শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে সপ্তাহে ৫ দিন ‘মিড ডে মিল’

এস. এম. রকি, খানসামা (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৮: ৪১
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৯: ০৪
শিক্ষার্থীদের জন্য খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি ও পড়াশোনার মানোন্নয়নে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়েছেন শিক্ষকেরা। নিজ উদ্যোগেই এই স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য সপ্তাহে ৫ দিন ডিম কিংবা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার এবং প্রতি বৃহস্পতিবার খিচুড়ি খাওয়ানো হচ্ছে। শিক্ষকদের এমন উদ্যোগে স্কুলে নিয়মিত শিক্ষার্থী উপস্থিতি আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২২ সাল থেকে ব্যতিক্রমী এই কাজ করা প্রতিষ্ঠান দলি গুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নের গুলিয়ারা গ্রামে অবস্থিত। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দলি গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে।

২০১৮ সালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫০ জন। সে সময় দৈনিক ৩০ জনের মতো শিক্ষার্থীরা আসত। এখন শিক্ষার্থী আছে ৮৪ জন। আজ বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে ৭৫ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ৬ জন।

শিক্ষক ও অভিভাবকেরা জানায়, ২০১৮ সালে দলি গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মো. আক্তারুজ্জামান। ওই সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ও উপস্থিতি ছিল কম। তাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে প্রধান শিক্ষক মো. আক্তারুজ্জামান শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা এবং ঝরে পড়া রোধে নিজেই উদ্যোগ নিলেন পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার।

এরপর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় সবার সম্মতি নিলেন। ২০২২ সালের জুন মাস থেকে দলি গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু হয় ‘মিড ডে মিল’। যেটি এখনো চলমান।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই স্কুল ক্যাম্পাস গিয়ে দেখা যায়, এক শিক্ষক খিচুড়ি রান্নার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাঁকে সহায়তা করছে এক অভিভাবক। রান্না শেষ হতে হতেই বেলা ১টা ৫০ মিনিটের দিকে বিরতির ঘণ্টা বেজে উঠল। বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এল শিক্ষার্থীরা। এ সময় হই-হুল্লোড় করে বেসিন ও টিউবওয়েলে হাত ধোয়া, প্লেট পরিষ্কার ও পানির বোতল ভর্তিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা।

বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বসে খিচুড়ি খাচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বসে খিচুড়ি খাচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

হাত ধুয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শুরু করল দুপুরের খাবার। এতে প্রধান শিক্ষক মো. আক্তারুজ্জামানসহ অন্য সহকারী শিক্ষকেরা পরিবেশনে ব্যস্ত দেখা যায়।

এমন আয়োজনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি দুপুরে খাবার পেয়ে খুশি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।

সহকারী শিক্ষক মনমত কুমার রায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম ছিল। বর্তমান প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে তাঁরা নানামুখী উদ্যোগ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার আয়োজনের মাধ্যমে ভর্তি ও উপস্থিতি আরও বেড়েছে। এখন উপস্থিতি হার প্রায় ৯০ শতাংশ।

শিক্ষার্থী প্রীতম, জিৎ, মনিষা ও কাকলীসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, সঠিক সময়ে বাসায় রান্না না হওয়া এবং প্রতিদিন স্কুলে আসার পরে ক্ষুধার জন্য বাড়ি চলে যাওয়া বন্ধ করতে স্যারদের এই আয়োজন ভালোই লাগে। ডিমসহ নানা খাবার দেয় ও বৃহস্পতিবার খিচুড়ি ও ডিম ভাজি খাওয়ায় স্যারেরা।

রিমা রাণী রায় নামে এক অভিভাবক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষকদের এমন আয়োজনে সবাই খুশি। বাড়ির কাজের ফাঁকে এমন আয়োজনে স্কুলের অভিভাবকরাও সহযোগিতা করে থাকি।’

রমা রাণী রায় নামে রান্নার কাজে সম্পৃক্ত এক শিক্ষক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ক্ষুধামুক্ত থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ থাকবে। তাই এমন আয়োজন। এতেই আমাদের ভালোই লাগে। কেননা এতে বাচ্চারা ভালো থাকে ও নিয়মিত স্কুলে আসে।’

দলি গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আক্তারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর দেখতে পান অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। অভাব-অনটনের কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে আসত না। অনেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই নিয়মিত শিক্ষার্থী উপস্থিতি, শিক্ষার মানোন্নয়নসহ ঝরে পড়া রোধে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতেই এমন উদ্যোগ নেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, এই আয়োজনে প্রতি মাসে তাঁর ৭-৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য তাই, এমন আয়োজনে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এমন উদ্যোগ ধরে রাখার সঙ্গে পরিধিও বৃদ্ধি করা যাবে।

এ বিষয়ে ভাবকী ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল আলম তুহিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিজ অর্থায়নে ওই স্কুলের শিক্ষকদের এমন উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। তাঁদের এমন ইতিবাচক কাজে ইউনিয়ন পরিষদ পাশে থাকবে।

স্ব-উদ্যোগে বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাজ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার এমন উদ্যোগই পারবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে উপস্থিতি ও একসঙ্গে খাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি হবে। যেটি তাদের মানবিক করে তুলবে। এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগে উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে থাকবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত