সারা দিন ধরে টিপটিপ বৃষ্টি। সন্ধ্যা নামতেই চারপাশ অন্ধকার। ১৬ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় একটি লেগুনা প্রবেশ করল। ভেতরে কালো কাপড়ে ঢাকা একটি মরদেহ। শরীরের শেষ অংশ দড়ি দিয়ে বাঁধা। পা দুটো বাইরে ঝুলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অপঘাতে মৃত্যু।

মরদেহ বহনকারী লেগুনাচালক মানিক মিয়াকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘থানা আর আগের মতো নাই। বদলে গেছে। অনেক দিন পর লাশ টানলাম। প্রদীপ স্যার থাকতে প্রায় প্রতি রাতেই লাশ টানতে হতো। বন্দুকযুদ্ধে আহত-নিহতদের হাসপাতালে আনা-নেওয়া করতাম। এখন এসব নেই।’

মানিকের সঙ্গে সুর মেলালেন টেকনাফ থানায় দায়িত্বরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানও। থানার ৩৬তম এই কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বললেন, টেকনাফ থানা আসলেই বদলে গেছে। পুলিশ সম্পর্কে এলাকায় বসবাস করা মানুষের যে আতঙ্ক বা ভীতি ছিল, সেটি দূর করতেই কাজ করা হচ্ছে। সবার সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। থানা-পুলিশ এখন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

গত বছর ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় পাঁচ দিন পর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে টেকনাফ থানা নিয়ে ভয়াবহ সব তথ্য। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৮ সালে এই থানাতে যোগ দেওয়ার পর, মাদক নির্মূলের অজুহাতে পুরো উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার করে ত্রাস সৃষ্টি করেন তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বহু লোক মারাও যায়।

সিনহাতেই শেষ হয় থানা-পুলিশের সেই জুলুম, অত্যাচার। বদলাতে থাকে টেকনাফ থানা-পুলিশ। ওসি প্রদীপ বরখাস্ত হওয়ার পর তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নেন আবুল ফয়সাল। ১৬ দিনের মাথায় আবুল ফয়সালকেও বদলি করা হয়। তার পর থেকে ৪০ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে মাদকের উৎসভূমি হিসেবে পরিচিত এই থানায় কাজে আসেন হাফিজুর রহমান।

বর্তমানে থানার পরিস্থিতি নিয়ে হাফিজুর রহমান বলেন, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই টেকনাফকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় অপরাধ মাদক চোরাচালান। তা ছাড়া, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী নির্যাতনের ঘটনাও আছে। এলাকায় পুরোনো কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী আবার নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। পুলিশ চিহ্নিত মাদক কারবারিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে।

সরেজমিনে এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানুষ এখন চাইলেই থানায় যেতে পারেন, সমস্যার কথা বলতে পারেন। থানার সামনে বসা মুদির দোকানদার শাহজাহান আলী বলেন, একটা সময় ছিল মানুষ থানার এই গেট দিয়ে ঢুকতেই ভয় পেত। থানায় সেবা পাওয়ার অধিকার সবার থাকলেও ভেতরে যাওয়ার অধিকার সবার ছিল না।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর অবশ্য বলছেন, সাবেক ওসি প্রদীপের সময় যেসব দালালের থানায় ঘরবাড়ি ছিল, দীর্ঘ বিরতির পর তাঁরা আবার থানায় যাতায়াত শুরু করেছেন। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা যদি তাঁদের বিষয়ে সতর্ক না হন, সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

 ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই সময় থেকে গতকাল পর্যন্ত চারজন নারীসহ কক্সবাজার জেলায় ২৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই নারীসহ ১১২ জন রোহিঙ্গা। শুধু টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬৮ জন।

এই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল টেকনাফ থানার বিরুদ্ধে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সিনহা হত্যার পর গত এক বছরে টেকনাফ থানাকেন্দ্রিক বন্দুকযুদ্ধ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। পুলিশের দাবি, গত এক বছরে মাত্র একজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, যেকোনো সময়ের চেয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। টেকনাফের চিত্রও বদলে গেছে।