শিমুলের পথ শুরু থেকে খুনে-খুনেই রাঙা

কাজী শামিম আহমেদ, খুলনা
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৪, ১০: ১৫

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একসময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল চরমপন্থার রাজনীতি। সেই দিন আর এখন নেই, পরিস্থিতি প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সেকালে পারিবারিক আবহে পড়ে এই ভুলের পথে নেমেছিলেন শিমুল বিশ্বাস। আর ফিরতে পারেননি। দুই খুনের মামলায় ২০ বছরের মতো জেল খেটেছেন। এর বাইরেও কয়েকজন চেয়ারম্যানসহ অনেক খুনের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

দক্ষিণের এই মূর্তিমান আতঙ্ক শিমুল ভূঁইয়ার নাম আবার আলোচনায় এসেছে ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর। আমানউল্লাহ নামেই পুলিশ তাঁকে গণমাধ্যমের কাছে হাজির করেছে। এটা তাঁর ছদ্মনাম। এমন নাম আরও আছে।

পুলিশের হাতে শিমুল ছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁর স্ত্রী সাবিনা মুক্তা এবং ভাইপো তানভীর ভূঁইয়া। এরপরই এই পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যশোর সদর, অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, বিস্ফোরকসহ মোট ৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে।

পারিবারিক আবহেই শিমুল ভূঁইয়ার উত্থান
চাচা প্রয়াত হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ নেতা। ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, খুলনার বিএল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় শিমুল প্রথমে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর রাজনীতি করতেন। তাঁর ছোট ভগ্নিপতি ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির অন্যতম রূপকার ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) নেতা এবং ভাগ হয়ে যাওয়া জনযুদ্ধের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক নেতা মোফাখ্খারুল ইসলাম। তাঁর হাত ধরেই তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালে যশোরের অভয়নগর থানা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী গণেশকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে আলোচনায় আসেন শিমুল ভূঁইয়া। এ মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। ২০০২ সালে তিনি ইমান আলী নামে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেন। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে মোফাখ্খারুল ইসলামের নির্দেশে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) ভেঙে দিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল জনযুদ্ধ) আত্মপ্রকাশ করে। তখন জনযুদ্ধের বিভাগীয় সামরিক শাখার দায়িত্ব পান শিমুল ভূঁইয়া। তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড করা হয় ঝিনাইদহ সদরের বিষয়খালী গ্রামের আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনকে। সংগঠনটি হত্যা ও চাঁদাবাজি করে দায় স্বীকার করার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। একই বছর ২৫ আগস্ট খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইমামকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শিমুল ভূঁইয়া ও দাদা তপনের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

একই পরিবারের তিন চেয়ারম্যান খুন
খুলনার ফুলতলায় উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ভূঁইয়া পরিবারের সঙ্গে সরদার পরিবারের বিরোধ প্রায় তিন যুগ ধরে। আধিপত্যের কারণে ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট হত্যা করা হয় উপজেলার দামোদর ইউপির চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা সরদার আবুল কাশেমকে। অভিযোগ আছে, সেদিন দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে বসে থাকা অবস্থায় শিমুল তাঁর ক্যাডার বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে চেয়ারম্যানের মাথায় গুলি করেন। এরপর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তাঁরই বড় ছেলে সরদার আবু সাঈদ বাদল। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার ঘটনায়ও শিমুল ভূঁইয়া সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ আছে। এ দুটি হত্যা মামলার বাদী ছিলেন সরদার আবুল কাশেমের ছোট ছেলে সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। তিনি বিপুল ভোটে ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৬ মে রাতে নিজ অফিসে বসে থাকা অবস্থায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্তে নেপথ্যে শিমুল ভূঁইয়ার ছোট ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান শরিফ মো. শিপলু ভূঁইয়ার নাম আসে।

শিমুলের বিরুদ্ধে ৮ মামলার রেকর্ড
ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যশোর সদর, অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় এ পর্যন্ত ৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা এবং চাঁদাবাজি, অপহরণ ও বিস্ফোরক আইনে মামলা রয়েছে। এ ছাড়া আরও মামলা আছে কি না তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

খুলনার পুলিশ সুপার সাঈদুর রহমান বলেন, ‘শিমুল ভূঁইয়ার গ্রেপ্তারের বিষয়ে আমাদের জানা নেই।’

শিমুল ভূঁইয়ার ‘ফুফাতো ভাই’ পলাতক শাহিন
ফুলতলার দামোদর গ্রামের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুলিশের কাছে চিহ্নিত পলাতক মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন সম্পর্কে শিমুল ভূঁইয়ার ফুফাতো ভাই। তবে পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

বহুরূপী শিমুল ভূঁইয়া
সৈয়দ আমানুল্লাহ, আমানুল্লাহ সাঈদ, শিহাব, ফজল মোল্লা, ফজলসহ বিভিন্ন ছদ্মনাম রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর তালাবদ্ধ। ছোট ভাই শিপলু ভূঁইয়ার বাড়িতেও কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। পাশের আরেকটি বাড়িতে বাস করেন বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভূঁইয়া। লাকি ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়াও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। লাকি ভূঁইয়ার বাড়িটিও তালাবদ্ধ। জানালার কপাট খোলা থাকলেও ঘরের মধ্যে কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। তাঁরা কোথায় গেছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি প্রতিবেশীরা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত