‘পেলাস্টিক হামার ব্যবসা খাচে’

গোলাম কবির বিলু, পীরগঞ্জ (রংপুর) 
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১: ৩১
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১: ৪৪

‘পেলাস্টিক হামার ব্যবসা খাচে। হামরা জন্মের পর থাকিই মাটির জিনিসপত্র বানে (তৈরি) বাজারোত বিক্রি করি সংসার চলাই। হামার এই পাড়ার অনেকেরই জমিজমা নাই। মাটির জিনিসই হামার হাল, গরু, জমিজমার কাম করে। সেই মাটির জিনিস একন বাজারোত চলে না। একন পেলাস্টিকের জিনিস বেরাচে। সেই জন্যে হামরাও একন অনেকটা বেকার হয়া আচি।’ 

আঞ্চলিক ভাষায় গড়গড় করে কথাগুলো বলছিল স্কুলছাত্রী মল্লিকা রানী। সে পীরগঞ্জ উপজেলার কুমেদপুর ইউনিয়নের বারুদহ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ। তাই অলস সময়ে সে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করছে। উপজেলার কুমেদপুর ইউনিয়নের চণ্ডীপুর পালপাড়ায় সারাক্ষণই চলছে মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ। কিন্তু তারা কেউই তৃপ্ত নয়। অনেকটা কষ্ট নিয়েই তারা মাটি দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করছে। 

সম্প্রতি চণ্ডীপুরের ওই কুমোর পল্লির পালপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলছাত্রী মল্লিকা রানী চরকিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাসন আর পাতিল তৈরি করছে। তার পাশে মা কল্পনা রানীও (৫০) কাজ করছেন। পাশেই রোদের আলোছায়ায় বসে অনেক নারী মাটির জিনিসপত্র তৈরি করছেন। তাদের মধ্যে সবিতা রানী, অপরূপা, স্বপ্না রানী, নীলিমা রানীও সাংসারিক প্রয়োজনীয় বেশ কিছু মাটির জিনিস তৈরি করে রোদে শুকাতে দিয়েছেন। 

গৃহবধূ সবিতা রানী জানান, ছয় বছর আগে চণ্ডীপুর পালপাড়ার প্রশান্ত চন্দ্র পালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বাবার বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা সদরে। পড়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। 

সবিতা রানী বলেন, ‘বাবার বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করতাম। স্বামীর বাড়িতে এসেও একই কাজ করছি। কারণ আমাদের এটি বাপ-দাদার পেশা।’ 

কল্পনা রানী বলেন, ‘আমার স্বামী বৈদ্যনাথ পাল। তার পেশা এটি। সংসারের কাজের মতোই প্রতিদিনই মাটির জিনিস তৈরি করি। মাটি দিয়ে বাসন, চাঁড়ি, মটকি, ঢাকনি, প্লেট, গ্লাস, কলস, হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, মাটির ব্যাংকসহ অনেক জিনিসপত্র তৈরি করি। প্রায় দুই সপ্তাহ রোদে শুকানোর পর সেগুলো আগুনে পোড়াতে হয়। এরপর বিক্রি করা হয়। এভাবেই খাওয়া চলে, এনজিওর কিস্তিও চলে।’ 

প্রশান্ত চন্দ্র পাল বলেন, ‘আগের মতো মাটিও পাওয়া যায় না। এখন দূর থাকি মাটি আনা নাগে। দামও বেশি। খরচও বেশি হয়। কিন্তু মাটির জিনিসপত্রের দামও সেংকা (তেমন) নাই। কামকাজ নাই। তাই পোত্যেক দিন শরীলের খাটনি দিয়া এ্যাগ্লা বানাই। ধীরে ধীরে খরচ হয়। আর একবারে বেচি ট্যাকা পাই।’ 

কুমোররা জানায়, ওই পল্লিতে দেড় শতাধিক পরিবার বসবাস করে। মাটির তৈরি জিনিসপত্র আগুনে পোড়ার জন্য ২০টি ভাটা (চুল্লি) রয়েছে। ঢাকা, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে ওই সব জিনিসপত্র নিয়ে যায়। 

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কুমোরদের জীবন-জীবিকা খুবই কষ্টের। আধুনিক মানসম্মত মাটির জিনিসপত্র তৈরির জন্য মৃৎশিল্পীদের সরকারি বরাদ্দের প্রকল্প দিয়ে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করব। পাশাপাশি তাদের তৈরি করা পণ্যের বাজারজাতকরণেও উদ্যোগ নেব।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত