Ajker Patrika

লিবিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ ২৪ বাংলাদেশি, সন্ধান চেয়ে শরীয়তপুরে স্বজনদের অনশন

শরীয়তপুর প্রতিনিধি
শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা
শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা

শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার ২৪ যুবক দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে এক বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে লিবিয়ায় গিয়ে তাঁরা নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তাঁদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। কয়েক দফায় প্রত্যেক পরিবার দালালদের ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার পরেও এখনো পর্যন্ত তাঁদের কোনো হদিস পাচ্ছে না পরিবার।

নিরুপায় হয়ে এবার দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে আমরণ অনশনে বসেছেন নিখোঁজ ২৪ পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা।

গতকাল শনিবার সকাল থেকে তাঁরা শরীয়তপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে অনশনে বসেন। আজ রোববার বেলা ২টা পর্যন্ত তাঁদের অনশন করতে দেখা গেছে।

এরই মধ্যে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে করা মামলায় রাশেদ খান নামে দালাল চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সূর্যমণি এলাকার সাইফুলের বাবা ফারুক পেদার দায়ের করা মামলায় রাশেদ খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল তাঁকে শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পরে আদালতের জ্যেষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেট মরিয়ম আক্তার নিপা তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

পুলিশ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা জানান, শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারীয়া ইউনিয়নের চরযাদবপুর গ্রামের রাশেদ খান ও তাঁর ভাইয়েরা বিভিন্ন দেশে জনশক্তি পাঠানোর কাজ করেন। রাশেদ খান তাঁর ভাই ও সহযোগীর মাধ্যমে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে পাঠান।

২০২২-২৩ সালে শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া, দক্ষিণ ভাষানচর, নতুন হাট, চর নেয়ামতপুর, চর ভাষানচর, চাপাতলী, চরচাটাং মাদারীপুর সদরের জাগীর, জাফরাবাদ, ত্রিভাগাদি, কালকিনির সূর্যমণি এলাকার ২৪ যুবক ও তরুণকে অবৈধ পথে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠানোর জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, তারপর মিসর হয়ে লিবিয়া পাঠানো হয়। এর পর থেকে তাঁরা নিখোঁজ আছেন।

ওই ২৪ তরুণ-যুবকের পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্রটি।

গত বছরের ২২ মার্চ থেকে ওই ২৪ জন পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করছেন না বলে দাবি করেছেন স্বজনেরা। এখন তাঁরা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, তা-ও জানেন না পরিবারের লোকজন।

রাশেদ খান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের আদালত ও সদরের পালং মডেল থানায় ১১টি মামলা করেছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের স্বজনেরা। এসব মামলা করার পর পুলিশ রাশেদ খান ও তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তারের জন্য তৎপর হয়। শুক্রবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাশেদ খানকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল দুপুরে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা
শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাশেদের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে নিখোঁজ ২৪ তরুণ-যুবকের স্বজনেরা শরীয়তপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে ব্যানার টাঙিয়ে অনশনে বসেন। বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও তাঁদের শিশুসন্তানদের অনশনে দেখা যায়। এ সময় স্বজন হারানোর বেদনায় আদালত চত্বরে বুকফাটা আর্তচিৎকার ও গড়াগড়ি খেতে দেখা গেছে স্বজনদের।

অনশনে যোগ দিয়ে আদালত চত্বরে মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্না করছিলেন রিয়াজ আকন। তাঁর ছোট ভাই দিদার হোসেন ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন। রিয়াজ বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পরিবারের অভাব দূর করার জন্য জমি ও গরু বিক্রি করে ছোট ভাইকে ইতালি পাঠানোর জন্য দালাল রাশেদকে ২০ লাখ টাকা দিই। কিন্তু দালাল রাশেদ আমার ভাইকে লিবিয়া নিয়ে অবৈধ পথে সমুদ্র দিয়ে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এক বছর ধরে ভাইয়ের সন্ধান পাচ্ছি না। সে বেঁচে আছে, না মরে গেছে কিছুই বলতে পারছি না। আমরা স্বজনদের সন্ধান চাই। আর রাশেদসহ দালাল চক্রের সবার শাস্তি চাই।’

এ সময় আদালত চত্বরে নিখোঁজ শাহীন শিকদারের মা রুমা বেগম, ফারুক হোসেনের মা মাহফুজা বেগম, সরদার সাকেবুলের মা শিয়িয়া বেগম, শামীম কাজীর মা সাথী বেগম, আতিকুর রহমানের বোন আফরোজা আক্তার, রফিক মোড়লের মা রহিমা বেগম, আমিনুল ইসলামের মা কমলা বেগম, দিপু শিকদারের বাবা ইউনুস শিকদারসহ অনেকের বুকফাটা আর্তচিৎকার ও গড়াগড়িতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা
শরীয়তপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে লিবিয়ায় নিখোঁজদের স্বজনদের অনশন। ছবি: আজকের পত্রিকা

নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ-মধ্যপাড়া গ্রামের চুন্নু ভূঁইয়ার ছেলে আল-আমিন ভূঁইয়া, দক্ষিণ ভাষানচর গ্রামের সালাম আকনের ছেলে দিদার হোসেন আকন, চর নেয়ামতপুর গ্রামের সলিম জমাদ্দারের ছেলে রাশিদুল জমাদ্দার, চর নেয়ামতপুর গ্রামের বোরহান মৃধার ছেলে সিরাজ মৃধা, দক্ষিণ ভাষানচর গ্রামের ইদ্রিস আলী খানের ছেলে আমিনুল ইসলাম, চরচটাং গ্রামের আব্দুল মান্নান ওঝার ছেলে মিরাজ ওঝা, দক্ষিণ ভাষানচর গ্রামের সুফিয়ান সরদারের ছেলে মো. ফারুক সরদার, দড়িচর দাদপুর গ্রামের হাতেম শেখের ছেলে জাফর শেখ, কদমতলী গ্রামের সালমান শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার, চরচটাং গ্রামের জাহাঙ্গীর মোড়লের ছেলে রফিক মোড়ল, চর নেয়ামতপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান খানের ছেলে আতিকুর রহমান খান, চরচটাং গ্রামের ইকবাল কাজীর ছেলে শামীম কাজী, চর যাদবপুর গ্রামের সিরাজ মোল্লার ছেলে সাঈদ মোল্লা, মানিক ফরাজির ছেলে শহিদুল ফরাজি, পালং এলাকার আল আমিন ফকির, মাদারীপুরের খালেক মোল্লার ছেলে রিমন মোল্লা, শাহ আলম সরদারের ছেলে সরদার সাকেবুল, শাজাহান খানের ছেলে পারভেজ খান, ইউনুস শিকদারের ছেলে দিপু শিকদার, ফারুক পেদার ছেলে সাইফুল পেদা, সিয়াম হাওলাদার, আব্দুল ব্যাপারীর ছেলে নাহিদ ব্যাপারী ও হাবিব ব্যাপারীর ছেলে নাঈম ব্যাপারী, শাজাহান হাওলাদার ও সিয়াম হাওলাদার।

জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারের ৫৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি মামলা তদন্ত করছে জেলা পুলিশ, সিআইডিতে তদন্তাধীন রয়েছে ২০টি মামলা।

এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা ২৬০। এর মধ্যে ২৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে এবং দুটি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রাশেদ খান নামে মানব পাচারকারী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গতকাল আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিড়াল মনিবকে কেন মৃত প্রাণী ‘উপহার’ দেয়

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

বৃষ্টি অপেক্ষায় রেখেছে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়েকে

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

শেখ হাসিনার সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রত্যাহার করতে পারে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত