Ajker Patrika

প্রথমে অনলাইনে, বাকি সব ঘুষে

  • দালালের শরণাপন্ন না হলে পড়ে থাকে ফাইল, দায়িত্ব দিলেই কাজ হয় নিমেষে ।
  • নামজারির সরকারি ফি ১১৭০ টাকা , কিন্তু আগে লাগত ৪ হাজার , এখন লাগে ৮ হাজার ।
  • নতুন কর্মকর্তা এলেই বাড়ে ঘুষের পরিমাণ ।
  • ১২ টি ইউনিয়নের দুই ভাগে ঘুষ বণ্টন ।
মো. সেলিম হায়দার, তালা (সাতক্ষীরা) 
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৫২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে পদে পদে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নামজারি, নাম সংশোধনসহ ভূমি-সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানে পকেট কাটা হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। এই ঘুষ-বাণিজ্যের হোতা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মিরাজ হোসেন, সায়রাত সহকারী আব্দুল হাই ও নাজির তপন কুমার সরদার।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে প্রতিনিয়ত সেবাপ্রার্থীদের পকেট কাটছে এই চক্রটি। ঘুষের টাকা হাতানোর জন্য চক্রটি একটি দালাল সিন্ডিকেট গঠন করেছে। এসব দালালের মাধ্যমে তাঁরা ঘুষের টাকা গ্রহণ করেন। দালালদের শরণাপন্ন না হলে মাসের পর মাস ফাইল পড়ে থাকে, আর দালালদের দায়িত্ব দিলে কাজ হয় নিমেষেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো জমির নামজারি করতে হলে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর শুরু হয় ঘুষ-বাণিজ্য। আবেদনের পর ইউনিয়ন সহকারী ভূমি অফিস থেকে প্রত্যয়ন নিতে হলে দিতে হয় ঘুষ, এরপর সার্ভেয়ারের প্রত্যয়নেও লাগে ঘুষ। এদিকে বর্তমান সায়রাত সহকারী ও নাজির যোগদান করার পর ঘুষের ফর্মুলারও পরিবর্তন হয়েছে। তাঁরা দুজনে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন দুই টেবিলে ভাগ করে নিয়েছেন। সে অনুযায়ী ঘুষের টাকা জমা হয় বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, নাজির তপন কুমার সরদার সেবাপ্রত্যাশীদের কক্ষের বাইরে বসিয়ে রেখে দরজা আটকে অতিথিদের আপ্যায়ন করছেন। আর সেবাপ্রত্যাশীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ সময় সেবাপ্রত্যাশীরা আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আমরা কোনো মানুষই না। আমাদের বসিয়ে রেখে তাঁরা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।’

নগরঘাটা গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নামজারি করতে আনছার নামের এক ব্যক্তির কাছে ৮ হাজার টাকা দিয়েছি। এখনো কাগজ হাতে পাইনি। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আগের এসি ল্যাল্ডের সময় ৩-৪ হাজার টাকায় নাম জারি করা যেত, এখন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা না দিলে কাজ হয় না। অফিসে নতুন কর্মকর্তা এলেই ঘুষের পরিমাণ বাড়ে। এখন দেখছি জমিজমা না থাকাই ভালো ছিল।’

কয়েকজন দালালের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেন, ‘আগের অফিসারদের ১ হাজার টাকা দিলেই হতো, এখন ফাইলপ্রতি দিতে হয় ১৬০০ টাকা। অফিসারসহ নতুন কর্মকর্তারা যোগদানের পর ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে। আপনার কাজ থাকলে আমাদের দিলে কম খরচে করে দেব, তবে ৫ হাজারের নিচে হবে না।’

পরিচয় গোপন করে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে সহকারী কমিশনার অফিসের অফিস সহকারী জুয়েল বলেন, ‘যেকোনো জমির নামজারি করতে গেলে সমস্যা না থাকলে ৬ হাজার টাকা লাগবে। আর যদি সমস্যা থাকে, তাহলে টাকা আরও বেশি লাগবে। প্রকৃত কত টাকা লাগবে কাগজ না দেখে বলা যাবে না। আপনাদের কাজের কোনো সমস্যা হবে না। আমি সব সময় স্যারের সঙ্গে থাকি, অন্যদের কাছে কাজ দিলে হয়তো দেরি হবে, আমার কাছে দিলে কোনো সময় লাগবে না। আর আমার কাছে টাকা মার যাওয়ার আশঙ্কা নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সায়রাত সহকারী আব্দুল হাই বলেন, ‘যেকোনো জমির নামজারি করতে সরকারি খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা। এর বেশি কোনো টাকা নেওয়া হয় না। কেউ আমার নাম বলে টাকা নেয় কি না, আমার জানা নেই। আপনি অফিসে আসেন, বিস্তারিত বলা যাবে।’

ভূমি অফিসের নাজির তপন কুমার সরদার সব প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আপনি এখন কোথায় আছেন? অফিসে আসেন। এখানে বসে নিরিবিলি আলোচনা করা যাবে।’

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমার অফিসে সরকারি খরচ ছাড়া অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ টাকা নেয় কি না, তা আমার জানা নেই। আমি আগামীকাল অফিসে থাকব। অফিসে দেখা করেন, প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ইউএনও শেখ মো. রাসেল বলেন, ‘ঘুষের বিনিময়ে কোনো কাজ করা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে যদি এমন হয়ে থাকে, অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত