প্রশ্নবিদ্ধ নেতৃত্বে দুর্বল অবস্থানে রূপালী ব্যাংক

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪, ০৮: ১১
আপডেট : ২৭ মে ২০২৪, ০৮: ৫৮

মাথায় খেলাপি ঋণের বিশাল বোঝা। বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতিও। পরপর দুই বছর লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ফলে মান নেমে এসেছে জেড ক্যাটাগরিতে। নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত এই প্রতিষ্ঠানের নাম রূপালী ব্যাংক পিএলসি। শীর্ষ নেতৃত্বের অদক্ষতার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটির এমন দুর্দশা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

২০২২ সালের ১৪ আগস্ট থেকে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সিইও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সূচকে দিন দিন খারাপ হতে থাকে ব্যাংকটির অবস্থা। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা, যা তখন পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৭ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশই এখন খেলাপির খাতায়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। 

ব্যাংকের এমন দশার কারণে বর্তমান এমডির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রূপালী ব্যাংকে পেশাদার ও অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা নেতৃত্ব দিয়েছেন। সময়ে সময়ে ব্যাংকটি বিভিন্ন সংকটে পড়লেও তাঁদের পেশাদারত্বে ভর করে মোটামুটি সফলতার সঙ্গেই এগিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নিজের পুরো কর্মজীবন এই ব্যাংকে কাটালেও তাঁর নিয়োগ, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অনেক কিছুই ব্যাংকটির শীর্ষ ওই পদকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

রূপালী ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বর্তমান এমডির পরিচিতিতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ১৯৯০ সালে অফিসার হিসেবে রূপালী ব্যাংকে তাঁর ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। একই তথ্য তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেও (এফআইডি) দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাংকটির মানবসম্পদ নীতিমালা, ২০১১-এর জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামোতে বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি সময় ধরে অফিসার পদে জনবল নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮, ২০০০, ২০০১ ও ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটির (বিআরসি) মাধ্যমে কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। যেখানে ১২ বছর ধরে ব্যাংকে অফিসার নিয়োগ বন্ধ ছিল, সেখানে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কীভাবে অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এমডি হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আগে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ডিএমডি পদে থাকা অবস্থায় রূপালী ব্যাংকের স্থায়ী পদ থেকে অবসরে যান। পরে অবসরোত্তর যে সুবিধা তিনি নিয়েছেন, তাতে ১৯৮৫ সাল থেকেই তাঁর কর্মকাল গণনা করা হয়। অর্থাৎ ১৯৯০ সালে কর্মকর্তা পদে নিয়োগের যে তথ্য এফআইডিতে তিনি দিয়েছেন, তার সত্যতা নেই। প্রকৃত সত্য হলো, তিনি ১৯৮৫ সালের ১৯ জানুয়ারি রূপালী ব্যাংকে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অফিসার হন। 

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আজকের পত্রিকাকে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বিশেষ গোষ্ঠীর মাতামাতি ছাড়া কিছু না। কারও অমূলক কথায় কর্ণপাত করা সমীচীন হবে না। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও একাগ্রতার বলেই আজ শীর্ষ পদে থেকে ব্যাংকটির নেতৃত্ব দিতে পারছি। সামনে অনেক দূর যেতে চাই। এখন ব্যাংকটি ভালো চলছে।’ 

দুই পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণি বা বিভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না। অথচ রূপালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (বিকম) দুই পরীক্ষাতেই তৃতীয় শ্রেণি নিয়ে পাস করেছেন। শিক্ষাজীবনে দুটি তৃতীয় শ্রেণি পাওয়ার পরও ২০২২ সালে রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

দুটি তৃতীয় শ্রেণি থাকার পরও রূপালী ব্যাংকের বর্তমান এমডির নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভাগ নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতা, খেলাপি এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা যাচাই করে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য অনুমোদন (অ্যাপ্রুভাল) দিয়ে থাকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাপ্রুভালের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ দেয় এফআইডি। বিশেষ কেউ নন; যিনিই নিয়ম লঙ্ঘন করবেন, তাঁর শাস্তি হবে।’ 

এসব বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই নিয়োগ হয়েছে। আর জালিয়াতির বিষয়ে কাগজপত্র না দেখে এই মুহূর্তে বেশি কিছু বলব না।’ 

রূপালী ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা, ২০১১ অনুযায়ী, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ২ বছরের চাকরিসহ ব্যাংকে ৬ বছরের কর্মের অভিজ্ঞতা জরুরি। কর্মকর্তা পদে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। আর রূপালী ব্যাংক (কর্মচারী) চাকরি প্রবিধানাবলি, ১৯৮১ বলছে, সরাসরি কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে সরাসরি নিয়োগে বয়স সর্বনিম্ন ২১ বছর ও সর্বোচ্চ ২৫ বছর। কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য প্রথমত স্নাতক পাস কোনো কর্মচারী ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স পরীক্ষার দুই পার্ট ডিপ্লোমা পাসসহ ন্যূনতম ৪ বছর ব্যাংকে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি কোনো কর্মচারী ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স পরীক্ষার এক পার্ট পাসসহ ন্যূনতম ৫ বছর ব্যাংকে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া স্নাতক পাস কোনো কর্মচারী ৬ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হবেন। তিনি ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পার্ট-১ পাস করেন ১৯৯৯ সালে এবং পার্ট-২ ২০০৮ সালে। এ ক্ষেত্রেও নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত