বাসমতী চালের জিআই পেতে বেদ–পুরান দেখাচ্ছে ভারত, ইইউতে মুখোমুখি দিল্লি–ইসলামাবাদ

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ২৭
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫: ৩২
Thumbnail image
ইউরোপের বাজারে পাকিস্তানি বাসমতী চালের একাধিপত্য। ছবি: সংগৃহীত

বাসমতী চালের প্রধান দুই উৎপাদক দেশ ভারত ও পাকিস্তান। তবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পাকিস্তানি বাসমতী চালের কদর বেশি। এই সুগন্ধী চালের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ট্যাগ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে নথিপত্র জমা দিয়েছে পাকিস্তান। বিষয়টি জানার পরই নড়েচড়ে বসেছে ভারত। সেই নথি চেয়ে আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ইউরোপীয় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে নয়াদিল্লি।

ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাসমতী চালের জিআই মালিকানা দাবি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে পাকিস্তান যে নথি জমা দিয়েছিল, তা দেখতে চেয়েছিল ভারত। কিন্তু ভারতের সেই আবেদন খারিজ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তাদের ১০৪৯ /২০০১ নিয়মাবলি অনুযায়ী ওই তথ্য দিতে তারা বাধ্য নয়। নিয়ম ভেঙে ভারতকে এই নথি দিলে ইসলামাবাদের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই ভারতের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। এর পরেই ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসের কাছ গেছে নয়াদিল্লি।

অবশ্য বাসমতী চালের জিআই মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো পণ্য পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করলে সেই আঞ্চলিক পণ্যের জন্য জিআই (জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন) আবেদন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সেই পণ্য ওই নির্দিষ্ট এলাকাতেই যে খ্যাতি লাভ করেছে, তার প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয়। সেই প্রমাণ খতিয়ে দেখেন কর্মকর্তারা।

জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে, একাধিক দেশ একই স্বত্বাধিকারের জন্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আবেদন করতে পারে। এমনকি, প্রথমে অন্য দেশ করলে তারপর আর এক দেশও তা করতে পারে।

বাসমতী চালের জিআই মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে বছর কয়েক আগে। বাসমতী চালের জিআই ট্যাগ পেতে আবেদন করে ভারত। এরপর পাল্টা মালিকানা দাবি করে পাকিস্তান।

পশ্চিম এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাসমতী চাল রপ্তানি করে ভারত। তবে ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার বাসমতীর বাজার পাকিস্তানের দখলে। এর পেছনে রয়েছে গুণ মানের পার্থক্য। ইউরোপের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, ভারতের বাসমতীতে রাসায়নিকের (রাসায়নিক সার ও কীটনাশক) পরিমাণ বেশি। সে তুলনায় পাকিস্তানি বাসমতী অনেক বেশি প্রাকৃতিক (অরগানিক)। এ কারণে ইউরোপের বাজারে পাকিস্তানি বাসমতী চালের একাধিপত্য।

ইউরোপীয় মানে উতরে যেতে ভারত সরকার কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সফলতা আসেনি।

এর পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত ইউরোপের বাজারে পাকিস্তানের আধিপত্য ঠেকাতেই হঠাৎ করে বাসমতী চালের জিআই ট্যাগ দাবি করে বসে ভারত। ভারতের পর পাকিস্তান বাসমতী চালের জিআই ট্যাগ পায় ২০২১ সালে।

এরপর বাসমতীর মালিকানা পেতে উঠেপড়ে লাগে ইসলামাবাদ। বাসমতী চালের ‘প্রোটেক্টেড জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন (পিজিআই) ’ পেতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জমা দেয় পাকিস্তান।

বিপরীতে ভারত বাসমতীর মালিকানার পক্ষে বেদ-পুরানের রেফারেন্স তুলে ধরে। তারা বলে, যজুর্বেদ থেকে শুরু করে বহু প্রাচীন পুঁথি–পুরানে বাসমতী চালের উল্লেখ রয়েছে।

এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে পাকিস্তানের জমা দেওয়া নথিপত্র দেখতে আবেদন করে ভারত। গত ২৭ মার্চ ভারতের বাসমতী চালের রপ্তানির দায়িত্বে থাকা এপিইডিএর আইনজীবী পাকিস্তানের নথি দেখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে আবেদন করেন।

গত ১ জুলাই ভারতের সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ইইউ। শুধু তা-ই নয়, নয়াদিল্লিকে কারণ দর্শানোও হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এবার পাকিস্তানের নথিপত্র দেখতে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসের দ্বারস্থ হয়েছে এপিইডিএ।

বাসমতীর প্রধান রপ্তানিকারক

ভারত ও পাকিস্তান বাসমতী চালের প্রধান রপ্তানিকারক। মূলত সুগন্ধের জন্যই বিখ্যাত এই চাল। দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেও রপ্তানি হয় এই চাল।

২০২৩–২৪ অর্থবছরে চাল রপ্তানি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। যেখানে আগের বছরের তুলনায় পরিমাণে ৬২ শতাংশ এবং ডলারের হিসাবে ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে রপ্তানি।

পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চাল রপ্তানি ৩৭ লাখ ২০ হাজার টন থেকে বেড়ে ৬০ লাখ টনে পৌঁছেছে। মূল্যের হিসাবে ২১৫ কোটি থেকে বেড়ে ৩৯৩ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে।

এই প্রবৃদ্ধি প্রধানত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ চাল উৎপাদনের বৃদ্ধি থেকে এসেছে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ—৯৯ লাখ টন ছুঁয়েছে।

রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান–এর কর্মকর্তারা এই প্রবৃদ্ধির জন্য ‘ভারতীয় ফ্যাক্টর’–কে দায়ী করেছেন। যেখানে ভারত মোটা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং আধাসিদ্ধ চালের ওপর ২০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করেছিল।

ভারত সরকার জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে প্রিমিয়াম দামে চাল রপ্তানি করলেও, বেসরকারি খাতকে মোটা চাল রপ্তানি থেকে বিরত রাখে মূলত নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম কম রাখতে।

এই সুযোগে উচ্চমানের চাল এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক বাজার অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত