Ajker Patrika

মাঠেই কৃষকের নববর্ষ—ফসলই এখানে উৎসব

 নওগাঁ প্রতিনিধি
নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা
নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা

নববর্ষ মানে ঢাক-ঢোল, রঙিন জামা, পান্তা-ইলিশ আর শহুরে সাজসজ্জা—এই চেনা ছবির বাইরেও রয়েছে আরেক বৈশাখ। যেখানে আনন্দ আসে অন্যভাবে, মাঠে ঘামের ফোঁটায়। ঠিক যেমনটা দেখা গেল উত্তরের জেলা নওগাঁয়।

এখানে বৈশাখ মানে ধান, আম আর সবজির মাঠে চিরচেনা সেই ব্যস্ততা। ধানের মাঠে নতুন শিষে কৃষকের ব্যস্ততা। পাশাপাশি আমবাগানেও শুরু হয়েছে গুটির যত্ন আর ছাঁটাইয়ের কাজ। আর অনেক কৃষক গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষে পুরোপুরি ব্যস্ত।

সদর উপজেলার কীর্ত্তিপুর, ফতেপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেল—ধানের মাঠে কৃষকের ব্যস্ততা। কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউবা কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। মাঠে মাঠে ধান এখনো কাঁচা, সবুজ শিষগুলো বড় হচ্ছে; এসব ঘিরেই কৃষকের ব্যস্ততা। পাশে মাচা তুলে লাগানো হয়েছে করলা, ঝিঙে, শসা, লাউ। গরম শুরু হওয়ায় সেচ দিতে হচ্ছে নিয়মিত। ভোরে উঠেই যাঁর যাঁর খেতের খোঁজে ছুটেছেন কৃষকেরা।

কৃষক আব্দুল খালেক বললেন, ‘সকালে পান্তা খাইছি, এখন আইছি ধানের মাঠে আগাছা পরিষ্কার করতে। কয়েকটা জমিতে করোলা লাগাইছি। ধান-সবজির দুই কাজ নিয়া খুব চাপ। শহরের মানুষ হয়তো ভাবে আমরা উৎসব করি না—আসলে এই কাজই তো আমাদের উৎসব।’

নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা
নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা

কীর্তিপুরের তরুণ কৃষক সাইফুল ইসলাম জানালেন, ‘আমরা বৈশাখ মানে বুঝি নতুন আশার শুরু। এই সময় জমিতে ভালো পরিচর্যা করতে পারলে সারা বছরের ফলন ভালো হয়। আমি করলা আর ধান—দুইটাই করেছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে থাকলেও মন টানে না শহরের কনসার্টে।’

সবজিখেতে কথা হয় রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। তাঁর জমিতে শসা আর মরিচ। তিনি বললেন, ‘বাচ্চারা মেলায় গিয়েছে। আমি এখানে। জমি দেখে মনে হয়—ভালো হবে। এই আনন্দ কী আর অন্য কিছুতে আছে?’

অন্যদিকে সাপাহার উপজেলার তিলনা ও আশড়ন্দ গ্রামজুড়ে আমবাগানের দৃশ্য একেবারেই অন্য রকম। আমগাছে গুটি এসেছে। তবে গুটি নরম, টেকসই হয়নি এখনো। একটু বাতাসেই পড়ে যাচ্ছে। তাই সকাল-সন্ধ্যা বাগানে উপস্থিত থাকছেন চাষিরা। বৃষ্টি বা কালবৈশাখীর আশঙ্কাও তাড়া করে ফিরছে সবাইকে।

নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা
নওগাঁয় বৈশাখের প্রথম দিন কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকেরা। মাঠে ঘামের ফোঁটায় যেন তাঁদের নববর্ষের আনন্দ, ফসলই যেন উৎসব। ছবি: আজকের পত্রিকা

তিলনা গ্রামের আমচাষি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর মুকুল বেশ ভালো ধরেছিল। এখন গুটি ঝরার চিন্তায় আছি। প্রতিদিন স্প্রে দিতে হচ্ছে, গাছ ঝাঁড়া লাগে, আবার সারও দিতে হচ্ছে। বৈশাখ এলেও আমাদের রোদে-পিচে এই গাছগুলোর নিচেই দিন চলে যায়।’ তাঁর পাশের চাষি হানিফ আলী জানালেন, ‘বউ সকালে পান্তা দিল, তাই খেয়ে চলে এলাম। শহরে বৈশাখ দেখতে ইচ্ছা করে না, এই বাগানই আমার উৎসব।’

জেলার কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, একসঙ্গে ধান, সবজি আর আম—তিনটির মৌসুম শুরু হওয়ায় এখন কৃষকের ব্যস্ততা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। একদম ভুল করা চলবে না। কারণ, এ সময়ের একটু অবহেলা পুরো মৌসুমে প্রভাব ফেলতে পারে।

জানতে চাইলে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ সময় মাঠে থাকা কৃষকেরাই আমাদের জাতীয় উৎপাদন সামলাচ্ছেন। বৈশাখে ধান তো আছেই, এখন বাম্পার আমের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। সে জন্যই চাষিরা উৎসবের থেকেও বেশি মনোযোগী মাঠে।’

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি ডি এম আব্দুল বারি বলেন, ‘বৈশাখ মানেই তো নতুন কিছু শুরু করার সাহস। কৃষকেরা সেটা করেন মাঠে। মাটির সঙ্গে থাকা উৎসবগুলো আমাদের চোখে পড়ে না বলেই তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নওগাঁর বৈশাখকে যদি একটু নিবিড়ভাবে দেখা যায়, বোঝা যাবে—এখানেও উৎসব আছে। কেবল সে উৎসব শহরের মতো শব্দ করে না, আলো ঝলমলে নয়। বরং সে উৎসব মাটির গন্ধে ভরা, চাষির গলায় ঘামের রেখায় লেখা—একটি নতুন বছরের গল্প।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত