ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে আশুলিয়ার অর্ধশতাধিক গার্মেন্টস কারখানা ছুটি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও সাভার প্রতিনিধি (ঢাকা)
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬: ৫৭
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮: ১২

দেশের গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে অসন্তোষ থামছে না। গতকালের ধারাবাহিকতায় আজ বুধবারও ঢাকার সাভারের আশুলিয়া এলাকার শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবিতে কাজ বন্ধ রেখে সড়কে নেমেছেন। বিক্ষোভের মুখে আজ অর্ধশতাধিক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

শিল্প পুলিশ ও কারখানা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ বুধবার সকালে শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে কাজ শুরু করেন। সকাল ৮টার দিকে বিভিন্ন কারখানার মূল ফটকে বহিরাগত শ্রমিকেরা ঢিল ছুড়তে থাকেন। এ অবস্থায় মালিকপক্ষ একের পর এক কারখানায় ছুটি ঘোষণা দিতে থাকে। সকাল ৯টার মধ্যে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়ক এবং জিরাব-বিশমাইল সড়কের আশপাশের অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানা ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ৮টার দিকে ৩০-৩৫ জন দুষ্কৃতিকারী জামগড়া এলাকার ফ্যাশনইট সোয়েটার কারখানার গেট ও ভবন লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ে। তখন কর্তৃপক্ষ কারখানাটি ছুটি ঘোষণা করে। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি কারখানার গেটে গিয়ে ঢিল ছুড়লে গোলযোগের আশঙ্কায় সেসব কারখানাও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। 

মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক কারখানার শ্রমিকেরা কর্মস্থলে উপস্থিত হলেও বিভিন্ন দাবিতে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। সেসব কারখানাও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। পরে কারখানা থেকে বের হয়ে তাঁরা যেসব কারখানায় কাজ চলছিল, সেসব কারখানায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। 

শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আজ আশুলিয়ার ফ্যাশন ফোরাম গার্মেন্টস লিমিটেড, প্রীতি গ্রুপ, এফএনএফ ট্রেন্ড ফ্যাশন লিমিটেড, দি রোজ, ফ্যাশন ইট সোয়েটার লিমিটেড, এনভয় গ্রুপ, স্টারলিং গ্রুপ, বানদু ডিজাইন, প্লাটিনাম ক্রিয়েশন ডিজাইন লিমিটেড, হামীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, অরুণিমা স্পোর্টস ওয়্যার লিমিটেড, জে এল সোয়েটার লিমিটেড, মাসকট গ্রুপ, আইরিশ সোয়েটার লিমিটেড, রেডিয়্যান্স নিট ওয়্যার লিমিটেড, সাউদার্ন গার্মেন্টস লিমিটেড, অ্যালায়েন্স নিট কম্পোজিট লিমিটেড, এসএস ডি অ্যাপারেলস লিমিটেড, ইউনিওয়ার্ল্ড ফুট ওয়্যার লিমিটেড, সাউদার্ন ডিজাইন লিমিটেড, এশিয়া সোর্স লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আগামী অ্যাপারেলস লিমিটেড, এআর জিনস প্রোডিউসার লিমিটেড, অনন্ত গার্মেন্টস, ট্রাউজার লাইনসহ অর্ধ শতাধিক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারখানার মালিক বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বন্ধ ঘোষণা করা কারখানার শ্রমিকেরা চালু থাকা বিভিন্ন কারখানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তাঁরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশীরাও যোগ দেন। পরে সহিংসতা এড়াতে আমরা কারখানা ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হই।’

ছুটি ঘোষণার পর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল ও জিরাব-বিশমাইল সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে সেনাবাহিনী ও শিল্পপুলিশের সদস্যরা তাঁদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেন। 

আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছেই। ছবি: আজকের পত্রিকাজামগড়া এলাকার দি রোজ ড্রেসেস লিমিটেড কারখানার জেনারেল ম্যানেজার সাধন বাবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকেরা সকালে কাজ শুরু করেছিল। সকাল ৮টার পর আশপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা আমাদের কারখানার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। হামলার আশঙ্কায় আগেই আমরা ছুটি দিয়ে দিই।’ 

সাধন বাবু আরও বলেন, ‘আশপাশের কারখানা থেকে শ্রমিকেরা বের হয়ে এলেও শিল্প পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যকে আমাদের কারখানার সামনে দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু রাখা অনিরাপদ।’ 

‘বহিরাগতদের হামলার’ কারণে কাজ শুরুর আধা ঘণ্টা পর কারখানায় ছুটি দিতে বাধ্য হয় আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকার শারমিন গ্রুপ। এসময় কারখানাটির সামনে থাকা দুটি মিনিবাস ভাঙচুর করা হয়। 

শারমিন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘নাসা গ্রুপ, আল মুসলিম ও নিউ এইজ গার্মেন্টস বন্ধ ছিল। ওরা আজ খুলে দেয়। বাইরের কিছু লোক এসে কারখানা ভাঙচুর করলে কারখানাগুলো ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের শ্রমিকেরা তো কাজ করছিল। বাইরে থেকে এসে যদি আক্রমণ করে, তাহলে শ্রমিকদের সেফটি কীভাবে দেব? এ জন্য আমরা তাদের ছেড়ে দিই।’ 

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘শ্রমিকদের দাবি, পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে নারী-পুরুষের সমতা আনতে হবে। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রডাকশনের চাপ কমাতে হবে। এছাড়া ছুটি ঠিকমতো দিতে হবে। শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করা যাবে না। হাজিরা বোনাস বাড়াতে হবে। এরকম অনেক দাবি করে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা।’ 

বর্তমান অসন্তোষে শ্রমিক সংগঠনের কোনো ভূমিকা আছে কিনা জানতে চাইলে খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘এই আন্দোলনে শ্রমিক সংগঠনের তেমন কোন ভূমিকা নেই। কারণ শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা যে দাবি করেছি তা ছিল বেতন বৃদ্ধি, রেশনিং চালু ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকে এই দাবিগুলো আসেনি। শ্রমিকেরা মূলত তাদের কারখানার ভেতরের সমস্যা সমাধানের দাবি জানাইছে। তাই শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকা নেই। তবে শ্রমিক নেতারা ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলনের সময় শ্রমিকেরা বলছে যে তাদের শ্রমিক নেতার দরকার নাই। তাই এই সমস্যা মেটানোর জন্য আলাপ-আলোচনা কিংবা নেগোসিয়েশনের জন্য শ্রমিক নেতারা তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না।’

অস্থিরতা কারণ জানতে চাইলে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘কারখানার মালিকানা বা বিজিএমইএর নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এখানে ভূমিকা রাখছে। আওয়ামী লীগের আমলে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ যাদের কাছে ছিল, এখন সেখান থেকে হাতবদল হওয়ার ব্যাপারটাও একটা ভূমিকা রাখছে। একটা শ্রেণি আছে যখন এমন কোনো বিক্ষোভ হয়, তখন তারা কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট করে, তারাও আছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ কিংবা শিল্প পুলিশ যে মীমাংসা বা নেগোসিয়েশন করে, এবার সে ব্যাপারটাও তেমন চোখে পড়েনি। শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তেমন চোখে পড়েনি। আমার মনে হয়, শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে ব্যাপারগুলো দ্রুত সমাধান করা উচিত।’ 

শিল্প পুলিশ-১ (আশুলিয়া) এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘আজ বুধবার নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকেরা কারখানায় উপস্থিত হন। পরে বিভিন্ন বিভিন্ন দাবিতে তাঁরা কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় অর্ধশতাধিক কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’

সমস্যা নিরসনে শিল্প পুলিশ আগের মতো কাজ করতে পারছে কিনা জানতে চাইলে শিল্প পুলিশ-১-এর (আশুলিয়া) পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘মালিকেরা এখন কথা শুনছেন না, শ্রমিকেরাও শুনছেন না। এখন তো একটা পরিবর্তিত অবস্থা। তারা আমাদের কো-অপারেট করছে না।’

যৌথ অভিযানের কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যৌথ অভিযানের আমরা একটা অংশ, কিন্তু আমরা তো মুখপাত্র না। ওইটা কিন্তু মূলত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য। আমরা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। তবে আমরা সহযোগী হিসেবে তাদের সঙ্গে আছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত