গান গেয়েই সংসার চলে আমির হোসেনের

হাতিয়া (নোয়াখালী) ইসমাইল হোসেন কিরন
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫: ৫২

শিল্পী হিসেবে নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। গানের সময় প্রয়োজন হয় না বাদ্যযন্ত্রের। নিজেই গান রচনা করে পরিবেশন করেন। পথে, ঘাটে, হাঁটে যে কারও অনুরোধে গান গেয়ে শোনান। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাঁর গান ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেছেন হাতিয়ার বুড়িরচর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র শিল্পী আমির হোসেন। 

আমির হোসেন বলেন, 'প্রতিদিনই অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। পরিবারে মা নেই। বৃদ্ধ পিতা ও চার সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে চলছে সংসার। নিজের মনের কষ্ট দূর করতেই মূলত গান গাওয়া।' 

এলাকা সূত্রে জানা যায়, দুই বার নদীগর্ভে বিলীন হয় আমির হোসেনের বাড়ি। ছয় বছর আগে এক একর জায়গা নিয়ে বসতি শুরু করেন হাতিয়ার চানন্দী ইউনিয়নের কেরিংচরে। অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে পুনরায় বসতি স্থাপন করেন একই এলাকার জয়ের বাজারের কাছে। দুই বছর পর তাও মেঘনায় বিলীন হয়। 

বর্তমানে তিনি হাতিয়ার বুড়িরচর ইউনিয়নের জোড়খালী গ্রামে বসবাস করছেন। নদী ভাঙনের ফলে সহায় সম্বল হারিয়ে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। নিজের অবস্থার সঙ্গে আরও অনেকের দুরবস্থা দেখে রচনা করেন নদী ভাঙন নিয়ে গান। নদী ভাঙন নিয়ে তাঁর গান এখন হাতিয়ার অনেক মানুষের মুখে মুখে।

মূলত সাত সদস্যের পরিবারের প্রধান আমির হোসেন। তিনি পেশায় দিন মজুর। সারা দিন বিভিন্ন জনের খেতে কাজ করে যে টাকা পান তাতে মোটেও সংসার চালানো যায় না। এ জন্য বিকেলের পরে অবসর সময়টুকু বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে বাড়তি উপার্জন করেন। তাতেও চলে না তাঁর সংসার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেকটা অনাহারে অর্ধাহারে কাটে দিনকাল।

সম্প্রতি আমির হোসেনের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর বাড়িতে। সংবাদকর্মীদের দেখে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দুটি চেয়ার এনে বসতে দেন। পাশেই দেখা যায় তাঁর জরাজীর্ণ কুড়ে ঘর। ঘরের অধিকাংশ জোড়া তালি দিয়ে তৈরি করা। ওপরে চালের একপাশে কিছু টিন থাকলেও আরেক পাশে ত্রিপাল দিয়ে বৃষ্টির পানি থেকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ঘরে একটি মাত্র চৌকি, তাতে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েসহ ছয়জনকে ঘুমাতে হয়। ঘরে অতিরিক্ত জায়গা না থাকায় বাবাকে ঘুমাতে হয় প্রতিবেশীদের ঘরে।

আমির হোসেনের মেয়ে আমেনা (১২) স্থানীয় আসাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবার বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলে, 'বাবার উপার্জনে চলে সংসার। মাঝে মাঝে না খেয়ে যেতে হয় স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়লেও সরকারি উপবৃত্তি পায় না সে। কারণ তাঁর জন্ম নিবন্ধন কার্ড নেই।'

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়নের নির্বাচনে গান পরিবেশন করছেন শিল্পী আমির হোসেনআমির হোসেনের বৃদ্ধ বাবা গোলাম মাওলা বলেন, 'অভাবের সংসারে প্রতি বেলায় খাবার জোটে না। বসত ঘরের অনেক জায়গা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। অর্থের অভাবে মেরামত করতে পারছি না। সরকারিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন সাহায্য সহযোগিতাও পাচ্ছি না।'

এ বিষয়ে জোড়খালী গ্রামের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য লিটন চৌধুরী বলেন, 'গ্রামের লোকজন আমির হোসেনকে চিনে ভান্ডারি হিসেবে। তাঁর গান অনেকের ভালো লাগে। তাই সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান হলে যেতে হয় আমির হোসেনকে। নিজের সঙ্গে নিয়ে যান একটি খালি কলসি। সেখানে কলসির তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান করেন।'

লিটন চৌধুরী আরও বলেন, 'অন্যের জায়গায় বসতি করে থাকতে হয় আমির হোসেনকে। নির্বাচনের পরে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম শুরু হলে তাঁকে একটি ঘর তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করব।' 

এলাকা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি শেষ হয়েছে হাতিয়ায় সাতটি ইউনিয়নের নির্বাচন। নির্বাচনে আমির হোসেনের চাহিদা ভালো ছিল। বিভিন্ন প্রার্থীর হয়ে গান পরিবেশন করেন তিনি। এতে ১৫ দিনে গান পরিবেশন করে তিনি প্রায় ২০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলেও কণ্ঠ সুমধুর থাকায় এরই মধ্যে অনেকের মন কেড়েছেন এই শিল্পী। 

এ বিষয়ে হাতিয়া বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, 'সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় বাদ্যযন্ত্র ছাড়া বিভিন্ন বাজারের চায়ের দোকানে বসে গান পরিবেশন করছেন আমির হোসেন। আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়া তাঁর অনেক গান দেখেছি। তিনি যেভাবে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে গান রচনা ও পরিবেশন করেন তা অসাধারণ। আমি মনে করি ভালো তালিম পেলে গানে আরও ভালো করবে আমির হোসেন।'

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, 'গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিল্পী আমির হোসেনের প্রতিভার কথা আমি শুনেছি। তাঁর প্রতিভা কাজে লাগানোর জন্য আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা করব।'     

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত