ফিরে দেখা ২০২৪ /নানা অঘটন, তবু সংস্কার উদ্যোগে আশার সঞ্চার

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২: ০৭
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ২১
Thumbnail image
ফাইল ছবি

২০২৪ সাল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল সংকটময় ও ঘটনাবহুল। বছরের শুরুতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যায় এবং করপোরেট ঋণখেলাপিদের অবাধ শোষণ প্রকাশ পায়, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। পাশাপাশি বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের অর্থ পাচারের ঘটনা ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা আরও স্পষ্ট করে তোলে, যার ফলস্বরূপ ব্যাংকগুলো ভয়াবহ তারল্য-সংকটে পড়ে।

ইসলামী ব্যাংক ও কিছু দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকের পরিস্থিতি সামনে আসার পর গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং টাকা তোলার হিড়িক পড়ে, যা চেক ডিজঅনারসহ ব্যাংক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচুর পরিমাণে টাকা ছাপায়, যা সমালোচনার জন্ম দেয়। ব্যাংক খাতে সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে দেশের অর্থনীতির সংকট আরও গভীর হতে পারে এবং সমগ্র খাতকেই অস্থিতিশীল করতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং ছিল ২০২৪ সাল, যেখানে ডলারের বাজারে অস্থিরতা, আমদানি এলসিতে সংকট এবং ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনৈতিক কারসাজি এবং নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়; আর বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। তবে এসব সংকটের মধ্যেও দেশের ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারে কিছু আশার আলো দেখা গেছে। নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে ব্যাংক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কার্যক্রম শুরু করা অন্যতম।

২০২৪ সালের শেষের দিকে যদিও রিজার্ভের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ ছিল এবং কিছু সময় তলানিতে চলে গিয়েছিল, তবে রেমিট্যান্সপ্রবাহের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তির দিকে চলে আসে। এটা সত্ত্বেও, ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতের দৃশ্যপটের স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে কাঠামোগত সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার সরকারের পালাবদলের পর ব্যাংকের খেলাপি ও পাচারের তথ্য জেনে মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ে। ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র জানার জন্য ব্যাংকিং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। জাতি এখন এই টাস্কফোর্সের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

b

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় পৌঁছায়। এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া ডলার বাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। প্রতি ডলার ১১০ টাকার থেকে বেড়ে ১২৩ টাকায় পৌঁছায় এবং খোলাবাজারে ১২৯ টাকায় ওঠে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়, যা ২০২৩ সালের ২৬ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২৪ সালের শেষে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

এ সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগ হারের অবনতি ঘটে।

এতেও ব্যাংকিং খাতে তারল্য-সংকট তৈরি হয়; যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা সহায়তা দিলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

এভাবে ২০২৪ সালের ব্যাংকিং খাতের সংকট দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, সুদের হার বাড়ানোর কারণে বিনিয়োগের ধীরগতি, তারল্য-সংকট ও রিজার্ভের পতন—এসব বিষয় দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত