Ajker Patrika

হাসপাতালে দুই দিন ধরে চিকিৎসাসেবা বন্ধ, রোগীদের দুর্ভোগ

রংপুর প্রতিনিধি
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২০: ২৭
চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। আজ রোববার দুপুরে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। আজ রোববার দুপুরে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

আজ রোববার দুপুর ১২টা। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে টাঙানো চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ব্যানারের নিচে হাঁসফাঁস করছিলেন ঝাঁকুয়াপাড়া গ্রামের রোগী বৃদ্ধ আব্দুল মজিদ। তাঁর একটু সামনে দুই বছরের অসুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নারায়ণজন গ্রামের গৃহবধূ চায়না বেগম।

আব্দুল মজিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা। সকালে হাসপাতালোত আলচু। ডাক্তারে চেম্বারোত তালা। ধর্মঘট করোছে। ডাক্তারোক ধরি নাকি মারছে, ওই জন্যে ধর্মঘট করোছে। চিকিৎসা বন্ধ থুইছে। চিকিৎসা বন্ধ থুইলে হামরা বাঁচমো কেমন করি? অনেক্ষণ থাকি বসি। আর আনা দম নিয়ে বাড়িত যাইম।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহবধূ চায়না বেগম বলেন, ‘ছাওয়া কোনার জ্বর। ৪০ টাকা ভ্যান খরচ করি হাসপাতালোত আসনু। কিন্তু ডাক্তার কোনো রোগী দেখছে না। রুমোত তালা ঝুলাইছে। অসুস্থ ছাওয়াটাক নিয়া অ্যালা কোনটে যাইম কন তো?।’

শুধু বৃদ্ধ আব্দুল মজিদ ও গৃহবধূ চায়না বেগমই নন, আরও অনেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসা নিতে এসে না পেয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরেছেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী চিকিৎসককে সমন্বয়ক পরিচয়ে গত শুক্রবার মারধরের অভিযোগ ওঠে। প্রতিবাদে গতকাল থেকে দুই দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। এতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা রাধারানী মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আতাউর রহমান বুকে ব্যথা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক সাবরিনা মুসরাত জাহান মৌ (৩০) ওই রোগীকে হৃদরোগে আক্রান্ত হিসেবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। এরপর তিনি অন্য রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হন। এ সময় সেখানে সমন্বয়ক পরিচয়ধারী রোগী আতাউর রহমানের ছেলে তাহমিদ সরকার তুর্যসহ আরও চার–পাঁচজন ওই চিকিৎসককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। একপর্যায়ে চিকিৎসকের শরীরে আঘাত করেন। এ ঘটনায় চিকিৎসক সাবরিনা মুসরাত জাহান মৌ তুর্য, তাওরাতসহ অজ্ঞাতনামা চার–পাঁচজনের বিরুদ্ধে শুক্রবার রাতে তারাগঞ্জ থানায় অভিযোগ দেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। আজ রোববার দুপুরে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। আজ রোববার দুপুরে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

তবে চিকিৎসককে মারধর করার অভিযোগ অস্বীকার করে তাহমিদ সরকার তুর্য বলেন, ‘আমার বাবা হাসপাতালে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। ওই চিকিৎসককে বারবার দেখার জন্য অনুরোধ করছিলাম। তিনি না শুনে উল্টো আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে একটু কথা–কাটাকাটি হয়েছে।’

আজ দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকে পুলিশি পাহারা। হাসাপাতালের সামনে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ব্যানার টাঙানো। বহির্বিভাগে কার্যক্রম বন্ধ, চিকিৎসকদের কক্ষে ঝুলছে তালা। হাসপাতাল চত্বর বহির্বিভাগের সামনে ও বারান্দায় রোগীদের জটলা। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা অপেক্ষার পর ফিরে যাচ্ছেন। ভর্তি রোগীরাও বেডে কাতরাচ্ছেন।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ফকিরপাড়া গ্রামের তৌহমিনা বেগম বলেন, ‘শ্বাসকষ্টে বাচুছি না। জীবন বাঁচার জন্যে হাসপাতাল আসনো, তা এটা সউগ বন্ধ। কি করমো বুঝির পাওছি না। হামার জীবন নিয়া টানাটানি উঠছে।’

দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর চিকিৎসক দেখাতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের নুর হোসেনের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৬০)। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘পায়োত খোচা ঢুকছে। ব্যথাতে সারা রাত ঘুমার পাও নাই। সকাল ৯টায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিবার আলছুং। কিন্তু দুই ঘণ্টা বসি থাকি কোনো চিকিৎসা পানু না। বাড়ি ফেরত যাওছু।’ ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে ফিরে গেছেন পালপাড়া গ্রামের চিন্তা মনি মহন্ত।

চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জগদীশপুরের বৃদ্ধা মজিফা বেগম, ঝাঁকুয়াপাড়ার নুর বানু, সাহেবা বেগম, সুরঙ্গের বাজারের আশরাফুল ইসলাম, পালপাড়ার চিন্তা মনি মহন্তসহ অন্তত ৩০ জন রোগী।

চিকিৎসকদের দ্বিতীয় দিনের কর্মবিরতিতে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবাকক্ষগুলোতে তালা ঝুলছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
চিকিৎসকদের দ্বিতীয় দিনের কর্মবিরতিতে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবাকক্ষগুলোতে তালা ঝুলছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

শুধু বহির্বিভাগেই নয়, কর্মবিরতিতে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালে ভর্তি কাংলাচড়া গ্রামের ধীরেন্দ্র রাথ রায় বলেন, ‘হাত ফাটি গেছে। এক দিন এক রাত হওছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার, কিন্তু কোনো ডাক্তার মোক দেখিল না।’

জানতে চাইলে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অর্নিবান মল্লিক বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসককে হামলাকারী গ্রেপ্তার হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। চিকিৎসকদের পুলিশি প্রটেকশন দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

রংপুরের সিভিল সার্জন শাহীন সুলতান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর গতকাল হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আজও চিকিৎসকদের আউটডোর–ইনডোর সেবা চালু রাখার অনুরোধ করেছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর জেলা কমিটির সদস্য আল-আমিন ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির সদস্য তাওরাত আর তাহমিদ সরকার তুর্য উপজেলা কমিটির জন্য লিস্টেট সদস্য। সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে কেউ যদি অন্যায় করে, তাঁর শাস্তি হবে। কোনো ব্যক্তির দায়ভার কোনো সংগঠন নেবে না। তবে তাঁরা সত্যি কোনো অপরাধ করেছে কি না, তা দেখার বিষয়।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর গতকাল তারাগঞ্জ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। রোগী-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেবাপ্রার্থীরা চিকিৎসক ও হাসপাতালের স্টাফদের আচরণ খারাপের অভিযোগ করেছে। যে দুজনের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের সঙ্গে ঝামেলার অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে তাওরাত জেলা কমিটির সদস্য।’ তাহমিদ সরকার তুর্যের বিষয়ে বলেন, এখনো উপজেলা কমিটি ঘোষণা হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত