলে গেছি। ফোর্স হাতে যা ছিল, সবাইকে কাজে লাগিয়েছি। কিন্তু উত্তেজিত জনতার কারণে পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।’
মেয়র সাক্কুর ভাষায়, ‘তারা (প্রশাসন) আরেকটু কঠিন হইলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। অন্য মণ্ডপগুলো কী হলো, চকবাজার, ঠাকুরপাড়া, কাপুড়িয়াপট্টি—এসব মন্দিরে কেন হামলা হলো—প্রশাসনের লোক এর উত্তর দিক। উত্তর তাদের দিতে হবে।’
কুমিল্লা থেকে শুরু হওয়া ঘটনা ছড়িয়েছে পুরো দেশে। ভাঙচুর, সংঘর্ষ, হত্যা, মৃত্যু–কিছুই বাদ যায়নি। আগুন জ্বলেছে। সে আগুনে পুড়েছে বিশ্বাস। শত শত বছর ধরে নিশ্চিন্তে পাশের বাড়ির রহিম-করিমের সঙ্গে পাল-সাহা-ঘোষদের সম্পর্ক। তাহলে এই অবস্থাটা তৈরি করল কে?
প্রশ্ন হলো, ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন কুমিল্লায় যা ঘটেছে, তা কি নিয়ন্ত্রণ করা যেত না? কে বা কারা সেই কাণ্ডের সূত্রপাত করল? ঘটনার পর গ্রেপ্তার ও মামলা হলেও অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা তদন্তের অগ্রগতি মন্ত্রণালয়ে জানাচ্ছি।’ পুলিশ সুপার তাঁর দায়িত্বের জায়গা থেকে হয়তো ঠিকই বলছেন। কিন্তু দেশের মানুষ তো প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়?
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য, কুমিল্লা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকিয়া আফরিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুনানি চলছে। সাক্ষী অনেকেই কারাগারে থাকায় শুনানিতে সময় লাগছে। প্রতিবেদন জমা দিতে আমরা আরও ১৫ দিন সময় চেয়েছি।’ যদিও গত শুক্রবার জেলা প্রশাসন জানিয়েছিল, তিন কার্যদিবসে প্রতিবেদন দেবে কমিটি।
যা ঘটেছিল সেদিন
প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের যে বর্ণনা দিলেন, তাতে নানুয়া দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে কে পবিত্র কোরআন রেখেছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। দিঘির পশ্চিম পাড়ে তিন দশক ধরে বাস করেন ষাটোর্ধ্ব চৌধুরী হাসানুজ্জামান। ঘটনার পরদিন দুপুরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মণ্ডপের সামনেই আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, ‘পূজা এলেই এখানে মণ্ডপ হয়, স্থানীয় সবাই উৎসবমুখরভাবেই তাতে অংশ নেন।
গত দুই দশকে অন্তত এ বিষয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। আমরা বয়স্করা প্রতি সকালেই দিঘির পাড়ে হাঁটতে বের হই। ওই দিন বের হয়ে দেখি অনেক মানুষের জটলা। পবিত্র কোরআন পাওয়া নিয়ে সবাই কথা বলেছেন। কিন্তু কে রেখেছে, এ বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি। পরে তো অনেক লোক এসে এখানে হামলার জন্য জড়ো হয়েছে, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে অনেক।’
মণ্ডপের লাগোয়া নবনির্মিত বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ওই দিন সকালে প্রথম হনুমানের মূর্তির কোলে কোরআন শরিফ দেখেছিলেন দুজন হিন্দু নারী। তাঁদের কাছ থেকে জেনে জাতীয় হেল্প লাইন ৯৯৯-এ ফোন করেন রেজাউল করিম। যিনি নানুয়া দিঘির আশপাশেই থাকেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনওয়ারুল আজিম পৌঁছে যান সেখানে। উদ্ধার করেন কোরআন শরিফ। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। এরপরই মণ্ডপ ঘিরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরে এই মণ্ডপসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়।
নানুয়া দিঘির পাশেই বজ্রপুর এলাকায় থাকেন আকরাম উজ জামান চৌধুরী। এলাকায় সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ঘটনাস্থলেই সমাধান করে ফেলা যেত, যদি ফেসবুক লাইভটা না হতো। সেখানে পুরো বিষয়টি উসকানিমূলকভাবে প্রচার করা হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সামনে এক ব্যক্তি এভাবে ফেসবুক লাইভে ধর্মীয় বিষয় প্রচার করলেও তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
ঘটনার দিন নানুয়া দিঘির পাড়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তামূলকব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ কিংবা প্রশাসন। ওই মণ্ডপ থেকে মিনিট তিনেকের দূরত্বে কুমিল্লার মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বাসা। তিনিও এসেছিলেন অনেক পরে। ঘটনার পর তাঁর বাসায় গিয়ে ডাকাডাকিও করেন স্থানীয় লোকজন।
মেয়র সাক্কু বলেন, ‘আমি ঘটনা জানার পরেই চলে গেছি। ওসিসাব টেলিফোন করেছেন। বলেছি, আমাকে আধা ঘণ্টা সময় দেন। নয়টার মধ্যে ওখানে পৌঁছে গেছি আমি।’ মেয়র বলেন, ‘আমি যখন গেছি তখন ওখানে কেউ ছিল না। দেখি অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সবাই উত্তেজিত। ডিসি, ওসি কেউ ছিল না। সবার হাত ধরে বললাম, ‘আমি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছি, আপনারা চলে যান, সবকিছু ঠিক থাকবে। তিনটা পর্যন্ত ছিলাম। পরে প্রশাসনের লোকজন আসেন।’
স্থানীয় কোনো মানুষ ওখানে ভাঙচুর করেনি জানিয়ে মেয়র সাক্কু বলেন, ‘টোকাই গোছের একদল উচ্ছৃঙ্খল ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। কেউ কারও কথা শুনছিল না। পুলিশ ফাঁকা গুলি করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় ৭০ জনের মতো লোক স্পটে নিয়ে আসি।’ কাউকে চিনতে পেরেছিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নওয়াববাড়ি, তেইল্লা পুকুর পাড়, মুরাদপুর—এসব এলাকা থেকে লোকজন এসেছিল। শহরের কেউ না, ইউনিয়ন থেকে জমায়েত হয়ে তারা শহরে ঢুকেছে।
মহানগর পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস টিটু বলেন, ‘নানুয়া দিঘির ঘটনার পরেই আমাদের পক্ষ থেকে বারবার পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলাম। সময়মতো যদি উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে মন্দিরগুলো রক্ষা পেত। মানুষের জানমালের ক্ষতি হতো না।’
যেভাবে হামলার শুরু
১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটার কিছু পরে নানুয়া দিঘির পাড় থেকে ওসি চলে যান। তিনি কোনো আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেননি। কিন্তু ফেসবুক লাইভের কারণে বিষয়টি তখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। সকাল ১০টার দিকে কিছু লোক জড়ো হয়ে নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে হামলা করে। সেটিতে সফল হয়ে তারা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে।
শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় চকবাজার। সেখানে অন্যতম বড় মন্দির চানমনি কালীবাড়ি। বেলা ১১টার দিকে এক দফা হামলার চেষ্টা হয় সেখানে। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধের মুখে সফল হতে পারেনি হামলাকারীরা। তবে বেলা ৩টার দিকে তারা আবার ফিরে আসে এবং মই দিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পূজামণ্ডপ জ্বালিয়ে দেয়। ওই মণ্ডপের সামনে কথা হয় কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে। নিরাপত্তার কারণে তাঁরা নাম বলতে চাননি। বলেন, ‘পুলিশকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হয়েছে। বারবারই তাঁরা বলেছেন, ব্যবস্থা নিচ্ছি, ফোর্স পাঠাচ্ছি। কিন্তু সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও তাঁরা আসেননি।’
ওই দিন সন্ধ্যার আগপর্যন্ত রাজগঞ্জ, বজ্রপুর সালাহউদ্দিনের মোড়সহ বেশ কিছু এলাকায় মন্দিরে হামলা হয়। সব জায়গায় সনাতন ধর্মের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় মুসলমানরাও মন্দির ও মণ্ডপ রক্ষায় সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদেরই একজন আরেফিন হক। কীভাবে ছোটবেলার বন্ধুদের ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তাঁর। আরিফ নিজেও আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো দিন এমন অসহায় চেহারা দেখিনি আমাদের পাড়ার হিন্দুদের। কোত্থেকে এরা আসল, মনে হচ্ছিল সব ভেঙেচুরে দেবে।’
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, ‘যদি দলীয় সিদ্ধান্তে আমরা সকাল থেকে মাঠে নামতে পারতাম, তাহলে হয়তো হামলা রোধ করা যেত। পরের দিন আমি রামঘাট থেকে নিজ উদ্যোগে সবাইকে নিয়ে শান্তির পদযাত্রা আয়োজন করি। সেখান থেকেই মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।’
কারা হামলা করল
১৩ অক্টোবর রাত থেকেই পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সতর্ক নজরদারি ছিল কুমিল্লায়। কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। চানমনি কালীবাড়ি, কাত্যায়নী কালীবাড়ি, আনন্দময়ী কালীবাড়ি, কালীগাছতলা মন্দিরসহ হামলার শিকার হওয়া মন্দিরগুলোতে গিয়ে সে কথাই জানা যায়। ওই এলাকার স্থানীয় কোনো মুসলমান হামলা করেনি। শহরের লাগোয়া এলাকা থেকে এসেছিল হামলাকারীরা। মিছিলের সামনের দিকে দু-একজন বয়স্ক লোক থাকলেও পেছনে ১২ থেকে শুরু করে ১৮-২০ বছরের কিশোর ও তরুণেরা।
গত বুধবারের হামলায় আহত হওয়া ব্যবসায়ী মিঠুন পাল জানান, কুমিল্লা শহরের পাশে মুরাদপুর নামের একটা এলাকা রয়েছে, সেখান থেকেই এসেছিল বেশির ভাগ ছেলেপিলে। তাদের হাত ছিল লাঠি আর বাঁশি। সামনে থাকা লোকজন নারায়ে তকবির বলে স্লোগান দিচ্ছিল।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিকভাবে ঘটনাটা মোকাবিলা করার আগে যদি প্রশাসন সংযুক্ত হয়ে যেত, তাহলে ঘটনা এত দূর গড়াত না। হামলার আগে জমায়েত হয়েছে। সেখানে নানা রাজনৈতিক মতের লোকজন ঢুকেছে। আগেই প্রশাসনের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা। সাধারণত মণ্ডপে দু-তিনজন করে আনসার থাকে। পুলিশ থাকে, এবার তাও চোখে পড়েনি। কেউ কোনো গুরুত্বই দেয়নি।
সময়মতো সাড়া না দেওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ কুমিল্লা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, যতটুকু সামর্থ্য ছিল সব দিয়েই চেষ্টা করেছেন তাঁরা। বলেন, ‘আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পটে চলে গেছি। ফোর্স হাতে যা ছিল, সবাইকে কাজে লাগিয়েছি। কিন্তু উত্তেজিত জনতার কারণে পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।’
মেয়র সাক্কুর ভাষায়, ‘তারা (প্রশাসন) আরেকটু কঠিন হইলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। অন্য মণ্ডপগুলো কী হলো, চকবাজার, ঠাকুরপাড়া, কাপুড়িয়াপট্টি—এসব মন্দিরে কেন হামলা হলো—প্রশাসনের লোক এর উত্তর দিক। উত্তর তাদের দিতে হবে।’
শেরপুরের মুর্শিদপুর দরবার শরীফে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আহত হাফেজ উদ্দিন (৩৯) নামে একজন মারা গেছেন। আজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
২৫ মিনিট আগেচট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার বিচারের দাবিতে এবং সারাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি-উন্মাদনা-হামলা রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। আজ বুধবার বিকেলে বাসদ সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে নগরের আম্বরখানার দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
৪০ মিনিট আগেচট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের গাড়িবহরের একটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে একটি ট্রাক। ওই বহরে থাকা চট্টগ্রামের আরেক সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি অভিযোগ করেছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা।
১ ঘণ্টা আগেআওয়ামী সমর্থক অপবাদ দিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় কামাল হোসেন চৌকিদার (৪৬) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার উপজেলার চড়কগাছিয়া গ্রামের সাপলেজা মাছ বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
১ ঘণ্টা আগে